আমরা প্রায়স ইমান/ঈমান শব্দটা মুসলিমদের মুখ থেকে শুনে থাকি। তাই আপনি ইসলাম বা অন্য ধর্মের মানুষ হলোেও আপনার জনে রাখা দরকার, মুসরমানদের ঈমান/বিশ্বাস সমূহ আসলে কি?
মুসলিম হতে হলোে সর্বপ্রথম যে বিষয়টা আসে, তা হলোো ঈমান/ইমান/ব্শ্বিাস। অর্থ্যাৎ এটি ইসলামের প্রথম সম্ভ।
ঈমান কাকে বলে, ঈমান শব্দের অর্থ কি?
ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ স্বীকার করা, স্বীকৃতি দেওয়া, অনুগত হওয়া মতান্তরে দৃঢ় বিশ্বাস করা। সংক্ষেপে ও সাধারণভাবে ইসলামের ধর্মীয় বিশ্বাসকে ঈমান বলা হয়।
ঈমানের মূল বিষয় কয়টি?
ঈমানের মূল বিষয় ৬ টি। যথা:
১. “আল্লাহ”-এর উপর ঈমানঃ
✅ আল্লাহ তা’আলার উপর ঈমান বলতে মৌলিক ভাবে তিনটি বিষয় বিশ্বাস করা ও মেনে নেয়াকে বুঝায়:
✅ আল্লাহর সত্তা ও তাঁর অস্তিত্বে বিশ্বাস করা।
✅ আল্লাহর ছিফাত অর্থাৎ, তাঁর গুণাবলীতে বিশ্বাস করা। ( অন্য একটি পোষ্টে আল্লাহর গুণাবলী তাঁর গুণবাচক নাম সমুহে ব্যক্ত হয়েছে।)
✅ তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা। এই তাওহীদ বা একত্ব আল্লাহর সত্তার ক্ষেত্রে যেমন, তাঁর গুণাবলী ও ইবাদতের ক্ষেত্রেও তেমন।
অর্থাৎ, আল্লাহর সত্তা যেমন এক-তাঁর সত্তায় কেউ শরীক নেই, তেমনিভাবে তাঁর গুণাবলীতেও কেউ শরীক নেই এবং একমাত্র তাঁরই ইবাদত করতে হবে, ইবাদতে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করা যাবেনা।
তাওহীদের বিপরীত হলো শির্ক। অতএব একাধিক মা’বূদে/সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করা শির্ক।
যেমন, অগ্নিপূজক সম্প্রদায় কল্যাণের মা’বূদ হিসেবে ‘ইয়াযদান’ এবং অকল্যাণের মা’বূদ হিসেবে ‘আহরামান’-কে বিশ্বাস করে। এটা শির্ক।
এমনিভাবে খৃষ্টানরা তিন খোদা মানে।
হিন্দুগণ ব্রহ্মাকে সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণুকে পালনকর্তা এবং মহাদেবকে সংহারকর্তা বলে মানে; এভাবে তারা একাধিক ভগবানে বিশ্বাসী। এ ছাড়াও তারা বহু দেবদেবীতে বিশ্বাস করে, এটা শির্ক।
এমনিভাবে আল্লাহর গুণাবলীতে কোন সৃষ্টিকে শরীক করা, যেমনঃ মানুষের কোন কল্যাণ সাধন কিংবা বিপদ মোচন ইত্যাদি বিষয়ে কোন সৃষ্টিকে
ক্ষমতাপ্রাপ্ত মনে করা, এটা শির্ক।
২. ফেরেশ্তা সম্বন্ধে ঈমান/ইমান/বিশ্বাসঃ ফেরেশতা কি? ফেরেশতা কারা? ফেরাশতাদের গুণ বৈশিষ্ট্য কি? প্রধার ৪ ফেরেফতার কাজ কি?
