বিষয়: উত্তম চরিত্র গঠনের উপায়ঃ কয়েকটি উত্তম চরিত্রের গুণাবলী।
হ্যাশট্যাগ: #উত্তম চরিত্র গঠনের উপায় #কয়েকটি উত্তম চরিত্রের গুণাবলী।
উত্তম চরিত্র গঠনের উপায়ঃ কয়েকটি উত্তম চরিত্রের গুণাবলী
সততা ও সত্যবাদিতা :
ইসলামে সততা ও সত্যবাদিতার গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যবসা-বাণিজ্য,লেন-দেন মো‘আমালা-মো’আশারা যাবতীয় ক্ষেত্রে সত্য কথা বলা ও সততার উপর টিকে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং সত্যবাদী ও সত্যপরায়ণ লোকদের সঙ্গ ও পক্ষ অবলম্বন করতে বলা হয়েছে এবং এর বিপরীত মিথ্যাকে করা হয়েছে হারাম। মিথ্যাচারিতার পরিণাম হল ধ্বংস ও ব্যর্থতা।
আমানতদারী :
আমানতদারী হল সততা ও সত্যবাদিতার একটি বিশেষ অংশ। মানুষ অর্থ-সম্পদ গচ্ছিত রাখলে তা যথাযথ ভাবে আদায় করা যেমন আমানতদারী, তেমনিভাবে কেউ কোন গোপনীয় কথা জানালে বা কোন ভাবে কারও কোন গোপনীয় বিষয় জানতে পারলে তা গোপন রাখাও আমানতদারীর অন্তর্ভুক্ত।
ব্যাপক অর্থে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শরী’আতের যে বিধি-বিধান দিয়েছেন তা সমুদয় আল্লাহ্ তাআলার পক্ষ থেকে আমাদের কাছে আমানত। তার হক আদায় করাও আমাদের উপর ওয়াজিব। টাকা-পয়সার আমানত, কথার আমানত, কাজের আমানত, দায়িত্বের আমানত ইত্যাদি যে কোন আমানতের খেয়ানত করা কবীরা গোনাহ।
সদ্ব্যবহার :
ইসলাম আপন-পর, ছোট-বড় মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে সকলের সাথে, এমনকি অবলা প্রাণীর সাথেও সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে। কারও সাথে সদ্ব্যবহার করার অর্থ হল তার সাথে যা করণীয় তা করা এবং তার হক বা অধিকার আদায় করা। তাই মাতা-পিতার অধিকার থেকে শুরু করে জীব-জন্তুর অধিকার পর্যন্ত সব কিছু রক্ষা ও আদায় করা এই সদ্ব্যবহারের অন্তর্ভুক্ত। মনকে সকলের অধিকার আদায়ের জন্য সচেতন করে তুললেই সদ্ব্যবহার গুণ অর্জিত হবে।
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা :
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার হুকুম ফরয, সুন্নাত ও বৈধ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে অবস্থার প্রেক্ষিতে এবং আত্মীয়দের ভিন্নতার কারণে। তবে সাধারণভাবে সবার সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা ওয়াজিব এবং সম্পর্ক ছিন্ন করা সকলের ঐক্যমতে হারাম। তবে কারো কারো নিকটে কবীরা গোনাহ।
পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা ফরয। অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা সুন্নাত।
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য কতিপয় কাজ করা যরূরী। সেগুলো হচ্ছে-
তাদের সাথে সাক্ষাৎ করা, তাদের অবস্থা সম্পর্কে লক্ষ্য রাখা এবং তাদের খোঁজ-খবর নেওয়া। তাদেরকে উপহার-উপঢৌকন প্রদান করা, তাদের যথাযথ সম্মান করা ও মর্যাদা দেওয়া। তাদের মধ্যে যারা দরিদ্র তাদেরকে দান করা।
