এই পুরো পোষ্টটিতে, কোয়েল পাখির ডিমের ও মাংসের উপকারিতা ও অপকারিতা এবং কোয়েল পাখির ডিম ও মাংস খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
আপনি যদি, সম্পূর্ণ পোষ্ট মনোযোগসহ ধৈর্য নিয়ে পড়ে এই বিষয়গুলো নিয়ে আপনার আর কোন প্রশ্ন থাকবে না।
চলুন সূচনা করি-
কোয়েল পাখির ডিমঃ
♦ পোল্টিজগতে কোয়েল যতটা বিচিত্র তার থেকেও বেশি বিচিত্র এর ডিম। রঙিন কারুকাজ করা এই ডিমগুলো দেখতে যতটা সুন্দর ও আকর্ষণীয় গুণে-মানে তার থেকেও বেশি। আর খেতেও অত্যন্ত সুস্বাদু। ওজনে হাঁস ও মুরগির ডিমের যথাক্রমে প্রায় ১/৬ ও ১/৫ ভাগ হলেও পুষ্টিমানের তুলনামূলক বিচারে কোয়েলের ডিম অনেক বেশি এগিয়ে।
♦ কোয়েলের ডিমের খোসা ও তার উপরের এই বিচিত্র কারুকাজের রঙগুলো প্রোটোপরফাইরিন (Protoporphyrin) ও বিলিভারডিন (Biliverdin) রঞ্জক পদার্থ থেকে সৃষ্টি। এগুলো কোয়েলের জরায়ুর এক বিশেষ ধরনের কোষ থেকে নি:সৃত হয়। ডিম পাড়ার ২.৫-৩.৫ ঘণ্টা পূর্বে এগুলো ডিমের খোসার উপর নি:সৃত হয়ে খোসাকে রঙিন করে দেয়। আর খোসার উপরের সুন্দর সুন্দর ফোঁটাযুক্ত কারুকাজের জন্য রঙ নি:সৃত হয় এর অনেকক্ষণ পরে। ডিম পাড়ার মাত্র কিছুক্ষণ পূর্বে এই কারুকাজ তৈরি হয়। তাই ডিমপাড়ার সাথে সাথে ডিমে হাত দিলে অনেক সময় হাতের সাথে ডিমের কারুকাজের রঙগুলো উঠে আসে।

কোয়েল পাখির ডিম ও মুরগির ডিমের তুলনাঃ
♦ কোয়েলের ডিমের আকৃতি (Shape) মুরগির ডিমের মতোই; তবে আকার (Size) অনেক ছোট। লম্বায় মাত্র ২.৪-২.৬ সেমি। ওজন গড়ে মাত্র ১১ গ্রাম। তবে ডিমের ওজন পাখির জাত, বয়স, খাদ্য ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে ৬-১৬ গ্রাম হতে পারে।
♦ আকারভেদে ডিমের পুষ্টিমানেরও কিছুটা তারতম্য ঘটে থাকে। ওজনে কোয়েলের ডিম মুরগির ডিমের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ। তবে দৈহিক ওজনের হিসেবে তুলনা করলে মুরগির ডিমের তুলনায় কোয়েলের ডিম বড়। কারণ, একটি মুরগি তার দেহের ওজনের ৩% ওজনের ডিম পেড়ে থাকে। আর কোয়েল পাড়ে নিজ দেহের ওজনের ৮%। সেই বিবেচনায় আকার ও ওজনে ছোট হলেও কোয়েল কম খাবার খেয়ে তুলনামূলকভাবে মুরগি থেকে বড় ডিম পেড়ে থাকে।
♦ কোয়েল ও মুরগির ডিমের বাহ্যিক গঠন তুলনা করলে দেখা যায়, কোয়েলের ডিমের তুলনায় মুরগির ডিমে শ্বেত বা সাদা অংশ অর্থাৎ অ্যালবুমিনের (Albumen) হার বেশি ও কুসুমের হার কম থাকে। আর খোসার (খোসাপর্দাসহ) পরিমাণ শতকরা হারে মুরগির থেকে কোয়েলে কিছুটা বেশি। সারণি- ৭ : এ কোয়েল ও মুরগির বাহ্যিক গঠনের তুলনা দেখানো হয়েছে। খোসা ও খোসাপর্দার মিলিত পুরুত্ব মুরগি ও কোয়েলের ক্ষেত্রে