বিষয়: আধুনিক পদ্ধতিতে গরুর খামারের ব্যবস্থাপনা, গরুর ঘর তৈরির নিয়ম, গরুর ঘর তৈরির পদ্ধতি।
হ্যাশট্যাগ:# আধুনিক পদ্ধতিতে গরুর খামারের ব্যবস্থাপনা# গরুর ঘর তৈরির নিয়ম# গরুর ঘর তৈরির পদ্ধতি।
গরুর বাসস্থান পদ্ধতি
গবাদিপশুকে প্রধানত তিন পদ্ধতিতে উৎপাদন ও লালন-পালন করা হয়। যেমন-
১। এক্সটেনসিভ পদ্ধতি;
২। সেমি-ইনটেনসিভ পদ্ধতি;
এবং ৩। ইনটেনসিভ পদ্ধতি;
১। এক্সটেনসিভ পদ্ধতি (Extensive system)
গোয়ালা ছাউনিতে সকালে দুধ দোহন করে সারাদিন গরু চরিয়ে বিকেলে দ্বিতীয়বার দুধ দোহন করে। দুধ দোহনের পূর্বে বাছুরকে তার মার দুধ চুষতে দেয় ফলে দুধ সহজেই নেমে যায়।
সামাজিক প্রথা অনুযায়ী পুরুষ বা স্ত্রী লোক দুধ দোহন করে থাকে।
গ্রাম্য পদ্ধতিতে ছোট ছোট দলে পশু চরানো হয়। এ পদ্ধতিতে পশু প্রায় গাছপালা খায় এবং চরেও খায়। তবে শুষ্ক ঋতুতে চারণ ভূমিতে ঘাস না থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাছের পাতা খেয়ে থাকে।
দিনের বেলায় পশু বহুদূরে হেঁটে ঘাস ও গাছপালা খায় এবং রাত্রের বেলায় অস্থায়ী বা আধাস্থায়ী ছাউনিতে রাখা হয়।
২। সেমি-ইনটেনসিভ পদ্ধতি (Semi-intensive system)
এই পদ্ধতিতে গরু রাস্তার পার্শ্বে ও পানিসেচন বাঁধে বা জমির আইলে এবং শুষ্ক মৌসুমে শস্যদি কাটার পর জমিতে যেটুকু ঘাস থাকে তা চরে খায়। অন্যথা গরুকে দড়ি গলায় বেঁধে কাটা ঘাস ও শস্যের উপজাত খাওয়ানো হয়।
সেমি-ইনটেনসিভ পদ্ধতিতে পালিত গাভীর দুধ সমবায়-সমিতি বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন যেমন মিল্ক ভিটা সংগ্রহ ও পাস্টুরাইজ করে বাজারজাত করে।
বলদ এবং কিছু অঞ্চলে গাড়ী কৃষি কাজে ব্যবহৃত হয় এবং গবাদিপশুর গোবর গ্রাম অঞ্চলে জ্বালানা এবং জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার হয়।
বয়োবৃদ্ধ ও ছাঁটাই করা গরু মাংসের জন্য যবাহ করা হয়।
সাধারণত এই পদ্ধতি গরু ত্রি-উদ্দেশ্য লালন পালনে ব্যবহৃত হয়।
গাভী সক্রিয় জীবনে পরিশ্রম করে, দুধ দেয় এবং বয়োবৃদ্ধিতে যখন দুধ ও পরিশ্রম দানে সক্ষম হয় না তখন মাংসের জন্য ব্যবহৃত হয়।
৩। ইনটেনসিভ পদ্ধতি (Intensive system)
সম্পদ ও সংগতি একত্রিত এবং শ্রমিক খরচ হরাস করে অধিক খাদ্য উৎপাদন করা ইনটেনসিভ পদ্ধতি মূল উদ্দেশ্য।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ইনটেনসিভ পদ্ধতিতে ডেইরি ও বীফ গরু পালন করা হয়।
পশু ও শস্য একত্রে উৎপাদন বেশ লাভজনক। জমির শস্য কাটার পর সে জমি পশুর চারণভূমি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
গরুর বাসস্থান এর ব্যবস্থাপনা
◼ পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে গাভীর বাসস্থান বা আদর্শ মিনি ডেয়রী ফার্ম গড়ে তোলা প্রয়োজন যাতে কম খরচে অধিক লাভবান হওয়া যায়। ডেয়রী খামার বা পশুর বাসস্থান স্থাপনের পূর্বে নিম্নোক্ত বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
◼ গোয়াল ঘরের চারপাশে প্রচুর গাছপালা থাকা ঠিক নয়। অর্থাৎ কোন অবস্থায় যেন ঘরে স্যাঁতস্যাঁতে অবস্থা না থাকে। পশুর মলমূত্র ও গোশালয় আবর্জনা ঘরের ভিতর যাতে না জমে সেজন্য নির্গমনের নালা বা ড্রেনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কারণ পশুর মল-মূত্র, আবর্জনা জমে থাকলে পরিবেশ মশা-মাছি, পরজীবী ও অন্যান্য রোগ জীবাণুর উপদ্রবে দূষিত হবে। এইরূপ পরিবেশে পশু সহজেই রোগাক্রান্ত হয়।
