🛑“আল্লাহ যদি সত্যিই অতি দয়ালু হয় তাহলে দোযখ বানিয়ে মানুষকে এতো কষ্ট দিবে কেন? এই জীবনে অল্প কয়েক বছরের কিছু দোষের জন্য দোযখে এতো ভয়াবহ শাস্তি পেতে হবে – এটাতো অন্যায়”
🔷উত্তরঃ হিটলার প্রায় ছয় লাখ মানুষ মেরে গেছে। তাকে যদি ছয় লাখ বার আগুনে ঝলসানো হয় তাহলে কি তাকে যথাযথ শাস্তি দেওয়া হবে? যতদিন পর্যন্ত মানুষ বেঁচে থাকবে ততদিন পর্যন্ত হিটলারের এই গণহত্যার কারণে যেই ক্ষতিটা হয়ে গেছে, তাকে তার জন্য ছয় লাখ বার আগুনে ঝলসালেও কিছুই হবে না। তাকে ছয় কোটি বার ফুটন্ত পানিতে চুবালেও সেই ছয় লক্ষ মানুষের পরিবারের কষ্টের সমান কষ্ট দেওয়া হবে না। সেই ছয় লক্ষ মানুষ যে কয়েক কোটি মানুষকে জন্ম দিতে পারতো, তার উসুল হবে না। “আমরা তো হিটলার না। আমরা তো মানুষ খুন করছি না, বা তেলের লোভে যুদ্ধ করছিনা, অথবা গরীব মানুষের টাকা মেরে দিচ্ছিনা। আমাদেরকে কেন আল্লাহ ফুটন্ত পানিতে ঝলসাবে, আগুনে চামড়া পুড়িয়ে আবার নতুন চামড়া দিবে বার বার কষ্ট দেবার জন্য? আমরা এমন কি দোষ করলাম যার জন্য এত ভয়াবহ শাস্তি পাবো?” আমাদের প্রতিটা দোষের ফলাফল এবং প্রভাব যে কত ব্যাপক, সেটা আমরা কখনও ঠিকভাবে চিন্তা করে দেখিনা। আমরা অনেকেই মনে করি – আমরা যেসব পাপ করি সেগুলো ছোটখাট ব্যপার। এর জন্য আল্লাহ আমাদেরকে এত বড় শাস্তি দিবেন না। কয়েকটা দিন হয়তো দোযখে একটু কষ্ট করবো, ব্যাস, তারপরেই মুক্তি। এধরণের মানুষদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেছেনঃ “তারা বলে, “আগুন আমাদের মাত্র কয়েকটা দিনই স্পর্শ করবে”। তাদেরকে বল, “তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে কোন অঙ্গীকার নিয়েছ – কারণ আল্লাহ কখনো অঙ্গীকার ভাঙেন না? নাকি তোমরা আল্লাহর সম্পর্কে এমন কিছু বল যা নিয়ে তোমাদের কোনই জ্ঞান নেই?” [২:৮০]
কিছু উদাহরণ দেই:
উদাহরণ: ১
আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে বসে একদিন একটা অশ্লীল হিন্দি গান দেখলেন। আপনার কাছে ব্যাপারটা কিছুই না, কারণ আপনার বয়স চল্লিস, আপানার চোখ এসব দেখতে দেখতে ইতিমধ্যে ঝলসে গেছে। আপনার কাছে এগুলো আর গায়ে লাগে না। কিন্তু আপনার ১১ বছরের যৌন আকাঙ্ক্ষায় টগবগে কিশোরের গানের একটা শট দেখে মাথা ঘুরে গেল। সে দিনে রাতে যখনি চোখ বন্ধ করে তখনি সেই শটটা বার বার দেখতে পায়। তারপর থেকে তার বাথরুমে গোসল করতে আধাঘণ্টার বেশি সময় লাগা শুরু হল, সে তার ঘরের দরজা লক করে থাকা শুরু করলো, বন্ধুর বাসায় গিয়ে রাতে দেরি করে ফেরা শুরু হল, নানা কারণে দিনে রাতে যখন তখন বাসার বাইরে যাওয়া আসা আরম্ভ হল। এখান থেকে শুরু হল তার পতন। একসময় সে বিয়ে করলো এবং তার দীর্ঘ দিনের বদভ্যাসের ফলে শারীরিক সমস্যার কারণে বিকলাঙ্গ, না হয় অসুস্থ সন্তানের জন্ম দিল। তার পরিবারে চরম অশান্তি নেমে আসলো। সারাটা জীবন তাকে চরম কষ্ট করে, তার পোড়া কপালের জন্য আল্লাহকে দোষ দিয়ে, এক দুর্বিষহ জীবন পার করতে হল।