প্রায় সমান। কিন্তু কোয়েলের ডিমের খোসা (খোসাপর্দাবাদে) মুরগির ডিমের থেকে পাতলা। তাই কোয়েলের ডিম সাবধানে নাড়াচাড়া করা উচিত। কোয়েলের ডিমের পুরো ওজনের ৫৫-৫৮% অ্যালবুমিন, ২৮-৩২% কুসুম (Yolk) এবং ১০-১৫% খোসার (খোসাপর্দাসহ) ওজন। কোয়েলের ডিমে অ্যালবুমিন, কুসুম ও খোসার অনুপাত ৬:৩:১। মুরগির ডিমের সাথে তুলনা করলে কোয়েলের ডিমে অ্যালবুমিনের থেকে কুসুমের হার বেশি। কোয়েলের ডিমে অ্যালবুমিন ও কুসুমের অনুপাত ৬১:৩৯।

কোয়েল পাখির ডিমের পুষ্টিগুণঃ
কোয়েল পাখির ডিমে কি ভিটামিন আছে?
- এবার কোয়েলের ডিমের পুষ্টিমান নিয়ে আলোচনা করা যাক। হাঁস-মুরগি বা অন্যান্য পোল্ট্রির ডিমের মতো কোয়েলের ডিমও পুষ্টি উপাদানে ভরপুর; আর স্বাদে অতুলনীয়। কোয়েলের ডিম হাঁস-মুরগির ডিমের থেকেও বেশি সুস্বাদু। কোয়েলের ডিমের রাসায়নিক বিশ্লেষণ থেকে এর বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের হার সম্পর্কে জানা যায়। এতে পানি, আমিষ, চর্বি ও ছাই (Ash) যথাক্রমে ৭৩.৮০%, ১৩.২৩%, ১০.৮৩% ও ১.০৩% করে থাকে।
- কোয়েলের ডিম বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজের ভালো উৎস। মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় সব ক’টি অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যসিড এই আমিষে রয়েছে। অ্যালবুমিনে কোন চর্বি নেই অ্যালবুমিন ও কুসুমে পানিতে দ্রবণীয় সব ক’টি ভিটামিন বিদ্যমান। তবে চর্বিতে দ্রবণীয় চারটি ভিটামিন, যেমন : ভিটামিন-‘এ’, ‘ডি’, ‘ই’ ও ‘কে’ শুধু কুসুমেই থাকে। কোয়েলের ডিমে কিছু পরিমাণ (১.০২%) শর্করাও রয়েছে। তবে যে কোন ডিমেই শর্করা কম থাকে বলে ডিমের চর্বি ও আমিষই শক্তির প্রধান উৎস।
- কোয়েলের ডিমের সাদা অংশে যথাক্রমে ৮৭.৩৪% পানি, ১১.১৮% আমিষ, ০.৭৯% ছাই ও ০.৬৭% শর্করা থাকে। সাদা অংশে কোন চর্বি নেই। কুসুমে যথাক্রমে ৪৮.২০% পানি, ১৯.৩০% আমিষ, ৩০% চর্বি, ১.৮০% ছাই ও ০.৭০% শর্করা থাকে।
- কুসুমের সমস্ত লিপিডের (Lipid) মধ্যে ৬৪% ট্রাইগ্লিসারাইড, ২৯% ফসফোলিপিড ও ২.৫% মুক্ত কোলেস্টরল থাকে। এ ছাড়াও এতে অল্প পরিমাণে ডাইগ্লিসারাইড, মুক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড ও কোলেস্টেরল ইস্টার থাকে।

গর্ভাবস্থায় কোয়েল পাখির ডিম খাওয়ার উপকারিতাঃ
ডিমের খাওয়ার উপযোগী অংশের পুষ্টিমাণ হিসেব করলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মুরগির ডিমের তুলনায় কোয়েলের ডিমের পুষ্টিমান বেশি কোয়েলের ডিমে মুরগির ডিমের তুলনায় আমিষ, ছাই ও শর্করা বেশি থাকে। যা এ সম্পর্কিত একটি গবেষণায়, মুরগি ও কোয়েলের ডিমের বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন ও শক্তির তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেখানো হয়েছে (প্রতি ১০০ গ্রাম তরল অংশ)।
