বিষয়: উন্নত জাতের হাঁসের নাম ও হাঁস পালনের প্রয়োজনীয়তা | উন্নত জাতরে হাসের খামার দিতে হাসের জাত পরিচিতি।
হ্যাশট্যাগ: #উন্নত জাতের হাঁসের নাম #হাঁস পালনের প্রয়োজনীয়তা #উন্নত জাতরে হাসের খামার #হাসের জাত পরিচিতি।
দেশের বর্তমান অর্থনীতির ক্ষেত্রে হাঁস-মুরগি পালন একটি লাভজনক উৎপাদন কার্যক্রম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। তবে এ অবস্থায় আসার পেছনে রয়েছে অনেক দীর্ঘ ইতিহাস। উন্নত জাতরে হাসের খামার দিতে হলে আগে হাসের জাত পরিচিতি জানতে হবে।
আমাদের হাঁস-মুরগি পালনের ঝোঁক এবং তা থেকে দুপয়সা রোজগার করার কিম্বা পারিবারিক মাংস ও ডিমের চাহিদা মিটানোর লক্ষ্যে কবে থেকে হাঁস-মুরগি পালনের গোড়াপত্তন আর্থসামাজিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে তা সর্বজন স্বীকৃত।
হাঁসের জাত পরিচিতি/উন্নত জাতের হাঁসের নাম
দেশি বিদেশি মিলিয়ে হরেক রকমের জাত থাকলেও এখানে বিশেষ কয়েকটি জাত এবং যাদের খামারে পালন লাভজনক এগুলো নিয়েই আলোচনা করা দরকার।
১. রানার
- ভারতীয় পাতিহাঁসের মধ্যে রানার শ্রেণী লেগহর্ণ নামে পরিচিত।
- জাত হিসাবে উৎকৃষ্ট হাঁসের পর্যায়ে পড়ে।
- আকারে ছোট এবং বিভিন্ন আবহাওয়ায় সহজে ধাপ খাইয়ে নিতে পারে।
- আমাদের দেশ ছাড়াও মালয়েশিয়া এবং চীন দেশে এই হাঁস দেখতে পাওয়া যায়। আজকাল ইংলণ্ডেও এই শ্রেণীর হাঁস পালন করা হচ্ছে।
- রানার শ্রেণীর মধ্যে আরও দুটি জাত রয়েছে। তাদের কেবলমাত্র ডিম উৎপাদনের জন্যে পালন করা যেতে পারে।
- সারা বছরে গড়ে প্রায় ২৫০ থেকে ২৬০টি ডিম দেয়। অবশ্য এটাও ঠিক কথা ডিম উৎপাদন হলো নির্দিষ্ট একটি ব্যাপার যা ব্যবস্থাপনা ও হাঁস-মুরগিদের ক্ষেত্রে ওদের মৌলিক গুণাগুণের ওপর নির্ভরশীল।
- রানার জাতের হাঁসের শরীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত প্রায় সোজা গলাটা বেশ লম্বা। পালক ঘন এবং দেহের রং সাদা। অন্যান্য হাঁস যেমন হেলে দুলে চলে, এরা তার থেকে ব্যতিক্রম। এরা সোজা চলে। এইভাবে চলার জন্যেই এদের কোন কোন জায়গায় পেঙ্গুইন হাঁসও বলা হয়ে থাকে।
- উত্তম ও মাঝারি ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি হাঁস বছরে গড়ে ২০০টি ডিম দিয়ে থাকে। অসংখ্য নজীর রয়েছে যে ঠিকভাবে প্রতিপালিত হওয়ায় সারা বছরে গড়ে ৩০০টি পর্যন্ত ডিম পাওয়া গেছে।
- পাতিহাঁস পালনকারীদের মধ্যে একটি বিশ্বাস রয়েছে যে, মুরগির সাথে হাঁসের বাচ্চাদের পালন করা হলে তারা বলবান ও সতেজ হয়। এই রকম ধারণার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। আসল কথা হলো হাঁসের বাচ্চাদের ডিম থেকে বার হবার পর উত্তাপের প্রয়োজন হয়।
