বিষয়ঃ খামারিয়ান এর আজকের এই পোষ্টটিতে তুলে ধরা হবে, কথা বলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুনঃ কথা বলার দক্ষতা অর্জন করুনঃ বক্তব্যে শ্রোতাদের মন জয় করা সহজ উপায়, একজন সফল বক্তা হওয়ার উপায়, বক্তব্য ওয়ার নিয়ম ও ভাষণ দেওয়ার নিয়ম, কথা বলার কৌশল, কথা বলার জড়তা দূর করার উপায় (পর্ব-৮, লেখকঃ ডেল কার্নেগী, বই অনুবাদ)। আশা করি শেষ অবধি সাথেই থাকবেন, চলুন শুরু করা যাক।
আজকে আমরা আলোচনা করবঃ
(৮) কথা বলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুনঃ
◼ যখন আপনাকে জনসাধারণের সামনে বক্তৃতা দিতে ডাকা হবে, আপনি অন্য আর একজন বক্তাকে পরিচিত করে নিতে পারেন অথবা আপনার বক্তৃতাকে বোধগম্য, মনোজ্ঞ এবং কার্যকর করে তোলার জন্য বক্তব্য রাখুন। হয়ত আপনি কোনও সামাজিক সংস্থার অনুষ্ঠানে সভাপতি অথবা কোনও মহিলা সমিতির সদস্য এবং আপনার কাজ হল পরবর্তী বক্তৃতা সভায় প্রথম বক্তাকে পরিচিত করানো অথবা কোনও স্থানীয় সংবাদ সংস্থার বা কোনও বিক্রয় সংস্থার অথবা কোনও ইউনিয়ন সভা বা রাজনৈতিক দলের কাছে বক্তৃতা দেওয়ার সময় আপনি সময়স্বল্পতা হেতু বারবার ঘড়ি দেখছেন হয়ত কারণ আপনি জানেন আপনার পেছনে অনেক বক্তা লাইন দিয়ে রয়েছে, বক্তৃতা দীর্ঘ করা চলবে না কিন্তু এমনও হতে পারে দীর্ঘ বক্তৃতাই করতে হবে। কারণ সেখানে আপনি প্রতিযোগী, আপনাকে ছিনিয়ে নিতে হবে শ্রেষ্ঠ পুরষ্কারটি।
◼ তাহলে প্রথমেই যেটা করবেন তা হল, কখনও বলতে উঠে শ্রোতাদের কানে মার্জনা চাইবেন না বা দুঃখ প্রকাশ করবেন না। একজন বিখ্যাত বক্তার কথায় বলা যাক-আদেশ করুন, স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে কথা বলুন, কোনও বক্তাকে পূর্ব প্রস্তুত বক্তব্য রাখতে হবে এটা আমি বিশ্বাস করি না। এটা খুবই সহজ ব্যাপার, একদমই কার্যকর নয়। বক্তব্যের আকর্ষণ আর মাধুর্যকে খুন করে দেয় পূর্বপ্রস্তুতি। আমি অপক্ষো করি শ্রোতার তরফ থেকে সাড়া আর উদ্দীপনা পাওয়ার জন্য। আর আমি কখনও তা পেতে নিরাশ হই না। ধরুন, এই বক্তার নাম মিঃ জন।
◼ আমাদের এই পূর্বতন বক্তার নিজের লেখা বই থেকে একটি ঘটনার কথা বলছি আমি একবার একটি সভায় আমন্ত্রিত হলাম বক্তা হিসেবে। বসে আছি তো আছিই। আমার আর ডাক পড়ে না। এমন সময় একজন অনুষ্ঠান ঘোষক মঞ্চে উঠে শ্রোতাদের কাছে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং আমাকে বক্তব্য রাখতে আহবান জানালেন।
◼ উপস্থি ভদ্রমহোদয়গণ, অনুগ্রহ করে আপানারা একটু শুনুন। আমি আপনাদের কাছে কিছু দুঃসংবাদ শোনাতে এসেছি। বিখ্যাত বক্তা এমারসনের বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল, অনিবার্য কারণবশত তিনি আসতে পারছেন না, কারণ তিনি অসুস্থ। আমরা দুঃখিত ও লজ্জিত পরবর্তী বক্তা ছিলেন সেনেটের ডেভিড মেকচ্চন, কিন্তু হঠাৎ জরুরী কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তিনিও আসেননি। আমরা এজন্য দুঃখিত, এরপরে অবশ্য আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলাম উইলিয়াম হেনরীকে আনার জন্য কিন্তু তিনি আসতে পারেননি। অগত্যা আমরা বাধ্য হয়ে এখানে উপস্থিত মিঃ জনকে বক্তব্য রাখতে বলেছি।