আপনি এটা পুরোটাই প্রতিরোধ করতে পারতেন হিন্দি গানটা শুরু হবার সাথে সাথে চ্যানেল পালটিয়ে দিয়ে এবং জোরে জোরে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলে ছেলেকে বুঝিয়ে দিয়ে যে হিন্দি গান দেখাটা একটা খুবই খারাপ জিনিস। আপনার ছেলে আপনার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝত, এটা খুবই খারাপ কাজ এবং তারপর সে তার বাকি জীবনটা সংযত রাখত। সে আগামী বিশ বছর প্রতিদিন আধা ঘণ্টা করে বাথরুমে সময় নষ্ট না করে বিশ বছরে প্রায় ৩,৬৫০ ঘণ্টা কোন ভালো কাজ করে ব্যাপক পুণ্য অর্জন করতে পারত।
একটি ছেলের জীবন নষ্ট করে, সে যত ভালো কাজ করতে পারত এবং সেই ভালো কাজগুলোর জন্য যত মানুষের যত উপকার হত সেটা না হতে পারার জন্য; তার স্ত্রী, সন্তান, শ্বশুর, শাশুড়ির সারাজীবন দুখের জন্য এবং একটি বিকলাঙ্গ বা অসুস্থ প্রজন্মের শুরু করার জন্য আপনাকে যদি আল্লাহ কয়েক হাজার বার চামড়া আগুনে পুড়িয়ে আবার নতুন চামড়া দেন, আপনি কি বলবেন শাস্তিটা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেছে? আপনি কি তখন চিল্লাচিল্লি করবেন – “আমিতো একটা হিন্দি গানই দেখেছিলাম!” “(জাহান্নামে তাদেরকে বলা হবে) “তোমাদেরকে কি আমার বাণী বার বার শোনানো হয় নি? তারপরেও কি তোমরা অমান্য করনি?” তারা বলবে, “ও আমাদের প্রভু, আমরা আমাদের উচ্ছৃঙ্খলতা/অবাধ্যতায় ডুবে ছিলাম, আমরা একটা বিভ্রান্ত জাতি ছিলাম। ও আমাদের প্রভু, আমাদেরকে এখান থেকে উদ্ধার করুন। আমরা যদি এরপরেও একই কাজ করি, তাহলে আমরা সত্যিই অন্যায়কারী।” [২৩:১০৫-১০৭]
উদাহরণ: ২
একদিন সকালে আপনি আপনার ড্রাইভারকে একটা চড় মেরে তেল আনতে পাঠালেন। ড্রাইভার রাগে গজ গজ করতে করতে উল্টাপাল্টা গাড়ি চালিয়ে রাস্তায় আরও দশ জন মানুষের মেজাজ খারাপ করে পেট্রোল পাম্পে গেল। সেই দশ জন মানুষ তাদের মেজাজ খারাপটা ছাড়ল রাস্তার আরও বিশ জন মানুষের উপর। সেই ত্রিশ জন লোক বাসায় ফিরে ত্রিশটা পরিবারের একশ জন সদস্যর উপর মেজাজ ছাড়ল। সেই একশ পরিবারের সদস্য তাদের মনের ঝাল মেটাল তাদের হাজার খানেক বন্ধু, আত্মীয়ের উপর।
আপনি সেদিন ড্রাইভারকে চড় মেরে একটা চেইন রিয়েকশন শুরু করে দিয়েছিলেন। সেই চেইন রিয়েকশনের ভুক্তভুগি হাজার হাজার মানুষের কষ্টের জন্য আপনি দায়ী। আপনাকে যদি একটা চড় মারার জন্য জাহান্নামে এক লক্ষ বার লাঠি দিয়ে পেটানো হয়, আপনি কি বলবেন, “দোযখের শাস্তি এতো কঠিন কেন?” “তুমি যদি দেখতে পেতে, যখন অপরাধীরা মাথা নত করে বলবে, “ও আমাদের প্রভু, আমরা দেখলাম এবং শুনলাম। আমাদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দিন। এবার আমরা ভালো কাজ করবো। আমরা এবার নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছি।” [৩২:১২]
উদাহরণ: ৩