- মুরগি যেভাবে তার বাচ্চাদের ডানার নিচে রেখে গরম করার চেষ্টা করে হাঁসের বাচ্চাদের ঐভাবে রাখলে ওরা কিছুটা আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
- পরিণত অবস্থায় একটি পুরুষ হাঁসের ওজন প্রায় আড়াই কেজি এবং একটি মেয়ে হাঁসের ওজন পোনে দু কেজি থেকে দু কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। মাথার খুলি থেকে পায়ের গোড়ালি অবধি মাপ হলো ২০ থেকে ৩০ ইঞ্চি।
- আট সপ্তাহ বয়স হলেই গলার আওয়াজ শুনে ধরতে পারা যায় কোনটা মদ্দা আর কোনটা মাদী।
- মাদী হাঁস ‘কোয়াক’ ‘কোয়াক’ আর মদ্দা হাঁস নিচু স্বরে ‘হিস হিস’ শব্দ করে। প্রচুর ডিম পাড়ে বলে সহসা তা দিতে বসতে চায় না। কাজেই ডিম ফোটাবার যন্ত্র খামারে রাখা দরকার।
২. খাকি ক্যাম্পবেল
- পালনকারীরা এই শ্রেণীর পাতিহাঁসকে খুব পছন্দ করেন। তার কারণ সারা বছরে গড়ে প্রায় ২০০টির কাছাকাছি ডিম দেয়।
- এই শ্রেণীর হাঁসের সৃষ্টির পেছনে ছোট একটা ইতিহাস রয়েছে। মিসেস ক্যাম্পবেল নামে জনৈকা বিদেশি মহিলা রানার ও ভারতীয় হাঁসের মিশ্রণে এই জাতের সৃষ্টি করেন। সেই কারণে ঐ মহিলার নাম অনুসারে ক্যাম্পবেল আর দেহের রং খাকি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত খাকি ক্যাম্পবেল নাম দেওয়া হয়েছে।
- তবে পুরুষ হাঁসদের গলা উজ্জ্বল সবুজ আভাযুক্ত সামান্য কালচে রং হয়ে থাকে। পরিণত হাঁসের ওজন হয় দু কেজি থেকে সোয়া দু কেজি।
- এই শ্রেণীর হাঁসের মধ্যে কিছু ত্রুটি রয়েছে। অবশ্য এই ত্রুটিকে জাতের বৈশিষ্ট্যও বলা যায়। আবার যত্ন করে পালন না করতে পারলে এই ত্রুটি তখন স্থায়ীভাবে বংশের মধ্যে চিহ্নিত হয়ে যায়।
- খাকি ক্যাম্পবেলের মধ্যে যারা বিখ্যাত তাদের চোখ হয় হলুদ আর বাইরের শরীরের পালক হয় সাদা। এদের বলা হয় সাদা ক্যাম্পবেল। অবশ্য আমাদের দেশে এই শ্রেণীর হাঁস খুব বেশি পালন করা হয় না।
- সাধারণভাবে একবার চোখে দেখেই যাতে ধরতে পারা যায় সেই কারণে কতকগুলো সুস্পষ্ট পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। খাকি ক্যাম্পবেলের দেহ, পাখা, পিঠ ও বুকের দিক মদ্দা হাঁসের ক্ষেত্রে সারা দেহের রং খাকি এবং পেছনের নিচের দিকের রংটা তামাটে অথবা বাদামী। মাদী হাঁসের ক্ষেত্রে দেহের রং গাঢ় এবং কোমরের পালক হবে হালকা।
৩. সাধারণ দেশি হাঁস
