Skip to content

 

কার্যকর কথা বলার উপায়ঃ বক্তব্যে শ্রোতাদের মন জয় করা সহজ উপায়, একজন সফল বক্তা হওয়ার উপায়, বক্তব্য দেওয়ার নিয়ম ও ভাষণ দেওয়ার নিয়ম, কথা বলার কৌশল, কথা বলার জড়তা দূর করার উপায় (পর্ব-১০, লেখকঃ ডেল কার্নেগী, বই অনুবাদ)।

কার্যকর কথা বলার উপায়ঃ বক্তব্যে শ্রোতাদের মন জয় করা সহজ উপায়, একজন সফল বক্তা হওয়ার উপায়, বক্তব্য ওয়ার নিয়ম ও ভাষণ দেওয়ার নিয়ম, কথা বলার কৌশল, কথা বলার জড়তা দূর করার উপায় (পর্ব-১০, লেখকঃ ডেল কার্নেগী, বই অনুবাদ)।

বিষয়ঃ খামারিয়ান এর আজকের এই পোষ্টটিতে তুলে ধরা হবে, কার্যকর কথা বলার উপায়ঃ বক্তব্যে শ্রোতাদের মন জয় করা সহজ উপায়, একজন সফল বক্তা হওয়ার উপায়, বক্তব্য ওয়ার নিয়ম ও ভাষণ দেওয়ার নিয়ম, কথা বলার কৌশল, কথা বলার জড়তা দূর করার উপায় (পর্ব-১০, লেখকঃ ডেল কার্নেগী, বই অনুবাদ)। আশা করি শেষ অবধি সাথেই থাকবেন, চলুন শুরু করা যাক।

(১০) কার্যকর কথা বলার উপায়

◼ আমি খুব কমই টেলিভিশন দেখে থাকি। কিন্তু আমার এক বন্ধুর অনুরোধে বাড়ির গৃহিনীদের জন্য নির্ধারিত মধ্যাহ্নের অনুষ্ঠান দেখে চমৎকৃত হলা। আমার খুবই ভালো লাগলো। আমার বন্ধুও সেটাই আশা করেছিলো। শ্রোতা ও দর্শকদের ভেতর থেকেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের নির্বাচন করা হয়েছিলো। এদের মধ্যে প্রত্যেকেই ছিল অতি সাধারণ, কথা বলার কোন রকম প্রশিক্ষণই এদের ছিলো। কোনরকম মতামত বিনিয়োগ করার সুযোগও এরা কখনও পায়নি।

◼ মোটকথা, জনংযোগমূলক কোন অনুষ্ঠানের ধারে-কাছেও যায়নি এরা। খুবই সুন্দর ও মনোজ্ঞ হয়ে উঠেছিলো অনুষ্ঠানটি। কিন্তু অংশগ্রহণকারীরা সকলেই ছিলো কৌতুহল উদ্দীপক। তারা যখন অনাড়ম্বর সাদামাঠাভাবে কথা বলতে শুরু করলো তখন তারা সহজেই ভুলে যেতে পেরেছিলো শক্তিশালী ক্যামেরার উপস্থিতি। আন্তরিকভাবে দর্শকদের মধ্যেই মন-প্রাণ ঢেলে দিতে পেরেছিলো অংশগ্রহণকারীরা। কি করে এটা সম্ভব হল? এর উত্তরও আমার জানা। দীর্ঘদিন ধরে বহুলোককে এ ব্যাপারে কার্যকর ও অন্যান্য কৌশল শিখিয়ে আসছি আমি। লোকগুলো নতুন কিছু বলছিলো না। এরা ছিলো অতি সাধারণ সব পুরুষ ও মহিলা। এরা এদের নিজেদের জীবনের স্মরণীয় মুহুর্তগুলোর কথাই বলেছিলো সহজসরল ভাষায়। কেউ-বা বলেছিলো তার স্ত্রীর কথা-কেউ কেউ বা তার স্বামীর বিষয়ে। এখানে ভূমিকা বা পরিচিতি নেয়ার কথা খুব একটা ভাবেনি তারা। চমক বক্তৃতা বা কায়দাকানুনের দিকে নজর দেওয়া বা বাক্যের অভূতপূর্ব গঠনশৈলীর দিকে মনোযোগ দেওয়ার কথা জানতোই না এরা।

