বিষয়: ইতেকাফ সম্পর্কে আলোচনা। অর্থ, সংঙ্গা, হুকুম, শর্ত, ভঙ্গের কারণ, থাকার নিয়ম, মোস্তাহাব ও আদবসমূহ।
ইতেকাফ অর্থ কি?
ইতেকাফ অর্থ স্থির থাকা, অবস্থান করা।
ইতেকাফ কাকে বলে?
পরিভাষায় জাগতিক কার্যকলাপ ও পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছওয়াবের নিয়তে মসজিদে বা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা ও স্থির থাকাকে ইতেকাফ বলে।
ইতেকাফ করার হুকুম কি? এটি ফরজ নাকি সুন্নাত?
রমযানের শেষ দশকে ইতেকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কেফায়া, অর্থাৎ, বড় গ্রাম বা শহরের প্রত্যেকটা মহল্লা এবং ছোট গ্রামের পুর্ণ বসতিতে কেউ কেউ ইতেকাফ করলে সকলেই দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে- আর কেউই না করলে সকলেই সুন্নাত তরকের জন্য দায়ী হবে।
ইতেকাফের সময় কখন?
রমযানের ২০ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত ইতেকাফের সময়।
ইতেকাফের শর্ত সমূহ কি?
ইতেকাফের জন্য তিনটি শর্ত; যথাঃ
- এমন মসজিদে ইতেকাফ হতে হবে যেখানে নামাযের জামা’আত হয়। জুমুআ-র জামা’আত হোক বা না হোক। এ শর্ত পুরুষের ইতেকাফের ক্ষেত্রে। মহিলাগণ ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে ইতেকাফ করবে।
- ইতেকাফের নিয়ত করতে হবে।
- হায়েয নেফাস শুরু হলে ইতেকাফ ছেড়ে দিবে।
ইতেকাফ ভঙ্গের কারণ সমূহ কি?
যে সব কারণে ইতেকাফ ফাসেদ তথা নষ্ট হয়ে যায় এবং কাযা করতে হয়ঃ
- স্ত্রী সহবাস করলে ইতেকাফ ফাসেদ হয়ে যায়, চাই বীর্যপাত হোক বা না হোক, ইচ্ছাকৃত হোক বা ভুলে হোক। সহবাসের আনুষঙ্গিক কাজ যেমন চুম্বন, আলিঙ্গন, ইত্যাদির কারণে বীর্যপাত হলে ইতেকাফ ফাসেদ হয়ে যায়। চুম্বন ইত্যাদির কারণে বীর্যপাত না হলে ইতেকাফ বাতিল হয় না, তবে ইতেকাফের অবস্থায় তা করা হারাম।
- ইতেকাফের স্থান থেকে শরী’আত সম্মত প্রয়োজন বা স্বাভাবিক প্রয়োজন ছাড়া বের হলে ইতেকাফ ফাসেদ হয়ে যায়।
ইতেকাফ ভঙ্গের কারণ নয় সমূহ কোনগুলো?
- শরী’আত সম্মত প্রয়োজন হলে মসজিদের বাইরে যাওয়া যায়; যেমন সে মসজিদে জুমুআর জামা’আত না হলে জুমুআর নামাযের জন্য জামে মসজিদে যাওয়া, ফরয বা সুন্নাত গোসলের জন্য বের হওয়া ইত্যাদি।
- আর স্বাভাবিক প্রয়োজনেও বের হওয়া যায়; যেমন পেশাব-পায়খানার জন্য বের হওয়া, খাদ্য খাবার এনে দেয়ার লোক না থাকলে তা আনার জন্য বের হওয়া, মসজিদের ভিতর উযূর পানির ব্যবস্থা না থাকলে এবং পানি দেয়ার কেউ না থাকলে উযূর পানির জন্য বাইরে যাওয়া। কিন্তু যে কাজের জন্য বাইরে যাওয়া হবে সে কাজ সমাপ্ত করার পর সত্বর ফিরে আসবে, বিনা প্রয়োজনে কারও সাথে কথা বলবে না।
ইতেকাফের অবস্থায় যে সব জিনিস মাকরূহ
- ইতেকাফ অবস্থায় চুপ থাকলে ছওয়াব হয় এই মনে করে চুপ থাকা মাকরূহ তাহরীমী।
- বিনা জরুরতে দুনিয়াবী কাজে লিপ্ত হওয়া মাকরূহ তাহরীমী। যেমন ক্রয়-বিক্রয় করা ইত্যাদি। তবে নেহায়েত জরুরত হলে যেমন ঘরে খোরাকী নেই এবং সে ব্যতীত কোন বিশ্বস্ত লোকও নেই-এরূপ অবস্থায় মসজিদে মাল-পত্র উপস্থিত না করে কেনা-বেচার চুক্তি করতে পারে।
