আজকের পোষ্টটিতে আমার আলোচনা করব- কবুতর পালন পদ্ধতির ধারাবাহিক বর্ণনা ও জানব কবুতর পালন করা লাভজনক কেন? কবুতর পালন পদ্ধতি ছাদে ও খামারে সহ। আমি এ সম্পর্কে যা সবটুকু আপনাদের প্রদান করার চেষ্টা করব ইংশাল্লাহ। আশা করি শেষ অবধি পড়বেন।
আজকে আমরা আলোচনা করবঃ
কবুতর পালন করা লাভজনক কেন?
- কবুতর পালন করার জন্য অতিরিক্ত কোনো খরচ হয় না।
- কবুতরকে সহজেই পোষ মানানো যায়।
- বাড়ির যেকোনো কোণ বা আঙিনা অথবা বাড়ির ছাদ কিংবা কার্নিশের মতো ছোট বা অল্প জায়গাতে ও কবুতর পালন করা যায়। এমনকি ছাদের সঙ্গে ঝুড়ি ঝুলিয়েও কবুতর পালন করা সম্ভব।
- কবুতরের মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু এবং শক্তি বর্ধক।
- অন্যান্য পাখির মাংসের চাইতে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি। ফলে আমিষের পাশাপাশি বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্যেও কবুতরের মাংস খাওয়া হয়ে থাকে।
- বাণিজ্যিকভাবে কবুতর পালন করে অনেকেই অল্প সময়ে লাভ জনক ব্যবসা হিসেবে দাঁড় করাতে পেরেছেন।
- কবুতর সাধারণভাবে জোড়ায় বেঁধে বাস করে। প্রতি জোড়ায় একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী কবুতর থাকে।
- এরা ১২ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত বাঁচে। যতদিন বেঁচে থাকে ততদিন এরা ডিমের মাধ্যমে বাচ্চা প্রজনন করে থাকে।
- ডিম পাড়ার পর স্ত্রী ও পুরুষ উভয় কবুতরই পর্যায়ক্রমে ডিমে তা দেয়।
- কবুতরের কোনো জোড়া হঠাৎ ভেঙে গেলে সেই জোড়া তৈরি করতে কিছুটা বেগ পেতে হয়
- নতুন জোড়া তৈরি করার জন্য স্ত্রী ও পুরুষ কবুতরকে একঘরে কিছুদিন রাখতে হয়।
কবুতর পালনের ইতিহাসঃ
মানুষ ও কবুতরের সম্পর্ক অতি প্রাচীন। হাঁস-মুরগির মত কবুতর পালনের সূচনা কবে থেকে তা সঠিক জানা যায়না। তবে আদিকালে দেব দেবীর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ ছাড়াও সংবাদপত্র প্রেরণ ও সুস্বাদু মাংসের জন্য কবুতরের প্রচলন ছিল। জনশ্রুতি আছে যে, বাদশা সোলাইমান (আঃ) প্রায় ৯৫০ খৃষ্টপূর্বে সংবাদ প্রেরণের কাজে কবুতর ব্যবহার করতেন। পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা এবং ভারত বর্ষে মোগল সম্রাটদের আমলে কবুতর সমাদরের সাথে পালনের ইতিহাস জানা যায়। বাংলাদেশের সিলেটে হজরত শাহ জালাল (রাঃ) সঙ্গে করে যে কবুতর নিয়ে এসেছিলেন তা আমাদের দেশে জালালী কবুতর নামে পরিচিত।
কবুতর পালনের সুবিধাঃ
→ কবুতরের মাংস অত্যন্ত সুস্বাদু ও বলকারক হিসেবে সদ্যরোগ মুক্ত ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
→কবুতর ছয় মাস বয়স থেকেই ডিম দিয়ে থাকে এবং প্রতি মাসে গড়ে দুইটি বাচ্চা দেয় ।
→ কবুতর পোষার মাধ্যমে সামান্য ব্যয়ে উৎকৃষ্ট মাংস সংস্থানের সাথে সাথে দু’পয়সা আয়ের পথ অতি সহজেই করে নেয়া যায়।