◼ তবুও দর্শকদের হৃদয়ে ভালা লাগার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। এরা পুরোপুরি মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলো। এ নাটকীয় প্রমাণ থেকেই আমি এবারে বলবো কার্যকরভাবে কথা বলার দ্রুত এবং সহজ কয়েকটি উপায়।

(ক) এমন বিষয়ে কথা বলুন যে বিষয়টিতে আপনার অভিজ্ঞতা রয়েছে

◼ পূর্বোল্লিখিত টেলিভিশন অনুষ্ঠানটি প্রাণ-প্রাচুর্যে জীবন্ত হয়ে উঠেছিলো, দর্শকদের ভালো লেগেছিলো। কারণ অংশগ্রহণকারী নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই বক্তব্য রেখেছিলো। তারা এমন কথাবার্তা বলেছিলো যা তারা ভালো ভাবে জানে, যা সত্যি এবং বিশ্বাসযোগ্য।

◼ অথচ একবার ভাবুন দেখি কি বিরক্তিকর নিষ্প্রাণ অনুষ্ঠানই না হতো, যদি এই লোকগুলোকে কম্যুনিজম বা আমেরিকার সংবিধানিক বিষয়ে বলতে বলা হত। তাহলেই কর্তৃপক্ষ বিরাট ভুল করতেন। বিষয় নির্বাচনে, ঠিক যেমন করে অসংখ্য বক্তা প্রতিদিন ভুল করে চলছে শক্ত শক্ত দাঁতভাঙা বিষয় নিয়ে অথবা বক্তব্য রাখার কষ্টকল্পিত প্রয়াস চালাতে গিয়ে বেশির ভাগ বক্তাই এমন বিষয় নির্বাচন করেন, যে সম্পর্কে তিনি খুবই জানেন এবং খুবই কম পড়াশুনা আছে তাঁর। তাঁরা বিষয় বাছতে গিয়ে অবলীলায় বেছে নেন-দেশপ্রেম, পড়াশুনা, ন্যায়বিচার ইত্যাদি ইত্যাদি। লাইব্রেরীতে কয়েক ঘন্টা বই ঘেঁটে হাত নোংরা করে যত গাদা গুচ্ছের উদ্ধৃতি জোগাড় করেন, কলেজে পড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান কাজে লাগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন।

◼ পরিশেষে বক্তৃতাকালীন সময়টাই দীর্ঘতর হয় এবং শ্রোতারা ভয়ানকভাবে বিরক্ত হন। বক্তার মুখে ক্লান্তিকর পান্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা হজম করেন, নিরুপায় হয়ে-মনে মনে গালাগালি করতে থাকেন। অথচ ব্যাপারটা সহজ ‘স্বাভাবিক হলে কত সুন্দরই না হতো, শ্রোতারা কত খুশিই না হতো! কর্নাড হলটন হোটেলে বছর কয়েক আগে ‘ডেল কার্নেগী ইনস্টিটিউশনে’র এক বার্ষিক সম্মিলনী সভায়, একজন তরুণ ছাত্র হঠাৎই বলতে শুরু করলো- স্বাধীনতা, সাম্য আর সৌভ্রাতৃত্ব হল মানব ইতিহাসের অভিধানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর প্রয়োজনীয় বিষয়। স্বাধীনতা ছাড়া বেঁচে থাকা অর্থহীন। ইত্যাদি ইত্যাদি।

◼ অনুষ্ঠানটাই নীরস বক্তৃতা দিয়ে মাটি করে দেয় ছাত্রটি— এই ভেবে একজন প্রশিক্ষক কৌশলে জানতে চাইলেন ছাত্রটির কাছে, কেন কোন প্রমাণ ছাড়া উপরোক্ত বিষয় নিয়ে অনর্থক সময় নষ্ট করে কি লাভ ছাত্রটির। তখন নিজের বক্তব্যের সমর্থনে ছেলেটি এক হৃদয় বিদারক ঘটনা বর্ণনা করলো।

