Skip to content

 

কথা বলার দক্ষতা অর্জন করুনঃ বক্তব্যে শ্রোতাদের মন জয় করা সহজ উপায়, একজন সফল বক্তা হওয়ার উপায়, বক্তব্য দেওয়ার নিয়ম ও ভাষণ দেওয়ার নিয়ম, কথা বলার কৌশল, কথা বলার জড়তা দূর করার উপায় (পর্ব-৩, লেখকঃ ডেল কার্নেগী, বই অনুবাদ)।

কথা বলার দক্ষতা অর্জন করুনঃ বক্তব্যে শ্রোতাদের মন জয় করা সহজ উপায়, একজন সফল বক্তা হওয়ার উপায়, বক্তব্য ওয়ার নিয়ম ও ভাষণ দেওয়ার নিয়ম, কথা বলার কৌশল, কথা বলার জড়তা দূর করার উপায় (পর্ব-৩, লেখকঃ ডেল কার্নেগী, বই অনুবাদ)।

বিষয়ঃ খামারিয়ান এর আজকের এই পোষ্টটিতে তুলে ধরা হবে, কথা বলার দক্ষতা অর্জন করুনঃ বক্তব্যে শ্রোতাদের মন জয় করা সহজ উপায়, একজন সফল বক্তা হওয়ার উপায়, বক্তব্য ওয়ার নিয়ম ও ভাষণ দেওয়ার নিয়ম, কথা বলার কৌশল, কথা বলার জড়তা দূর করার উপায় (পর্ব-৩, লেখকঃ ডেল কার্নেগী, বই অনুবাদ)। আশা করি শেষ অবধি সাথেই থাকবেন, চলুন শুরু করা যাক।

◼ অনেক বছর আগে একজন দর্শনের অধ্যাপক, যিনি ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে যৌবন কাটিয়েছিলেন, আমাদের নিউইয়র্কের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলেন। তাঁর ইংরেজী উচ্চারণ ছিলো খুবই ভালো আর উন্নতমানের। আমাদের শিক্ষকদের চেয়েও ভাল করতে পারতেন তিনি। তিনি ছিলেন শহরে কৃষ্টিবান সংস্কৃতি সম্পন্ন। তাঁর বক্তব্য ছিলো যুক্তিপূর্ণ আর আদব-কায়দা ঘেঁষা। অতএব গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও তাঁর বক্তৃতা জমাট বাঁধতো না। তাঁর বক্তব্য হতো সাধারণ আর প্রাণহীন। কোন ঘটনা বলা বা দৃষ্টান্ত দিতে পারতেন না তিনি অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে। ধারাবাহিক তাত্ত্বিক আলোচনার মতই নীরস আর প্রাণহীন দুর্বোধ্য আর বিমূর্ত আদর্শ ঘেঁষা ছিল তাঁর বক্তৃতা।

◼ অপরদিকে এক অর্থ লেনদেনকারী সংস্থার কর্ণধারও আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলেন। তাঁর বক্তৃতা চিল সুনির্দিষ্ট, মাপা বক্তব্যের ঠাম বুননে ঘটনার বিবৃতিতে ছবির মতই উপভোগ্য। তিনি দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বক্তব্যের মালা গাঁথতেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনি নিজে যে সব অসুবিধার সম্মুখীন হতেন, তিনি স্রোতাদের সঙ্গে খুবই অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে তা আলোচনা করতেন। শ্রোতারা গভীর আগ্রহ আর আনন্দের সঙ্গেই তাঁর বাস্তব নির্দেশবহুল বক্তৃতাকে পছন্দ করত।

◼ পাশাপাশি একজন অধ্যাপক আর লেনদেনকারীর মধ্যে আলোচনার কি তফাৎ থাকতে পারে তা বুঝলেন আপনারা। এই আলোচনা করার মূল উদ্দেশ্য হল কি করে বা কেমন করে একজন বক্তা শ্রোতার মনে সাড়া জাগাতে পারে, শ্রোতাকে প্রভাবিত করতে পারে, শুধুমাত্র বক্তব্যের গুরুত্ব বর্ণনামূলক ঘটনাসমৃদ্ধ কথা বলতে পারার গুণে।

বক্তব্যকে জোরদার আর সমৃদ্ধ করার জন্য বেশ কয়েকটি উপায় রয়েছে, যা ঠিকমত অনুশীলন করলে শ্রোতার মন জয় করা যাবেই যাবে। শ্রোতা গভীর আগ্রহ আর ঔৎসুক্য নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করবে আপনার পববর্তী কণ্ঠস্বর শোনার জন্য।

(ক) বিষয়বস্তুকে অযথা না বাড়িয়ে সংক্ষিপ্ত করুন

◼ বিষয়বস্তু নির্বাচিত হয়ে গেলে আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন, যাতে কোন অবস্থাতেই আপনি নির্ধারিত বিষয়ের আওতার বাইরে পা না বাড়ান। বিরাট পটভূমি টেনে অনেক বিষয়বস্তু নিয়ে বক্তব্য রাখার চেষ্টা না করাই আপনার পক্ষে শ্রেয়। না হলে সবকিছু গুলিয়ে যাবে, তালগোল পাকিয়ে হাসির খোরাক হয়ে উঠবেন শ্রোতাদের চোখে। নিজে- ভাববেন, কত গুরুগম্ভীর পান্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা দিচ্ছেন।

◼ একবার একজন যুবক বক্তা নিজের দোষে হাসির খোরাক হয়ে উঠেছিল শ্রোতাদের কাছে। মাত্র দু’ মিনিটের জন্য বলতে উঠে, সে বিষয় বেছে নিয়েছিল ‘খৃঃ পূঃ ৫০০ সালের এথেন্স থেকে আজকের কোরিয়ার যুদ্ধ।’ কি মুর্খতার পরিচয় ছিল বক্তার বিষয় নির্বাচনে! এথেন্সের গোড়াপত্তনের শুরু হতে না হতেই সময় ফুরিয়ে গেলো বলার। ছেলেটি মুখ চুন করে বসে পড়তে বাধ্য হল।

◼ এ ধরনের হাজারটা বক্তৃতা আমি শুনেছি। অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে, একাধিক প্রসঙ্গ টেনে আনতে গিয়ে, এরা সবাই মূল লক্ষ্য থেকে, আলোচ্য বিষয় থেকে যেন হাজার মাইল দূরের এক শুকনো মরুভূমিতে মুখ থুবড়ে পড়েন আচমকা। শ্রোতারা আকর্ষিত হওয়া তো দূরের কথা, গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন, কখন বক্তার বলা শেষ হবে, বিরক্তিকর পরিস্থিতির হাত থেকে নিস্তার পারেন তারা। কেন এ রকম হয়? কারণ কি?