কোয়েলের ডিমে ফসফরাস, লৌহ, ভিটামিন-বি, (থায়ামিন), ভিটামিন-বি, (রাইবোফ্লাভিন) এবং নিয়াসিন মুরগির ডিমের থেকে বেশি থাকে। উভয় পাখির ডিমেই ক্যালসিয়ামের হার প্রায় সমান। তাছাড়া মুরগির ডিমের তুলনায় কোয়েলের ডিমে ভিটামিন- এ কম থাকে। কোয়েল থেকে মুরুগির ডিমে শক্তি অনেক সময় সমান; আবার অনেক সময় বেশিও থাকে।
শিশুদের জন্য কোয়েল পাখির ডিমের উপকারিতাঃ
কোয়েল পাখির ডিম খেলে কি হয়?
কোয়েলের ডিম সুস্থ ব্যক্তিদের পাশাপাশি অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য বেশি উপকারি। তাছাড়া শিশুদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশে এ ডিম অত্যন্ত কার্যকরী। এগুলো রঙিন ও ছোট হওয়ায় বাচ্চারা বেশি পছন্দ করে। বয়সভেদে প্রতিটি বাচ্চার জন্য দৈনিক ১-২টি ডিমই যথেষ্ট। এতে অর্থেরও বেশ সাশ্রয় হয়। কাজেই ছোটবড় সকলেরই কোয়েলের ডিম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।

কোয়েল পাখির ডিমের অপকারিতাঃ
কোয়েল পাখির ডিমের উল্লেখ করা যায় এমন কোন অপকারিতা নেই। কাজেই ছোট হলেও তুলনামূলকভাবে কোয়েলের ডিম হাঁস-মুরগির ডিমের থেকেও উন্নতমানের।
কোয়েল পাখির ডিমের ক্ষতিকর দিকঃ
বয়স অনুযায়ী পরিমিত পরিমাণে খাওয়া হলে কোয়েল পাখির ডিমের কোন ক্ষতিকর দিক নেই। যেহেতু এটি পুষ্টিমানে ভালো তাই যে কোন বয়সের মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষা ও পুষ্টিসাধনের এই ডিম বেশি উপকারি হবে। তাই আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যে কোয়েলের ডিমের প্রাধান্য থাকা উচিত।

কোয়েল পাখির মাংসের উপকারিতা ও অপকারিতাঃ
কোয়েলের মাংস অত্যন্ত নরম ও সুস্বাদু। তাছাড়া এ মাংস অত্যন্ত পুষ্টিকর যা ব্রয়লার মুরগি বা ব্রয়লারের মাংস থেকে গুণেমানে কোন অংশেই কম নয়। এর পুষ্টিমান ও স্বাদের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি অতি উঁচুমানের খাদ্য হিসেবে পরিগণিত হয়। আর আস্ত কোয়েলের রোস্টের জনপ্রিয়তা তো ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তবে কোয়েলের এই সুস্বাদু মাংস খাওয়াটা হালাল কিনা মুসলমান অধ্যুষিত এ দেশটির অনেকেই তা নিয়ে প্রশ্ন করে থাকেন। এর জবাব পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে পাওয়া যায়।