ফেরেশতা সম্বন্ধে এই বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ এক প্রকার নূরের মাখলূক সৃষ্টি করেছেন, যারা পুরুষও নয় নারীও নয়। যারা কাম, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি রিপু থেকে মুক্ত। যারা নিষ্পাপ।
আল্লাহর আদেশের বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম তারা করে না। তারা বিভিন্ন আকার ধারণ করতে পারে। তারা সংখ্যায় অনেক। আল্লাহ তাদেরকে বিপুল শক্তির অধিকারী বানিয়েছেন।
আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করে বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। কতিপয় আযাবের কাজে, কতিপয় রহমতের কাজে নিযুক্ত আছে। কতিপয় আমলনামা লেখার কাজে নিযুক্ত, তাদেরকে “কিরামান কাতিবীন” বলা হয়।
এমনিভাবে সৃষ্টির বিভিন্ন কাজে ফেরেশ্তাদেরকে আল্লাহ নিয়োজিত করে রেখেছেন।
প্রধান ফেরেশতা কতজন/প্রসিদ্ধ ফেরেশতা কয়জন?
ফেরেশ্তাদের মধ্যে চারজন সর্ব প্রধান।
যথাঃ
(এক) জিব্রাইল ফেরেশ্তা: কে তার কাজ কি?
উত্তর: তিনি ওহী ও আল্লাহর আদেশ বহন করে নবীদের নিকট আসতেন। এছাড়া আল্লাহ যখন যে নির্দেশ প্রদান করেন তা কর্তব্যরত ফেরেশ্তার নিকট পৌঁছান।
(দুই) মীকাঈল ফেরেশ্তা: কে? তার কাজ কি?
উত্তর: তিনি মেঘ প্রস্তুত করা ও বৃষ্টি বর্ষাণো এবং আল্লাহর নির্দেশে মাখ্লূকের জীবিকা সরবরাহের দায়িত্বে নিযুক্ত।
(তিন) ইসরাফীল ফেরেশ্তা: কে? তার কাজ কি?
উত্তর: তিনি রূহ সংরক্ষণ ও সিঙ্গায় ফুৎকার দিয়ে দুনিয়াকে ভাঙ্গা ও গড়ার কাজে নিযুক্ত।
(চার) আযরাঈল ফেরেশ্তা: কে? তার কাজ কি?
উত্তর: জীবের প্রাণ হরণের কাজে নিযুক্ত তিনি I তাকে ‘মালাকূল মউত’ও বলা হয়। রূহ কবজ করার সময় তাকে কারও কাছে আসতে হয় না বরং সারা পৃথিবী একটি গ্লোবের মত তার সামনে অবস্থিত, যার আয়ু শেষ হয়ে যায় নিজ স্থানে থেকেই তিনি তার রূহ কব্য করে নেন।
তবে মৃত ব্যক্তি নেককার হলোে রহমতের ফেরেশ্তা আর বদকার হলোে আযাবের ফেরেশ্তা মৃতের নিকট এসে থাকেন এবং মৃত ব্যক্তির রূহ নিয়ে যান।
৩. নবী ও রাসূল সম্বন্ধে ঈমানঃ
প্রশ্ন: নবী কি? নবী কাদের বলা হয়? তাদের কাজ কি?
উত্তর: জিন ও ইনছানের হেদায়েতের জন্য আল্লাহ আসমান থেকে যে কিতাব প্রেরণ করেন, সেই কিতাবের ধারক বাহক বানিয়ে, সেই কিতাব বুঝানো ও ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য তথা আল্লাহর বাণী হুবহু পৌঁছে দেয়ার জন্য এবং আমল করে আদর্শ দেখানোর জন্য আল্লাহ নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং জিন ও মানব জাতির নিকট তাঁদেরকে প্রেরণ করেছেন। তাঁদেরকে বলা হয় নবী বা পয়গম্বর।
প্রশ্ন: রাসূল কি? রাসূল কাদের বলা হয়? তাদের কাজ কি?