আত্মীয়-স্বজন বাড়ীতে আসলে তাদেরকে সানন্দে গ্রহণ করা ও যথাসাধ্য আপ্যায়ন করা এবং মাঝেমধ্যে বাড়ীতে আমন্ত্রণ করা। তাদের কোন অভিযোগ থাকলে তা শোনা ও দূর করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা। সর্বোপরি তাদের মর্যাদাকে সবার উপরে স্থান দেওয়া।
তাদের সুসংবাদে শরীক হওয়া এবং দুঃসংবাদে সহমর্মী ও সমব্যথী হওয়া। তাদের নিরাপত্তা ও সংশোধনের জন্য দো‘আ করা। বিবদমান বিষয় দ্রুত মীমাংসা করা এবং সম্পর্কোন্নয়ন ও মযবূত করণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখা।
আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ অসুস্থ হ’লে তাকে দেখতে যাওয়া এবং সাধ্যমত তার সেবা-শুশ্রূষা করা। কোন আত্মীয় দাওয়াত দিলে তার দাওয়াত কবুল করা।
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, তাদের হেদায়াতের চেষ্টা করা, সঠিক পথের দিকে তাদেরকে দাওয়াত দেওয়া। সেই সাথে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেওয়া ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা, বাধা দেওয়া। আত্মীয়-স্বজন সৎ কর্মশীল হ’লে এবং সঠিক পথে থাকলে এ সম্পর্ক অব্যাহত থাকে। পক্ষান্তরে আত্মীয়-স্বজন কাফের বা পাপাচারী হ’লে তাদেরকে উপদেশ দেওয়া এবং তাদের হেদায়াতের জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখা।
যদি কোন আত্মীয়ের মধ্যে অহংকার, আত্মগৌরব, শত্রুতা ও বিরোধীভাব পরিলক্ষিত হয় অথবা কেউ যদি এই আশংকা করে যে, তার কোন আত্মীয় তাকে প্রত্যাখ্যান করবে ও তার সাথে বাড়াবাড়ি করবে, তাহ’লে তার সাথে নম্রতা অবলম্বন করা অথবা তাদের থেকে এমনভাবে দূরত্ব বজায় রাখা যে, সেটা যেন তাদের কোন কষ্টের কারণ না হয়। আর তাদের জন্য অধিক দো‘আ করা, যাতে আল্লাহ তাদের হেদায়াত করেন। আত্মীয়দের কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযায় শরীক হওয়া।
সর্বোপরি আত্মীয়-স্বজনের সাথে নম্র ব্যবহার এবং তাদের সাথে সদ্ভাব-সম্প্রীতি স্থাপন ও পরস্পর ভালবাসার সৃষ্টির মাধ্যমে এ সম্পর্ক অটুট রাখা যায়।
অতিথি পরায়ণতা :
এটি মূলত একটি মনের চরিত্র। মেহমানকে শুধু পর্যাপ্ত আপ্যায়ন করানোর নাম অতিথি পরায়ণতা নয়, বরং সাধ্য অনুযায়ী মেহমানকে আপ্যায়নতো রয়েছে, সেই সাথে প্রফুল্লচিত্তে এবং বিকশিত মনে মেহমানকে গ্রহণ করা ও তার সাথে সম্মানজনক আচরণ করাই হল সত্যিকার অতিথি পরায়ণতা। মেহমান এলে আমার পানাহারে শরীক হবে, আর্থিক ক্ষতি হবে, ঝামেলা বাড়বে- এরূপ দুঃশ্চিন্তা মনকে বিকশিত হতে দেয় না, আর এটাই অতিথি পরায়ণতা গুণ সৃষ্টি হওয়ার অন্তরায়। পক্ষান্তরে যদি কেউ চিন্তা করে যে, তাকদীরের বিশ্বাস অনুসারে মেহমান তারই হিস্যা ভোগ করবে- আমার নয়, তদুপরি আমি মেজবানের প্রতি মেহমানের হক বা অধিকার রয়েছে, তাহলে আতিথ্যের জন্য মন আর সংকুচিত হবে না বরং বিকশিত হবে এবং তখনই সৃষ্টি হবে অতিথি পরায়ণতা চরিত্র। হাদীছে ইরশাদ হয়েছেঃ অবশ্যই তোমার প্রতি তোমার মেহমানের হক বা অধিকার রয়েছে।
ভ্রাতৃত্ব ও স্নেহ-মমতা :