কোরআন শরীফে তিনবার (২ঃ৫৭, ৭ঃ ১৬০, ২০ঃ ৮০-৮১ আয়াতসমূহ) কোয়েল পাখির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা হযরত মুসা (আ:) ও তাঁর অনুসারীদের (বনী ইসরাইল) উষর মরুভূমিতে দীর্ঘ অবস্থানকালে জীবনীশক্তি লাভ করার জন্য ‘মান্না’ (তুরাঞ্জাবীন- বরফের মতো স্বচ্ছ-শুভ্র এক ধরনের মিষ্ট খাবার) ও ‘সালওয়া’ (বটের বা কোয়েল পাখি) প্রেরণ করেছিলেন এবং এগুলোকে ভালো খাবার হিসেবে খাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। কোয়েলকে, এমনকি, বেহেশতের পাখির ন্যায় পাখি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
কাজেই কোয়েলের মাংস খাওয়ার ব্যাপারে মুসলমানদের কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয়। কোয়েলের মাংসের স্বাদ কিন্তু মোটেও মুরগির মাংসের মতো নয়। বরং এতে অন্য এক ধরনের নতুন স্বাদ পাওয়া যায় যা মুরগির মাংস থেকে ভালো লাগে।
কোয়েল পাখির মাংসের উপকারিতাঃ
→ এবার কোয়েলের মাংসের পুষ্টিমানের কথায় আসা যাক। এ মাংস ব্রয়লারের মতোই সব ধরনের পুষ্টি উপাদানে ভরপুর। মাংসের রাসায়নিক বিশ্লেষণে এর বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের হার জানা যায়। এতে পানি, অশোধিত আমিষ, ইথার নির্যাস (Ether extract) ও ছাই যথাক্রমে ৭৩.৯৩%, ২০.৫৪%, ৩.৮৫% ও ১.১২% করে থাকে।
→ মাংসে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ থাকে। কোয়েলের মাংসের আমিষ অত্যন্ত উঁচুমানের। এতে মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সবক’টি অ্যামাইনো অ্যাসিডই বিদ্যমান। শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সকলের জন্যই কোয়েলের মাংস অত্যন্ত উপাদেয়। বিশেষ করে রোগ থেকে সদ্য সেরে ওঠা ব্যক্তিদের জন্য এটি অত্যন্ত ভালো পথ্য।
→ কোয়েলের মাংস ব্রয়লারের মাংসের তুলনায় বেশি নরম। ব্রয়লার থেকেও এতে পানির ভাগ বেশি থাকে। ফলে মাংস হজম করতে বেশ সুবিধা হয়। অশোধিত আমিষ (Crude pro- tein) কিছুটা কম হলেও তা গুণেমানে অতুলনীয়। ইথার নির্যাস ব্রয়লারের তুলনায় বেশি থাকে বলে কোয়েলের মাংস থেকে বেশি শক্তি পাওয়া যায়।
→ তাছাড়া কোয়েলের মাংসে খনিজ পদার্থের ভাগও বেশি থাকে। সারণি- ১০ : এ ব্রয়লার কোয়েল ও ব্রয়লারের মাংসে উপস্থিত বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের তুলনা দেখানো হয়েছে।
→ পাঁচ সপ্তাহ পালন করার পর ব্রয়লার কোয়েল বাজারজাত করার উপযুক্ত হয়। বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে, পাঁচ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত পালনের পর জবাই করলে সর্বোচ্চ আর্থিক সুবিধা পাওয়া যায়। তাছাড়া এ বয়সে এদের দৈহিক বৃদ্ধি, মাংসের গুণগত মান, দেহে মাংস ও হাড়ের অনুপাত, মাংসের কোমলতা, স্বাদ ইত্যাদি অত্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে। এ সময়ে এদের জীবিত ওজন ও খাওয়ার উপযোগী মাংসের হার যথাক্রমে ১৪০-১৫০ গ্রাম ও ৭২.