উত্তর: নবীদের মধ্যে বিশেষ ভাবে যারা নতুন কিতাব প্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁদেরকে বলা হয় রাসূল, আর যারা নতুন কিতাব প্রাপ্ত হননি বরং পূর্ববর্তী নবীর কিতাব প্রচারের দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদেরকে শুধু নবী বলা হয়। তবে সাধারণ ভাবে নবী, রাসূল, পয়গম্বর সব শব্দগুলো একই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
নবী ও রাসূলদের প্রতি ঈমান রাখার অর্থ হলো প্রধানতঃ নিম্নোক্ত বিষয়াবলীতে বিশ্বাস রাখা।
(এক) নবীগণ নিষ্পাপ-তাঁদের দ্বারা কোন পাপ সংঘটিত হয়না। কারণ তাদের রয়েছে আল্লাহ বিশেষ ও সরাসরি সাহায্যে।
(দুই) নবীগণ মানুষ, তাঁরা খোদা নন বা খোদার পুত্র নন বা খোদার রূপান্তর (অবতার) নন বরং তাঁরা খোদার প্রতিনিধি ও নায়েব। আল্লাহর বাণী অনুসারে জিন ও মানুষ জাতিকে হেদায়েতের জন্য তাঁরা দুনিয়াতে প্রেরিত হন।
(তিন) নবীগণ আল্লাহর বাণী হুবহু পৌঁছে দিয়েছেন।
(চার) নবীদের ছিলছিলা হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর শেষ হয়েছে।
(পাঁচ) আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং তিনি খাতামুন্নাবী অর্থাৎ, তাঁর পর আর কোন নবী আসবে না। অন্য কেউ নবী হওয়ার দাবী করলে সে ভন্ড এবং কাফের।
(ছয়) হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত যত পয়গম্বর এসেছেন, তাঁদের সকলেই হক ও সত্য পয়গম্বর ছিলেন, সকলের প্রতিই ঈমান রাখতে হবে।
তবে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনের পর অন্য নবীর শরী’আত রহিত হয়ে গিয়েছে, এখন শুধু হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শরী‘আত ও তাঁর আনুগত্যই চলবে।
(সাত) নবীদের দ্বারা তাঁদের সত্যতা প্রমাণিত করার জন্য অনেক সময় অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। এসব অলৌকিক ঘটনাকে ‘মু’জিযা’ বলে। মু’জিযায় বিশ্বাস করাও ঈমানের অঙ্গীভূত।
৪. আল্লাহর কিতাব সম্বন্ধে ঈমানঃ
আল্লাহ তা’আলা মানব ও জিন জাতির হেদায়েত এবং দিক নির্দেশনার জন্য নবীদের মাধ্যমে তাঁর বাণীসমূহ পৌঁছে দিয়ে থাকেন। এই বাণী ও আদেশ নিষেধের সমষ্টিকে বলা হয় কিতাব।
আল্লাহ তা’আলা যত কিতাব দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন তার মধ্যে অনেকগুলো ছিল সহীফা (পুস্তিকা) অর্থাৎ, কয়েক পাতার কিতাব।
এক বর্ণনা মতে সর্বমোট ১০৪ খানা কিতাব প্রেরণ করা হয়। তন্মধ্যে চারখানা হলো বড় কিতাব। যথাঃ
প্রশ্নঃ তাওরাত বা তৌরীত কোন নবীর উপর নাযেল হয়?
তাওরাত বা তৌরীত: যা হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর নাযেল হয়।
প্রশ্নঃ যবূর কোন নবীর উপর নাযেল হয়?
উত্তরঃ যবূর যা হযরত দাউদ (আঃ)-এর উপর নাযেল হয়।
প্রশ্নঃ ইঞ্জীল কোন নবীর উপর নাযেল হয়?
