ইসলাম সম্পর্কে পাশ্চত্যের ১০টি ভুল ধারণাঃ
এক. পাশ্চাত্যকে মুসলমানদের ঘৃণা
সাধারণরত পশ্চিমাবিশ্ব মনে করে যে, সকল মুসলমানরাই পাশ্চাত্যকে ঘৃণা করে। পশ্চিমা অনলাইন সংবাদ সংস্থা ‘নাউ দ্যা এন্ড বিগেইন’ যার অনুসরণকারী এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার, তাদের এক নিবন্ধে উল্লেখ করে,
‘মুসলিম শিশুরা ছোট থেকেই পশ্চিমা বিশ্বকে ঘৃণা করতে শিখে।’
কিন্তু ইন্সটিটিউট অব সোস্যাল পলিসি এন্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর গবেষণায় এর বিপরীত মত প্রকাশ করা হয়েছে।
গবেষণায় ৩৫টি দেশের পঞ্চাশ হাজার মুসলিমের উপর জরিপ করা হয়েছিল। এই গবেষণায় দেখা যায়, খুব অল্প মুসলিমই পাশ্চাত্যের তীব্র বিরোধিতা করে। তন্মধ্যে ইরানের ২% এবং সউদি আরবের ৬% লোক পাশ্চাত্যের তীব্র বিরোধিতাকারী।
দুই. সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রশিক্ষণ
পাশ্চাত্যের মুসলমানদের সম্পর্কে একটি অমূলক ধারণা হল, পাশ্চাত্যে বসবাসকারী মুসলমানরা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের উপর গোপনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। মুসলিমবিদ্বেষী সংগঠন ‘কৃশ্চিয়ান অ্যাকশন নেটওয়ার্ক’ এর প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন ময়ার দাবি করেন, আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে গোপন প্রশিক্ষণ শিবির রয়েছে, যাতে মুসলমানরা সন্ত্রাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। তিনি তার বই ‘টুইলাইট ইন আমেরিকা’তে তিনি বলেন, নিউইয়র্কের ইসলামবার্গে এরূপ একটি প্রশিক্ষণ শিবির রয়েছে যেখানে বিভিন্ন সশস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।
ইসলামবার্গ মূলত একটি শান্ত শহরতলী, যেটি আফ্রিকান-আমেরিকান মুসলিমদের দ্বারা ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। নিউইয়র্ক শহরের তৎকালীন বর্ণবাদের ভয়াবহ বিষবাষ্প হতে রক্ষার জন্য তারা এখানে এসে বসবাস শুরু করেছিলো।
ময়ারের দাবি নিউইয়র্কের পুলিশ কর্তৃপক্ষও প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, তারা নিয়মিতই এ অঞ্চলে আসা যাওয়া করে এবং আইনশৃংখলা রক্ষায় তারা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে যথাযথ সহযোগিতা পেয়ে থাকেন।
তিন. নিষিদ্ধ স্থান
২০১৫ সালের জানুয়ারীতে ফক্স নিউজের জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক কেটি ম্যাকফারল্যান্ড এক অনুষ্ঠানে বলেন, ফ্রান্সে ৭৫০ টির মত জায়গা রয়েছে যেখানে সাধারণ ফরাসীরা এবং অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারেনা। তিনি বলেন, একমাত্র মুসলিমরাই সেখানে বসবাস করে এবং সেখানে কঠোরভাবে শরীয়া আইন মেনে চলা হয়।
ম্যাকফারল্যান্ডের এরূপ দাবি ব্যাপক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। তার দাবিকৃত কথিত নিষিদ্ধ স্থানসমূহ মূলত ফরাসী সরকার নতুন করে সংস্কার কাজ করার জন্য অধিকৃত করে নিয়েছে। ফরাসী সিটি কাউন্সিল ফক্সনিউজের বিরুদ্ধে এই বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করার জন্য পরবর্তীতে একটি মামলা দায়ের করেছে।
চার. ইসলামী সন্ত্রাসবাদ
বর্তমানে পশ্চিমাবিশ্বে ইসলামকে সর্বাধিক গুরুতর সন্ত্রাসবাদের উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় একে সম্পূর্ণ অবান্তর ধারণা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখানো হয়েছে, নাইন ইলেভেনের পর এ পর্যন্ত বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলায় মোট এক লক্ষ নব্বই হাজার মার্কিন নাগরিক নিহত হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩৭ জন ইসলামী চরমপন্থীদের হাতে নিহত হয়েছে।
অপরদিকে ইউরোপোল নামক অপর একটি সংস্থা দেখিয়েছে, ২০০৬ থেকে ২০১৩ মাঝামাঝি সময়ে সমগ্র ইউরোপে সংগঠিত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাত্র ০.৭ শতাংশ ইসলামী চরমপন্থীদের দ্বারা সংগঠিত হয়েছে।
