কিয়াম করা যাবে কিনা, করা গেলেও কিয়াম করার নিয়ম সম্পর্কিত এই বিষয়ে ৫টি হাদীস নিচে বর্ণা করা হলো-
যেভাবে কিয়াম করা যাবে না বা জায়েজ নয়ঃ
আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ أحًبَّ أنْ يَتَمَثَّلَ النَّاسُ لَهُ قِيَاماً فَلْيَتَبَوَّأ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ. (رواه أحمد)
অর্থাৎ, যে লোক কামনা করে যে, মানুষ তার সম্মানে দাঁড়িয়ে যাক সে যেন তার ঠিকানা আগুনে করে নেয়। (আহমাদ)
আনাস রা. বলেছেনঃ
ماَ كَانَ شَخْصٌ أحَبَّ إلَيْهِم مِنْ رَسُولِ اللهِ صلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَكاَنُوا إذا رأوْهُ لَمْ يَقُوْمُوْا لَهُ لماَ يَعْلَمُونَ مِنْ كراهِيَّتِهِ لِذَالِكَ. (رواه الترمذي)
অর্থাৎ, সাহাবায়ে কিরামের নিকট নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে অধিক প্রিয় আর কেউ ছিলেন না। তথাপি তারা তাঁকে দেখতে পেলে সম্মানার্থে দাড়াতেন না, কারণ তারা জানতেন এমনটি তিনি অপছন্দ করেন। ( আহমদ ও তিরমিযি)
১। হাদিস দুটি হতে এটা পরিস্কার বুঝা যায় যে, যে মুসলিম তার সম্মানার্থে মানুষের দাঁড়ানোকে কামনা করে, তাহলে এ কাজ তাকে (জাহান্নামের) আগুনে প্রবেশ করাবে। সাহাবায়ে কেরাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। এতদসত্ত্বেও, তাঁকে তাদের সম্মুখে আসতে দেখলে দাঁড়াতেন না। কারণ, সে দাঁড়ানোকে তিনি খুব অপছন্দ করতেন।
২। বর্তমানে মানুষ একে অপরের জন্য দাঁড়াতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বিশেষ করে উস্তাদ যখন শ্রেণী কক্ষে প্রবেশ করেন অথবা ছাত্ররা তাকে কোথাও দেখতে পায় তখন তার সম্মানার্থে সকলে দাড়িয়ে যায়। কোনো ছাত্র না দাড়ালে তাকে তিরস্কার ও ধিক্কার দেয়া হয়। দাড়ানো কালে শিক্ষকের নীরবতা অথবা না দাড়ানো ছাত্রকে তিরস্কার করা এটাই প্রমাণ করে যে, তারা নিজেদের জন্য দাঁড়ানোকে পছন্দ করেন। যদি অপছন্দ করতেন তাহলে এসব হাদিস বলে দাড়ানোকে নিরুৎসাহিত করতেন। এবং যারা দাড়ায় তাদের নসীহত করতেন। এভাবে তার জন্য বারে বারে দাঁড়ানোর ফলে তার অন্তরে আকাঙ্খা সৃষ্টি হয় যে, ছাত্ররা তার জন্য উঠে দাঁড়াক। কেউ না দাঁড়ালে তার প্রতি অন্তরে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
উল্লেখিত হাদিসের বক্তব্য অনুযায়ী যারা দাড়িয়ে অপরকে সম্মান জানাচ্ছে তারা মূলত: সেসব মানুষ শয়তানের সাহায্যকারী, যারা নিজের জন্য এভাবে দাঁড়ানো পছন্দ করে। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে নিষেধ করে বলেছেন :
وَلاَ تَكُوْنُوا عَوْنَ الشَّيْطان عَلى أخِيْكُم. (رواه البخاري)
অর্থাৎ, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের বিরুদ্ধে শয়তানের সাহায্যকারী হয়ো না। (বুখারি)।
৩। অনেকে বলেন : আমরা শিক্ষক বা বুজুর্গদের সম্মানে দাড়াইনা বরং তাদের ইলমের সম্মানে দাঁড়াই। আমরা বলব : আপনাদের কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইলম এবং তাঁর সাহাবিদের আদব সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ আছে? সাবারাতো নবীজীর সম্মানে দাঁড়াতেন না। ইসলাম এভাবে দাঁড়ানোকে সম্মান প্রদর্শন বলে মনে করে না। বরং হুকুম মান্য করা ও আনুগত্যের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সম্মান। সালাম করা ও হাত মিলানই ইসলাম সম্মত সম্মান।