◼ উত্তর হল, কারণ মানুষের মন ধারাবাহিক একঘেয়ে বিরক্তিকর তথ্যবহুল হিসেব নিকেশের রসকহীণ শুকনো কচকচি শুনতে একদম পছন্দ করে না— অত্যন্ত বিরক্ত হয়। যদি কোন বক্তা বলতে উঠে সারা পৃথিবীর বর্ষপঞ্জিকা নিয়ে বলতে থাকেন, তাহলে চোখ বুঝে বলতে দেয়া যায়, অধিকাংশ শ্রোতা বাইরে চলে যাবে চা সিগারেট খেতে, শ্রোতা হয় ঝিমোতে থাকবে হাই তুলতে তুলতে, না হয় অন্য কিছু ভাববে মশগুল হয়ে।

◼ আর একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন আপনি বেড়াতে গেছেন ইয়োলোষ্টোন পার্কে। দেখবেন দর্শক যেন মৌমাছির মতো গুঞ্জনে গুঞ্জনে সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে সৌন্দর্যের মধু আহরণে। কোন দৃশ্যাবলী বা সুন্দর নিসর্গ থেকেই বঞ্চিত হতে চায় না তারা।

◼ কিন্তু সবকিছু দেখার শেষে তাদের স্মৃতিতে গাঁথা থাকে জলপ্রপাতের শব্দ ঘুর্নায়মান জলস্তম্ভ, মৌনবিধুর পাহাড় আর উষ্ণ প্রস্রবণে সন্তরণের আরামদায়ক অভিজ্ঞতার কথা। যদি কোন বক্তাকে ইয়েলোষ্টোন পর্কে গিয়ে বলতে দেওয়া হয়, তাহলে তার বক্তৃতা হয়ে উঠবে স্মরণীয় এবং বরণীয়, যদি তিনি বহুবিধ দৃশ্যাবলী আর নিঃসর্গ শোভা থেকে একটি বা দু’টি বিষয়কে বেছে নেন। তিনি নির্বাচন করতে পারেন নিজের সবচেয়ে ভালো লাগা প্রিয় দৃশ্যটিকে। তাহলেই তিনি সক্ষম হবেন খুঁটিনাটি বিবরণ দিয়ে বক্তব্যকে বর্ণনাময় দৃশ্যগ্রাহ্য করে তুলতে। শ্রোতারা মনোযোগী হবে শুনতে, কারণ তাদরে মনে হবে প্রতিটি বর্ণনা তারা শুধু শুনতে পাচ্ছে না চোখের সামনে যেন দেখতেও পাচ্ছে। নানা রকম বৈচিত্র্যের সম্ভারে প্রাণময় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে বক্তৃতা। অতি সহজেই শ্রোতার হৃদয় জয় করতে সক্ষম হবেন বক্তা।

◼ যে-কোন বিষয়েই এ কথা খাটে। তা বিক্রয় দক্ষতা, পাউরুটি-কেক তৈরী, করদানে অব্যহতি লাভ, স্বয়ংক্রিয় ক্ষেপণাস্ত্র ইত্যাদি যাই হোক না কেন।

◼ বক্তৃতা দেওয়ার পূর্বে নির্ধারিত বক্তব্যটি কেটে সংক্ষিপ্ত করুন, পাঁচ মিনিটের কম সময়ে যেন শেষ হয়। ধরুন আপনাকে ও সময়টাই বলার জন্য দেওয়া হয়েছে। তাই আপনাকে একটি-দু’টি প্রধান সূত্র নিয়েই বলে যেতে হবে, বেশি নয়। দীর্ঘ সময়কালীন বক্তৃতা, ধরা যাক আধ ঘন্টা সময়সীমার মধ্যে খুব কম বক্তাই পারেন চার-পাঁচটার বেশি সূত্র নিয়ে বক্তৃতা দিতে।

তাহলে সার কথা দাঁড়ায়— বক্তব্যের বিষয়বিস্তু সংক্ষেপ করুন। অযথা টেনে বাড়াবেন না।

(খ) সংরক্ষিত ক্ষমতা বাড়ান

◼ ভাসাভাসা কোন কিছু বলা খুবই সহজ’। বক্তব্যের গভীরে না ঢুকে দায়সারাভাবে বলা যাকে বলে। এ ধরনের কথা বলা কোন কাজে লাগে না। শ্রোতার মনে আদৌ কোন ছাপ পড়ে না। কম কথা হবে অথচ বক্তব্য হবে জোরালো। আপনি যখন কোন একটি বক্তব্য বিষয় নির্বাচন করবেন, তখন ভালো করে নিজেকে প্রশ্ন করুন এ বিষয়গুলো দিয়ে কেন আপনি তা বিশ্বাস করবেন, বাস্তব জীবনের সঙ্গে কেমন করে মিল খুঁজে বের করবেন? সত্যি কথা ভাবতে চেষ্টা করুন, আপনি কি প্রমাণ করতে চাইছেন। বাস্তবে কেমন করেই বা এসব ঘটবে।

◼ এসব প্রশ্ন সম্পর্কিত উত্তর একটাই। ক্ষমতাকে সংরক্ষণ করুন। এলোপাতাড়ি ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না। তাহলেই আপনার বিশেষ সংরক্ষিত ক্ষমতার বলে শ্রোতাকে মনোযোগী করে তুলতে পারেন, চুপ করে বসিয়ে রাখতে পারেন। একবার একজন প্রখ্যাত উদ্ভিদ-বিজ্ঞানী আমাকে বলেছিলেন- আমি কয়েক লক্ষ গাছপালা নিয়ে করে গবেষণা চালিয়ে একটি বা দু’টি উন্নতমানের গাছের সন্ধান পেয়েছি মাত্র। চিন্তার মধ্যে নব্বইটিকে তাড়িয়ে দিয়ে মাত্র দশটিকে ধরে রাখুন, যত্ন করুন।

◼ আর একজন অধিক বিক্রিত জনসংযোগকারী তথ্যসমৃদ্ধ পুস্তকপ্রণেতা আমাকে জানিয়েছিলেন- আমি আমার প্রয়োজনীয় খবর, যা আমার কাজে লাগাতে পারবো তা সংগ্রহ করি প্রয়োজন থকে দশগুণ বা একশো গুণ বেশি।

◼ এখানে লেখক আসলে বই লেখার তথ্য সংগ্রহ করার বাস্তব অভিজ্ঞতার দিক থেকে একথা বলেছিলেন। আরও একবার সেই ‘লেখক- যখন পাগলা গারদ এবং গাগলদের সম্পর্কে বই লেখার বা বক্তৃতা দেবার জন্য তথ্য অনুসন্ধান ও সংগ্রহ করেছিলেন, তখন তাঁর এক ঘনিষ্ঠ সহকারী আমাকে অনেক কথা জানিয়েছিল। কয়েকশো পাগল, হাসপাতালের ডাক্তার, রুগী, পরিচালক, নার্স, পরিচালন বিভাগের বিভিন্ন কর্মীকে নিয়ে তিনি হাজারো প্রশ্ন করেছিলেন তথ্যের জন্য। দিনের পর দিন হাসপাতাল চত্বরে ঘোরাফেরা করে জুতোর সুকতলা খুইয়ে লেখক ভদ্রলোক মোটা খাতা ভর্তি করে ফেলেছিলেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য দফতর হাসপাতাল কর্তকপক্ষ কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র- পত্রিকা, রিপোর্ট, বুলেটিনও সংগ্রহ করেছিলেন তিনি।

◼ অবশেষে তিনি মাত্র চারটি ছোট নিবন্ধ লিখেছিলেন যা শ্রোতার সামনে সুন্দর সংক্ষিপ্ত চিত্ত জয়কারী বক্তৃতা দিতে সহায়ক হয়েছিলো। কয়েক পাউন্ড ওজনের নথিপত্র থেকে তিনি আহরণ করেছিলেন এমন শক্তি বা সংরক্ষিত ক্ষমতা যা শ্রোতাদের হৃদয় স্পর্শ করেছিল আন্তরিক মুগ্ধতায়।