উত্তরঃ ইঞ্জীল যা হযরত ঈসা (আঃ)-এর উপর নাযেল হয়।
উল্লেখ্য যে, আলাহ্ প্রেরিত আসল ইঞ্জীল দুনিয়ার কোথাও নেই। বর্তমানে ইঞ্জীল বা বাইবেল নামে যে গ্রন্থ পাওয়া যায় তা মূলতঃ ঈসা (আঃ) কে আল্লাহ তা’আলা উর্ধ্ব আকাশে উঠিয়ে নেয়ার বহু বৎসর পর কিছু লোক রচনা ও সংকলন করেছিল। তারপর যুগে যুগে বিভিন্ন পাদ্রী ও খৃষ্টান পন্ডিতগণ তাতে বহু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজন করেছে।
ফলে বর্তমান ইঞ্জীল বা বাইবেল কোন ক্রমেই আর আসমানী ইঞ্জীল বলে মেনে নেয়া যায়না বরং এ হলো মানুষের মনগড়া, বিকৃত এবং মানব রচিত ইঞ্জীল-আসমানী ইঞ্জীল নয়।
প্রশ্নঃ কুরআন কোন নবীর উপর নাযেল হয়?
কুরআন যা আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর নাযিল হয়। কুরআনকে আল-কুরআন, আল-কিতাব, ফুরকান এবং আল-ফুরকানও বলা হয়।
আল্লাহর কিতাব বা আসমানী কিতান সম্বন্ধে ঈমান রাখার অর্থ হলো প্রধানত নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিশ্বাস করাঃ
(এক) এ সমস্ত কিতাব আল্লাহর বাণী, মানব রচিত নয়।
(দুই) আল্লাহ যেমন অবিনশ্বর ও চিরন্তন, তাঁর বাণীও তদ্রূপ অবিনশ্বর ও চিরন্তন। কুরআন নশ্বর বা সৃষ্ট নয়।
(তিন) আসমানী কিতাব সমূহের মধ্যে কুরআন শরীফ সর্বশ্রেষ্ঠ।
(চার) কুরআন শরীফ সর্বশেষ কিতাব, এর পর আর কোন কিতাব নাযেল হবে না। কিয়ামত পর্যন্ত কুরআন শরীফের বিধানই চলবে। কুরআন শরীফের মাধ্যমে অন্যান্য আসমানী কিতাবের বিধান রহিত হয়ে গিয়েছে।
(পাঁচ) করআন শরীফের হিফাজতের জন্য আল্লাহ তা’আলা ওয়াদা করেছেন, কাজেই এর পরিবর্তন কেউ করতে পারবেনা। কুরআন শরীফকে সর্বদা অবিকৃত বলে বিশ্বাস করতে হবে।
৫. আখেরাত সম্বন্ধে ঈমানঃ
আখেরাত বা পরকাল সম্বন্ধে বিশ্বাস করার অর্থ হলো মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে কবর ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়, হাশর-নাশর ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় এবং জান্নাত জাহান্নাম ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়-যেগুলো সম্পর্কে ঈমান আনার শিক্ষা দেয়া হয়েছে তার সব কিছুতেই বিশ্বাস করা।
অতএব এ পর্যায়ে মোটামুটি ভাবে নিম্নোক্ত বিষয়াবলীতে বিশ্বাস রাখতে হবে।
(এক) কবরের সওয়াল জবাব সত্যঃ
কবরে প্রত্যেক মানুষের সংক্ষেপে কিছু পরীক্ষা হবে। মুনকার ও নাকীর নামক দুজন ফেরেশ্তা কবরবাসীকে প্রশ্ন করবে- তোমার রব কে? তোমার দ্বীন কি? তোমার রাসূল কে?
সে ব্যাক্তি নেককার হলোে এ প্রশ্নাবলীর উত্তর সঠিক ভাবে দিতে সক্ষম হবে। তখন তার কবরের সাথে এবং জান্নাতের সাথে দুয়ার খুলে যোগাযোগ স্থাপন করে দেয়া হবে এবং কিয়ামত পর্যন্ত সে সুখে বসবাস করতে থাকবে।
আর নেককার না হলোে (অর্থাৎ, কাফের বা মুনাফেক হলোে) প্রত্যেক প্রশ্নের উত্তরেই সে বললে, “হায় হায় আমি জানি না!” তখন জাহান্নামের ও তার কবরের মাঝে দুয়ার খুলে দেয়া হবে এবং বিভিন্ন রকম শাস্তি তাকে দেয়া হবে।
(দুই) কবরের আযাব সত্যঃ ইসলাম ধর্ম মতে কবর কি? কবর কাকে বলে? কবরে শাস্তিই বা কিভাবে হয়?
