🛑আল্লাহ যদি জানেই কে বেহেস্তে যাবে, কে দোযখে যাবে? তাহলে মানুষকে পৃথিবীতে দিয়ে পরীক্ষা করার দরকার কি?
🛑আল্লাহ যদি জানেই আমি দোযখে যাবো তাহলে আমার আর ভালো কাজ করে লাভ কি?
🔷উত্তরঃ প্রথমত, আপনি যদি এই ধরণের প্রশ্ন করেন তাহলে আপনার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে – আপনি দোযখে যাবার জন্য সব দোষ আল্লাহকে দিতে চান। আপনি আপনার দোষের জন্য নিজে কোন দায়িত্ব নিবেন না, পুরোটাই আল্লাহর দোষ। আপনার আসল সমস্যা হচ্ছে আপনি প্রভু-দাস এই ব্যপারটি ঠিকমত বোঝেনি। একারণে আপনাকে অনুরোধ করবো প্রথম পর্বটি বার বার পড়ার।
দ্বিতীয়ত, আপনি ধরে নিচ্ছেন আপনি জাহান্নামে যাবেনই। কে বলেছে আপনাকে যে আপনি জাহান্নামে যাবেন এবং আপনার আর ভালো কাজ করে লাভ নেই? বরং আল্লাহ বলেছেনঃ “… ও আমার বান্দারা, তোমরা যারা নিজেদের উপরে চরম অন্যায় করেছ, আল্লাহর অনুগ্রহের উপর কখনও আশা হারিয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করেন। কোন সন্দেহ নেই, তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, নিরন্তর করুণাময়।” [৩৯ঃ৫৩] তখন আপনি প্রশ্ন করবেন, “আমার কি পরিণতি হবে সেটা তো আল্লাহ জানেই? যদি আল্লাহ জানেই আমি দোযখে যাচ্ছি, তাহলে আর ভালো কাজ করে লাভ কি?” এটা একটা জটিল প্রশ্ন কারণ এর সাথে ‘কদর’ বা ‘পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্যের’ ধারণা জড়িত। এটি একটি ব্যাপক ব্যপার যার জন্য বেশ কয়েকটি বই পড়া প্রয়োজন। আমি যদি একটা ছোট সারাংশ দেই তাহলে দাঁড়ায়ঃ আল্লাহর কোন কিছু জানার অর্থ এই না যে আপনার কোন স্বাধীনতা নেই। আল্লাহ মানুষকে ‘সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা’ দিয়ে পাঠিয়েছেন। প্রতিটি মানুষকে আল্লাহ কিছু ব্যপার পূর্ব নির্ধারিত করে দিয়েছেন, কিন্তু বাকি অনেক কিছু মানুষের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। মানুষ কোন পরিস্থিতে পড়ে যদি ভালো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সে তার জন্য পুরস্কার পাবে, যদি খারাপ সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তার জন্য শাস্তি পাবে। পরিস্থিতিগুলো আল্লাহ তৈরি করেন। প্রতিটি পরিস্থিতে মানুষ কতগুলো সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিতে পারবে সেটাও আল্লাহ নির্ধারণ করে দেন। মানুষের কাজ হচ্ছে ভাল সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া এবং নিজের রাগ, লোভ, কামনা, বাসনা, ইগো ইতাদির বশবর্তী হয়ে অন্যায় সিদ্ধান্ত গুলো না নেওয়া। “যেই কিনা সৎ কাজ করবে, সে তা নিজের উপকারেই করবে; আর যেই কিনা অসৎ কাজ করবে, তা সে নিজের বিরুদ্ধেই করবে। তোমার প্রভু তার বান্দাদের উপরে কখনই অবিচার করেন না।” [৪১:৪৬]
কিন্তু এর মানে এই না যে আল্লাহ জানেন না আমরা কি সিদ্ধান্ত নিব, বা আল্লাহ যদি জানেনই আমরা কি সিদ্ধান্ত নিব, তার মানে এই না যে আমাদের সমস্ত সিদ্ধান্ত পূর্ব নির্ধারিত। আমরা যখনি বলি – “আল্লাহ তো সব জানেন” – আমরা ধারণা করে নেই যে আল্লাহর জানাটা হচ্ছে অতীত কালের ঘটনা এবং যেহেতু আল্লাহ ‘অতীত কালে’ জেনে গেছেন, তার মানে বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবই পূর্ব নির্ধারিত। এটা ভুল ধারণা। আল্লাহ সময়ের উর্ধে। তাঁর জন্য কোন অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নেই। কোন সত্তা যখন সময়ের বাইরে চলে যায়, তখন সে একই সাথে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুই একই সময়ে, একই মুহূর্তে জানতে