◼ আমার এক সার্জন বন্ধু আমাকে একবার বলেছিলো- কিভাবে কেমন করে এ্যাপেনডিক্সকে অস্ত্রোপচার করে বাদ দিতে হয়, আমি তা তোমাকে মাত্র দশ মিনিটেই শিখিয়ে দিতে পারি। কিন্তু যদি কিছু খারাপ হয় কাটা-ছেঁড়ার সময়, তাহলে কি করতে হবে, সেটা শেখাতে আমার কম করে সময় লাগবে চার বছর।

◼ সুতরাং যখনই কিছু বলার জন্য বক্তৃতা মঞ্চে উঠবেন তখনই মনকে প্রস্তুত করে নেবেন যে-কোন প্রতিকুল অবস্থার মোকাবেলা করার জন্য। যে কোন জরুরী অবস্থার মুখোমুখি হতে পারেন আপনি। যেমন ধরুন, আপনার পূর্বতন বক্তা এমন কিছু বক্তব্য রাখবেন যে আপনাকে তার জবাব দিতে হবে বা আপনার বক্তব্যের মূল কাঠামোর পরিবর্তন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে বিষয় পরিবর্তন করুন। তাহলেই সংরক্ষিত ক্ষমতা ব্যবহার করার উপযুক্ত হবেন।

◼ দু-তিন দিন পরে কোথাও বক্তৃতা দেওয়ার কথা আছে আপনার আপনি ভাবলেন পড়ে দেখে নেবো, সময় তো রয়েছেই হাতে। তাহলেই সর্বনাশ হবে। যত তাড়াতাড়ি বক্তব্য বিষয় নির্বাচন করে ফেলবেন- তত দ্রুত আপনার মন এ বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করে দেবে। আপনার অজ্ঞাতসারে আপনি অভীষ্ট সিদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবেন। যখন আপনার হাতে অবসর আসবে, কাজের ঝামেলা থাকবে না-তখন নির্জনে বসে বিষয়টি নিয়ে ভাবুন। চিন্তার ডানা মেলে খুঁজে দেখুন নতুন কোন ঘটনার সঙ্গে বা অতীতের কোন কিছুর সঙ্গে কোন সম্পর্ক আবিষ্কার করতে পারেন কিনা। নিজে যত বেশি করে, ভালোভাবে বিষয়টি বুঝবেন, জানবেন, তত বেশি সফল হবেন আপনার চিন্তাকে শ্রোতাদের মনের তরঙ্গে পৌঁছে দিতে। যখন আপনি গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছেন বা বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন বা সাবওয়ের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছেন, তখন ইচ্ছে করলেই আপনি নির্বাচিত কোন বিষয় নিয়ে ভাবনায় নিমগ্ন হতে পারেন। এরকম ভাবতে শিখলেই নতুন নতুন যুক্তি ও ভাবনার তরঙ্গ আপনাকে বিদ্যুৎ সংকেত দেবে, এগিয়ে নিয়ে যাবে কাজের বাস্তব সাফল্যের দিকে।

◼ একজন প্রখ্যাত রাজনৈতিক বক্তা এ-বিষয়ে একমত। তার মত হল—মঞ্চে ওঠার পূর্বে, পথ চলতে, খবরের কাগজ পড়তে পড়তে, বিছানায় ঘুম আসার আগে সকালে প্রাতঃরাশের পূর্বে যে বক্তা যত বেশি গুরুত্ব সহকারে নির্বাচিত বিষয় নিয়ে ভাববেন তিনিই ততত বেশি দর্শকের দরবারে সংবর্ধনা লাভ করতে পারবেন। মাঝারি গোছের ভাবনা-চিন্তা থেকে কোন কিছু আশা করা যেতে পারে, কিন্তু ফল হয় মাঝারি গোছের বা তারও নিম্নমানের।

◼ যদি কোন দিন লেখা বা বলার ব্যাপারটাই আপনার জীবিকা হয়ে ওঠে, তখন দেখবেন পাতার পর পাতা জুড়ে লেখার লোভ কিছুতেই সংবরণ করে উঠতে পারছেন না আপনি। চেষ্টা করুন—যাতে এ লোভ থেকে মুক্ত হতে পারেন। বরঞ্চ চিন্তাটাকে কার্যকরভাবে গুরুত্বপূর্ণ পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করুন। নিজের মনে মনে বক্তব্য বিষয়ে গুরুত্ব ও মর্যাদা অনুসারে একটি নিরেট দুর্ভেদ্য কাঠামো করুন। কিন্তু সাবধান! কখনই কোন কিছু মুখস্থ করা বিষয় থেকে মনে করার চেষ্টা করবেন না।

◼ প্রখ্যাত কথাশিল্পী অভিজ্ঞতার সমুদ্র যিনি লঙ্ঘন করেছেন বেঁচে থাকার আগের মুহুর্ত পর্যন্ত-সেই মার্ক টোয়েন একবার বলেছিলেন লেখা কোন কিছু কখনই বলার মত সাব- লীল ভঙ্গির হতে পারে না-বক্তৃতা দেওয়া তো দূরে কথা। কার্যত লেখা বিষয়ে বা প্রবন্ধে সাহিত্যের গন্ধ বেশি থাকে। তারা একটু শক্ত হয়, অনমনীয় হয়, বলার সময় জিভ খুবই আড়ষ্টভাবে তা উচ্চারণ করার দায়িত্ব পালন করে। কিছুতেই সহজ সাবলীল প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা টগবগে বক্তব্য হয়ে পড়ে না শ্রোতার কাছে। যেখানে বক্তার কাজ হল শ্রোতাকে খুশি করা, আনন্দ দেওয়া নতুন নতুন তথ্যের জগতে ঘটনার জগৎ থেকে ভ্রমণ করে আনা সেখানে মুখস্থ করা গালভরা কাঠখোট্টা রসকষ প্রাণবিহীণ বক্তৃতা শ্রোতাদের মুগ্ধ করাতো দূরের কথা— বিরক্তে অস্থির ও চঞ্চল করে তোলে। এ যেন প্রতিটি শ্রোতার হাতে গোলাপফুল তুলে দিয়ে বলা হল সুগন্ধ আস্বাদন করার জন্য— অথচ ফুলগুলো হলো কাগজের তৈরী কৃত্রিম-প্রাণহীন।

◼ মোটর গাড়ি নির্মাণে শিল্পে যার নতুন নতুন চিন্তা আর উদ্ভাবনী শক্তি আবিষ্কারের বহুমুখী দরজা খুলে দিয়েছে অসংখ্যবার, এমন একজন পৃথিবী বিখ্যাত ব্যক্তি একবার আমাকে বলেছিলেন, মিঃ কার্ণেগী, ব্যাপারটা কি ভাবেন- আমি যা ভাবি, তা লিখে রাখতে পছন্দ করি। আমি বিশ্বাস করি আমার চিন্তার সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব হয়ে উঠবে না। তবে হ্যাঁ, কাগজের ওপর হিবিজিবি লেখার বিষয়ে কোন গুরুত্বই আমি দিই না- শ্রোতার হৃদয়ে, মনের পাতায়, বক্তব্যের কালির আঁচড়ে লিখতেই আমি পছন্দ করি। সারাজীবন ধরেই আমি এরকম লেখাই লিখে চলেছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যারা একখণ্ড সাদা কাগজ যখনই সেতু তৈরী করার চেষ্টা করেন তাঁরা ব্যর্থ হন শ্রোতার মনে প্রভাব ফেলতে। মাঝপথেই সেতু ভেঙে পড়ে।