- সাধারণ দেশি হাঁসের মধ্যেও নানা শ্রেণী রয়েছে। এই জাতের হাঁস পালন করা লোকসানের ব্যাপার। দেখতে ছোট এবং বিভিন্ন রংয়ের হয়ে থাকে। ডিম পাওয়া যায় খুব কম, গড়ে ৫০-৬০টি বেশি নয়। এদের পাড়া ডিম খেতে বেশ সুস্বাদু।
- ব্যবসার উদ্দেশ্যে খামার বছরে করতে হলে দেশি হাঁসের বদলে ভালো জাতের হাঁস পালন করা একান্ত প্রয়োজন। তবে গ্রাম অঞ্চলে যাঁদের বাড়ির সামনে পুকুর বা ডোবা রয়েছে তাঁরা সখ করে ঘরে দু চারটে যাতে খাবার ডিম পাওয়া যায় সেই হিসাবে দেশি হাঁস পালন করতে পারেন।
৪. এলিসবেরি
- ইংলণ্ডে জন্ম, মাংস ভারী ও তুলতুলে নরম এবং এজন্যেই এলিসবেরি জাতের এত কদর।
- রংয়ের দিক থেকে বিচার করলে এটিকে বিশুদ্ধ সাদা বলা যায়। শরীর চওড়া, সেই সাথে লম্বা ও গভীর।
- মাথা ও দেহ সব সময় খাড়া রাখে। ঠোঁট পাণ্ডুর তবে লালচে ভাব। চোখ গভীর ও বসা। গায়ের রং হাল্কা কমলা রংয়ের তবে উজ্জ্বলতা বেশি।
- একটা পরিনত মদ্দা হাঁসের ওজন সোয়া চার কেজি এবং মাদী হাঁস চার কেজির কিছুটা কম।
- আমাদের দেশে এর পালন হয় না বললেই চলে। যে সমস্ত জায়গায় বারো মাস প্রায় ঠাণ্ডা থাকে সেখানে পরীক্ষামূলকভাবে পালন করা যেতে পারে।
৫. পিকিং
- এটা চীন দেশের হাঁস। এলিসবেরির সাথে অনেক মিল রয়েছে।
- সাদা অথবা সাদার ওপর সামান্য ক্রীমের ভাব। এ ছাড়া যদি অন্য কোন রং দেখতে পাওয়া যায় তবে তাকে ত্রুটি হিসাবে ধরা হয়ে থাকে। কাজেই, সে রকম কিছু দেখলে ঝাঁক থেকে দূরে সরিয়ে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
- এদের শরীর বেশ লম্বা চওড়া। কাঁধ থেকে লেজ পর্যন্ত সামান্য চ্যাপ্টা।
- ডিমে সহসা তা দিতে চায় না। কাজেই, এদের পালন করতে হলে কৃত্রিম উপায়ে ডিম ফোটাবার জন্য ব্যবস্থা করা দরকার।
- আমেরিকাতে এই জাতের হাঁসকে সবুজ হাঁস বলা হয়।
- পূর্ণ বয়স্ক মদ্দা হাঁসের ওজন প্রায় সাড়ে চার কেজির কাছাকাছি এবং মাদী হাঁস প্রায় পৌনে চার কেজির মতন ওজন হয়।
৬. সামকোভি
- অনেক দাবি করেন যে, এই জাতের হাঁসের জন্ম দক্ষিণ আমেরিকায়। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মদ্দা এবং মাদীর মধ্যে বৈষম্য। মদ্দা হাঁস মাদীর থেকে আকারে বেশ বড় হয়। শুধু তাই নয়, অপর জাতের হাঁসের সাথে এদের মিলন হলেও এদের দেহে গর্ভ সঞ্চার হয় না। কাজেই, জাতিতে হাঁস হলেও অপর জাতের হাঁসের সাথে এদের কোন মিল নেই।
- এদের চরিত্রে আরও একটি আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটতে সময় লাগে ৩৫ দিন। অন্য সব শ্রেণীর হাঁসের সে জায়গায় সময় লাগে মাত্র ২৮ দিন।