◼ যুদ্ধের সময় ন্যাৎসীদের বিরুদ্ধে ছেলেটি ছিলো ফরাসী মুক্তিসেনার পাতালবাহিনীর একজন সক্রিয় যোদ্ধা। নাৎসীদের জঘন্য নির্দয় আইনের বলি হয় ছেলেটির পরিবার। ছেলেটি মর্মস্পশীভাবে বলেছিলো কেমন করে হিটলারের বিশেষ পুলিশ বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে সে আমেরিকাতে পালিয়ে আসতে পেরেছিলো। ছেলেটি তার বক্তব্য শেষ করেছিলো এই বলে- আজ আমি যখন মিচিগান অ্যাভিনিউ দিয়ে হেঁটে হেঁটে হোটেলে এলাম, আমি ছিলাম স্বাধীন। আমি যখন খুশি আসতে বা যেতে পারি, কেউ বাঁধা দেবে না, আপত্তি তুলবে না আইডেন্টিফিকেশন কার্ডের দোহাই তুলে। এ অনুষ্ঠান শেষ হলে চিকাগো শহরের যেখানে খুশি আমি যেতে পারি। কেউ আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না। বিশ্বাস করুন আপনারা স্বাধীনতা হচ্ছে এমন জিনিস, যারা জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতেও আমি ভয় পাবো না।

◼ সকল শ্রোতাদের কাছ থেকে অকুণ্ঠচিত্তে সাড়া পেয়েছিলো ছেলেটি, শ্রোতাদের ভালবাসা অর্জন করতে পেরেছিলো।

(খ) আমাদের বলুন জীবন থেকে কি শিখলেন

◼ বক্তা যদি তার জীবন থেকে শেখা অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করে তবে শ্রোতারা তা ভালো মনেই গ্রহণ করে। আমি বেশ ভালো করেই জানি, বেশির ভাগ বক্তা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে পছন্দ করেন না। তার চেয়ে শক্ত দর্শন, ইতিহাস বা সাধারণ চলতি ধ্যান-ধারণা নিয়েই বক্তৃতা করতে বেশি আগ্রহী হন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা ঘটনা এড়িয়ে চলেন। ব্যাপারটা যেন এ রকম— যখন সংবাদের জন্য অপেক্ষায় থাকছি, তখন যেন কেউ সম্পাদকীয় শোনাতে লাগলো।

◼ মোদ্দা কথা হল- সেই সম্পর্কেই কথা বলুন, যা আপনার জীবন থেকে নেয়া। তাহলেই মুগ্ধ শ্রোতা পাবেন আপনি। ডাব্লু ডি ইম্পসন সম্পর্কে বলা হয়, তিনি সর্বদা সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, বিরক্ত হতেন না। ছোট-বড় কোন প্রকার ভেদাভেদ তাঁর ছিলো না। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, প্রত্যেক লোকের কাছ থেকে কিছু না কিছু শেখার আছে। ব্যক্তিগত জীবনে আমিও বহুলোকের জীবনের নানা ঘটনা মনোযোগ দিয়ে শুনেছি, তাতে লাভ ছাড়া লোকসান হয়নি। খুলে বলছি, কয়েক বছর আগে আমাদের প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে, নিউয়র্ক সিটি ব্যাংকের প্রাজ্ঞ অফিসারদের জন্য বক্তৃতা শেখানো ক্লাস নিতে হয়েছিলো। তাদের দীর্ঘ ব্যাংকের কাজকর্মের অভিজ্ঞতা, জীবনের চলার পথে পেরিয়ে আসা চল্লিশ বছরের জমানো কথা থেকে বলার মত কিছুই খুঁজে পেলো না তারা। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বলাটা বর্জন করলো একেবারেই। একদিন একজন অফিসার একটি পত্রিকা সঙ্গে নিয়ে ঢুকলো। পত্রিকাতে ছাপা একটি নিবন্ধ সে জোরে জোরে পড়তে শুরু করলো। এই নয় যে, সে এতে খুব আগ্রহী। আসলে এ বিষয় নিয়ে সে কিছু বলার সুযোগ করে নিলো। ফল হল খুবই খারাপ। ক প্রবন্ধটা সে নিজেই হজম করতে পারেনি। তাই অন্যকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে সাড়া জাগানোতে পুরোপুরি ব্যর্থ হল। প্রত্যেকেই বিরক্ত হল। শুধু উদ্ধৃতি দিয়ে প্রাণহীন দায়সারাভাবে বক্তব্য রাখার চেষ্টা করলে তাই হয়। কারণ সে নিজেও বিশ্বাস করেনি নিবন্ধের বক্তব্য।