তাহলে ওপরের উপমাগুলো থেকে শিক্ষাই আমরা পেলাম-
ক্ষমতা সংরক্ষণ করুন এবং সংরক্ষিত ক্ষমতা বাড়ান।

(গ) আপনার বক্তব্যকে বর্ণনাবহুল চিত্রধর্মী করে তুলুন

◼ একবার ‘টাইমস্’ এবং ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ খুবই সারা জাগিয়েছিল। প্রবন্ধটি লিখেছিলেন একজন দিকপাল অধিক বিক্রিত পুস্তকের লেখক। তাতে তিনি লিখেছিলেন- পাঠযোগ্য লেখার পেছনে কি রহস্য থাকে? পাঠক কি ধরনের লেখা পড়তে ভালবাসে? প্রবন্ধের শেষে চুম্বক কথাটি বলেছিলেন- হ্যাঁ। এতে কোন দ্বিমত নেই, সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে পাঠক একমাত্র গল্প উপন্যাস পড়তেই সত্যিকারভাবে পছন্দ করেন, পাঠযোগ্য ভাবেন।

◼ আর একজন পাদ্রী লেখকের কথা বলছি, যাঁর ধর্মোপদেশ রেডিও টিভি মারফত কয়েক কোটি শ্রোতার হৃদয় দুয়ারে ঘা দিতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি একবার এক সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে আমাকে বলেছিলেন, ‘জানো, আমি বক্তৃতার সময় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই উপমার ওপরে, গল্প বলার ভেতর দিয়েই আমি প্রভুর বাণী শোনাই শ্রোতাদের।

◼ আমার লেখা প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ’ পুস্তকের সারকথা লেখা হয়েছে মাত্র দেড় পাতাতে। বাকি দুশো তিরিশ পাতা জুড়ে ছিল গল্প আর উদাহরণসমূহ এবং কেমন করে কিভাবে বাস্তব জীবনে আমার উপদেশ ও শিক্ষাকে কাজে প্রয়োগ করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হয়েছিলো আমরা ছাত্ররা।

◼ তাহলে কিভাবে কেমন করে আমার সেই প্রয়োজনীয় কলাকৌশল শিখতে পারবো ঘটনার উপাদান থেকে? কোন উপায় আছে কি শেখার? উপরোক্ত প্রশ্নগুলো আমাকে সামনে পেলে যে আপনারা করতেন, তা আমি ভালোভাবেই জানি। তাহলে সেই স্বর্ণখনির সন্ধান বলে দিচ্ছে।

◼ আপনার ইচ্ছে থাকলেই যত খুশি স্বর্ণ উত্তোলন করতে পারবেন আপনি। নিচের কথাগুলোকে হেলাফেলা করে পড়বেন না। যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে পড়ুন। ভাবুন। ব্যাখ্যা করুন।

কথাগুলো গুরুত্ব অনুসারে সাজিয়ে লিখছি-

  • (১) মানবতাকরণ
  • (২) বিন্যাসকরণ
  • (৩) ব্যক্তিগত ভাবনার আদান-প্রদান
  • (৪) নাটকীয়তা আনয়ন
  • (৫) দৃশ্যগ্রাহ্যতা

এবারে উপরোক্ত বিষয়সমূহ নিয়ে বিষদভাবে আলোচনা করছি চোখ কান মন-প্ৰাণ খোলা রেখে পড়ুন বুঝুন। বারবার পড়ুন। শুধুমাত্র পড়ার জন্যই পড়বেন না।

(ঘ) আপনার বক্তৃতাকে মানবতার পথে চালিত করুন

◼ একবার প্যারিসে বসবাসকারী আমেরিকার ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণে প্যারিসে যেতে হয়েছিলো বক্তৃতা দেবার জন্য। বক্তব্যের বিষয় ছিল ‘কি করে সফলতা অর্জন করা যায়?’

◼ প্রথমে আমি সবাইকে এক এক করে এ-বিষয়ে নিজেদের বিশ্বাস ও ধারণা সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে বললাম।

◼ বক্তারা প্রায় সকলেই নিগূঢ়-দুর্বোধ্যত্ব ধাঁচে বলে চললো কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায়, ধৈর্য্য আর অনমনীয় সংকল্প নিয়ে। পরিশেষে আমার বক্তব্যে আমি বললাম, আবার কেউ-ই উপদেশ শুনতে পছন্দ করে না। কেউ তা উপভোগ করে না। বরঞ্চ অতিমাত্রাই বিরক্ত হয়। সব সময় এটা মনে রাখতে হবে আমাদের, আপনি শ্রোতাদের এমন কিছু বলুন যা তাদের শুনতে ভালো লাগে, আগ্রহ বাড়ায়, না হলে শ্রোতারা মনোযোগী হবে না। আপনার চেনা-জানা ‘কাছের দু’জন লোক সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন আমাদের। বলুন, কেন একজন উন্নতি করলো আর একজন ব্যর্থ হল। আমরা গভীর আগ্রহ নিয়ে তা শুনবো। তা মনে রাখবো। আর সেই থেকে জীবনের চলার পথের শিক্ষা নেবো। উপকৃত হবো।

◼ সেই বক্তৃতা আসরে এমন কোন ব্যক্তি ছিলেন না, যিনি নিজের সম্পর্কে বা চেনা- জানা কারুর সম্পর্কে বলতে আগ্রহী নন এবং সেই সঙ্গে শ্রোতাদেরও দূরে বসিয়ে না রেখে কাছে টানতেও আপত্তি হলো না কারুর।

◼ একজন বক্তা বক্তব্যকে গুছিয়ে কাটছাঁট করে, মানবতাধর্মী করে সুন্দর বললো তার চেনা দু’জন প্রতিবেশেী সম্পর্কে। তাদের মধ্যে একজন ছাত্রজীবনে ইঞ্জিনিয়ারিং” পড়াকালীন তার সহপাঠী ছিল। সে ছিল খুবই গোঁড়া আর গোঁয়ার, সে শহরের সমস্ত দোকান থেকে শার্ট কিনতো- কে কোন দামে কত ভালো শার্ট দেয় তা চার্ট তৈরী করতো। কেউ যেন তাকে ধমকানোর দুঃসাহস না দেখায় এই ভেবে সে সর্বদা শঙ্খিত থাকতো। কি করে টাকা দিয়ে কেনা শার্টের প্রতিটি পয়সা উশুল করা যায় এ নিয়েই তার সময় কাটতো। সে কারুর সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করতো না, মিশতো , না। সব সময় শুধু নিজেকে নিয়েই মগ্ন থাকতো নিজের ভালো ছাড়া অন্যকিছু সে ভাবতেই পারতো না। পাস করে বেরুনোর পর অন্য সবাই যখন হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে ঝালিয়ে নিচ্ছে, পরস্পর মতের আদান-প্রদান করে নিজেদের ভুলত্রুটি সংশোধন করে নিচ্ছিলো, সেই প্রাচীনপন্থী গোঁড়া স্বার্থপর ছাত্রটি কলেজের পরপর গোটা তিনেক সমাবর্তন উৎসবের কোনটাতেই আসার প্রয়োজন মনে করলো না- সে তখন জামা-কাপড়ের দোকানে চার্ট তৈরীর কাজে ব্যস্ত রইলো।.