◼ এভাবে যদি কাউকে অপ্রস্তুত অবস্থায় বক্তৃতা দিতে হয় তাহলে তার মনের অবস্থা কেমন বুঝতেই পারছেন। তবে এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে যদি পড়েন- তবে শ্রোতাদের সাহায্য নিন, তাদের কাছে খোলাখুলিভাবে বক্তব্য পৌঁছে দিন— তাহলেই তারা আপনাকে গ্রহণ করবে। শ্রোতারাই আপনাকে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেবে। ঠিন যেমন দিয়েছিলেন মিঃ জনকে।
(ক) আপনি যা বলতে চান তা পরিষ্কারভাবে বুঝুন, তৈরী হোন
- T.I.S ফরমুলা অনুসরণ করুন।
- T.I.S ফরমুলা আপনার সত্যিকারের বন্ধুর কাজ করবে। এ পর্যন্ত আপনি যা শিখলেন তার বাস্তব প্রয়োগে সাহায্য করবে।
- T=T হল গিয়ে বিষয়।
- I=I হল গিয়ে বক্তব্য বিষয়ের গুরুত্ব নির্ধারণকারী।
- S =S হল গিয়ে বক্তা। বক্তার নাম ধাম পরিচয়, ঠিকানা, পেশা ইত্যাদি…………।
◼ যখনই আপনার উপর দায়িত্ব বর্তাবে কোন বক্তাকে দর্শকের বা শ্রোতার সামনে পরিচয় করিয়ে দেবার- তখনই ওপরের তিনটি ফরমুলা মাথায় গেঁথে রাখবেন। বিষয়টি কি? বিষয়ের শিরোনামই-বা কি? প্রথমে বক্তার বিষয় সম্পর্কে পরিচয় করাবেন শ্রোতাদের।
◼ এবার হল বিষয়বস্তুর গুরুত্ব। যাদের কাছে বক্তা বক্তব্য রাখছে- তারা বিষয়বস্তুর কোন্ কোন্ অংশে বেশি গুরুত্ব দিতে পারে বা দেবে সেটা ভেবে নিয়ে আলোকপাত করুন বিষয়টির অংশবিশেষ।
◼ বক্তার নাম পরিষ্কার করে ঘোষণা করুন। আর শিক্ষাগত বা অন্যান্য যোগ্যতার উল্লেখ করুন। সম্ভভ হলে এমন কিছু খুঁজে নিয়ে বলুন-যা কিনা বক্তার বক্তব্য বিষয়কে গুরুত্ব দেবে-একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাবে।
◼ এবার একটি উদাহরণ দিচ্ছি যা থেকে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠবে আপনাদের কাছে।
ধরুন : ‘নিউইয়র্ক শহরে টেলিফোনের অগ্রগতি’ এ বিষয়টির উপর বক্তব্য রাখবেন কোন বক্তা। আপনি তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেবেন- এরকম ঠিক করা আছে। আপনি প্রথমে টেলিফোন সম্পর্কে দু’চার কথা বলতে পারেন। পরে সরাসরি বক্তার পরিচয় দিন। টেলিফোন সম্পর্কে তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কথা বলে সরাসরি তাঁর নাম ঘোষণা করুন। এবারে আপনার সামনে উপস্থিত হবেন মিঃ জন, প্রেসিডেন্ট, নিউইয়র্ক টেলিফোন কোম্পানী।
এবারে আর একটি উদাহরণ দিচ্ছি- আপনি এভাবেও শুরু করতে পারেন, কোন বক্তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ‘আমি খুব আনন্দের সহিত জানাচ্ছি আজ আমরা আমাদের মাঝে পেয়েছি মিঃ ম্যালথাসকে। তিনি আপনাদের তাঁর জীবনের স্মরণীয় কিছু ঘটনার কথা বলবেন। এমনি নানাভাবে আপনি বক্তাকে শ্রোতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন। শুধু মনে রাখবেন পরিচয় পর্বটা যেন অন্তঃসারশূন্য, রসকষহীন কাঠখোট্টা না হয়ে দাঁড়ায় এবং সবচেয়ে যেটা জরুরী তা হল এ ফরমুলা অনুসরণ করে চলা। তাহলেই দেখবেন কাউকে পরিচয় করিয়ে দিতে আপনাদের কোন অসুবিধেই হচ্ছে না।