৫% হয়। অর্থাৎ ১৪০-১৫০ গ্রাম ওজনের একটি কোয়েল থেকে প্রায় ১১০ গ্রাম খাওয়ার উপযোগী মাংস পাওয়া যায়। ব্রয়লার কোয়েল জাব্যইয়ের পূর্বে এদেরকে প্রায় ১২ ঘণ্টা উপবাস রাখতে হবে। এতে মাংসের গুণগত মান ভালো থাকে।
→ জবাইকৃত কোয়েলের খাওয়ার উপযোগী মাংসের মধ্যে বুকের মাংসের (Breast meat( পরিমাণই সবচেয়ে বেশি থাকে। এরপরেই যথাক্রমে পিঠ, রান, ডানা, ড্রামস্টিক (Drum stick), ঘাড় ইত্যাদির স্থান।
→ দেহের বিভিন্ন অংশের খাওয়ার উপযোগী মাংসের শতকরা হার করলে দেখা যায়, বুক ও রানের মাংসের পরিমাণ ৬৭.৫%। অন্যান্য অংশের মধ্যে ড্রামস্টিক থেকে ১১.৪% এবং পিঠ, ঘাড় ও ডানা (যেগুলোতে প্রধানত হাড়ই বেশি থাকে) থেকে ২১% মাংস পাওয়া যায়। ৫-৮ সপ্তাহ বয়সে মাংস ও হাড়ের অনুপাত ৩.৩-৩.৬ এর মধ্যে থাকে।
→ বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে, ৫৮ সপ্তাহ বয়সের লেয়ার কোয়েল জবাইয়ের পর খাওয়ার উপযোগী মাংস পাওয়া গেছে প্রায় ৬৬.৪%। এ বয়সের প্রজননের (Breeder) পুরুষ কোয়েল থেকে প্রায় ৭৪.৭% মাংস পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ৫ সপ্তাহ বয়সের ব্রয়লার কোয়েল থেকে প্রায় ৭২.৫% মাংস পাওয়া গেছে।
→ তাছাড়া ব্রয়লার কোয়েলের মাংস ও হাড় অত্যন্ত নরম। কাজেই খাওয়ার জন্য ব্রয়লার কোয়েলের মাংসই সর্বোৎকৃষ্ট। তবে ব্রয়লার কোয়েল থেকে ভালো উৎপাদন পেতে হলে বাজারজাত করার পূর্বের ৭-১০ দিন এদের ঘরের আলো দৈনিক ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টায় আনতে হবে। এতে এদের যৌন পরিপক্কতার গতি ধীর হবে। তাছাড়া এরা মারামারি ও দৌড়াদৌড়িতে কম সময় নষ্ট করবে। ফলে যা খাবে তাই মাংস উৎপাদনে ব্যয় করবে।
কোয়েল পাখির মাংসের অপকারিতাঃ
কোয়েল পাখির মাংসের তেমন কোন অপকারিতা নেই। কোয়েলের মাংসের পুষ্টিমান ও অনন্য স্বাদের কথা বিবেচনা করে তাই আমাদের মাংসজাতীয় খাদ্য তালিকায় এটি অগ্রাধিকারভিত্তিতে যোগ করা উচিত।
কোয়েল পাখির ডিম ও মাংস খাওয়ার নিয়মঃ
- কোয়েলের ডিম ও মাংস মুরগির মতোই নানাভাবে রান্না করা যায়। বিয়ে, জন্মদিন, পার্টি বা যে কোন উৎসবে এর ডিম ও মাংস বিরিয়ানী, রেজালা ও অন্যান্য খাবারে সহজেই ব্যবহার করা যায়।
- যে কোন ধরনের উন্নতমানের খাবারের ডিশ (Dish) আকর্ষণীয় করে তুলতে কোয়েলের ডিমের জুড়ি নেই। কোয়েলের সিদ্ধ করা ডিম নানা রঙে রাঙিয়ে খাবারের ডিশে সরবরাহ করলে তা ডিশের মান বাড়ায়। তাছাড়া একসাথে ৪/৫টি ডিমের পোচ প্রাতরাশকেও (Breakfast) আকর্ষণীয় করে তোলে।