◼ এভাবে নিজেকে গুটিয়ে রেখে মেলামেশা না কের সেই ছাত্রটি নিজেকে শুধু কুয়োর ব্যাঙে রূপান্তরিত করে ফেললো। মাঝখানে লাভের মধ্যে এটাই হল- সে জীবনে কোন উন্নতিই করতে পারলো না, লোকের অপ্রিয়ভাজন হয়ে ছোট পদেই কাটিয়ে দিতে হলো তাকে। সেখানে একই সঙ্গে পাসকরা অন্য বন্ধুরা দশ ধাপ এগিয়ে গেছে পদমর্যাদা এবং অন্যান্য বিষয়ে। জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় হওয়া ছাড়া অন্য কোন সঞ্চয় নেই আর।

◼ তারপর বক্তা একজন সফল সহপাঠীর বিষয়ে বলে গেলো। এই ছাত্রটি ছিলো হৃদয়বান, উদার। সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতো। নিজের বলে সব সময় আত্মকেন্দ্রিক ভাবনা ভাবতো না। সকলেই তাকে পছন্দ করতো, সে ছিলো উচ্ছাশসম্পন্ন। তাই সামান্য ড্রাফটম্যান থেকে জীবন শুরু করতেও ইতস্তত করেনি। কিন্তু সে সদা সর্বদা উন্নতির সোপান খুঁজেতো সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চাইতো। নিউইয়র্কে বিশ্ব-বাণিজ্য মেলা অনুষ্ঠিত হবার পূর্বে সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে একজন অংশীদার নিয়ে স্বাধীন ব্যবসা শুরু করলো। ফিলাডেলফিয়া ছেড়ে নিউইয়র্কে এলো, সে জানতো বাণিজ্য মেলাতে মেধা অনুযায়ী কাজের লোকের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। সেখানে গৃহনির্মাণ প্রকল্পের কন্ট্রাকটরি নিয়ে সে খুবই সুনাম অর্জন করে ফেললো। পরে টেলিফোন কোম্পানীর হয়ে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে দিলো, যাতে সবার মনোযোগ আকর্ষিত হল।

◼ সেই টেলিফোন কোম্পানীই প্রচুর টাকা মাইনে আর উচ্চপদ দিয়ে সেই ছেলেটিকে লুফে নিলো তার প্রতিষ্ঠানে।

◼ বক্তা যা বলেছিলো তার মূল সত্যগুলোই আমি বললাম এতক্ষণ। পূর্বে এই একই বক্তার তিন মিনিটের বক্তৃতা চলাকালীন সময়ে শ্রোতারা অধৈর্য-বিরক্ত হয়ে উঠেছিলো। অথচ মজার কথা হলো সেই একই বক্তার ঘটনাময় বর্ণনাবহুল বক্তৃতা চলেছিলো দশ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে। শ্রোতারা অধীর আগ্রহে তা শুনেছিলো।

◼ প্রত্যেক মানুষের পক্ষেই তার নিজের জীবনের ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু করার আছে। মানবতা গুণ-সমৃদ্ধ কোন ঘটনা বা উদাহরণময় বক্তৃতা শ্রোতাকে অনেক বেশি কাছে টানে, হৃদয়ে ছাপ ফেলতে সমর্থ হয়। বক্তাকে নিজের জীবনের ঘটনা থেকে উপাদান বেছে নিয়ে গল্পের ঢং-এ তা বলতে হবে। আর আমি বিশ্বাস করি প্রত্যেক মানুষেরই অভিজ্ঞতার স্বর্ণখনি রয়েছে নিজের মধ্যে যে তা উত্তোলন করতে জানেন এবং কেমন করে কাজে লাগাতে হয় তা জানেন, তিনি সফল হবেনই।

শ্রোতার মন জয় করার সহজ উপায় হল, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বক্তৃতার মাল-মশলা সংগ্রহ করা। ঘটনাগুলো সাধারণ বলে অবজ্ঞা না করা।

(ঙ) ব্যক্তিগত ভাবনাকে বিশ্বাসযোগ্য করার পরিচয় দিন

◼ যখনই হোক না কেন, যখন গল্প বলবেন তাতে জড়িত লোকজনদের সঠিক পরিচয় দিন এতে বক্তব্য খুবই চিত্তাকর্ষক ও আদরণীয় হয়ে ওঠে শ্রোতাদের কাছে। তবে আপনি যতদিন কোন কারণে নাম পরিচয় গোপন করার প্রয়োজন বোধ করেন, তাহলে ডাক নাম বা মিঃ স্মিথ জো, কিটস, ব্যাব বলে সম্বোধন করুন। অমুক তমুক বা সে ব্যবহার করার চেয়ে বড় বোকামি আর কিছুতেই হয় না। এতে শ্রোতারা বিরক্ত হয়-একঘেয় লাগে বক্তব্য।

◼ আমেরিকার একজন বিখ্যাত বক্তা একবার আমাকে বলেছিলেন, বক্তব্য বিষয় ও গল্পকে নাম-পরিচয়ে উল্লেখ অনেক বেশি মনোযোগী আর শ্রুতিমধুর করে তোলা এমন একটা গল্প পড়েছেন কি-যার নায়কের কোন নাম নেই।

আপনার বক্তৃতা শুনতে লোকে আগ্রহী হবে তখনই, যখন বিবিধ ঘটনা আর উদাহরণের মাল-মশলায় আপনার বক্তব্য প্রাণময় হয়ে উঠবে।

(চ) ঘটনাকে বিশ্বাসযোগ্য করুন

◼ ওপরের লেখাটা পড়েই আপনি মনে যা ভাবছেন সেটা হল- আমি কি করে তথ্য জোগাড় করবো? বা ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেবো আমার বক্তৃতায়, সেটা তো অসম্ভব মনে হচ্ছে মিঃ কার্ণেগী।

◼ এর একটা সুন্দর উপায় আছে। ফরমূলার সাহায্যে এটা সম্ভব হয়ে উঠবে আপনার কাছে। এই পদ্ধতি …. যার সাহায্য নেয় পৃথিবীর প্রায় সাংবাদিক। যেমন করে একজন সংবাদিক তার সংবাদের মাল-মশলা সাজিয়ে সংবাদ গল্প লেখে।

◼ এভাবে লিখতে বা ভাবতে শুরু করে সাংবাদিক। কে? কি? এবং কেন? কখন? কোথায়? যদি আপানি এই পদ্ধতির ছকে ফেলে আপনার জানা উদাহরণকে সাজাতে পারেন তাহলেই তা হয়ে উঠবে বর্ণনাময়, উজ্জ্বল আর প্রাণবন্ত।