◼ তখন একজন প্রশিক্ষক তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন দেখুন মিঃ ব্রাউন ওই নিষ্প্রাণ প্রবন্ধে আমরা আগ্রহী নই, ক্ষীণ ব্যক্তিত্ব দিয়ে লেখা ভাসা-ভাসা চিন্তা ভাবনা নিয়ে যিনি প্রবন্ধ লিখেছেন, তাঁর উপর আমাদের কোন ভরসা নেই। প্রবন্ধকার সামনে উপস্থিতও নেই, কিন্তু আপনি আছেন। আপনার ব্যাপারে আমরা আগ্রহী। আপনার নিজের কথা বলুন, শুনবো মনোযোগী হয়ে। এই প্রবন্ধের বক্তা ও বক্তব্যের সঙ্গে আপনি একমত কিনা তাই বলুন। যদি একমত হন আপনার অভিজ্ঞতা দিয়ে যুক্তিতর্ক আর চিন্তার গভীরতা দিয়ে তার সঠিক মূল্যায়ন পরিমাপ করুন। যদি আপনি একমত নাও হন, তাহলেও কারণ দেখান আমাদের কেন আপনার কথা মেনে নেবো। ঠিক আছে, এবারে ওই প্রবন্ধ দিয়েই আপনি আপনার বক্তব্য শুরু করুন।

◼ মিঃ ব্রাউন একাধিকবার মনোযোগ দিয়ে প্রবন্ধটি পড়লেন। অবশেষে সিদ্ধান্তে এলেন, লেখকের সঙ্গে কোন দিক থেকেই তিনি একমত নন। তিনি স্মৃতির মণিকোঠা থেকে মূল্যবান সব প্রমাণপত্র পেশ করতে লাগলেন। কেন তিনি একমত নন। তার সপক্ষে সহজ প্রমাণসাপেক্ষে একাধিক ঘটনার উল্লেখ করলেন তিনি। তিনি যেন খনি থেকে ধাতু তুলতে থাকলেন।

◼ তাহলে এবার নিজেরাই বুঝে দেখুন- কি ধরনের বক্তব্যে শ্রোতাদের মন জয় করা সহজ। নিজের জীবন থেকে নেয়া ঘটনা বলুন। তাহলে খুব সহজেই শ্রোতাদের মনে প্রভাব ফেলতে পারবেন।

(গ) বিষয়বস্তুর জন্য অতীতের দিকে ফিরে তাকান

◼ একবার আমার প্রতিষ্ঠিত ‘ডেল কার্নেগী ইনস্টিটিউশনে’র প্রশিক্ষকদের বলা হয়েছিল তারা যেন লিখিতভাবে জানায় সবচেয়ে বড় সমস্যা কোনটা, যখন নতুন ছাত্রদের বক্তৃতা শেখানো শুরু হয়। যখন লেখা কাগজগুলো একত্রিত করে খোলা হল, দেখা গেল প্রত্যেক প্রশিক্ষকই একমত হয়েছেন একটি বিষয়ে। তা হল-শিক্ষার্থীরা কিছুতেই সঠিক বিষয় নির্বাচন করতে পারে না। সঠিক বিষয় বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে, যা আপনি জানেন, চেনেন, পড়েছেন বা অভিজ্ঞতা নিয়ে সঞ্চয় করেছেন। কেমন করে আপনি সঠিক বিষয় খুঁজে বের করবেন? স্মৃতির অতীতে পদচারণা শুরু করুন। দেখবেন অনেক উজ্জ্বল স্মৃতির শস্য আপনার ভাণ্ডারে জমা হয়েছে অনেক স্মরণীয় দিন আর স্মরণীয় ঘটনা পরিব্যক্ত হয়ে। শৈশব থেকে কৈশর এবং পরবর্তী দিনগুলো থেকে বলার মত অনেক উপাদান মিলতে পারে। পারিবারিক জীবন, স্কুল জীবন, ছোট বয়সের স্মৃতি, নানারকম বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বড় হওয়া, এসব থেকেও খুব ভালো বক্তব্য বাছাই করা যেতে পারে। প্রায় সবারই জীবনে এরকম স্মৃতি থাকে, তাই বক্তা যখন বলে চলে তখন অধিকাংশ ‘শ্রোতাই নিজের জীবনের সঙ্গে তা মিলিয়ে নেন।

◼ ভালো খেলা দেখার স্মৃতি, ভালো ছবি দেখা, ভালো গল্প আস্বাদনের ভাগও অপরকে দেওয়া যেতে পারে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, শ্রোতারা এসব পছন্দ করে।