কবর মূলতঃ শুধু নির্দিষ্ট গর্তকে বলা হয় না, কবর বলতে আসলে বুঝায়মৃত্যুর পর থেকে নিয়ে হাশরের ময়দানে পুনর্জীবিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সময়কালীন জগতকে।
এ জগতকে কবর জগৎ, আলমে বরযখ বা বরযখের জগৎ বলা হয়।
মৃত্যুর পর মানুষের মরদেহ যেখানেই যেভাবে থাকুক না কেন সে কবর জগতের অধিবাসী হয়ে যায় এবং বদকার হলোে তার উপর আযাব আহকামে যিন্দেগী চলতে থাকে।
কবরের এ আযাব মূলতঃ হয় রূহের উপর এবং রূহের সাথে সাথে দেহও সে আযাব উপলব্ধি করে থাকে। তাই দেহ যেখানেই যেভাবে থাকুক না কেন, জ্বলে পুড়ে ছাই বা পঁচে গলে মাটি হয়ে যাক না কেন, তার যে অংশ অবশিষ্ট থাকবে সেটুকু আযাব উপলব্ধি করবে।
আর মৌলিক ভাবে আযাব যেহেতু রূহের উপর হবে, তাই কবরের আযাব হওয়ার জন্য এই দেহ অবশিষ্ট থাকাও অপরিহার্য নয়।
(তিন) পুনরুত্থান ও হাশর ময়দানের অনুষ্ঠান সত্যঃ
কিয়ামতের সময় সিঙ্গায় ফুঁক দেয়ার পর সবকিছু নেস্ত-নাবূদ হয়ে যাবে।
আবার আল্লাহর হুকুমে এক সময় সিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হলোে আদি অন্তের সব জিন ইনছান ও যাবতীয় প্রাণী পুনরায় জীবিত হয়ে হাশরের ময়দানে একত্রিত হবে।
(চার) আল্লাহর বিচার ও হিসাব নিকাশ সত্যঃ
পুনর্জীবিত হওয়ার পর সকলকে আল্লাহ্ তা’আলার বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। তাঁর নিকট সমস্ত কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে।
(পাঁচ) নেকী ও বদীর ওজন সত্যঃ
কিয়ামতের ময়দানে হিসাব-নিকাশের জন্য মিযান বা দাড়িপাল্লা (মাপযন্ত) স্থাপন করা হবে এবং তার দ্বারা নেকী বদী ওজন করা হবে ও ভাল-মন্দ এবং সৎ-অসৎ এর পরিমাপ করা হবে।
(ছয়) আমল নামার প্রাপ্তি সত্যঃ
কিয়ামতের ময়দানে আমল নামা উড়িয়ে দেয়া হবে এবং প্রত্যেকের আমলনামা তার হাতে গিয়ে পড়বে এবং প্রত্যেকে তার জীবনের ভাল-মন্দ যা কিছু করেছে সব তাতে লিখিত অবস্থায় পাবে। আমলনামা উড়িয়ে দেয়া হবে।
তখন নেককারের আমল নামা তার ডান হাতে গিয়ে পৌঁছবে, আর বদকারের বাম হাতে আমল নামা গিয়ে পড়বে।
(সাত) হাউযে কাউছার সত্যঃ হাউযে কাউছার কি?