- এদের মাথাটি ন্যাড়া, গভীরতার থেকে প্রস্থে এবং চওড়া। পা এবং গোড়ালির রং ফ্যাকাশে, কমলা অথবা হলুদ। মদ্দা হাঁসের মাথা লম্বা আর মাদী হাঁসের বড়। মদ্দার ওজন প্রায় পাঁচ কেজির কাছাকাছি। মাদী হাঁসের ও তার থেকে সামান্য কম হয়।
৭. রুয়ে
- ফরাসী দেশের রুয়ে শহরে এদের জন্ম বলে তার থেকে রুয়ে নামটি এসেছে। এরা ভালো ডিম দেয়, সেই সাথে মাংসের যথেষ্ট কদরও রয়েছে। তবে মেদবহুল শরীর বলে ডিমের শ্রেণীতে ধরা হয়নি।
- এদের শরীর বেশ লম্বা-চওড়া। গলা লম্বা ও সোজা। চলাটা খুব ধীরে বলেই শরীর সমান্তরাল বলে মনে হয়। বাজারে এই জাতের তেমন বিশেষ চাহিদা নেই। তার প্রধান কারণ হলো দেহের বৃদ্ধি হয় খুব ধীরে ধীরে। রং কালো বলে কোন ত্রুটি সহজে ধরা পড়ে না।
হাঁস-পালনের প্রয়োজনীয়তা
- মুরগি পালনের মত হাঁস পালনেও কিছু জ্ঞান থাকা দরকার, উন্নয়নের শাখা হিসাবে হাঁস রক্ষণও একটি। তাছাড়া পাতিহাঁস, রাজহংস, টার্কি প্রভৃতি সকলেই মুরগি পরিবারের মধ্যে পড়ে। আদর্শ পোলট্রি তাকেই বলা হয়, যেখানে মুরগি এবং হাঁস পালন করা হয়ে থাকে।
- আমাদের দেশে পরিচ্ছন্নতার কারণে বাড়িতে অনেকেই মুরগি পালন পছন্দ করেন না। কাজেই, ইচ্ছে থাকলে মুরগির বদলে হাঁস পালনও করা যেতে পারে। হাঁস পালনে ঝামেলা কম। হাঁসের রোগ বালাই কম হয়ে থাকে। কাজেই, খামার মালিকের পক্ষে এটা একটা বড় সুবিধে।
- প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের অভাব পূরণ করা যায়। যে সমস্ত বাড়িতে মুরগির মাংস অথবা ডিম অপছন্দ সেখানে হাঁসের মাংস ও ডিম প্রোটিনের অভাব অনেকটা পূরণ করতে পারে। এর পরেও রয়েছে ব্যবসার দিক। বাড়িতে যেমন খাওয়া চলে তেমনি ডিম ও তার থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে বিক্রি করে দুপয়সা আয়ও হয়।
- হাঁসের ডিমে প্রোটিন, এ, বি, সি এবং ডি ভিটামিন পাওয়া যায়। আমাদের লক্ষ্য কিভাবে বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন করা যায়। আর তার একটি সহজ উপায় হলো হাঁস বৈজ্ঞানিক উপায়ে পালন করা।
- আমাদের জমি এবং মূলধনের অভাব। বুদ্ধি করে মূলধনের ব্যবস্থা করে একবার কাজে নামতে পারলে তখন আর বিশেষ অসুবিধে হবে না। যাই হোক মুরগি পালনের মাধ্যমে আমরা যেমন ডিম, মাংস বিষ্ট ও হাড় পেয়ে থাকি একই ভাবে হাঁস পালনের মাধ্যমেও একই উপকারিতা লাভ করা যায়। তাই হাঁস পালনেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
সমাপ্ত: উন্নত জাতের হাঁসের নাম ও হাঁস পালনের প্রয়োজনীয়তা | উন্নত জাতরে হাসের খামার দিতে হাসের জাত পরিচিতি।