◼ প্রচণ্ড সংগ্রাম আর প্রতিকূল দিন পেরিয়ে যারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তাঁদের পক্ষে বিষয়বস্তুর জন্য ভাবনা নেই। কি কি কাজ করেছেন আপনি অতীতে, যদিও আজ আপনি ধনী ব্যক্তি তবুও অতীতের সেইসব কষ্টকর কান্তিময় দিকগুলোই এখন আপনার সফলতার দিকচিহ্ন। কিভাবে কোন ঘটনাতে আপনা জীবন ও জীবিকার মোড় ঘুরে গেলো— আপনি সফলতার সিঁড়িতে পা রাখার সুযোগ পেলেন, এইসব শ্রোতাদের কাছে মূল্যবান দলিল-সম মনে হবে। সর্বোপরি কঠোর বাস্তবের ভয়ঙ্কর আর তীব্র প্রতিদ্বন্ধিতার মাঝখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন, এসব শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকবে শ্রোতারা।

◼ আপনার কোন বিশেষ শখ বা আমোদ-প্রমোদ থেকেও বক্তৃতার উপাদান খুঁজে পেতে পারেন। এছাড়া কোন বিশেষ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের কাজ করার অভিজ্ঞতাও কম মূল্যবান নয়। আপনি নিজের কর্মক্ষেত্রে এককজন বিশেষজ্ঞ, যদি আপনি আপনার জীবিকা-বিষয়ক বিচিত্র অভিজ্ঞতা শ্রোতাদের ঘটনাপঞ্জীর মাধ্যমে গুছিয়ে বলতে পারেন তাহলে শ্রোতারা আগ্রহী হবে জানতে।

◼ এছাড়া একটু ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা হলে তো আরও ভালো। যেমন যুদ্ধের সময় আপনি অগ্নিদগ্ধ বাড়িতে চাপা পড়েও কেমন করে প্রাণে বাঁচলেন বা ঐশ্বরিক কোন কাজকর্ম যদি আপনার জীবনে থাকে। এসব বিষয়ের উপাদান থেকেই আপনি বক্তৃতার মাল-মশলা সংগ্রহ করতে পারেন।

◼ যে বিষয়ে আপনি বক্তব্য রাখবেন, সে বিষয়ে অন্য সবার চেয়ে আপনার বেশি জানা উচিত। তাহলেই শ্রোতারা আগ্রহী হবে, আপনার চিন্তা-ভাবনা সংক্রমিত হবে তাহাদের মধ্যে। ভাসা-ভাসা জ্ঞান শ্রোতাদের আকৃষ্ট করবেন না। আপনার নিজের গভীর বিশ্বাস আর ভালোলাগা থেকেই সুন্দর বক্তব্যের জন্ম হবে।

(ঘ) সিদ্ধান্তে আসুন পছন্দমত বক্তব্যে কতটা উত্তেজিত হবেন

◼ উত্তেজিত হওয়ার মত বিষয়বস্তু খুব কমই মেনে যদি না নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের বিষয়বস্তু মিলে যায়। আমাদের যদি বাসন ধোয়া সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে হয়, আমি মোটেই ভালো বলবো না। প্রথমত, বাসন ধোয়ার ঘটনার কথা আমার মনেই নেই। অথচ বাড়ির গৃহিণীরা এ সম্পর্কে দারুণ বলবে, উত্তেজিত হয়ে উঠবে সহজেই। এ বিষয়ে একটা প্রশ্ন করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে, বক্তব্য কতটা আপনার পছন্দমত সেটা বোঝা যাবে তখনই, যখন আপনার বক্তৃতার সময় কেউ যদি আপনার মতামতের তীব্র সমালোচনা করে কথা বলে। আর আপনি যদি যুক্তি-তর্ক দিয়ে প্রতিপক্ষকে থামিয়ে দিতে পারেন তাহলেই আপনার জিত। বিষয়বস্তু সুনির্বাচিত ও কার্যকর হয়েছে।