এই উম্মতের মধ্যে যারা পূর্ণভাবে সুন্নাতের পায়রবী করবে, কিয়ামতের ময়দানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে একটি হাউয থেকে পানি পান করাবেন, যার ফলে আর তাদেরকে পিপাসায় কষ্ট দিবে না। এই হাউযকে বলা হয় “হাউযে কাউছার”।
(আট) পুলসিরাত সত্যঃ
হাশরের ময়দানের চতুর্দিক জাহান্নাম দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকবে। এই জাহান্নামের উপর একটি পুল স্থাপন করা হবে, যা চুলের চেয়ে সরু এবং তলোয়ারের চেয়ে ধারালো হবে। এটাকে বলা হয় পুলসিরাত। সকলকেই এই পুল পার হতে হবে।
এই পুরসিরাত হলো দুনিয়ার সিরাতে মুস্তাকীমের স্বরূপ। দুনিয়াতে যে যেভাবে সিরাতে মুস্তাকীমের উপর চলেছে, সে সেভাবে পুরসিলাত পর হয়ে যাবে।
কেউ বিদ্যুৎ গতিতে, কেউ চোখের পলকে, কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে, কেউ দৌড়ে, কেউ হেঁটে, আবার কেউ হামাগুড়ি দিয়ে।
মোটকথা, যার যে পরিমাণ নেকী সে সেরকম গতিতে উক্ত পুল পার হবে। আর পাপীদেরকে জাহান্নামের আংটা জাহান্নামের মধ্যে টেনে ফেলে দিবে।
(নয়) শাফা’আত সত্যঃ শাফায়াত কি?
পরকালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আলেম, হাফেজ প্রমুখদেরকে বিভিন্ন পর্যায়ে সুপারিশ করার ক্ষমতা দেয়া হবে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক প্রকারের শাফা’আত বা সুপারিশ করবেন। তন্মধ্যেঃ
১. হাশরের ময়দানের কষ্ট থেকে মুক্তির জন্য। হাশরের ময়দানে কষ্টে সমস্ত মাখলূক যখন পেরেশান হয়ে বড় বড় নবীদের কাছে আল্লাহর নিকট এই মর্মে সুপারিশ করার আবেদন করবে যেন আল্লাহ পাক বিচার কার্য সমাধান করে হাশরের ময়দানের কষ্ট থেকে সকলকে মুক্তি দেন, তখন সকল নবী অপারগতা প্রকাশ করবেন। কারণ আল্লাহ তা’আলা সেদিন অত্যন্ত রাগান্বিত থাকবেন। অবশেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সুপারিশ করবেন। এটাকে শাফা’আতে কুব্রা বা বড় সুপারিশ বলা হয়।
২. কোন কোন কাফেরের আযাব সহজ করার জন্য। যেমন রাসূলের চাচা আবূ তালেবের জন্য এরূপ সুপারিশ হবে।
৩. কোন কোন মু’মিনকে জাহান্নাম থেকে বের করার জন্য।
৪. যে সব মু’মিন বদ আমল বেশী হওয়ার কারণে জাহান্নামের যোগ্য হয়েছে- এরূপ মু’মিনদের কতকের মাগফেরাতের জন্য।
৫. কোন কোন মু’মিনকে বিনা হিসেবে বেহেশতে প্রবেশ করানোর জন্য।
৬. বেহেশতে মু’মিনদের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য।
৭. আ’রাফ তথা জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে অবস্থিত প্রাচীরে যারা অবস্থান করবে তাদের মুক্তির জন্য।
(দশ) জান্নাত বা বেহেশ্ত সত্যঃ
আল্লাহ তাআলা তাঁর নেক বান্দাদের জন্য এমন সব নেয়ামত তৈরী করে রেখেছেন যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শোনেনি, কারও অন্তরে তার পূর্ণ ধারণাও আসতে পারে না। এই সব মহা নেয়ামতের স্থান হলো জান্নাত বা বেহেশ্ত ৷ জান্নাত বা বেহেশত কোন কল্পিত বিষয় নয় বরং সৃষ্টরূপে তা বিদ্যমান আছে এবং অনন্ত কাল বিদ্যমান থাকবে। মু’মিনগণও অনন্তকাল সেখানে থাকবেন।
(এগার) জাহান্নাম বা দোযখ সত্যঃ
পাপীদেরকে আল্লাহ আগুন ও আগুনের মধ্যে অবস্থিত সাপ, বিচ্ছু, শৃংখল প্রভৃতি বিভিন্ন শাস্তির উপরকণ দ্বারা আযাব দেয়ার জন্য যে স্থান প্রস্তুত করে রেখেছেন, তাকে বলা হয় জাহান্নাম বা দোযখ। দোযখ আল্লাহর সৃষ্ট রূপে বিদ্যমান রয়েছে এবং অনন্তকাল বিদ্যমান থাকবে। কাফেররা অনন্তকাল তাতে অবস্থান করবে।
প্রশ্নঃ জাহান্নাম/দোযখ কয়টি ও কি কি?