৪। অনেক সময় দেখা যায়, মজলিসে কোনো ধনী লোক প্রবেশ করলে মানুষ তার সম্মানে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু দরিদ্র ব্যক্তির জন্য কেউ দাঁড়ায় না। এমনও হতে পারে, আল্লাহ তাআলার কাছে ঐ দরিদ্রের সম্মান সে ধনী ব্যক্তির চেয়ে বেশী। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ (الحجرات 13)
অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাবান যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। ( সূরা হুজুরাত, ৪৯: আয়াত ১৩)
অনেকে ভাবে যদি আমরা না দাঁড়াই তাহলে আগমনকারী মনে ব্যাথা পাবেন । তাদের এই বলে বুঝান দরকার যে, দাঁড়ানটাই সুন্নতের বিপরীত। বরং হাত মিলান, সালাম করাই সুন্নাত।
কিয়াম করার নিয়ম ও দলিলঃ
অনেক সহিহ হাদিস ও সাহাবিদের আমল দ্বারা প্রমাণিত যে, আগমণকারীর অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়ানো জায়েয। আসুন আমরা সে হাদিসগুলো বুঝতে চেষ্টা করি এবং সেমতে আমল করারও ।
১। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আদরের মেয়ে ফাতিমা রা. আপন পিতার খিদমতে আসলে নবীজী তার জন্য দাঁড়াতেন। অনুরূপভাবে যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে যেতেন, তখন তিনিও উঠে দাঁড়াতেন। এটা জায়েয এবং জরুরি। কারণ, এটি অতিথির সাথে সাক্ষাত ও তার একরামের জন্য।
রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ كاَنَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فاَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ (متفق عليه)
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের উপর বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার অতিথিকে সম্মান করে। (বুখারি ও মুসলিম) তবে এটা শুধুমাত্র বাড়ীর মালিকের জন্য প্রযোজ্য অন্য কারো জন্য নয়।
২। অন্য হাদীসে আছে :
قُوْمُوْا إلى سيِّدِكُمْ وَفِى رواية (فانزلوه) (متفق عليه)
অর্থাৎ, তোমাদের সর্দারের জন্য দাঁড়াও। ( বুখারি ও মুসলিম)। অন্য রিওয়ায়েতে আছে : (এবং তাকে নামিয়ে আন)
এই হাদিসের কারণ হল : সা’দ রা. আহত ছিলেন। তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহুদিদের বিচার করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি গাধার উপর উঠলেন। যখন তিনি পৌঁছলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের বললেন : তোমরা তোমাদের সর্দারের জন্য উঠে দাঁড়াও এবং তাকে নামিয়ে আন। তাই তারা দাঁড়ালেন এবং নামিয়ে আনলেন। এখানে আনসারদের সর্দার সা’দ রা.-কে সাহায্য করার জন্য দাঁড়ানোর প্রয়োজন ছিল, কারণ তিনি ছিলেন আহত। তাছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এবং আনসাররা ব্যতীত অন্য কোনো সাহাবি দাঁড়াননি।
৩। সাহাবি কা’ব ইবনে মালেক রা. সম্বন্ধে বর্ণিত আছে, তিনি মসজিদে প্রবেশ করলেন, সাহাবাগণ সকলে বসা ছিলেন। তিনি প্রবেশ করলে তালহা রা. তার তাওবা কবুল হয়েছে মর্মে সুসংবাদটি প্রদানের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাবুক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করার কারণে কা’ব রা. ও তার দুই সাথীর সাথে বয়কট করা হয়েছিল। পরে তাদের তাওবা কবুল হয়। এখানে দৃশ্যত: দেখা যাচ্ছে তালহা রা. কা’ব রা.-এর উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়েছেন, প্রেক্ষাপটের বিচারে এ দাঁড়ানোতে দোষের কিছু নেই এবং এটা জায়েয। কারণ, এতে বিমর্ষ ব্যক্তিকে খুশি করার চেষ্টা করা হয়েছে। এবং আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত প্রাপ্তিতে আনন্দ প্রকাশ করা