🛑নাস্তিক মুক্তমনার প্রশ্নঃ
কা’বায় এক সময় ৩৬০টি মূর্তি ছিল। যেখানে এক সময় মূর্তিপুজা হয়েছে তা কী করে একত্ববাদী ইবাদতের কেন্দ্র হয়?
🔷উত্তরঃ
মুহাম্মাদ(ﷺ) এর আগমনের পূর্বে কা’বায় মূর্তিপুজা হত এই ইতিহাসকে ব্যবহার করে দ্বীন ইসলামের একত্ববাদী চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করে খ্রিষ্টান লেখক ও নাস্তিক-মুক্তমনারা। কা’বায় এক সময় মূর্তিপুজা হত এমনকি সেখানে এক সময় ৩৬০টি মূর্তিও স্থাপন করা হয়েছিল – সত্য। কিন্তু এটাই কা’বার প্রাচীনতম ইতিহাস নয়। কা’বা মোটেও মূর্তিপুজার জন্য স্থাপন করা হয়নি বরং এর স্থাপনের উদ্যেশ্য ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। কা’বা নির্মাণ করেন তাওহিদের(একত্ববাদ) দাওয়াহর মহানায়ক আল্লাহর নবী ইব্রাহিম(আ.) এবং তাঁর পুত্র ইসমাঈল(আ.)। আল কুরআনে বলা হয়েছেঃ
وَإِذۡ يَرۡفَعُ إِبۡرَٲهِـۧمُ ٱلۡقَوَاعِدَ مِنَ ٱلۡبَيۡتِ وَإِسۡمَـٰعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ (١٢٧) رَبَّنَا وَٱجۡعَلۡنَا مُسۡلِمَيۡنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَآ أُمَّةً۬ مُّسۡلِمَةً۬ لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبۡ عَلَيۡنَآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ (١٢٨) رَبَّنَا وَٱبۡعَثۡ فِيهِمۡ رَسُولاً۬ مِّنۡہُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡہِمۡ ءَايَـٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَـٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَيُزَكِّيہِمۡۚ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ (١٢٩)
অর্থঃ “ স্মরণ কর, যখন ইব্রাহিম ও ইসমাঈল কা’বাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল। তারা দোয়া করেছিলঃ আমাদের প্রভু! আমাদের থেকে কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ।
হে আমাদের প্রভু, আমাদের উভয়কে আপনার আজ্ঞাবহ করুন এবং আমাদের বংশধর থেকেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি করুন, আমাদের হজের রীতিনীতি বলে দিন এবং আমাদের ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই আপনি তাওবা কবুলকারী, দয়ালু।
হে আমাদের প্রভু, তাদের মধ্যে থেকেই তাদের নিকট একজন রাসুল প্রেরণ করুণ যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন। এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান। ” [13]