(খ) সবচেয়ে আগে নিজেকে উদ্দীপ্ত করুন
◼ ধরুন, আপনি যদি কোনও বক্তার নাম প্রথমে না বলে তার পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও নানারকম কর্মদক্ষতা সম্পর্কে শ্রোতার মনে সুন্দর ধারণা গড়ে তুলতে পারেন এবং তারপরেই ধীরে ধীরে স্থির গলায় পরিষ্কার উচ্চারণে বক্তার নাম ঘোষণা করেন, তাহলে দেখবেন আপনার শ্রোতারা শতগুণে আগ্রহী হয়ে উঠবে বক্তা সম্পর্কে। বক্তার নাম ঘোষণা করার সময় তিনটি শব্দ সর্বদা মাথায় রাখবেন। তা হলো থামা, সুসামঞ্জস্য ও দৃপ্ত ভঙ্গি।
- (১) থামা : এর মানে হলো কোনও বক্তার নাম ঘোষণার পূর্বে একটু থামুন। তাতে ফল হবে এই যে নৈঃশব্দ ভঙ্গ করে বক্তার নাম শ্রোতার নাম শ্রোতার মনে একটা রিনরিনে ছন্দের সুর এনে দেবে।
- (২) সুসামঞ্জস্য : এর অর্থ হল শ্রোতার নাম এবং পদবীর উল্লেখ করার সময় সুসামঞ্জপূর্ণভাবে একটু থামুন, যাতে বক্তার নাম শ্রোতার অন্তরের অন্তরতম স্থলে সুগভীর আবেগের সৃষ্টি করে।
- (৩) দৃপ্ত ভঙ্গি : এর অর্থ হল বক্তার নাম ঘোষণায় কণ্ঠস্বরে উদ্দীপনা এবং দৃঢ়তা আনুন। মিনমিনে বা অস্পষ্ট উচ্চারণে কখোনই বক্তার নাম ঘোষণা করতে যাবেন না।
(গ) আপনার আন্তরিকতা যেন শ্রোতার হৃদয় স্পর্শ করে
◼ যখন বক্তাকে শ্রোতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে যাবেন তখন যেন শ্রোতার চেয়ে বক্তাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে শ্রোতাকে আহত করে তুলবেন না, হাস্যরস বা কোনও ঘটনার কথা বলতে গিয়ে এমন কোনও শব্দ বা কথা উচ্চারণ করবেন না যাতে করে শ্রোতাদের অশিক্ষিত, হৃদয়হীন বা অজ্ঞ বলে মন্তব্য করার পর্যায়ে চলে যায়।
◼ প্রত্যেকটি মানুষের গোপন আকাঙ্খা হল সম্মান লাভ করা, পুরস্কৃত হওয়া। পুরস্কার যিনি পান তিনি তা পাওয়ার যোগ্য এটা। যতটা ঠিক, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করাটাও কোন অংশে কম সম্মানের নয়। তাই যখনই কোন পুরস্কৃত বিজয়ী সম্পর্কে শ্রোতাদের কিছু বলতে যাবেন, তখন পুরস্কার না পাওয়া প্রতিযোগিদের কোন ভাবে ছোট বা হেয় প্রতিপন্ন করতে যাবেন না।
◼ তাই পুরস্কারবিতরণী সভাতে বক্তব্য রাখার সময় বিজীয়দের পুরস্কৃত করার সময় প্রতিটি শব্দ নির্বাচনে যথেষ্ট গুরুত্ব দেবেন, সতর্ক থাকবেন। নিচে বহু পরিক্ষিত একটি ফরমূলা বলে দেয়া হল :
- (১) কিভাবে পুরস্কার দেওয়ার রেওয়াজ হল সে সম্পর্কে বলুন— হয়তো এটা হতে, পারে যে দীর্ঘদিন যোগ্যতার সঙ্গে কাজের জন্য অথবা কোন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে বিজয়ী হওয়ায় ব্যক্তিগত কোন সৃজশীল কাজের জন্য এরকম পুরস্কার দেয়া যেতে পারে। আপনি সহজ সরল অন্তরঙ্গতায় শ্রোতাকে তা বলুন।
- (২) পুরস্কার বিজয়ীর কাজকর্ম বা জীবনের কিছু স্মরণীয় ঘটনা সম্পর্কে আলোকপাত করুন।