- কোয়েলের মাংসের অতুলনীয় স্বাদের জন্য এ থেকে তৈরি বিভিন্ন খাবার মানুষকে বেশ আকর্ষণ করে। আস্ত কোয়েলের রোস্ট তো অত্যন্ত জনপ্রিয়। কোয়েলের মাংস দিয়ে বিরিয়ানী, শিককাবাব, ফ্রাই ইত্যাদি অত্যন্ত মুখরোচক ও উপদেয় খাবার।
- বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোয়েলের মাংস ও ডিম থেকে নানা ধরনের সুস্বাদু ও আকর্ষণীয় খাবার তৈরি করা হয়। এগুলো যেমন টাটকা অবস্থায় খাওয়া যায় তেমনি সংরক্ষণ করে বা বিভিন্ন ধরনের সংরক্ষিত খাদ্যদ্রব্য তৈরির মাধ্যমে ব্যবহার করা যায়।

কোয়েল পাখির ডিম খাওয়ার নিয়মঃ
টাটকা ডিম পোচ, অর্ধসিদ্ধ ও সিদ্ধ করে খাওয়া যায় বা এ থেকে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা যায়। টাটকা অবস্থায় না খাওয়া হলে এগুলো ঘরের তাপমাত্রায় (২২° সে.-এ) দুই সপ্তাহ এবং রেফ্রিজারেটরে (৫° সে.-এ) এক মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এতে ডিমের গুণগত মানের তেমন একটা হেরফের হয় না। এর থেকে বেশি দিন সংরক্ষণ করতে হলে ডিম থেকে বিভিন্ন ধরনের দ্রব্য, যেমন : ডিম পাউডার, পিকেল ইত্যাদি তৈরি করতে হবে।
১. ডিমের পাউডার (Whole Egg Powder)
স্প্রে-ড্রাইড (Spray-dried) পদ্ধতিতে কোয়েলের ডিমের পাউডার তৈরি করা যায়। এতে উৎপন্ন পাউডারের উপাদান, জীবাণুতাত্ত্বিক (Microbiological) মান, পুনর্গঠন ধর্ম (Reconstitution property) মুরগির ডিম থেকে তৈরি পাউডারের মতোই থাকে। এ পাউডার দিয়ে ওমলেট (Omellet) তৈরি কারা যায় সহজেই। ওমলেট তৈরির জন্য এক ভাগ পাউডারের সাথে তিন ভাগ কুসুম গরম পানি যোগ করতে হবে এবং ওমলেটের স্বাদ সঠিক রাখার জন্য এতে পরিমাণ মতো লবণ, মরিচ ও অন্যান্য মশলা মিশাতে হবে।
২. কোয়েলের ডিমের পিকেল (Pickle)
সিরকা ও লবণে সংরক্ষিত খাদ্যদ্রব্যকে পিকেল বলে। ভারতের সি.এ.আর.আই.-এর বিজ্ঞানীরা কোয়েলের পুরো সিদ্ধ ও খোসা ছাড়ানো ডিম থেকে পিকেল তৈরির দুটো পদ্ধতি উদ্ধাবন করেছেন। যথা :
১. ভিনেগারভিত্তিক ডিমের পিকেল ও
২. তেলভিত্তিক ডিমের পিকেল।
প্রস্তুত প্রণালী :
ক. প্রথমে টাটকা ডিম ঘরের তাপমাত্রায় ২৪ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে।
খ. এরপর ডিমগুলো ২% খাবার লবণ সহযোগে ১০ মিনিট ধরে ফুটন্ত পানিতে সিদ্ধ করতে হবে।
গ. পুরোপুরি সিদ্ধ করা ডিমগুলো এরপর পানি প্রবাহে (Running water) ঠাণ্ডা করতে হবে।
ঘ. এরপর খোসা ছাড়িয়ে পরিষ্কার পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