আমি আমার জীবনের একটি ঘটনা বলছি— কলেজ থেকে বেরুনোর পর বছর দুয়েক আমি একটি বিখ্যাত কোম্পানীর ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছিলাম। আমাকে প্রায় সব সময়ই আমেরিকা চষে বেড়াতে হতো। সাধারণত ট্রেনে চড়েই বেশি ভ্রমণ করতাম আমি। একবার রেডভিল্ড এস.ডি স্টেশন দিয়ে যাচ্ছিলাম ট্রেনে চড়ে। পথে ঘন্টা দু’য়েকের বেশি সময় ট্রেনটি থামার কথা ছিল এই স্টেশনে। রেডভিল্ড জায়গাটা আমার কাজের সীমারেখার বাইরে থাকায় আমার পক্ষে বিক্রি বিষয়ক কাজ করা সম্ভব ছিলো না। হঠাৎ মনে হল, তাই তো, এক বছরের মধ্যে আমি তা আমেরিকান অ্যাকাডেমী অফ ড্রামাটিক আর্টস-এ পড়তে যাচ্ছি। তাই আমি ঠিক করলাম বাকি সময়টা অযথা নষ্ট না করে কথা বলার অভ্যাস করবো। আমি ট্রেন থেকে নেমে একটু নির্জনে হেঁটে গিয়ে ‘ম্যাকবেথ’ এর একটি দৃশ্য থেকে আবৃত্তি করতে শুরু করলাম অঙ্গভঙ্গি সহকারে, নাটকীয়ভাবে কণ্ঠস্বর ওঠানামার ঘাত-প্রতিঘাতে। কোন অংশে চেঁচিয়ে উঠলাম দুর্দমনীয় ক্রোধে, আবার কোথাও-বা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম নতজানু হয়ে। এমনি করে আমার ব্যক্তিত্বকে ভেঙ্গে চুরে ফেলে আমি সেই ঐতিহাসিক ম্যাকবেথে রূপান্তরিত হলাম। আমি ভুলে গেলাম পরিবেশ স্থান-কালপাত্র। হুঁশ ফিরলো চারজন পুলিশের কর্কশ কণ্ঠস্বরে। তারা আমার হাত চেপে ধরলো। জানতে চাইলো আমি চেঁচিয়ে কেন ভয় দেখাচ্ছি মেয়েদের। আমি খুব একটা অবাক হতাম না, যদি শুনতাম পুলিশ আমাকে পুরোটা ট্রেন ডাকাতির জন্য অভিযুক্ত করছে।

◼ তারাই আমাকে জানালো যে, একজন বাড়ির গৃহিনীর তার রান্না ঘরের পর্দার আড়াল থেকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করেছিলো। সে আমার কাছ থেকে একশো গজ দূরত্বে ছিল সে নাকি আমার মত বিপজ্জনক খুনী পাগলা দেখেনি-তাই ভয়ে ভীত হয়ে পুলিশে খবর দিয়েছে। ওরা আমাকে এও বললো ছুরি দিয়ে আমি কার যেন রক্তপাত করতে চাইছিলাম আর ছুরিটাই বা কোথায় লুকোলাম। আমি পুলিশদের যখন বললাম, আমি শেক্সপীয়রের ‘ম্যাকবেথ’ থেকে আবৃত্তি করা অনুশীলন করছিলাম- তারা মোটেই বিশ্বাস করলো না সে-সব। ছেঁদোকথা বলে হেসে উড়িয়ে দিলো- থানায় যাবার হাত থেকে রেহাই পেতে আমাকে আমার কোম্পানীর দেওয়া অর্ডার বই আর পরিচয়পত্র দেখিয়ে অনেক কষ্টে বাঁচাতে হয়েছিলো নিজেকে।

লক্ষ করুন, উপরের এই ক্ষুদ্র সত্য ঘটনা থেকেই আপিনি আপনার এ ফরমুলার পাঁচটি প্রশ্নের সদুত্তর পেয়ে যাবেন।

◼ তবে এটাও সত্য যে, বেশি খুঁটিনাটি বর্ণনার আবার অনেক সময় ভালো করার চেয়ে ক্ষতি করে বেশি। আমরা কষ্টকল্পিত ঘটনা আর তত উদ্দেশ্যবিহীন হাল্কা বর্ণনাতে বিরক্ত হই।

◼ তাই বক্তব্যকে বেশী মনোযোগী বর্ণনাবহুল করতে গিয়ে আপনার শ্রোতাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করবেন না যেন।

মোটকথা হল— বক্তব্যকে ঘটনাবহুল করতে হবে পরিমিতবোধ মেনে।

(ছ) সংলাপ যুক্ত করে আপনার কথা বলাকে নাট্যরসে সমৃদ্ধ করে তুলুন

ধরুন, আপনি একজন দোকানদার। নানারকম ক্রেতাকে সন্তুষ্ট রাখতে হয় আপনাকে, মিষ্টি কথা ভুলিয়ে অনুরোধ-উপরোধের মাধ্যমে। ধরুন আপনার একদিনের ঘটনার কথা বর্ণনা করছেন আমাদের, একদিন একজন মক্কেল বা খদ্দের প্রচণ্ড রেগেমেগে হৈ-চৈ বাঁধিয়ে তুললো, কারণ তার কাছে যে কাপড় ধোয়ার যন্ত্র বিক্রি করা হয়েছিলো তা কাজ করছিলো না। মাত্র এক সপ্তাহ আগে সেটি তার কাছে বিক্রি করা হয়েছিলো। আমি তার কাছে মার্জনা চেয়ে বললাম, এরপর আর কখনও এমন ভুল হবে না। আমি তার যন্ত্রটিকে তক্ষুণি সারিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়াতে খদ্দেরটি খুশি মনে চলে গেলো আর, আমরা উটকো ঝামেলার হাত থেকে বাঁচলাম।

◼ আপনার মুখ থেকে যে ঘটনাটি আমরা জানলাম তা যদিও সত্যি ঘটনা খুঁটিনাটি বিবরণও দিয়েছেন আপনি ভালো, তবুও কতকগুলো ত্রুটি রয়ে গেছে। যেমন: সত্যিকার নাম-ধাম, ঘটনার বিন্যাসের আগাগোড়া বিবরণ। সবচেয়ে যেটার বেশি অভাব ছিল তা হল সংলাপের অনুপস্থিতি, যা ওই সত্যিকার ঘটনাটিতে প্রাণ সঞ্চার করতে পারতো, এবারে সংলাপ জুড়ে দিয়ে ঘটনাটিকে কী রকম স্বাদ পালটে দেওয়া যায় দেখা যাক। বিশেষ ওই গুণকে কাজে লাগিয়ে অর্থ্যাৎ সংলাপ জুড়ে এবারে পুনরায় ঘটনাটিকে বিবৃত করা যাক।

◼ গত মঙ্গলবার আমি আমার দোকানের অফিস ঘরে বসে কাজ করছিলাম। এমন সময় দড়াম করে আমার ঝোলানো-দরজা খুলে গেলো। রাগে গরগর করতে করতে ঘরে ঢুকল চার্লস রাউস্ক।

◼ চার্লসের মুখ থমথমে, রক্তচাপে ফেটে পড়তে চাইছে যেন। দেখেই বুঝলাম, কিছু একটা গন্ডগোল বেঁধেছে কোথাও। চার্লস আমার অনেকদিনের পুরানো খদ্দের। আমি তাকে বলার আগেই ক্রুদ্ধ গর্জনে ফেটে পড়লো চার্লস। দেখো এড, অমর শেষ কথা বলছি, ভাল করে শোন। এক্ষুণি ট্রাক পাঠাও, লোক গিয়ে যেন আমার বাড়ি থেকে তোমার পঁচাধচা যন্ত্রটা নিয়ে আসে। না হলে হুলস্থুল করবো বলে দিলাম। জেনেশুনে একটা বাজে মাল আমাকে গছিয়েছো তুমি। “কি হয়েছে ব্যাপারটা বলবে?”