উত্তরঃ জাহান্নামের সাতটি স্তর বা দরজা থাকবে। একেক স্তরের শাস্তির ধরন হবে একেক রকম। অপরাধ অনুসারে যে যে স্তরের উপযোগী হবে তাকে সে স্তরে নিক্ষেপ করা হবে। এ স্তরগুলোর পৃথক পৃথক নাম রয়েছে। যথাঃ (এক) জাহান্নাম (দুই) লাযা (তিন) হুতামা (চার) সায়ীর (পাঁচ) সাকার (ছয়) জাহীম (সাত) হাবিয়া।
৬. তাকদীর বা ভাগ্য সম্বন্ধে ঈমান বা বিশ্বাসঃ ইসলাম ধর্মে ভাগ্য বা তাকদির বলতে কি বুঝায়?
ষষ্ট যে বিষয়ে ঈমান রাখতে হয়, তা হলো তাকদীরের বিষয়ে ঈমান। “তাকদীর” অর্থ পরিকল্পনা বা নকশা।
আল্লাহ তা’আলা সবকিছু সৃষ্টি করার পূর্বে সৃষ্টি জগতের একটা নকশাও করে রেখেছেন, সবকিছুর পরিকল্পনাও লিখে রেখেছেন। এই নকশা ও পরিকল্পনাকেই বলা হয় তাকদীর। এই পরিকল্পনা এবং নকশা অনুসারেই সবকিছু সংঘটিত হয় এবং হবে।
অতএব ভাল মন্দ সবকিছুই আল্লাহর তরফ থেকে এবং তাকদীর অনুযায়ী সংঘটিত হয়- এই বিশ্বাস রাখতে হবে।
ভাল এবং মন্দ উভয়টার সৃষ্টি কর্তা আল্লাহ এই বিশ্বাস রাখা অপরিহার্য। এর বিপরীত কেউ যদি ভাল বা ‘সু’-র জন্য একজন সৃষ্টিকর্তা আর মন্দ বা “কু”-র জন্য অন্য একজন সৃষ্টিকর্তা মানে তাহলোে সেটা ঈমানের পরিপন্থী কুফ্র ও শির্ক হয়ে যাবে।
যেমন অগ্নিপূজারীগণ কল্যাণের মা’বূদ হিসেবে ‘ইয়াযদান’ এবং অকল্যাণের মা’বুদ হিসেবে ‘আহরামান’ কে মানে। এটা শির্ক। হিন্দুগণ ‘সু’-র সৃষ্টিকর্তা লক্ষ্মীদেবী এবং ‘কু’-র সৃষ্টিকর্তা শনি দেবতাকে মানে। এটা কুফ্র ও শিক।
এখানে এ প্রশ্ন করা যাবে না যে, সবই যখন আল্লাহর পরিকল্পনা অনুসারে হয়, তখন আমলের প্রয়োজন কি, যা হওয়ার তা তো হবেই?
এ প্রশ্ন করা যাবে না এজন্য যে, আল্লাহ তা’আলা কর্ম জগতের নক্শায় লিখে রেখেছেন যে, যদি মানুষ ইচ্ছা করে তাহলোে এরূপ আর যদি ইচ্ছা না করে তাহলোে এরূপ। এমনিভাবে আল্লাহ মন্দ-এর সৃষ্টিকর্তা হলোেও তিনি দায়ী নন বরং মানুষ মন্দ করার জন্য দায়ী এ কারণে যে, তাকে আল্লাহ ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, সে নিজের ক্ষমতা ও ইচ্ছা শক্তি মন্দের জন্য ব্যয় করল কেন?