ইতেকাফের থাকার নিয়ম: মোস্তাহাব ও আদবসমূহ
- ইতেকাফের জন্য সর্বোত্তম মসজিদ নির্বাচন করবে। সর্বোত্তম মসজিদ হল মসজিদুল হারাম, তারপর মসজিদে নববী, তারপর বায়তুল মুকাদ্দাস, তারপর যে জামে মসজিদে জামা’আতের এন্তেজাম আছে, তারপর মহল্লার মসজিদ, তারপর যে মসজিদে বড় জামা’আত হয়।
- নেক কথা ব্যতীত অন্য কথা না বলা।
- বেকার বসে না থেকে নফল নামায, তিলাওয়াত ও তাসবীহ তাহলীলে মশগুল থাকা উত্তম।
- ইতেকাফে খাস কোন ইবাদত করা শর্ত নয়- যে কোন নফল নামায, যিকির-আযকার, তিলাওয়াত, দ্বীনী কিতাব পড়া, পড়ানো বা যে ইবাদত মনে চায় করতে পারে।
- ইতেকাফ শুরু করার পর নিজের বা অন্যের জীবন বাঁচানোর তাগিদে অনন্যোপায় অবস্থায় ইতেকাফের স্থান থেকে বের হলে গোনাহ নেই বরং তা জরুরী, তবে তাতে ইতেকাফ ভেঙ্গে যাবে।
- কোন শরী’আত সম্মত প্রয়োজনে বা স্বাভাবিক প্রয়োজনে বের হলে ইত্যবসরে কোন রোগী দেখলে বা জানাজায় শরীক হলে তাতে কোন দোষ নেই।
- পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ইতেকাফে বসা অথবা বসানো উভয়টা না-জায়েয ও গোনাহ।
- মহিলাদের জন্য মসজিদে ইতেকাফ করা মাকরূহ তাহরীমী। তারা ঘরে ইতেকাফ করবে। স্বামী মওজুদ থাকলে ইতেকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি গ্রহণ করতে হবে। স্বামীর খেদমতের প্রয়োজন থাকলে ইতেকাফে বসবে না। শিশুর তত্ত্বাবধান ও যুবতী কন্যার প্রতি খেয়াল রাখার প্রয়োজনীয়তা থাকলে ইতেকাফে না বসাই সমীচীন। মহিলাগণ নির্দিষ্ট কোন কামরায় বা ঘরের কোণে এক স্থানে পর্দা ঘিরে ইতেকাফে বসবে। মহিলাদের জন্য ইতেকাফের অন্যান্য মাসায়েল পুরুষদেরই ন্যায়।
ওয়াজিব ইতেকাফ (মান্নতের ইতেকাফ)-এর মাসায়েল
- ইতেকাফের মান্নত করলে ইতেকাফ ওয়াজিব হয়ে যায়। তবে কোন শর্তের ভিত্তিতে মান্নত করলে (যেমন আমার অমুক কাজ হয়ে গেলে ইতেকাফ করব ইত্যাদি) শর্ত পূরণ হওয়ার পূর্বে ওয়াজিব হয় না।
- ওয়াজিব ইতেকাফের জন্য রোযা শর্ত-যখনই ইতেকাফ করবে রোযাও রাখতে হবে।
- ওয়াজিব ইতেকাফ কমপক্ষে একদিন হতে হবে। বেশী দিনের নিয়ত করলে তা-ই করতে হবে।
- যদি শুধু এক দিনের ইতেকাফের মান্নত করে তাহলে তার সঙ্গে রাত শামেল হবে না। তবে যদি রাত দিন উভয়ের নিয়ত করে বা একত্রে কয়েক দিনের মান্নত করে তাহলে রাতও শামেল হবে। দিন বাদে শুধু রাতে ইতেকাফের মান্নত হয় না।
- সুন্নাত ইতেকাফের ক্ষেত্রে যে সব মাসায়েল বর্ণনা করা হয়েছে, ওয়াজিব ইতেকাফের ক্ষেত্রেও সেগুলো প্রয়োজ্য।
মোস্তাহাব/নফল ইতেকাফের মাসায়েল
- সুন্নাত ইতেকাফ (রমযানের পূর্ণ শেষ দশক) ও ওয়াজিব ইতেকাফ ব্যতীত অন্যান্য যে কোন সময়ের ইতেকাফের জন্য কোন পরিমাণ সময় নির্ধারিত নেই- সামান্য সময়ের জন্যেও তা হতে পারে।
- যে সব জিনিস দ্বারা ইতেকাফ ফাসেদ হয়ে যায় এবং কাযা করতে হয় সেসব দ্বারা মোস্তাহাব ইতেকাফও নষ্ট হয়ে যাবে। তবে মোস্তাহাব ইতেকাফের জন্য যেহেতু সময়ের পরিমাণ নির্ধারিত নেই, তাই তার কাযাও নেই।
সূত্র: আহকামে যিন্দেগী।