◼ ব্যাপার আবার কি? যন্ত্রটা খারাপ- চলছে না একদম। মাঝখান থেকে আমার আর স্ত্রীর একগাদা-জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফর্দাফাই। তোমার মত বদ লোকের দোকান থেকে আর কখনও কোনও জিনিস কিনছি না আমি। এই শেষ কথা শেষ করেই টেবিলে প্রচণ্ড জোরে চাপড় মারলো চার্লস- আমার স্ত্রীর ফটোটা হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিলো রাগে।

◼ একটু ঠাণ্ডা হয়ে বসো চার্লস। ঘটনাটা ঠাণ্ডা মাথায় খুলে বলো আমাকে আমি আমার যতদূর সাধ্য তোমার জন্য করার চেষ্টা করবো। আমার এ কথায় চার্লস একটু ইতস্তত করে বসার পর বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমি তাকে শান্ত করলাম।

◼ হয়তো সব সময় কথা বলার ফাঁকে সংলাপ রাখা সম্ভবপর নয়, তবে এটা ঠিক ভালোভাবে সংলাপ ব্যবহার করতে পারলে গল্পের বা ঘটনার মেজাজই পুরো পালটে যাবে।

◼ পুরো বক্তব্য একটা নাটকীয় আমেজ তৈরী করে দেবে। দৈনন্দিন জীবনের ফাঁকে কত সংলাপই না ব্যবহার করি আমরা! সংলাপ কাজে লাগাতে জানলে, আপনি কি খাবার . টেবিলে, কি জ্ঞানী-গুণীর সভায় অথবা মাইক্রোফোনের সামনে বক্তব্য রাখার সময়, সঠিক ও পরিমিত সংলাপ আপনার বক্তব্য জনপ্রিয় করে তুলবে অতি সহজেই।

বক্তৃতাকে কোন ঘটনার বর্ণনা দেবার সময় এমনভাবে আবেদন তৈরী করুন, যাতে দর্শকরা চোখের সামনে তা দেখতে পায়।

◼ একবার একজন পৃথিবীবিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন, মানুষ সারাজীবনে যতটা শেখে তার শতকরা পঁচাশি ভাগই শেখে চোখ দিয়ে যা দেখে তা থেকে। টেলিভিশনের জনপ্রিয়তাই তার উজ্জ্বল প্রমাণ! জনসাধারণের সামনের কথার বলার ক্ষমতটা শব্দগ্রাহ্য এবং দৃশ্যগ্রাহ্য করে তুলতে পারাটাই হল বক্তার সবচেয়ে বড় সফলতা। যিনি তা পারবেন- তিনিই কর্মক্ষেত্রে জয়ী হবেন। সাফল্যের বরমাল্য তাঁর জন্য অপেক্ষা করবেই করবে।

◼ একবার আমাদের যন্ত্রসম্পর্কিত শিক্ষাক্রমে একজন যন্ত্রবিশারদ বড় সুন্দর বক্তব্য রেখেছিলেন। আজও তা আমার চোখে লেগে আছে। হাত-পা-চোখ মুখকে কাজে লাগিয়ে মুকাভিনয়, মাঝে মাঝেই তাঁর বক্তব্যকে গতিময় করে তুলেছিলেন পশু-পাখির ডাকের সাহায্যে। তাতে বক্তার প্রতিটি কথাই শ্রোতারা যেন গিলছিলো।

◼ এখানে শ্রোতাকে প্রভাবতি করেছিল যেটা, সেটা হল বক্তা তাঁর বক্তব্যকে দৃশ্যগ্ৰহ্য করতে তুলতে পেরেছিলেন। তাহলে এ পর্যন্ত যা শেখা হল তার মূল কথা হল- আপনি কি করে আপনার বক্তব্যকে দৃশ্যগ্রাহ্যকরে তুলবেন।

◼ তাহলে হাত-পা-চোখ-মুখের সহজ ভঙ্গি দিয়ে বক্তব্যকে বুঝিয়ে বলার অভ্যাস করুন— এমন শব্দ ও ভাবের সাহায্য নিন যা বক্তৃতা বিষয়কে দর্শকের দরবারে দৃশ্যগ্রাহ্য করে তুলতে সহায়ক হবে।

একটি প্রাচীন প্রবাদ মনে রাখুন সর্বদা। একটি সার্থক ছবি দশ হাজার শব্দ দিয়ে লেখা বিবরণীর চেয়েও বেশি দামী।

(জ) দর্শকের কাছে, শ্রোতার চোখে, শব্দ দিয়ে ছবি আঁকার জন্য সহজ পরিচিতির যথার্থ কথা খুঁজে নিন

◼ সাধারণত বেশির ভাগ বক্তাই একটি বিষয়ে প্রায়শই ভুল করে। অথচ সেই ভুলের মাশুল গুণতে গিয়ে শ্রোতার মন জয় করার কাজে ব্যর্থ হয়, অসফল হয়। সেই সূত্রটি পালন করলে, ঠিকমত অনুশীলন করে কাজে লাগাতে জানালে ম্যাজিকের মতোই ফললাভ হয়। জেনেশুনে অনেকে অবহেলা করেন পুরো ব্যাপাটা নিয়ে। এবারে ব্যাপারটাতে আসছি। কিছুই নয়, এমন শব্দ শ্রোতাদের কাছে বলুন, যা তৎক্ষণাৎ চোখের সামনে সুন্দর করে ছবি এঁকে দিতে পারে আপনার নিঃশ্বাসে বাতাস টানার মতই সহজ সরল সুন্দর শব্দের ছবি ছড়িয়ে দিন দর্শক শ্রোতার চোখের পদাতে। তাহলেই আপনার বক্তৃতা হয়ে উঠবে অধিক মনোরঞ্জনকারক আর অত্যধিক প্রভাবকারী।

◼ হার্বাট স্পেন্সার তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ফিলজফী অফ স্টাইলে অনেকদিন পূর্বেই লিখেছিলেন, কিভাবে শব্দ প্রয়োগের কৌলিন্যে উজ্জ্বল, বর্ণাঢ্য ছবি আঁকা সম্ভব।

◼ যেমন সাদামাটা প্রাণহীন বক্তব্য বিরক্তিই বাড়ায় শুধু। নিচের লেখার এ ধরনের বাক্যের ব্যবহার বর্জন করাই শ্রেয়। যেমন :
‘কোন জাতির আচার-আচরণ আদব-কায়দা এবং আনন্দ প্রকাশের ভঙ্গির তারতম্য অনুসারে বিচার করা যেতে পারে যে তারা কতটা নিষ্ঠুর পৈশাচিক বা বর্বর। জাতীয় দন্ডবিধিতে এ ধরনের নৈতিক আচরণের জন্য কঠোর, কঠিন ও ভয়ঙ্কর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।’

◼ উপরের লেখার পরিবর্তে আমরা নিচে এভাবে লিখতে পারি। যেমন : ‘যদি কোন জাতি প্রকাশ্য দিবালোকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় বা ষাঁড়ে-মানুষের লড়াই নিয়ে মাতামাতি করে বা গ্ল্যাডিয়েটরদের হিংস্র লড়াইতে আনন্দ খোঁজে তাহলে তাদের অপরাধজনিত আনন্দ বিনোদনের তারতম্য অনুসারে যথাক্রমে জাতীয় দন্ডবিধিতে ফাঁসি, আগুনে মারা যায় যন্ত্রণাদায়ক কঠোর শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা করা হবে’।