◼ গবাদিপশুর পানের জন্য প্রচুর পরিমাণে পানির প্রয়োজন হয়। এছাড়া গোয়াল ঘর পরিষ্কার, গাভীর স্নান, ফার্মের যন্ত্রপাতি ও বাসনপত্র পরিষ্কার ও ঘাস উৎপাদনের জন্য প্রচুর পানি প্রয়োজন হয়। তাই অতি সহজে অল্প খরচে প্রচুর পরিমাণে পরিষ্কার বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
◼ আধুনিক ডেয়রী ফার্মে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। বৈদ্যুতিক শক্তিতে গভীর নলকূপের সাহায্যে ফার্মে পানি সরবরাহ, ফার্মের যন্ত্রপাতি চালানো ও ফার্মে রাতে আলোর ব্যবস্থার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ রয়েছে এমন অঞ্চলে ডেয়রী খামার স্থাপন সুবিধাজনক।
◼ গাভীর বাসস্থান বা খামারের জন্য নির্ধারিত স্থানের মাটি শুষ্ক ও আশেপাশের জমি থেকে উঁচু হওয়া প্রয়োজন, যাতে বৃষ্টির পানি ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ না জমে সহজেই নিষ্কাশিত হতে পারে।
◼ খামারের জন্য নির্ধারিত জমির মাটি মোটামোটি উর্বর, বালির ভাগ বেশি এবং শুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। এতে বর্ষায় পানি জমে কর্দমাক্ত হবে না।
◼ গোশালায় যাতে পর্যাপ্ত আলো বাতাস প্রবেশ বা চলাচল করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ সূর্যের আলো সেসব ঘরকে একদিকে শুষ্ক রাখতে সাহায্য করে, অন্যদিকে রোগজীবাণু বাসা বাঁধতে পারে না। তাই পূর্ব পশ্চিমে লম্বা দক্ষিণমুখী গোয়ালঘর আরামদায়ক।
◼ পশুর মলমূত্র ও আবর্জনা দূরে গর্ত করে রাখতে হবে। সেগুলো পরে জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
গরুর বাসস্থান নির্মাণ
পশুর গোশাল/বাসস্থান প্রধানত আবহাওয়া, ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য অবস্থার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। তাই বিভিন্ন অঞ্চলে বা দেশের পশুর বাসগৃহ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে।
যে কারণে সব অঞ্চল বা সবদেশেরই উপযোগী এমন কোন আদর্শ বাসগৃহ তৈরির নকশা নাই।
আমাদের দেশের জন্য উপযোগী প্রধানত দু’ধরনের গোশালা নির্মাণ করা যায়। যথা-
১। উদাম ঘর পদ্ধতি এবং
২। বাঁধা ঘর পদ্ধতি।
১। উদাম ঘর পদ্ধতি
- বয়স্ক বাছুর ও দুধ দিচ্ছে না এমন গাভীর জন্য উদাম ঘর পদ্ধতি সুবিধাজনক।
- এই পদ্ধতির ঘরে প্রায় সব প্রজাতির পশুকে পালন করা যায়। এইরূপ পশুর বাসগৃহ বাংলাদেশের প্রায় সকল অঞ্চলে ব্যবহার উপযোগী।
- তবে অধিক বৃষ্টিপাত ও গরম অঞ্চলের জন্য উদাম ঘর পদ্ধতির নকশা কিছুটা হেরফের করার প্রয়োজন পড়ে।
- এই পদ্ধতিতে বাচ্চা প্রসব ও দুধ দোহার সময় ছাড়া দিন ও রাত্রি পশুকে দেয়াল বেষ্টিত খোলা জায়গায় পালন করা হয়। তবে প্রতিকূল আবহাওয়ায় যেমন- ঝড়, বৃষ্টি, গরম, ঠাণ্ডা ইত্যাদির সময় পশুর নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য খোলা স্থান সংলগ্ন ঘর সংযুক্ত থাকে।
- একটি গাভীর জন্য ৩.৫ বর্গমিটার আবৃতস্থান এবং ৭.০ বর্গমিটার খোলাস্থান আয়তনের মেঝের প্রয়োজন।
২। বাঁধা ঘর পদ্ধতি