পারে। সুতরাং, আমি জাহান্নামে যাবো এটা যদি আল্লাহ জানেন, তার মানে এই না যে আল্লাহর জানাটা অতীত কালে ঘটে গেছে এবং আমার আর ভালো কাজ করে কোন লাভ নেই, আমার ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিত। আল্লাহ এই মুহূর্তে আমি কি করেছি, কি করবো এবং তার ফলে আমার পরিণতি কি হবে তা সব দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু তার মানে এই না যে আমি কি করবো, কি করবোনা, সেই সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা আল্লাহ আমাকে দেন নি।
কিভাবে একই সাথে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ দেখা যায় তার একটা উপমা দেই। ধরুন আপনি সিনেমা হলে গিয়ে একটি চলচ্চিত্র দেখছেন। যেহেতু আপনি একটা একটা করে দৃশ্য দেখছেন, আপনি জানেন না সামনে কি হতে যাচ্ছে। আপনি শুধুই অতীতে কি হয়েছে জানেন এবং বর্তমানে কি দৃশ্য হচ্ছে তা দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু ধরুন চলচ্চিত্রটির পুরো ফিল্মের রোলটাকে যদি মাটিতে সমান করে বিছিয়ে রাখা হত এবং আপনি দশ তলা বাড়ির ছাদ থেকে পুরো ফিল্মটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একবারে, এক পলকে দেখতে পেতেন, তাহলে আপনি একই সাথে, একই মুহূর্তে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছুই দেখতে পেতেন। আপনার কাছে তখন আর চলচ্চিত্রটি একটা একটা দৃশ্য করে আগাতো না বরং পুরো চলচ্চিত্রটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক মুহূর্তে আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠত। এটা শুধুই একটা উপমা, আল্লাহ্ই জানেন সময় তাঁর কাছে কিভাবে কাজ করে।
এবার পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্যের একটা উদাহরণ দেই। ধরুন আপনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গাড়িতে করে যাচ্ছেন। আপনি একটা রাস্তার মোড়ে এসে দেখলেন একটা রাস্তা বায়ে গেছে, আরেকটা ডানে গেছে। আপনি বায়ের রাস্তা নিলেন এবং চট্টগ্রামের বদলে সিলেটে গিয়ে পৌঁছালেন। এখন যারা রাস্তা বানিয়েছে – বিআরটিএ, তারা ভালো করেই জানে কোন রাস্তায় গেলে মানুষ কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাবে। প্রত্যেকটা রাস্তার মোড়ে গিয়ে কোন দিকে ঘুরলে মানুষ কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাবে তারা তা সবই জানে। তার মানে এই না যে আপনি সিলেটে গিয়ে পৌঁছাবেন তা পূর্ব নির্ধারিত, কারণ বিআরটিএ ইতিমধ্যেই জানে রাস্তাগুলো সিলেটে গেছে। আপনি আপনার জীবনে যত মোড় নিবেন, তার প্রত্যেকটির পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ জানেন কারণ জীবনের রাস্তার প্রতিটা মোড় তাঁরই বানানো।
যেমন ধরুন আপনার যখন দশ বছর বয়স ছিল, আপনার স্কুলে দুজন বন্ধু ছিল। রহিম – যে একজন ভালো ছাত্র, সারাদিন পড়াশুনা করে, ভালো ঘরের ছেলে; আর রকি – যে বিরাট বড় লোকের ছেলে, যার ভিডিও গেমের অভাব নেই, সারারাত মুভি দেখে, বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়। আল্লাহ আপনাকে দুটো সুযোগ দিয়েছিলেন – রহিম এবং রকি। আপনি রকির ভিডিও গেমের লোভকে সামলাতে না পেরে রকির পিছনে লেগে গেলেন। পড়ালেখা বাদ দিয়ে সারাদিন সময় নষ্ট করে বেড়ালেন। স্কুল শেষ করলেন একটা বাজে রেজাল্ট নিয়ে। জীবনটা দুর্বিষহ করে ফেললেন। সারাজীবন আল্লাহকে দোষ দিলেন আপনার দুরাবস্থার জন্য। বাকি জীবনটা আল্লাহর কোন নির্দেশ না মেনে, তার সাথে যুদ্ধ করে, তার নির্দেশগুলো অমান্য করে দোযখে চলে গেলেন। আপনি যদি রকির পেছনে না ঘুরে রহিমের সাথে থাকতেন, আপনার একটা সুন্দর চরিত্র তৈরি হত, আপনি সুন্দর চিন্তা করতে শিখতেন, ঠিকমত পড়ালেখা করতেন, ভাল রেজাল্ট করে ভালো কলেজে পড়তে পারতেন। আপনার জীবনটা সফল হতো। তখন আপনি সারাজীবন আল্লাহকে ধন্যবাদ দিয়ে, তাঁর আদেশ মেনে জীবন পার করে বেহেশতে চলে যেতেন। আল্লাহ আপনাকে দুটো সুযোগ দিয়েছিলেন। আপনার সিদ্ধান্তের জন্য আপনি দায়ী।