→ জন্মের প্রথম ১০ দিন পর্যন্ত সাধারণত কবুতরের বাচ্চাকে খাদ্য দেয়ার প্রয়োজন হয়না। কারণ এসব বাচ্চা মায়ের খাদ্য থলির দুধ জাতীয় বস্তু খেয়ে বেঁচে থাকে।
→ কবুতর নিজেরাই নিজেদের খাবার সংগ্রহ করে খায়। তাই কবুতর পোষায় খাদ্য খরচ নাই বললেই চলে।
→ কবুতর পালন আনন্দদায়ক। তাই পরিবারের ছেলে- মেয়েরা সহজেই কবুতর পালন করতে পারে।
→ কবুতর সহজেই পোষ মানে এবং ঘরের ছাদে ও বাড়ির আঙ্গিনায় সহজেই পালন করা যায়।
→ প্রধানত মাংস ও চিত্তবিনোদনের জন্য কবুতর পোষা হয়।
কবুতরের বহিঃদেহের বিভিন্ন অংশ : কবুতরের বহিঃদেহের বিভিন্ন অংশ অন্যান্য পাখির মতই। একটি কবুতরের বহিঃদেহের বিভিন্ন অংশ দেখানো হল ।
চিত্র- কবুতরের বহিঃদেহের বিভিন্ন অংশ
কবুতরের জাত পরিচিতঃ
বিশ্বে বহু জাতের বহু বিচিত্র কবুতর দেখা যায়। আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি জাতের কবুতর রয়েছে। যেমন- জালানি, শিরাজি, গিরীবাজ, গোলা, লোটন, সিলভার কিং, হোয়াইট কিং ইত্যাদি। এসব জাতের মধ্যে থেকে প্রধান কয়েকটি জাত সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :

১. গোলা (Golas) কবুতরের জাত
→ এ জাতের কবুতর সাধারণত বিভিন্ন সেডযুক্ত ধূসর বর্ণের হয়ে থাকে।
→ এদের চোখের উপতারা গাঢ় লাল বর্ণের হয়। এছাড়া পায়ের রংও লাল বর্ণের হয়।
→ গোলা জাতের কবুতরের উৎপত্তিস্থল পাক-ভারত উপমহাদেশে। সম্রাট আকবরের সময় থেকে এই কবুতর পোষার প্রসার লাভ করে। আমাদের দেশে গোলা কবুতর দেখা যায় ।
→ ঘরের আশেপাশে এদের জন্য খোপের ব্যবস্থা করলে এরা আপনা থেকে এসে বসবাস করে।

২. টাম্বলার/গিরিবাজ কবুতরের জাত
→ এরা শূন্যের উপর চমৎকার ডিগবাজী খায়।
→ মনোরঞ্জনের জন্য আমাদের দেশে এদের যথেষ্ট কদর রয়েছে।
→ তবে ধর্মীয় বিধি নিষেধের জন্য মুসলমান ধর্মালম্বরা এ জাতের কবুতর খায়না।
→ এ জাতের কবুতর আকাশে ডিগবাজী খায় বলে এদের টাম্বলার বলে। আমাদের দেশে এ জাতটি গিরীবাজ নামে পরিচিত।
→ এরা উড়তে উড়তে আকাশের গভীরে প্রায় হারিয়ে যায় কিন্তু যথাসময়ে আবার ফিরে আসে।

৩. লোটন (Lotan / Lowtan) কবুতরের জাত
→ লোটন কবুতরকে রোলিং কবুতরও বলা হয়। দেশে বিদেশের কবিদের ছড়া ও কবিতায় এই লোটন কবুতর নিজ গুণে স্থান পেয়েছে।
→ গিরীবাজ কবুতর যেমন শূণ্যের উপর ডিগবাজী খায়, তেমনি লোটন কবুতর মাটির উপর ডিগবাজী খেয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জন করে।
→ প্রধানত সাদা বর্ণের এই কবুতরের ঘুরানো ঝুঁটি রয়েছে। এদের চোখ গাঢ় পিঙ্গল বর্ণের হয় এবং পা লোমযুক্ত।

৪. লাহরী (Lahore) কবুতরের জাত
→ লাহোরী কবুতর একটি এশিয়াটিক জাত এবং এদের উৎপত্তিস্থল বলে নামকরণ লাহোরী হয়েছে। আমাদের দেশের এই কবুতরটি শিরাজী কবুতর হিসেবে পরিচিত।
→ এদের চোখের চারিদিক থেকে শুরু করে গলার সম্মুকভাগে, বুক, পেট, নিতম্ব, পা ও লেজের পালক সম্পূর্ণ সাদা হয় এবং মাথা থেকে শুরু করে গলার পিছন দিকে ও পাখা রঙ্গীন হয়।