ভ্রাতৃত্ব ও স্নেহ-মমতা উত্তম চরিত্রের একটি বিশেষ দিক। হৃদয়ের যে কমনীয়তা, মাধুর্য, আবেগ, অনুরাগ এবং অনুগ্রহ; ক্ষেত্র বিশেষে সেটাকে স্নেহ-মমতা বলা হয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে সেটাকে প্রেম ভালবাসা বলে ব্যক্ত করা হয়, আবার গুরুজন ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির প্রতি সেটাকে নিবেদন করা হলে তা ভক্তি শ্রদ্ধা বলে আখ্যায়িত হয়ে থাকে। আর এ সব অনুভূতি যখন আপন জনের গন্ডি ছাড়িয়ে সার্বজনীন মানুষের প্রতি মানুষ হিসাবে নিবেদিত হয় তখন তাকে বলা হয় সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব এবং শুধু মুসলমানদের প্রতি নিবেদিত হলে সেটাকে বলা হয় ইসলামী ভ্রাতৃত্ব। ইসলামে স্নেহ-মমতা ও ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব এত বেশী যে, কারও মধ্যে এ গুণ উপস্থিত না থাকলে সে যেন মুসলমান বলেই আখ্যায়িত হওয়ার যোগ্য থাকে না। হাদীছে ইরশাদ হয়েছে যারা ছোটদের প্রতি স্নেহ-মমতা এবং বড়দের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেনা তারা আমাদের দলভুক্ত নয়। (তিরমিযী)
ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ সম্পর্কে হাদীছে বলা হয়েছেঃ সমস্ত মুসলমান একটা দেহের ন্যায়, একটা দেহের কোন অঙ্গ যদি পীড়িত হয় তাহলে অন্যান্য অঙ্গ যেমন তা উপলব্ধি করতে পারে, তদ্রূপ সমস্ত মুসলমানের মধ্যে একের প্রতি অন্যের এরূপ একাত্মতা ও সহমর্মিতা থাকতে হবে। সমস্ত মানুষ একই পরিবারভুক্ত, সকলেই এক আল্লাহ্র বান্দা, সকলেই এক আদমের সন্তান- মনের মধ্যে এই উপলব্ধি বদ্ধমূল ও উজ্জীবিত থাকলে পারস্পরিক একত্মতা ও সহমর্মিতা বোধ উদ্বেলিত হয়ে উঠবে। এক হাদীছে
বলা হয়েছে : তোমরা সকলে এক আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়েজীবন যাপন কর। (বোখারী ও মুসলিম)। হাদীছে আরও ইরশাদ হয়েছে : তোমরা সকলেই এক আদমের সন্তান। আর আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। একথা বলে ভ্রাতৃত্ববোধকে উদ্বেলিত করা হয়েছে।
ত্যাগ ও বদান্যতা :
ত্যাগ হল কৃপণতার বিপরীত এবং দানশীলতার চূড়ান্ত পর্যায়। আর বদান্যতা অর্থ দানশীলতা। দানশীলতার তিনটি স্তর রয়েছে। যথাঃ
১. নিজের প্রয়োজন পূরণে যেন কোনরূপ ব্যাঘাত না ঘটে এই পরিমাণ অন্যের জন্য খরচ করা।
২. অন্যকে এই পরিমাণ দান করা যার সমপরিমাণ বা তার চেয়ে কিছুটা কম নিজের কাছে অবশিষ্ট থাকে।
৩. নিজের প্রয়োজনে ব্যয় না করে নিজের প্রয়োজনের চেয়ে অন্যের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দেয়া। এই শেষোক্ত পর্যায়টিকে বলা হয় ত্যাগ। ত্যাগের মানসিকতা সৃষ্টির জন্য আল্লাহ্ হক ও বান্দার হকের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে এবং কৃপণতা বা বখীলীর চেতনা থেকে মনকে নিয়ন্ত্রণ ও কৃপণতার বিপরীত প্রেরণা লাভ করতে হবে এবং সুন্দর চরিত্রের প্রতি আকর্ষণ বোধ সৃষ্টি করতে হবে। (নীতিদর্শন গ্রন্থ থেকে গৃহীত।)
উদারতা :