◼ ইতোমধ্যে ১৯২৬ সালে লেখা নিজের কিছু আলোচনার ওপর চোখ বুলিয়েছিলাম। সে বছর আমি জেনেভাতে লীগ অফ নেসস এর সপ্তম অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানকার কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছিলাম। পরপর তিন থেকে চারজন বক্তা প্রাণহীনভাবে দেখে দেখে বক্তৃতা-লিপি পাঠ করলেন। স্যার জর্জ ফষ্টার বলার সময় কোন কাগজপত্র হাতে নিলেন না। তাঁর প্রতিটি কথা, প্রতিটি বক্তব্য নিজের বিশ্বাস আর একাগ্রতা দিয়ে তৈরী ছিল যেন। জেনেভার হ্রদ চোখে পড়ছিলো হল থেকে। হ্রদের জলের মতই সহজ-সরল হৃদয় নিংড়ানো ছিলো তাঁর বক্তব্যের বিষয়বস্তু। এ পর্যন্ত আপনাকে আমি একজন বক্তা সম্পর্কে যা বলে এসেছি-সমস্ত গুণাবলীর সংমিশ্রণ ঘটেছিলো স্যার জর্জ ফষ্টারের বক্তৃতায়। আমি যেন এখনও চোখ না বুঝেই দেখতে পাই জর্জ কিভাবে হাত নেড়ে বক্তৃতা করে চলেছেন। তিনি ছিলেন অন্তরিক গভীর অনুভূতিসম্পন্ন। মনপ্রাণ ঢেলে তিনি বলেছিলেন।

◼ আমেরিকার আলোড়ন তোলা বক্তা বিশপ মার্লো তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন- কলেজের বিতর্ক অনুষ্ঠানের আগে আমাদের বিতর্কবিষয়ক অধ্যাপক আমাকে ডেকে বললেন, তোমার মাথায় গোবর পোরা। এ কলেজের ইতিহাসে তোমার চেয়ে বাজে ছাত্র আর বিতর্কে অংশগ্রহণ করেনি। তোমার চেয়ে মাথা মোটা বক্তা আমি জীবনে দেখিনি মার্লো।

◼ যদি তাই হয় স্যার, আমাকে ডেকেছেন কেন বিতর্কে অংশ নেবার জন্য?

কারণ হল— ‘তুমি ধরে নিতে পার, পারার জন্য মোটেই ডাকিনি। ওই কোণে বসে, বক্তৃতার বিশেষ অংশটা মনেযোগ দিয়ে পড় গিয়ে। আমি পুনঃ পুনঃ এক ঘন্টা ধরে একটা অনুচ্ছেদই শুধু পড়ে গেলাম।

‘তুমি কি লেখাটিতে কোন ভুল খুঁজে পেলে?’ অধ্যাপক অনুসন্ধিৎসু হলেন জানতে।

‘না। কোর্ন ভুলই চোখে পড়ছে না আমার।’

◼ পুনরায় দু’ঘন্টা কেটে গেলো। ক্রমাগত পড়ে চলেছি আমি। আড়াই ঘন্টা কেটে গেলে পর আমি যেন নিঃশেষিত হলাম। খুবই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়লাম। তিন ঘন্টার মাথায় অধ্যাপক পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখনও কোন ভুল চোখে পড়ছে না তোমার? এতক্ষণ পর আমি বুঝতে পেলাম তিনি কি বোঝাতে চাইছেন। আমি বলে উঠলাম, হ্যাঁ ধরতে পেরেছি। আমি তেমন করে বলতে পারব না যেমন করে ব্যাপারটি বুঝে নিয়েছি।

এই প্রথম অধ্যাপক বলে উঠলেন, ‘এবারে তুমি বক্তৃতা দেবার জন্য তৈরী হলে।’

সারা জীবন ধরে বিশপ মার্লো একটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। তা হলো, তিনি নিজে পুরোপুরিভাবে বক্তব্যের গভীরে ডুবে যেতেন আন্তরিকভাবেই এবং তা করতেন।

◼ একবার কার্ণেগী ইনস্টিটিউশনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন জানালো, সে কোন বিষয়েই উত্তেজিত হয় না, নীরস একঘেয়ে জীবনযাপনে অভ্যস্থ। আমাদের প্রশিক্ষক জানতে চাইলো ছেলেটি তার অবসর সময়ে কিভাবে কাটাতে পছন্দ করে- ছেলেটি জানালো সে অবসর সময়ে দেশলাই এর খোসা জমাতে ভালবাসে। পৃথিবীর সবদেশের দেশলাই- এর বাক্স জোগাড় করা ছেলেটির একমাত্র নেশা। ইতোমধ্যেই সে সমস্ত দেশের দেশলাই বাক্স জোগাড় করে ফেলতে পেরেছে।