- (৩) পুরস্কারটি কিভাবে দেওয়া হয়, এর আর্থিক এবং সম্মানিক মূল্য কত এবং পুরস্কার বিজয়ী এটা জয় করে কতটা কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, সম্মানিত হয়েছেন সে সম্পর্কে বিশদ বলুন।
◼ পুরস্কারটি বিজয়ীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান এবং সমবেত শ্রোতামণ্ডলীর শুভেচ্ছা তাকে যেন ভবিষ্যতে আরও উন্নতির শিখরে নিয়ে যায় এটা জানাতে ভুলবেন না যেন।
পরিশেষে আর একটি কথা স্মরণ রাখবেন, পুরস্কারটি যারা দিচ্ছেন সে সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে এবং ধন্যবাদ জানাতে ভুলবেন না যেন।
(ঘ) আপনি যদি পুরুস্কার বিজয়ী হন তাহলে শ্রোতাদের উষ্ণ আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে ভুলবেন না
এ বিষয়ে গোটা চারেক অব্যর্থ ফরমুলা আপনাদের বলছি-
- (১) উপস্থিত শ্রোতামগুলীকে উষ্ণ আন্তরিক কণ্ঠস্বরে অসংখ্য ধন্যবাদ জানান।
- (২) পুরস্কার পেতে বিভিন্ন দিক থেকে আপনাকে যারা সহায়তা করেছিল তাদের প্রত্যেকের কাছে বিভিন্ন দিক থেকে আপনার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করুন। যেমন : এদের মধ্যে থাকতে পারে আপনার পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী এবং আপনার সহযোগিরা।
- (৩) পরিষ্কার করে সবাইকে বলুন, কি পুরস্কার আপনি পেয়েছেন। যদি পুরস্কারটির খোলা অবস্থায় থাকে, বিশেষ মোড়কে না থাকে, তাহলে পুরস্কারটি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাইকে দেখান। শ্রোতাদের আন্তরিকভাবে বলুন জিনিসটা কতটা মজবুত, কতদূর আপনার কাজে লাগবে। কি দিয়ে তৈরী, গায়ে নকশা বা কারুকার্য রয়েছে কি-না।
- (৪) পরিশেষে উপস্থিত শ্রোতামগুলীর কাছে উষ্ণ আন্তরিক ধন্যবাদ এবং সবিনয়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বিদায় নিন, বক্তব্যে ইতি টানুন।
সকল পর্বের তালিকাঃ
(এখন আপনি আছেন পর্ব-৮ এ)
পর্ব-১ : https://khamarian.com/বক্তব্যে-শ্রোতার-মন-জয়/
পর্ব-২ : https://khamarian.com/কিভাবে-আত্মবিশ্বাস-বাড়া/
পর্ব-৩ : https://khamarian.com/কথা-বলার-দক্ষতা-অর্জন-করু/
পর্ব-৪ : https://khamarian.com/সজীব-প্রাণবন্ত-কথা-বলুন/
পর্ব-৫ : https://khamarian.com/শ্রোতা-সঙ্গে-ভাব-বিনিময়/
পর্ব-৬ : https://khamarian.com/যা-বলতে-চান-গুছিয়ে-বলার-চ/
পর্ব-৭ : https://khamarian.com/কথায়-যোগাযোগ-স্থাপনের-ক/
পর্ব-৮ : https://khamarian.com/কথা-বলার-চ্যালেঞ্জ-গ্রহণ/
পর্ব-৯ : https://khamarian.com/কিভাবে-দীর্ঘক্ষণ-কথা-বলা/
সমাপ্তঃ আজকরে আলোচ্য বিষয় “কথা বলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুনঃ কথা বলার দক্ষতা অর্জন করুনঃ বক্তব্যে শ্রোতাদের মন জয় করা সহজ উপায়, একজন সফল বক্তা হওয়ার উপায়, বক্তব্য ওয়ার নিয়ম ও ভাষণ দেওয়ার নিয়ম, কথা বলার কৌশল, কথা বলার জড়তা দূর করার উপায় (পর্ব-৮, লেখকঃ ডেল কার্নেগী, বই অনুবাদ)।” পরবর্তী পোষ্ট পড়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে এই পোষ্টটি এখানেই সমাপ্ত করা হলো।