ধরুন আপনার স্বামী (বা স্ত্রীর) সাথে তুমুল ঝগড়া হল। যার ফলে আপনি মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে গেলেন এবং শয়তান এই সুযোগ নিয়ে আপনাকে টিভিতে হিন্দি গান দেখার, ফেইসবুকে ফ্লার্ট করার অথবা মোবাইলে পরকীয়া করার সুযোগ করে দিল। যেহেতু ঝগড়া করে আপনি এমনিতেই মানসিকভাবে দুর্বল, আপনি নোংরামি থেকে নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না, বরং এক ধরণের প্রতিশোধ নেবার মনোভাব থেকে – “আমার সাথে ঝগড়া করেছ? দাঁড়াও, আমি এখন বেশি করে পর্ণ দেখে, ফেইসবুকে আমার বয়ফ্রেন্ড/গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে ফ্লার্ট করে তোমাকে মজা দেখাচ্ছি” – এই মনে করে আপনি পাপে ডুবে গেলেন।
এখন আপনি দাবি করবেন, “ঝগড়া করে মেজাজ খারাপ ছিল, এজন্য এসব করেছি। এটা কোন মহা পাপ না, একটা মামুলি ঘটনা।”
এই মামুলি ঘটনা থেকে যদি আপনার অন্যায়ের তালিকা তৈরি করি, তাহলে কমপক্ষে এই কয়েকটা কারণে আপনাকে আল্লাহর আদালতে
অভিযুক্ত করা যাবেঃ
1] পরিবারের সদস্যের সাথে অসাদাচারন।
2] পরিবারের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি।
3] পরিবারের সদস্যের সাথে বেইমানি করা।
4] শয়তানের সাথে সহযোগিতা করা।
5] নিজের ঈমান দুর্বল করা।
6] ঈমান দুর্বল হবার কারণে ভবিষ্যতে করা সকল পাপ কাজ।
7] অন্যের অন্যায় সমর্থন করা।
8] অন্যের কাছে অন্যায় প্রচার করা।
9] অশ্লীলতা গ্রহন এবং প্রচার করা, অশ্লীল সাইটের ট্রাফিক বৃদ্ধি করে তাদের উপার্জন বৃদ্ধি করা।
10] অশ্লীল কাজে একাধিক মানুষের সময়ের অপচয়।
11] অশ্লীল কাজে বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাস প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়।
12] অশ্লীল কাজে পারিবারিক সম্পদের অপচয়, যা আপনার পরিবারের সদস্যদের হক।
এত সব অন্যায়ে অভিযুক্ত করে আপনাকে যদি লক্ষ বার অতি উত্তপ্ত পানিতে চুবিয়ে ঝলসানো হয়, তাহলে কি বেশি শাস্তি দেওয়া হবে?
আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা চিন্তা করিনা আমাদের প্রতিটি কথা এবং কাজের ফলাফল কত ব্যাপক। আমরা মনে করি আমরা যখন একজনকে কিছু বলি, বা একজনের সাথে কিছু করি, তার প্রভাব শুধুই তার উপর এবং তার কাছের মানুষের উপর পড়বে। কিন্তু তা নয়। আমাদের প্রতিটা কথা এবং কাজ সমাজে একটা চেইন রিয়েকশন শুরু করে দেয়। এমনকি ইন্টারনেটের বদলে আজকাল তার প্রভাব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যেতে পারে। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকটা খারাপ কথা বা কাজের জন্য আমাদেরকে দুই এক বার শাস্তি দিলে সেটা নিশ্চয়ই ন্যায় বিচার হবে না? বরং আমাদের কোন খারাপ কথা বা কাজের জন্য পৃথিবীতে যত মানুষের যত ক্ষতি হবে, তার সমান শাস্তি আমাদেরকে দিতে হবেই, যদি সত্যিই ন্যায়বিচার করতে হয়।
সালাম।