এমনকি ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থেও কা’বার কথা উল্লেখ আছে এবং তাদের ধর্মগ্রন্থ থেকেই প্রমাণ করা যায় যে ইব্রাহিম(আ.) মক্কায় এসেছিলেন। [14] কালক্রমে ইব্রাহিম(আ.) ও ইসমাঈল(আ.) এর বংশধর মক্কার আরবরা একত্ববাদী ধর্ম ছেড়ে বিভিন্ন কাল্পনিক দেবতার মূর্তি সহকারে পুজা শুরু করে এবং কা’বাগৃহেও মূর্তি স্থাপন করে। ইব্রাহিম(আ.) এর দোয়ার ফসল নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) আগমন করে তাদেরকে পুনরায় একত্ববাদী ইসলামের দিকে আহ্বান করেন এবং কা’বা ঘরকে মূর্তিমুক্ত করে এক আল্লাহর উপাসনার গৃহে পরিনত করেন ঠিক যেমনটি ইব্রাহিম(আ.) এর সময়ে ছিল। এটিই হচ্ছে কা’বাগৃহের ইতিহাস। [15] অর্থাৎ মূর্তিপুজা ছিল ইব্রাহিম(আ.) এর পরবর্তী লোকদের নব উদ্ভাবন ও পথভ্রষ্টতা। কা’বা নির্মাণের সাথে এর কোন সম্পর্কে নেই এবং এই ইতিহাস মোটেও কা’বাকে মূর্তিপুজার মন্দির প্রমাণ করে না।
এরপরেও যদি খ্রিষ্টান মিশনারীরা অপতর্ক করতে চায়, তাহলে আমরা বলব—বাইতুল মুকাদ্দাস তো তাদের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী ঈশ্বরের মহামন্দির(Temple Mount) যেখানে যিশু খ্রিষ্টসহ অন্য নবী-রাসুলগণ এক কালে উপাসনা করতেন ও শিক্ষা দান করতেন। [16] বাইবেল অনুযায়ী এই মহা মন্দিরের গোড়াপত্তনকারী হচ্ছেন ইব্রাহিম(আ.) এর নাতি ইয়া’কুব(আ.), [17] এবং এখানেও এক সময় পরবর্তী প্রজন্মের লোকেরা মূর্তিপুজা করেছে—ঠিক যেমনটি কা’বায় হয়েছে! এই তথ্য শুনে হয়তো অনেকেই চমকে উঠতে পারে, কিন্তু ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থে এমনটিই বলা আছে। —-
“তাঁর পিতা হিষ্কিয় যে সমস্ত উচ্চস্থান ভেঙে দিয়েছিলেন, মনঃশি আবার নতুন করে সেই সব বেদী নির্মাণ করেছিলেন। বায়াল মূর্ত্তির পূজার জন্য বেদী বানানো ছাড়াও, ইস্রায়েলের রাজা আহাবের মতই মনঃশি আশেরার খুঁটি পুঁতেছিলেন। তিনি আকাশের তারাদেরও পূজা করতেন। মূর্ত্তিসমূহের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে তিনি প্রভুর প্রিয় ও পবিত্র মন্দিরের মধ্যেও বেদী বানিয়েছিলেন। (এই সেই জায়গা যেখানে প্রভু বলেছিলেন, “আমি জেরুশালেমে আমার নাম স্থাপন করব।”) মন্দিরের দু’টো উঠোনে তিনি আকাশের নক্ষত্ররাজির জন্য বেদী বানান। তাঁর নিজের পুত্রকে তিনি যজ্ঞবেদীর আগুনে আহুতি দেন। ভবিষ্যত জানার জন্য তিনি প্রেতাত্মা ও পিশাচদের কাছে যাতায়াত করতেন। প্রভুকে অসন্তুষ্ট করার মত আরো অনেক কাজই মনঃশি করেছিলেন। ফলতঃ প্রভু খুবই রুদ্ধ হয়েছিলেন। মনঃশি পাথর কুঁদে আশেরার একটা মুর্তি বানিয়ে সেটাকে মন্দিরে[Temple Mount / বাইতুল মুকাদ্দাস] বসিয়েছিলেন। প্রভু দাউদ ও তাঁর পুত্র শলোমন[সুলাইমান(আ.)]কে বলেছিলেন, “সমস্ত শহরের মধ্যে থেকে আমি জেরুশালেমকে বেছে নিয়েছি। এখানকার এই মন্দিরে আমার নাম চিরদিনের জন্য থাকবে। ইস্রায়েলীয়দের পূর্বপুরুষদের আমি যে ভূখণ্ড দিয়েছিলাম, ইস্রায়েলীয়রা যদি আমায় মান্য করে চলে, আমার দাস মোশি[মুসা(আ.)