ব্যক্তি স্বার্থের সংকীর্ণ গণ্ডি পেরিয়ে সার্বজনীন স্বার্থের চিন্তায় মনের বিকশিত হওয়াকে বলা হয় উদারতা। উদারতার বিপরীত চরিত্রকে বলা হয় সংকীর্ণতা। চিন্তার সংকীর্ণতা বহু ধরনের পংকীলতার উৎস হয়ে থাকে সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে উন্নত চরিত্র সৃষ্টি হয় না। এরূপ মানসিকতা মানুষের জ্ঞানকে পক্ষপাতগ্রস্থ ও অনুভূতিহীন করে ফেলে। এই সংকীর্ণ মন-মানসিকতার গণ্ডিতে আবদ্ধ মানুষ আমিত্বকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। ব্যক্তি স্বার্থের বাইরে সে কিছু চিন্তা করতে পারে না। সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য কোন
বিরাট অবদান রাখতে পারে না। এই উদারতা না থাকার ফলে ক্ষমা, দয়া, আত্মত্যাগ প্রভৃতি বহু গুণ থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়ে যায়। এদিক থেকে চিন্তা করলে উদারতা এমন এক চরিত্র যা বহু চরিত্রের উৎসমূল। আমি শুধু আমার জন্য নই, আমার সবকিছু শুধু আমারই জন্য নয়- আমি পূর্ণাঙ্গ সমাজদেহের একটি অংশ মাত্র- এরূপ চিন্তা অর্থাৎ, চিন্তার পরিধিকে বিস্তৃত করা উদারতা সৃষ্টির সহায়ক হয়ে থাকে। তদুপরি- উদার মানুষের সাহচর্য এবং এমন মহামনীষীদের জীবনী পাঠও উদারতার মনোভাব জাগ্রত করে থাকে, যারা আৱত্যাগ ও সার্বজনীন সেবায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছেন।
হায়া বা লজ্জাশীলতা :
নিন্দা সমালোচনার ভয়ে কোন দূষণীয় কাজ করতে মানুষের মধ্যে যে জড়ত্ববোধ হয়ে থাকে সেটাকে বলে হায়া বা লজ্জা। এই লজ্জা মানুষকে ভাল কাজের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। এজন্যেই হাদীছে বলা হয়েছে : লজ্জা কেবল সুফল ও কল্যাণই বয়ে আনে। (বোখারী ও মুসলিম)। এর বিপরীত লজ্জা না থাকলে মানুষ যে কোন অন্যায় কাজই করতে পারে। তাই প্রবাদ আছে- যখন তোমার লজ্জা থাকবে না, তখন যা ইচ্ছা তাই কর। এখানে উল্লেখ্য যে, কোন ভাল কাজ করতে যদি কখনও জড়তাবোধ হয় তাহলে সেটা লজ্জা বা প্রশংসনীয় গুণ বলে আখ্যায়িত হবে না। যেমন- পর্দা করতে বা দাড়ি রাখতে বা টুপি মাথায় দিতে জড়তাবোধ হল, এটা লজ্জা বা হায়া নয় বরং এটা হল ধর্মীয় হীনমন্যতাবোধ। এমনি ভাবে নিজেকে অত্যন্ত ছোট করে প্রকাশ করা, যেখানে সেখানে চুপ করে থাকা এবং হীনতা প্রকাশ করা এটাও লজ্জা বা হায়া বলে প্রশংসিত হবার নয় বরং এটা হল স্বাভাবগত দুর্বলতা। যদি কেউ দৈহিক ও আৱিক শক্তিকে যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ ও যথাস্থানে প্রয়োগ করে এবং পানাহারের চাহিদা ও আৱিক কামনাসমূহকে নিয়ন্ত্রণ ও যথা স্থানে প্রয়োগ করে, তাহলে তার মধ্যে লজ্জার যথার্থ বিকাশ ঘটবে।
বড়কে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করা ও ছোটদের স্নেহ করা :
বড়দের সর্বদা ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে হয়। বিশেষ করে তাদের সাথে যেন কখনও বেয়াদবী না হয়ে যায়- সেদিকে খুব খেয়াল রাখতে হয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
ليس منا من لم يرحم صغيرنا ويعرف شرف كبيرنا.