→ সাধারণত কাল, লাল, হলুদ, নীল, রূপালী ইত্যাদি বর্ণের এই কবুতর দেখা যায়।

৫. কিং (Kings) কবুতরের জাত
→ ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ডাচেস (Duches), মোনডেইন (Mondain), মালটেজ (Maltese) এবং রেসিং (Racing) হোমার জাত থেকে কিং জাতের উৎপত্তি আমেরিকায়।
→ কিং জাতের কবুতরের মধ্যে হোয়াইট কিং ও সিলভার কিং আমেরিকাসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলিতে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
→ হোয়াইট কিংয়ের দু’টি উপজাতের মধ্যে একটি প্রদর্শনীতে এবং অন্যটি স্কোয়াব উৎপাদনে ব্যবহার হয়।
→ অনুরূপ সিলভার কিং কবুতরও প্রদর্শন ও স্কোয়াব উৎপাদনে ব্যবহার হয়।
→ এছাড়া রয়েছে ব্লু-রেড এবং ইয়েলো কিং।
→ এই জাতের কবুতর মূলত প্রদর্শনে ব্যবহার হয়।
কবুতর পালন পদ্ধতিঃ
নিচে ধারাবাহিক ভঅবে কবুতর পালন পদ্ধতির বর্ণনা দেওয়া হলো।
কবুতরের ঘর তৈরিঃ
- ভালো বাসস্থান কবুতর পালনের জন্য খুবই দরকারী। উত্তম নিষ্কাশন, পর্যাপ্ত সূর্যের আলো এবং বাতাস চলাচল আছে এরকম উঁচু এবং বালুময় মাটিতে কবুতরের ঘর করতে হয়। যা খামারির আবাসস্থল থেকে ২০০ থেকে ৩০০ ফুট দুরে ও দক্ষিণমূখী হওয়া উচিত।
- মাটি থেকে ঘরের উচ্চতা ২০ থেকে ২৪ ফুট এবং খাচার উচ্চতা ৮ থেকে ১০ ফুট হওয়া ভালো।
- একটি খামারের জন্য ৩০ থেকে ৪০ জোড়া কবুতর আদর্শ।
- কবুতরের খোপ ২ বা ৩ তলা বিশিষ্ট করা যায়। খোপের মাপ প্রতিজোড়া
- ছোট আকারের কবুতরের জন্য ৩০ সে. মি ×৩০ সে.মি. × ২০ সে.মি. এবং বড় আকারের কবুতরের জন্য ৫০ সে. মি. × ৫৫ সে.মি. × ৩০ সে.মি.।
- অল্প খরচে সহজে ঘর তৈরি এবং স্থানান্তরযোগ্য যা কাঠ, টিন, বাঁশ, খড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা যায়।
- খামারের ভিতরে নরম, শুষ্ক খড়-কুটা রেখে দিলে তারা ঠোঁটে করে নিয়ে নিজেরাই বাসা তৈরি করে নেয়।
- ডিম পাড়ার বাসা তৈরির জন্য ধানের খড়, শুকনো ঘাস, কচি ঘাসের ডগাজাতীয় উপাদান দরকার হয়।
- খোপের ভিতর মাটির সরা বসিয়ে রাখলে কবুতর সরাতে ডিম পাড়ে এবং বাচ্চা ফুটায়।
- সাধারণত একটি ভালো জাতের কবুতর বছরে ১২ জোড়া ডিম দিতে সক্ষম। এই ডিমগুলোর প্রায় প্রতিটি থেকেই বাচ্চা পাওয়া যায়। এই বাচ্চা ৪ সপ্তাহের মধ্যেই খাওয়া বা বিক্রির উপযোগী হয়।
- একটি পূর্ণাঙ্গ বয়সের কবুতর ডিম দেবার উপযোগী হতে ৫ থেকে ৬ মাস সময় লাগে।
- কবুতরের ডিম থেকে মাত্র ১৮ দিনেই বাচ্চা সাধারণ নিয়মে ফুটে থাকে। এই বাচ্চাই ৫ থেকে ৬ মাস পরে নিজেরাই ডিম প্রদান শুরু করে। ফলে কবুতর বংশ পরম্পরায় প্রাকৃতিক নিয়মে নিজেরাই বাড়াতে থাকে নিজেদের সংখ্যা।
- দেশি কবুতরের মাংস প্রচুর চাহিদা রয়েছে। একটি খুব ভালো প্রজাতির কবুতর লালন করলে ১ বছরের মধ্যে সেই জোড়া থেকে কয়েক জোড়া কবুতর পাওয়া খুব বেশি আশ্চর্যজনক বিষয় নয়।
কবুতরের খাদ্যঃ