/Moses]র দেওয়া বিধি ও আদেশগুলো অনুসরণ করে, তাহলে সেই ভূখণ্ড থেকে আমি কখনও তাদের উত্খাত করব না।” কিন্তু লোকরা ঈশ্বরের কথা গ্রাহ্য করল না। মনঃশি লোকদের বিপথে চালনা করলেন, যাতে তারা আরো বেশী পাপ কাজ করল সেই সব জাতিসমূহের চেয়েও, যাদের প্রভু ধ্বংস করেছিলেন এবং ইস্রায়েলীয়দের দিয়ে দিয়েছিলেন। প্রভু তাঁর দাস ভাববাদী(নবী/prophet)দের মাধ্যমে বলে পাঠিয়েছিলেনঃ “যিহুদার [ফিলিস্তিনে বনী ইস্রাঈলের দক্ষিণ রাজ্য] রাজা মনঃশি, ইমোরীয়দের থেকেও বহুগুণে ঘৃণ্য অপরাধ করেছে এবং মূর্ত্তিপূজা করে যিহুদাকেও পাপের পথে ঠেলে দিয়েছে।” [18]
খ্রিষ্টান মিশনারীরা কা’বার বিরুদ্ধে যে (অপ)যুক্তি প্রদান করেন, সেই এক যুক্তি কিন্তু Temple mount এর ক্ষেত্রেও খাটে। কিন্তু এ ব্যাপারে তারা অন্ধের ভান করে কা’বার বিরুদ্ধেই অভিযোগ করেন। নাস্তিক-মুক্তমনাদেরকেও কখনো বাইবেলের নবী-রাসুলদের Temple mountকে pagan temple বলতে দেখা যায় না। এই হচ্ছে তাদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। প্রকৃতপক্ষে বাইতুল মুকাদ্দাস(Temple Mount) কিংবা কা’বা গৃহের মসজিদ(মসজিদুল হারাম) এর কোনটিই pagan temple(পৌত্তলিকদের মন্দির) নয় বরং উভয়টিই এক-অদ্বিতীয় আল্লাহর উপাসনাগৃহ। উভয় গৃহই আল্লাহর নবীগণ নির্মাণ করেছেন, উভয় গৃহেই এক সময় পথভ্রষ্ট লোকেরা মূর্তিপুজা করেছে। এবং বর্তমানে এ উভয় গৃহই মূর্তিপুজামুক্ত হয়েছে, মসজিদুল হারাম ও বাইতুল মুকাদ্দাস উভয় স্থানেই এখন একত্ববাদী মুসলিমগণ এক-অদ্বিতীয় আল্লাহর উপাসনা করে।
নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) কা’বা থেকে মিথ্যা দেবতাদের মূর্তি অপসারণ করতে করতে যা বলছিলেন, ইসলামবিরোধীদের উদ্যেশ্যে আমরাও ঠিক তাই বলি-
جَآءَ ٱلۡحَقُّ وَزَهَقَ ٱلۡبَـٰطِلُۚ إِنَّ ٱلۡبَـٰطِلَ كَانَ زَهُوقً۬ا
অর্থঃ “…সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল।” [19]
তথ্যসূত্রঃ
[13] আল কুরআন, বাকারাহ ২:১২৭-১২৯
[14] দেখুনঃ “কা’বাঃ মূর্তিপুজকদের মন্দির, নাকি ইব্রাহিম(আ.) এর নির্মাণ করা ইবাদতখানা?”
[15] ■“A brief history of al-Masjid al-Haraam in Makkah” — islamQA(Shaykh Muhammad Saalih al-Munajjid)
https://islamqa.info/en/3748
■ ‘আর রাহিকুল মাখতুম’, শফিউর রহমান মুবারকপুরী(র) {তাওহিদ পাবলিকেশন্স}, পৃষ্ঠা ৪৬৩-৪৬৬
[16] বাইবেল, মথি(Matthew) ২১:১২-১৫, ২১:২৩; লুক(Luke) ২:৪৬-৪৯, ২০:১, ২১:৩৭-৩৮ দ্রষ্টব্য
[17] বাইবেল, আদিপুস্তক(Genesis) ২৮:১০-২২ দ্রষ্টব্য
[18] বাইবেল, ২ রাজাবলী(2 Kings) ২১:৩-১১
[19] আল কুরআন, বনী ইস্রাঈল(ইসরা) ১৭:৮১