যে ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করতে জানে না- সে আমার উম্মত নয়। -জামে তিরমিযি, হাদীস ১৯২০; আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীস ৩৫৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩২৯
ক্ষমা ও দয়া প্রদর্শন :
বিপদ-আপদে মানুষের প্রতি দয়া করা এবং অপরাধীর অপরাধ ক্ষমা করাও উত্তম চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হাদীছের বর্ণনা অনুযায়ী যে মানুষের প্রতি দয়া করে না তার প্রতিও দয়া করা হবে না, যে মানুষের অপরাধ ক্ষমা করে না আল্লাহও তার অপরাধ ক্ষমা করবেন না। এখানে ক্ষমা করার প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করা হয়েছে। যদিও যে পরিমাণ জুলুম কেউ করে ততটুকুর প্রতিশোধ তার থেকে নেয়া জায়েয, তবে উত্তম হল প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করে দেয়া। তবে উল্লেখ্য যে, এই ক্ষমা করার প্রশ্ন ব্যক্তিগত হক নষ্ট করার ক্ষেত্রে। পক্ষান্তরে কেউ দ্বীনের হক নষ্ট করলে যেমন মুরতাদ হয়ে ধর্মের অবমাননা করলে তা ক্ষমাযোগ্য নয়। এমনি ভাবে বিচারক আইন অনুযায়ী অপরাধের বিচার করবেন, অপরাধীকে ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারবেন না। কারণ সেটা তার ব্যক্তিগত হক নষ্ট হওয়ার সাথে জড়িত বিষয় নয়।
দয়া শুধু মুসলমানদের প্রতি নয় বা আপনজনদের প্রতি নয়। আপন-পর, শত্রু-বন্ধু, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের প্রতি এমনকি অবলা জীব-জন্তুর প্রতিও দয়া প্রদর্শনের আদর্শ ইসলামে রয়েছে। এই দয়া যেমন পার্থিব কষ্ট ক্লেশ দূর করার জন্য হবে, তেমনি পরকালীন কষ্ট ক্লেশ দূর করার জন্যও দয়া প্রদর্শিত হতে হবে। ঈমানহীনের ঈমান এবং আমলহীনের আমল পয়দা করার জন্য মনের পেরেশানীও তাই বড় দয়া বলে গণ্য।
ইনসাফ ও ন্যায় পরায়ণতা :
যার যা হক ও প্রাপ্য তাকে তা যথাযথ ভাবে দেয়াকে বলা হয় ইনসাফ বা ন্যায় পরায়ণতা। আর তার চেয়ে কম করা হল জুলুম বা অবিচার। ইসলামে ইনসাফ ও ন্যায্য বিচারের গুরুত্ব এত বেশী যে, অমুসলিমদের সাথেও তা রক্ষা করার হুকুম দেয়া হয়েছে। জুলুম ও অবিচারকে হারাম করা হয়েছে। ফয়সালার ক্ষেত্রে নিজের ও অন্যের মধ্যে ব্যবধান করার তথা পক্ষপাতিত্ব করার ব্যাপারে কঠোর ভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ইনসাফ করতে হবে, যদিও তা আপনজনের বিরুদ্ধে চলে যায়।
অঙ্গীকার রক্ষা করা :
অঙ্গীকার রক্ষা করা তথা ওয়াদা খেলাফ না করা সততারই অংশ বিশেষ। অঙ্গীকার রক্ষা করা ওয়াজিব। এমনকি বালক বা শিশুকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য কোন কিছু প্রদানের অঙ্গীকার করলেও তা পূরণ করা জরুরী। পূরণ করার নিয়ত না থাকলে অঙ্গীকার করবে না। তবে কোন পাপ কাজের অঙ্গীকার করলে তা পূরণ করা যাবে না। অঙ্গীকার পূর্ণ করার বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, হযরত রাসূল (সাঃ) তাঁর ভাষণে প্রায়ই বলতেনঃ যে ব্যক্তি নিজ অঙ্গীকার বাস্তবায়নের বিষয়ে যত্নবান নয়, দ্বীন ইসলামের মধ্যে তার কোন অংশ নেই।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা :
পাক-ছাফ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাকে আল্লাহ পছন্দ করেন। এজন্যেই ইসলাম শরীর, কাপড়-চোপড়, ঘড়-বাড়ির আঙ্গিনা ইত্যাদিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশ দিয়েছে। শরীরের অবাঞ্ছিত পশম নিয়মানুযায়ী কেটে বা উপড়ে ফেলা, খতনা, করা, নখ কাটা, মোচ কাটা এসবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার আওতাভুক্ত। এসব হল জাহিরী অর্থাৎ, বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতা। এর সাথে রয়েছে বাতিনী অর্থাৎ, আভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্নতার দিক। মনের রোগ থেকে নফ্স ও আত্মাকে এবং কুচরিত্র থেকে আখলাককে পবিত্র করার মাধ্যমেই এ দিকটি অর্জিত হবে।
আমর বিলমা’রূফ ও নাহি আনিল মুনকার :
সৎ কাজে আদেশ দেওয়া অসৎ কাজে নিষেধ করা।
তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, যাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য। তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে’ (আলে ইমরান ৩/১১০)।
কয়েকটি বিশেষ আমল, যার প্রতি যত্নবান হলে অন্যান্য বহু আমলের পথ খুলে যায়
১. ইলমে দ্বীন হাসিল করা : চাই কিতাব পড়ে হোক অথবা উলামাদের ছোহবতে গিয়ে। কিতাবের শিক্ষা সমাপ্ত করার পর উলামাদের ছোহবতে যাওয়া আবশ্যক। উলামা বলতে বুঝানো হচ্ছে যারা ইল্ম অনুযায়ী আমল করেন এবং শরী আত ও মারেফতের জ্ঞানে প্রাজ্ঞ। এরকম বুযুর্গ আলেমদের সোহবত যত বেশী লাভ করা যায় ততই মঙ্গল। যদি প্রতিদিন সম্ভব না হয়, তবে সপ্তাহে অন্ততঃ এক/আধ ঘন্টা বুযুর্গদের ছোহবতে থাকা দরকার। এর সুফল কিছু দিন গেলে স্বচক্ষেই দেখতে পাবেন।
২. নামায : যেভাবেই হোক পাঁচ ওয়াক্ত নামায় নিয়মিত আদায় করবে। যথা সম্ভব জামাতের পাবন্দী করার চেষ্টা করবে। এতে করে দরবারে এলাহীর সাথে এক বিশেষ সম্পর্ক স্থাপিত হবে। এর বরকতে ইনশাআল্লাহ নিজের হালাত ঠিক থাকবে। অশ্লীল গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকতে পারবে।
৩. কম কথা বলা, কম মেলা-মেশা করা এবং যথাসম্ভব ভেবে চিন্তে কথা বলার চেষ্টা করবে। হাজারো বিপদ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য এটা একটা বড় উপায়।
৪. মুহাছাবা ও মুরাকাবা : অন্তরে সর্বদা এই খেয়াল রাখবে যে, আমি আমার মালিকের দৃষ্টি সীমার মধ্যে আছি। তিনি আমার সমস্ত কথা-বার্তা, কাজ-কর্ম ও গতি-বিধির প্রতি লক্ষ্য রাখছেন। এটাই মুরাকাবা। আর কোন একটি সময় নির্দিষ্ট করে নির্জনে বসে সারাদিনের আমল স্মরণ করে খেয়াল করবে যে, এখন আমার হিসাব হচ্ছে এবং আমি জবাব দিচ্ছি। এটা হল মুহাছাবা।
৫. তওবা ও ইস্তিগফার : যখনই কোন ভুল-ত্রুটি হয়ে যায়, তখন দেরী না করে সঙ্গে সঙ্গে নির্জন পরিবেশে সাজদায় গিয়ে ক্ষমা চাইবে, কান্না-কাটি করবে। যদি কান্না না আসে, তাহলে কান্নার ছুরত ধারণ করবে। যাহোক এখানে পাঁচটি বিষয় উল্লেখ করা হল। যথাঃ উলামাগণের ছোহবত, পাঞ্জেগানা নামায, কম কথা বলা ও কম মেলা-মেশা করা, মুহাছাবা মুরাকাবা এবং তওবা ও ইস্তিগফার। ইনশাআল্লাহ এই পাঁচটি বিষয়ের প্রতি যত্নবান হলে- যা মোটেও কঠিন নয়- সমস্ত ইবাদতের দরজা খুলে যাবে।
কয়েকটি বিশেষ গুনাহ যা থেকে বিরত থাকলে প্রায় সকল গুনাহ থেকে মুক্তি লাভ করা যায়
১. গীবত : সবারই জানা এর দ্বারা দুনিয়া ও আখেরাতের নানা বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। আজকাল অনেক লোক এই রোগে আক্রান্ত। এর থেকে বাঁচার সহজ উপায় এই যে, একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কারও সম্পর্কে ভাল-মন্দ আলোচনা করবে না, শুনবেও না। নিজের প্রয়োজনীয় কাজ নিয়ে মশগুল থাকবে। আলোচনা করতে হলে নিজের আলোচনাই করবে। নিজের কাজই তো শেষ করা যায় না, অপরের আলোচনা করার অবকাশ কোথায়?