→ সাধারণত প্রতিটি কবুতর দৈনিক ৩৫-৫০ গ্রাম খাদ্য খায়। তাই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কবুতর উৎপাদনের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুষম খাদ্য খাওয়াতে হবে।
→ কবুতর প্রধানত শস্যদানা যেমন— গম, মটর, খেসারি, ভূট্টা, সরিষা, কলাই, ধান, চাউল, কাউন ইত্যাদি খেয়ে থাকে ।
→ মুক্ত অবস্থায় পালিত কবুতর নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী শস্যের মাঠ থেকে খাদ্য খেয়ে আসে। তবে সকাল বিকেল মাথা পিছু আধ মুঠ শস্যদানা নির্দিষ্ট খাদ্যের পাত্রে রেখে দিলে প্রয়োজনমত তারা খেতে পারে।
কবুতরের প্রজনন, ডিম উৎপাদন ও ডিম ফুটানোঃ
- হাঁস-মুরগির মতো যে কোনো মর্দা কবুতর মাদী কবুতরের সঙ্গে সহজে জোড়া বাঁধে না। এদেরকে একসঙ্গে ১ সপ্তাহ রাখলে জোড়া বাঁধে।
- ডিম পাড়ার পর থেকে মর্দা ও মাদী কবুতর পর্যায়ক্রমে ডিমে তা দিতে শুরু করে।
- মাদী কবুতর প্রায় বিকেল থেকে শুরু করে পরের দিন সকাল পর্যন্ত ডিমে তা দেয় এবং বাকী সময়টুকু অর্থাৎ সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত মর্দা কবুতর তা দিয়ে থাকে।
- তা দেয়ার পঞ্চম দিনেই ডিম পরীক্ষা করে উর্বর বা অনুর্বর ডিম চেনা যায়। আলোর সামনে ধরলে উর্বর ডিমের ভিতর রক্তনালী দেখা যায়। কিন্তু অনুর্বর ডিমের ক্ষেত্রে ডিমের ভিতর স্বচ্ছ দেখাবে।
- জন্মের প্রথম দিন থেকে ২৬ দিন বয়স পর্যন্ত কবুতরের বাচ্চার ক্রমবর্ধমান অবস্থা থাকে। প্রথমে সারা দেহ হলুদ পাতলা বর্ণের লোম দিয়ে ঢাকা থাকে। এই সময় নাক ও কানের ছিদ্র বেশ বড় দেখায়। প্রায় ৪-৫ দিন পর বাচ্চার চোখ খোলে বা ফুটে। ১৫ দিনে সমস্ত শরীর পালকে ছেয়ে যায়। প্রায় ১৯-২০ দিনে দু’টো ডানা এবং লেজ পূর্ণতা লাভ করে ও ঠোঁট স্বাভাবিক হয়। এই ভাবে ২৬- ২৮ দিনে কবুতরের বাচ্চা পূর্ণতা লাভ করে ।
কবুতরের খাবারঃ
- হাঁস-মুরগির মতো কবুতরের খাবারে শ্বেতসার, চর্বি, আমিষ, খনিজ, ভিটামিন প্রভৃতি থাকা প্রয়োজন।
- কবুতর তার দেহের প্রয়োজন এবং আকার অনুযায়ী খাবার খায়। প্রতিটি কবুতর দৈনিক প্রায় ৩০-৫০ গ্রাম পর্যন্ত খাবার খেয়ে থাকে।
- প্রধানত গম, মটর, খেশারী, ভুট্টা, সরিষা, যব, চাল, ধান, কলাই ইত্যাদি শস্যদানা খেয়ে থাকে।
কবুতরের খাদ্য তালিকাঃ
- বাণিজ্যিকভিত্তিতে কবুতর উৎপাদনের জন্য নিচে দেওয়া খাদ্য মিশ্রণ ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয় যাবে।
- খাদ্য উপাদান ও পরিমাণ : ভুট্টা ৩৫%, মটর ২০%, গম ৩০%, ঝিনুকের গুঁড়া/চুনাপাথর চূর্ণ/অস্থিচূর্ণ ০৭%, ভিটামিন/ এমাইনো এসিড প্রিমিক্স ০৭% ও লবণ ০১%।
- এর সঙ্গে কবুতরের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে হবে। এক পাত্রে কবুতরের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার ও অন্য পাত্রে প্রয়োজন মতো পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ ঠান্ডা পানি রাখতে হবে।