এরপরও তাকদীর সম্পর্কে এরূপ প্রশ্নের পর প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে এবং মনে তাকদীর ও ভাগ্য সম্পর্কে নানান প্রশ্ন দেখা দিতে পারে।
এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, এরূপ প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন, কেননা তাকদীরের বিষয়টি এমন এক জটিল রহস্যময় যার প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটন করা মানব মেধার পক্ষে সম্ভব নয় এবং তা উদ্ঘাটনের চেষ্টা করাও নিষিদ্ধ। আমাদের কর্তব্য তাকদীরে বিশ্বাস করা, আর আল্লাহ পাক আমলের দায়িত্ব দিয়েছেন তাই আমল করে যাওয়া।
তাকদীর কি? তাকদীর সম্বন্ধে ঈমান রাখার অর্থ হলো নিম্নোক্ত বিষয়াবলীতে বিশ্বাস রাখাঃ
১. সবকিছু সৃষ্টি করার পূর্বেই আল্লাহ তা’আলা সবকিছু লিখে রেখেছেন।
২. সবকিছু ঘটার পূর্বেই আল্লাহ তা’আলা অনাদি-জ্ঞানে সেসব কিছু সম্বন্ধে অবহিত এবং তাঁর জানা ও ইচ্ছা অনুসারেই সবকিছু সংঘটিত হয়।
৩. তিনি ভাল ও মন্দ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তবে মন্দ সৃষ্টির জন্য তিনি দোষী নন বরং যে মাখলূক মন্দ উপার্জন করবে সে দোষী।
কেননা মন্দ সৃষ্টি মন্দ নয় বরং মন্দ উপার্জন হলো মন্দ। মন্দ সৃষ্টি এজন্য মন্দ নয় যে, মধ্যেও বহু রহস্য এবং বহু পরোক্ষ কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তাই ভাল কাজে আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং মন্দ কাজে তিনি অসন্তুষ্ট।
৪. আল্লাহ তা’আলা কলম দ্বারা লওহে মাহ্ফূজে (সংরক্ষিত ফলকে) তাকদীরের সবকিছু লিখে রেখেছেন। তাই লওহ, কলম ও লওহে যা কিছু লিখে রাখা হয়েছে সব কিছুতে বিশ্বাস রাখা তাকদীরে বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত।
৫. মানুষ একদিকে নিজেকে অক্ষম ভেবে নিজেকে দায়িত্বহীন মনে করবে না এই বলে যে, আমার কিছুই করার নেই; তাকদীরে যা আছে তা-ই তো হবে। আবার তাকদীরকে এড়িয়ে মানুষ খোদার পরিকল্পনার বাইরেও কিছু করে ফেলতে সক্ষম- এমনও মনে করবে না।
৬. মানুষের প্রতি আল্লাহর যত হুকুম ও আদেশ নিষেধ রয়েছে, আর কোনটি মানুষের সাধ্যের বাইরে নয়। কোনো অসাধ্য বিষয়ে আল্লাহ কোন হুকুম ও বিধান দেননি।
৭. আল্লাহ তা’আলার উপর কোন কিছু ওয়াজিব নয়, তিনি কাউকে কিছু দিতে বাধ্য নন, তাঁর উপর কারও কোন হুকুম চলে না, যা কিছু তিনি দান করেন সব তাঁর রহমত ও মেহেরবানী।
পোষ্টটি লিখতে নিম্নক্তো বই/লেখকের লিখনী থেকে সাহায্য নেওয়া হয়েছে: আহকামে জিন্দেগী (মাকতাবাতুল আবরার প্রকাশনী) মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীন শায়খুল হাদীস, জামেয়া ইসলামিয়া আরার্বিয়া, তাঁতী বাজার, ঢাকা-১১০০ মুহাদ্দিছ, জামিয়া ইসলমিয়া দারুল উূলুম মাদানিয়া, ৩১২, দক্ষীণ যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২৩৬