২. জুলুম : অন্যের জান-মালের উপর জুলুম করা, কথার দ্বারা কষ্ট দেয়া, কম হোক বেশী হোক কারও হক নষ্ট করা, কাউকে অন্যায় ভাবে কষ্ট দেয়া অথবা কাউকে বে-ইজ্জত করা এ সবই জুলুম।
৩. নিজেকে বড় মনে করা এবং অন্যদের ছোট মনে করা : এ রোগ থেকেই জুলুম ও গীবত জন্ম নেয়। এছাড়া হিংসা-বিদ্বেষ এবং ক্রোধের মত নিন্দনীয় প্রবৃত্তিও এর থেকেই সৃষ্টি হয়।
৪. ক্রোধ : ক্রোধে আক্রান্ত হলে পরিণামে পস্তাতে হয়। কারণ ক্রোধ অবস্থায় বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে যায়। সুতরাং এ সময় সব কাজই হয় বিবেক বুদ্ধির পরিপন্থী। মুখ দিয়ে এমন মারাৱক কথা বের হয়ে পড়ে, অথবা হাত দিয়ে এমন অশোভন কাজ সংঘটিত হয় যা অনেক সময় মারাৱক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্রোধ অবদমিত হওয়ার পর তখন আর কিছু করার থাকে না এবং তা সারা জীবন মনোপীড়ার কারণ হয়ে থাকে।
৫. বেগানা নারী-পুরুষের সাথে যে কোন ধরনের (অবৈধ) সম্পর্ক রাখা : দেখা করা, কথা-বার্তা বলা, নির্জনে ঘনিষ্ঠ ভাবে বসা, অথবা তাকে খুশী করার জন্য নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা বা মোলায়েম ও মিষ্ট স্বরে কথা বলা এসবই অবৈধ সম্পর্কের অন্তর্ভুক্ত। এই অবৈধ সম্পর্ক খুবই খারাপ পরিণতি ডেকে আনে, বর্ণনাতীত বিপদের সম্মুখীন করে।
৬. হারাম খাওয়া : এর থেকেই সমস্ত পাপ-পঙ্কিলতার জন্ম। কারণ, খাদ্যরস থেকে রক্ত সৃষ্টি হয়ে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং খাদ্য যে রকম হবে, সেই প্রভাব সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সৃষ্টি হবে। এবং সেই ধরনের কাজই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা সংঘটিত হবে। যাহোক ছয়টি গুনাহ উল্লেখ করা হলো। এই গুনাহ্ সমূহ বর্জন করলে অন্যান্য গুনাহ থেকে দূরে থাকা সহজ হয়ে যাবে বরং আশা করা যায় আপনা আপনিই দূর হয়ে যাবে।
(এ পরিচ্ছেদ ও পূর্বের পরিচ্ছেদ জাযাউল আ’মাল-গ্রন্থ থেকে গৃহীত।)
সমাপ্ত: উত্তম চরিত্র গঠনের উপায়ঃ কয়েকটি উত্তম চরিত্রের গুণাবলী।
সূত্র: আহকামে যিন্দেগী।