আবার ধরুন আপনি রকির পেছনে লেগে ছিলেন এবং কোন মতে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পেরেছেন আপনার বাবা-মার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত চেষ্টা করার পর। তারপর একদিন আপনার বন্ধু করিম আপনাকে এসে বলল, “দোস্ত, আমার এক বন্ধুর কাছে খবর পেলাম। ওদের এক দল আছে যারা সন্ধার পর ‘ইয়ে’ করতে যায়। সাংঘাতিক মজার ব্যপার নাকি। চল, আমরাও আজকে একবার ‘ইয়ে’ করে দেখি।” এখন এতদিনে আপনার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে আজে বাজে বন্ধুর সাথে মিশলে জীবনে কত পস্তাতে হয়। কিন্তু তারপরেও আপনি লোভ সামলাতে পারলেন না, বন্ধুর সাথে চলে গেলেন। এর জন্য যদি আল্লাহ আপনাকে ধরে সোজা জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন, আপনি কি আল্লাহকে দোষ দিবেন? কিন্তু ধরুন আপনি নিজে তো গেলেনই না, বরং আপনার বন্ধু করিমকেও আটকে রাখলেন। তাকে আপনার নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে ভালো করে বোঝালেন। যার ফলে সে জীবনে একটা বড় ভুল করা থেকে বেঁচে গেল। নিজেকে সংশোধন করার জন্য এবং অন্য একজন মানুষের জীবনকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহ খুশি হয়ে আপনাকে বেহেশত দিয়ে দিলেন।
এভাবে আল্লাহ আমাদেরকে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রাস্তার ব্যবস্থা করে দেন। আমাদেরকে সংশোধনের সুযোগ করে দেন। কিছু রাস্তা আপনাকে আরও খারাপ করে দিবে, আপনার এবং আপনার পরিবারের সদস্যদের জীবনে আরও কষ্ট এনে দিবে। কিছু রাস্তা আপনাকে আপনার দুরবস্থা থেকে বের করে এনে জীবনটা সহজ করে দিবে। আপনি যদি আপনার গত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না পেয়ে, নিজের লোভ, ইগো, সন্মান, রাগ, অহংকারকে সংযত না করে আবারো ভুল রাস্তায় চলে যান, তাহলে এর জন্য আপনি দায়ী, আল্লাহ নয়। “আমি নিশ্চিত ভাবে মানুষকে সঠিক পথ দেখিয়েছি, সে কৃতজ্ঞ হোক আর অকৃতজ্ঞ হোক।” [৭৬:৩]
এ পর্যন্ত যা বললাম তা হল মানুষের মস্তিস্ক বর্তমানে যে পর্যায়ে আছে তার পক্ষে ধারণা করা সম্ভব এমন কিছু উপলব্ধি। যেহেতু ‘কদর’ ব্যপারটিই মানুষের কল্পনাতীত একটি ব্যপার, তাই মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা যত উন্নত হবে, মানুষের এই সম্পর্কে ধারণায় তত পরিবর্তন হবে। এখন পর্যন্ত আমরা এইটুকুই আন্দাজ করতে পারি। আল্লাহ্ই জানেন তিনি কিভাবে কদর সৃষ্টি করেছেন। এধরনের ব্যপার মানুষের জন্য চিন্তা করাটা কঠিন কারণ মানুষ সময়ের মধ্যে বাস করে এবং সময়ের বাইরে কোন কিছু তারা চিন্তা করতে পারেনা। আমাদের ভাষায় অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এর বাইরে আর কোন শব্দ নেই। যেহেতু আমাদের ভাষায় এর বাইরে কোন শব্দ নেই, সেহেতু আমরা সময়ের বাইরে কিছু কল্পনাও করতে পারিনা।
বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ
http://eshaykh.com/doctrine/destiny-before-adam-created/
http://www.deenresearchcenter.com/LinkClick.aspx?fileticket=6BnFlF8OBx8%3D&tabid=94&mid=511
http://www.islamweb.net/emainpage/index.php?page=articles&id=97118