- এই পদ্ধতির গোশালাকে প্রচলিত বলা হয়। এই পদ্ধতিতে গরুর গলায় দড়ি বা লোহার জিঞ্জির দিয়ে সীমাবদ্ধ স্থানে বেঁধে পালন করা হয়।
- একই স্থানে গাভীর দুধ দোহন ও খাওয়ানো সম্পূর্ণ করা হয়। সেজন্য গোশালা যাতে সহজে পরিষ্কার করা যায় এবং গাভী যাতে আরামে থাকে সেদিকে লক্ষ্য রেখে গোশালা নির্মাণ করা প্রয়োজন।
বাঁধা গোশালা প্রধানত দু’ধরনের হয়। যথা-
(ক) এক-সারি বিশিষ্ট গোশালা এবং
(খ) দ্বি-সারি বিশিষ্ট গোশালা।
(ক) এক-সারি বিশিষ্ট গোশালা:
সাধারণত অল্প সংখ্যক গবাদিপশুর জন্য গ্রাম অঞ্চলে পারিবারিক পর্যায়ে বাড়িতে একটি লম্বা সারিতে গরু বেঁধে পালনের জন্য এধরনের গোশালা তৈরি করা হয়।
পশুর সংখ্যা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জায়গা নির্ধারণ করে গোশালা তৈরি করতে হয়। একটি গাভীর ১৬৫ সেন্টিমিটার দাঁড়াবার স্থান, ১০৫ সেন্টিমিটার পাশের জায়গা, ৭৫ সেন্টিমিটার খাবার পাত্র ও ৩০ সেন্টিমিটার নালা আয়তনের জায়গা প্রয়োজন।
প্রতিটি পশুকে পৃথক রাখার জন্য লোহার তৈরি জিআইপি পাইপ দিয়ে পার্টিশন দেয়া ভালো। সাধারণত পার্টিশনের পাইপ লম্বায় ৯০ সেন্টিমিটার ও উচ্চতায় ৪৫ সেন্টিমিটার হওয়া প্রয়োজন।
(খ) দ্বি-সারি বিশিষ্ট গোশালা:
অধিক সংখ্যক পশু পালনের জন্য দ্বি-সারি বিশিষ্ট গোশালা প্রয়োজন হয়। এই ধরনের গোশালায় পশুকে দু’ভাবে দু’সারিতে রাখা হয়। যথা- ১। মুখোমুখি পদ্ধতি এবং ২। লেজের দিকে লেজ বা পিছেপিছি পদ্ধতি।
মুখোমুখি পদ্ধতি:
এই পদ্ধতিতে গোশালায় দুই সারি সামনা-সামনি থাকে। আর দু’সারি খাবারের চাড়ি বা খাবারের পাত্রের মাঝখানে ৪ ফুট চওড়া রাস্তা থাকে যা খাবার পাত্রে খাবার দেবার জন্য ব্যবহার হয়।
দাঁড়াবার স্থান গাভীর জন্য ৫.৫ ফুট এবং পাশের জায়গা ৩.৫ ফুট প্রয়োজন হয়।
লেজের দিকে লেজ বা পিছেপিছি পদ্ধতি:
এই পদ্ধতিতে উভয় সারির পশুর মাথা বহির্মুখী থাকে।
এধরনের গোশালায় দু’সারি গরু দাঁড়াবার জায়গার মাঝখানে ৪ ফুট চওড়া একটি সাধারণ পথ থাকে।
এই পদ্ধতিতে গরু দাঁড়াবার জায়গার জন্য ৫.৫ ফুট প্রয়োজন হয়।
স্বাস্থ্যসম্মত গরু পালন ব্যবস্থাপনা
◼ প্রতিদিন বিশেষ করে গরমের দিনে গাভীকে ভালভাবে গোসল করালে একদিকে শরীর সুস্থ থাকবে অন্যদিকে বহিঃদেহের পরজীবী যেমন- আঠালী, উকুন ইত্যাদি আক্রমণ করতে পারবে না।
◼ শীতের দিনে গাভীর দেহে চট জড়িয়ে ও ঘরের মেঝেতে খড় বিছিয়ে দিলে ঠাণ্ডা লাগবেনা।
◼ গাভীর দুধ দৈনিক প্রয়োজনমত এক বা একাধিকবার দোহানো যেতে পারে। দুধ দোহানোর পূর্বে গাভীর ওলান ও বাঁট এবং দুধ দোহনকারীর হাত পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
◼ গাভীর বাসগৃহ বা গোশালা সব সময় শুকানো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এক্ষেত্রে পশু মলত্যাগের পরপরই মল তুলে ফেলতে হবে অথবা কমপক্ষে দিনে দু’বার গোশালার মলমূত্র পরিষ্কার করতে হবে।
◼ গোশালা স্যাঁতস্যাঁতে অস্বাস্থ্যকর হলে পশু রোগাক্রান্ত হবার আশংকা থাকে। তাই গোশালার মেঝে পাকা হওয়া প্রয়োজন।
◼ তবে পাকা মেঝে যেন মসৃণ না হয়। কারণ তাতে পশু পিছলে পড়ার আশংকা থাকে। মেঝের নর্দমার দিক অল্প ঢালু করে তৈরি করতে হবে। এতে গোবর তোলার পর পানি দিয়ে মলমূত্র ধুয়ে দিলে মেঝে শুকিয়ে যেতে দেরি হয় না।