পাঁচ. ৯/১১ উদযাপন
২০১৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারনা চালানোর সময় বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, তিনি টিভির একটি ফুটেজে দেখেছেন নিউজার্সির মুসলমানদের ৯/১১ উদযাপন করতে। কিন্তু মার্কিন মিডিয়া এরূপ কোন ভিডিওর সত্যতা প্রদান করতে ব্যর্থ হয়। নিউজার্সির পুলিশ কমিশনার জেরি স্পেজিয়াল এধরনের দাবিকে ভিত্তিহীন বলে মন্তব্য করেছেন।
ছয়. ইসলামের প্রতিনিধি হিসেবে দায়েশকে বিবেচনা
পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই বর্তমানে ইসলামকে বুঝতে দায়েশ বা আইসিসের কার্যক্রমকে বিবেচনা করেন।
প্রকৃতপক্ষে, আইসিস শুধু অনৈসালিমকই নয়, বরং এটি ইসলাম বিরোধীও। ২০১৫ সালের প্রথম আট মাসে ইরাকের নয় হাজারের মত মুসলমানের মৃত্যুর জন্যও দায়ী ছিলো সংগঠনটি। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলার জন্যও সংগঠনটি তাদের দায় স্বীকার করেছে। মসজিদের মত পবিত্র স্থানও তাদের হামলা থেকে রক্ষা পায়নি।
সাত. মুসলিম মাত্রই সহিংসতার সমর্থক
সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি নামক একটি মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক দাবি করেছে, ২৫ শতাংশ আমেরিকান মুসলিম অপর আমেরিকান নাগরিকদের প্রতি সহিংসতার সমর্থনকারী। সংস্থাটি প্রকৃতপক্ষে ফ্রাঙ্ক গেফানি নামক একজন চিহ্নিত মুসলিম বিদ্বেষী বুদ্ধিজীবি দ্বারা পরিচালিত এবং তাদের গবেষণার জন্য পরিচালিত জরিপে মাত্র ছয়শত জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছিলো।
এর বিপরীতে পিউ রিসার্চ সেন্টারের বিশদ গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বের ১.৬ বিলিয়ন মুসলিমের মধ্যে মাত্র ০.০০৬৬২৫ শতাংশ চরমপন্থী ধারণা লালন করে।
আট. মুসলিম অধ্যুষিত বার্মিংহাম
২০১৫ সালে আমেরিকার ফক্স নিউজের এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিক ও কথিত ইসলামী চরমপন্থী বিশেষজ্ঞ স্টিভেন ইমারসনকে আহবান করা হয়। ইমরাসন সেই অনুষ্ঠানে দাবি করেন, যুক্তরাজ্যের বার্মিহাম শহরটি সম্পূর্ণরূপে মুসলিম অধ্যুষিত এবং অমুসলিমরা সেখানে প্রবেশ করতে পারেন না।
ইউকে ন্যাশনাল অফিস অব স্ট্যাটিকটিস অবশ্য ইমারসনের এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলছে, বার্মিহামের মাত্র ১৪.৫ শতাংশ অধিবাসী মুসলিম।
এই প্রেক্ষিতে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেন,
‘তার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমি চিন্তা করেছিলাম, আজকে এপ্রিল ফুল বোধহয়! এই লোকটি স্পষ্টভাবে মূর্খ।’
নয়. মুসলিম নারীরা নির্যাতিত
পাশ্চাত্যে জনপ্রিয় একটি ধারণা হল, মুসলিম নারীরা নির্যাতিত। তাদের নিকাব বা বোরকার মাধ্যমে বন্দী করে রাখা হয়।
প্রকৃতপক্ষে কুর’আনে মুসলিম নারীদের শালীনতা রক্ষার আদেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এর জন্য নির্দিষ্ট কোন পোশাকের উল্লেখ করা হয়নি।
পাশ্চাত্যে মনে করা হয়, ইসলাম মুসলিম নারীদের বোরকার মধ্যে বন্দী রেখে শিক্ষার সুযোগ সহ সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখে। কিন্তু বোরকার প্রচলন সত্ত্বেও অনেক মুসলিম দেশে নারী শিক্ষার হার অত্যাধিক। এরূপ একটি দেশ ইরান, যেখানে বোরকা পড়েই অনেক মুসলিম নারী উচ্চতর শিক্ষা ও বিভিন্ন পেশাক্ষেত্রে সফলতার সাথে অংশ গ্রহণ করছেন।
দশ. বিধর্মীদের লোকদের হত্যা করা মুসলিমদের জন্য আবশ্যক
পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে ধারণা করা হয়, অন্য ধর্মের প্রতি ইসলাম সম্পূর্ণরূপে অসহিষ্ণু। ইসলাম মুসলিমদের অন্য ধর্মের লোকদের হত্যা করারই শিক্ষা প্রদান করে থাকে। কিন্তু ইসলামের শিক্ষা এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, কেউ যদি ইসলামী রাষ্ট্রে কোন জিম্মি (নিরাপত্তার অধীন) অমুসলিম ব্যক্তিকে হত্যা করে তবে সে বেহেশতের সুঘ্রাণ ও পাবেনা।