◼ ‘কার্ণেগী ইনস্টিটিউশনে’র প্রশিক্ষক তখন তাকে তার প্রিয় নেশা সম্বন্ধে বক্তব্য রাখতে বললো ছেলেটি প্রথম মুখ খুলতে ইতস্তত করলো। তার ধারণা জন্মেছিলো, এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কেউ শুনতে আগ্রহী হবে না। এতক্ষণে তার প্রিয় শখ নিয়ে শুনতে সবার আগ্রহ দেখে সে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়লো। ছেলেটি গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে সমস্ত খুঁটিনাটি বলে গেল তার শখ সম্পর্কে।

◼ উপরের দৃষ্টান্তগুলো থেকে কার্যকরভাবে দ্রুত ও সহজে কথা বলার পদ্ধতি বলা হল। বিষয়টি বারবার পড়ুন। অনুশীলন করুন নিজে। কিছুতেই হাল ছেড়ে দেবেন না। পড়তে পড়তে থামুন এবং মন দিয়ে ভেবে দেখুন আপনি কি পড়ছেন।

(ঙ) আপনার চিন্তা শ্রোতাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার কৌশল বের করুন

◼ যে কোন কিছু বলার জন্য উঠে দাঁড়ালেই তিনটি মূল-প্রতিপাদ্য বিষয় ঘুরে ফিরে আসবেই। তা হল-বক্তা, বক্তৃতার বিষয়বস্তু এবং শ্রোতাবৃন্দ।

◼ এ পর্যন্ত যা বলেছি তাতে বক্তা ও তার বক্তব্যের অন্তর্নিহিত বিষয় সম্পর্কে আপনাদের একটা পরিষ্কার ধারণা তৈরী হয়েছে নিশ্চয়ই। এ পর্যন্ত কোথাও তেমনভাবে বক্তৃতাকালীন পরিবেশ সম্পর্কে কিছু বলিনি। একমাত্র তখনই বক্তৃতাকালীন পরিবশে সৃষ্টি হয়, যখন বক্তা জীবন্ত শ্রোতার সামনে তার বক্তব্য নিবেদন করতে শুরু করে। তখনই প্রাণসঞ্চার হয় পরিবেশে, অন্যথায় নয়। বক্তৃতার বিষয়বিস্তু পূর্বেই ভালো করে তৈরী থাকতে পারে, এমন কোন বিষয়েও বক্তৃতা থাকতে পারে, যা বক্তাকে উত্তেজিত করে তুলতে পারে। কিন্তু পরিপূর্ণ সফলতার জন্য এসবই যথেষ্ট নয়, অন্য এক উপাদান থাকা খুবই জরুরী, যা বক্তার কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে ঢুকে যাবে। বক্তাকে শ্রোতার মনে বিশ্বাস আনতে হবে, অনুভব করাতে হবে, সে যা বলছে তা খুবই জরুরী। বক্তাকে শুধু নিজের বক্তব্য নিয়ে উত্তেজিত হলেই চলবে না, সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাদের মধ্যেও তার উত্তেজনা ছড়িয়ে দিতে হবে সমানভাবে যে, সকল ঐতিহাসিক বক্তা জনসমক্ষে বক্তৃতা দিয়ে বাকপটুতার চূড়ান্ত আদর্শ স্থাপন করতে পেরেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের ভেতরেই ছিলো নির্ভুল হিসাবী মনের দক্ষতা।

◼ পুরানো দিনের খ্রিষ্টের বাণী প্রচারকের অধিকাংশ গুণই আপনি সেইসব বক্তার মধ্যে আবিষ্কার করতে পারবেন খুব সহজে। একজন ভালো বক্তা তার কার্যকর বক্তৃতাকে নিজের মাথার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে না। চিন্তা-ভাবনাকে তড়িৎ প্রবাহের মত ছুঁড়ে দেয় দর্শকদের বা শ্রোতাদের মনের সীমায়। নিজের ভাবনাকে তাদের মধ্যে সংক্রমিত করে কোন ভাবনারই সেখানে জায়গা নেই। কারণ অভিজ্ঞ কুশলী বক্তামাত্রই জানেন তাঁর বক্তৃতা খারাপ বা ভালো কিনা এ বিচারের ভার তাঁর নয়— শ্রোতার।