এভাবে আমরা অসংখ্য চিত্রকল্পী শব্দের ব্যবহার পাবো বাইবেল ও শেক্সপীয়রের রচনাবলীতে। যেমন : পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার এক জায়গায় লিখেছেন—

‘পরিশোধিত স্বর্ণকে অনাবশ্যক অলঙ্করণ করতে নেই, লিলি ফুলের উপর তুলি চালানে নিরর্থক এবং ভায়োলেট পুষ্পের ওপর সুগন্ধি নির্যাস ঢালার মত বোকামী করা একমাত্র মুর্খেরই সাজে।’

এভাবে সুদুর অতীতের দিকে যদি আমরা একবারও ফিরে তাকাই, তাহলে অনেক অনেক উজ্জ্বল গন্ধময় প্রবাদ বাক্যের আস্বাদ পাবো আমরা। উদাহরণ দিচিছ :

  • (১) নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো
  • (২) শিয়ালের চেয়ে ধূর্ত
  • (৩) পাথরের মত শক্ত
  • (৪) আপনি বাঁচলে বাপের নাম
  • (৫) যত গর্জে তত বর্ষে না
  • (৬) অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী

কত অর্থবহ ওপরের প্রতিটি প্রবাদ।

প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন একবার বলেছিলেন-

‘যখন আমি কোন লোককে একটি ঘোড়া কেনার জন্য পাঠাই, তখন ঘোড়ার ল্যাজে কতগুলো লোম’ আছে জানতে চাইনা। শুধু তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় মূল সূত্রগুলোই জানতে চাই।’

◼ আপনার বক্তব্যের আবেদন যেন নিদিষ্ট এবং স্থির হয়, এটাই লক্ষ রাখবেন সর্বদা। যেমন : ধরুন, ‘কুকুর’ শব্দটি বললেই একটি ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু আরও ভালো ছবি ফুটে উঠবে শ্রোতার কাছে যদি বলি পা ভেঙে যাওয়া খোঁড়া সেই বুলডগটি। শুধু ‘ঘোড়া’ বলার চেয়ে বেশি ফল হবে যদি বলি সাদা প্রাণিটা বড় প্রভুভক্ত ঘোড়া। শুধু ‘পেঁচা’ না বলে যদি বলি ‘কালো অন্ধ পেঁচা’ ডাকছে, তাহলে অনেক বেশি চিত্রধর্মী হবে। উইলিয়াম ট্রাঙ্ক ‘দি এলিমেন্টস অফ ষ্টাইডল’ নিবন্ধে লিখেছিলেন- শ্রোতার মন জয় করার সহজ উপায় হল, নির্বাচিত সঠিক চিত্রধর্মী শব্দের প্রয়োগ। হোমার দান্তে, শেক্সপীয়র তাঁরা যে মহৎ সৃষ্টি করতে পেরেছে তার মূল কারণ হিসেবে বলা যায়, অসাধারণ চিত্রকল্পতা-নাটকীয়তা। তাঁদের লেখাগুলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই চোখের সামনে সে দৃশ্যগুলো ভেসে ওঠে। লেখা বা বলার উৎকর্ষ সাধনের এটাই হল সত্যি কথা।

কথা বলার বিমূর্ত ভঙ্গি খুবই খারাপ। এ যেন লোহা-লক্কর, ইট-পাথর চেয়ার টেবিল, জীবজন্তু মানুষ আর স্ত্রীলোক প্রসঙ্গ নিয়েই সর্বক্ষণ বকর বকর করার মতন হয়ে য দাঁড়ায়— বলেছিলেন একজন বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক।

◼ একথা দৈনিন্দিন জীবনের প্রতিটি কথা বলার মাঝেও সমান অর্থবহ এবং চরম সত্য। এ পর্যন্ত বিষদভাবে আলোচনা করলাম, কেমন করে কীভাবে প্রাণবন্ত ঝকঝকে বক্তৃতা করা যায়। যদি কেউ নিজেকে বিতর্কিত ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক বক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান তাহলে উপরোক্ত নির্দেশ-উপদেশকে ধর্মীয় অনুশাসনের মত অনুশীলন করুন। শুধুমাত্র পড়ার জন্য পড়বেন না, আন্তরিক ইচ্ছার সঙ্গে পড়ুন। বারবার পড়ুন, যতক্ষণ না ক্লান্তি আসে। আপনি যদি বিক্রয় প্রতিনিধি হন- ব্যবসা বাড়াতে না পেরে অসফল হন তাহলে এই বইয়ের প্রতিটি নির্দেশ-উপদেশ যথাযথ পালন করুন। দেখবেন, অতি দ্রুত আপনি ম্যাজিকের মতই ফল পাবেন।

◼ যারা পদমর্যাদায় অফিসার বা বাড়ির গৃহবধু বা স্কুল শিক্ষক, তাঁরাও উপরে বর্ণিত শিক্ষা থেকে স্থায়ী ফল পাবেনই পাবেন।

◼ আপনি একনাগাড়ে অনেকক্ষণ ধরে ধৈর্য্য সহকারে এই বই পড়ে চলেছেন, এখন একটু বন্ধ করুন। বইতে চিহ্ন দিয়ে পাশে মুড়ে রাখুন। আরাম করে বসুন। বিশ্রাম করুন। এই বইতে লেখা নিয়মগুলো কেমন করে কিভাবে কাকে কোথায় প্রয়োগ করা যায় এ সম্পর্কে ভাবুন। আমি একটা কথা বলবো? বলছিলাম কি আপনার সবচেয়ে কাছে যিনি আছেন তাঁর উপরই প্রথমে এই উপায়গুলো প্রয়োগ করে দেখুন।

(এখন আপনি আছেন পর্ব-৩ এ)

পর্ব-১ : https://khamarian.com/বক্তব্যে-শ্রোতার-মন-জয়/

পর্ব-২ : https://khamarian.com/কিভাবে-আত্মবিশ্বাস-বাড়া/

পর্ব-৩ : https://khamarian.com/কথা-বলার-দক্ষতা-অর্জন-করু/

পর্ব-৪ : https://khamarian.com/সজীব-প্রাণবন্ত-কথা-বলুন/

পর্ব-৫ : https://khamarian.com/শ্রোতা-সঙ্গে-ভাব-বিনিময়/

পর্ব-৬ : https://khamarian.com/যা-বলতে-চান-গুছিয়ে-বলার-চ/

পর্ব-৭ : https://khamarian.com/কথায়-যোগাযোগ-স্থাপনের-ক/

পর্ব-৮ : https://khamarian.com/কথা-বলার-চ্যালেঞ্জ-গ্রহণ/

পর্ব-৯ : https://khamarian.com/কিভাবে-দীর্ঘক্ষণ-কথা-বলা/

সমাপ্তঃ আজকরে আলোচ্য বিষয় “কথা বলার দক্ষতা অর্জন করুনঃ বক্তব্যে শ্রোতাদের মন জয় করা সহজ উপায়, একজন সফল বক্তা হওয়ার উপায়, বক্তব্য ওয়ার নিয়ম ও ভাষণ দেওয়ার নিয়ম, কথা বলার কৌশল, কথা বলার জড়তা দূর করার উপায় (পর্ব-৩, লেখকঃ ডেল কার্নেগী, বই অনুবাদ)।” পরবর্তী পোষ্ট পড়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে এই পোষ্টটি এখানেই সমাপ্ত করা হলো।

Copyright Notice

কপি করা নিষিদ্ধ!