◼ নিউইয়র্ক সিটিতে অ্যামিরিকান ইনস্টিটিউট অব ব্যাঙ্কিং-এর ‘সঞ্চয় ও মিতব্যয়িতা বিষয়ক প্রচারকার্য চলাকালীন আমি বহু লোককে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। একজন লোক কিছুতেই কিছু শিখছিলো না। আসলে তার আগ্রহই ছিলো না বিষয়টিতে আমি তাকে বললাম, লোককে সঞ্চয় করাতে উদ্বুদ্ধ করানোর মধ্যে সমাজসেবামূলক মহৎ আদর্শ রয়েছে। আমি লোকটিকে আরো জানালাম, নিউইয়র্ক কোর্টের রেকর্ড অনুযায়ী শতকরা পঁচিশজন মানুষ মৃত্যুর পূর্বে কিছুই রেখে যায় না। শতকরা মাত্র তিন দশমিক তিন ভাগ লোকই দশ হাজার ষ্ট্যালিং বা তার ওপরে সঞ্চয় রেখে যায়। লোকটির মনে বদ্ধমূল ধারণা ছিল, সে কিছুতেই জনসাধারণের কাছে কোনরকম অনুগ্রহ ভিক্ষা করবে না সঞ্চয় করানোর জন্য, তাদের ক্ষমতায় না কুলোলে না করবে। শুধু সাধারণের মঙ্গলের কথাই সে ভাবছে, যাতে বৃদ্ধ বয়সে তাদের খাবার আর বাসস্থানের কষ্ট না হয়। তারা যেন রুটি মাংস আর জামা কাপড় কেনার মত অর্থ সঞ্চয় করতে পারে শেষের দিনের কথা ভেবে। লোকটি সর্বদা মনে রেখেছিল, সে জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য সামাজিক কাজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে, সঞ্চয় একটা মাধ্যম মাত্র।

◼ আস্থা বেড়ে গেলো অনেক খানি। মহৎ কাজ করার অনুপ্রেরণায় জনসাধারণের কাছে তার প্রভাব বেড়ে  গেলো অনেকখানি।

তাহলে মোদ্দা কথা হল- সহজ-সরলভাবে কথা বলার চেষ্টা করুন। আপনার বক্তব্যের সরলতা যেন শ্রোতার হৃদয় ছুঁয়ে যায় এবং তাকে আগ্রহী করে তোলে আপনার সম্পর্কে।

(চ) বক্ত্যব, বক্তা এবং শ্রোতা

◼ বক্তব্য, বক্তা, শ্রোতাকে তিনবাহু ধরে যদি ত্রিভুজ কল্পনা করি তাহলে পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা ত্রিভুজের তিন বাহু নিয়ে আলোচনা করবো। অর্থ্যাৎ স্রোতার সামনে একজন বক্তার বক্তৃতা দেওয়ার সময় যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, সে বিষয়ে আলোকপাত করবো।

◼ প্রথমত, আলোচ্য বিষয়বস্তু। নিজেই জোরালো হবে, যদি আমরা বক্তৃতার মূল বিষয় বস্তুকে ধরতে পারি যে, যা সুস্বাদু ও আদরণীয় হয়ে উঠতে পারে কেবলমাত্র আমাদের অভিজ্ঞতার মশলার টান বলুন তার গ্রন্থিমোচনে। দ্বিতীয়ত, আসছে বক্তার পালা। আমরা এখানে বক্তার দেহ এবং গলার আওয়াজ- এর বিভিন্ন ধর্ম, অংশ, ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিশদ আলোচনা করব। তৃতীয় বিষয় হল, যাদের সামনে বক্তব্য রাখবেন। একজন বক্তা শ্রোতার মনে বক্তৃতার দ্বারা প্রভাবিত করে মন জয় করে নিতে পারার ওপরেই নির্ভর করছে বক্তার সাফল্য-ব্যর্থতা।

(এখন আপনি আছেন পর্ব-১০ এ)

সমাপ্তঃ আজকরে আলোচ্য বিষয় “কার্যকর কথা বলার উপায়ঃ বক্তব্যে শ্রোতাদের মন জয় করা সহজ উপায়, একজন সফল বক্তা হওয়ার উপায়, বক্তব্য ওয়ার নিয়ম ও ভাষণ দেওয়ার নিয়ম, কথা বলার কৌশল, কথা বলার জড়তা দূর করার উপায় (পর্ব-১০, লেখকঃ ডেল কার্নেগী, বই অনুবাদ)।” পরবর্তী পোষ্ট পড়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে এই পোষ্টটি এখানেই সমাপ্ত করা হলো।

Copyright Notice

কপি করা নিষিদ্ধ!