ঙ. এ সময়ের মধ্যেই পিকেল তৈরির জন্য উল্লেখিত উপকরণগুলো একসাথে ভালোভাবে মিশিয়ে ১০ মিনিট উত্তপ্ত করে পাতলা কাপড়ের সাহায্যে ছেঁকে নিতে হবে। এরপর ডিমগুলোকে একটি কাচের জারে ভরে তার উপর পিকেল দ্রবণ ঢালতে হবে। দ্রবণ এমনভাবে ঢালা উচিত যাতে ডিম থেকে তা অন্তত ১.৫ সেমি উপর পর্যন্ত পূর্ণ করে ফেলে।
ছ. এভাবে ৪৮ ঘণ্টা রেখে দিলেই কোয়েলের ডিমের পিকেল তৈরি হয়ে যাবে। পিকেল তৈরি হয়ে গেলে তা দ্রবণ থেকে বের করে কাচের জার বা উচ্চ ঘনত্বের পলিথিনের (৩০০ জি.) মোড়কে ভরে সংরক্ষণ করা যায়। স্বাভাবিক ঘরের তাপমাত্রায় (২৪° সে.) ও ৫৮% আ. আর্দ্রতায় এগুলো ৪ মাস এবং রেফ্রিজারেটরে (৫°১° সে. তাপমাত্রা ও ৮০- ৮৫% আ. আর্দ্রতা) এক বছর পর্যন্ত ভালো থাকে।
৩. ব্রাইনড কোয়েল ডিম (Brined quail eggs)
পিকলিং ছাড়াও কোয়েলের সিদ্ধ ডিম ব্রাইনিংয়ের (Brining- খাবার লবণের দ্রবণে সংরক্ষণ) মাধ্যমেও সংরক্ষণ করা যায়। এতে সিদ্ধ ডিমের বাজারমান ভালো হবে। এই লবণযুক্ত ডিম আর কোন প্রসেসিং ছাড়াই খাওয়া অথবা অন্য কোন খাদ্যদ্রব্য তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। সিদ্ধ ও খোসা ছাড়ানো ডিম ৪% খাবার লবণের দ্রবণে রেখে এক মাস পর্যন্ত রেফ্রিজারেটরে (৫-৬°.-এ) সংরক্ষণ করা যায়। অবশ্য ৪% খাবার লবণ, ০.৪% সাইট্রিক অ্যাসিড ও ০.২% সোডিয়াম বেনজোয়েটের ব্রাইন দ্রবণে রাখলে দু মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। অত্যন্ত অল্প মাত্রায় সাইট্রিক অ্যাসিড থাকার ফলে ডিমের কুসুমের চারদিকে কালো বলয় (Ring) তৈরি হওয়া রহিত হয় এবং ডিমে টক স্বাদ হয় না।

কোয়েল পাখির মাংস খাওয়ার নিয়মঃ
টাটকা অবস্থায় কোয়েলের মাংস দিয়ে নানা ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরি করা যায়। টাটকা অবস্থায় খাওয়া না হলে রেফ্রিজারেটরে (৫°১° সে. তাপমাত্রা ও ৮০-৮৫% আ. আর্দ্রতা) এক সপ্তাহ এবং ফ্রোজেন অবস্থায় (-১০° সে.-এ) ৪-৬ মাস সংরক্ষণ করা যায়। এতে মাংসের গুণগত মান মোটেও কমে না। কোয়েলের সুস্বাদু মাংসের ব্যাপক চাহিদার কারণে, বিশেষ করে, খাওয়ার জন্য তৈরি অর্থাৎ Ready to eat বা Heat and serve- জাতীয় কোয়েলের চাহিদার কারণে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের মাংসজাত সংরক্ষিত খাদ্যদ্রব্য তৈরি করেছেন। যেমন : কোয়েলের মাংসের পিকেল, তন্দুরি কোয়েল, ফ্রাইড কোয়েল ইত্যাদি।
১. কোয়েলের মাংসের পিকেল (Quail meat pickle)
কোয়েল আকৃতিতে অত্যন্ত ছোট হওয়ায় জাবাইয়ের পর এর নাড়িভুঁড়ি ও অন্যান্য খাওয়ার অনুপযোগী মাংস বাদ দিয়ে পুরো কোয়েলকেই পিকেলে রূপান্তরিত করা যায়। ভোক্তাদের স্বাদ ও চাহিদার কথা বিবেচনা করে দু ধরনের মাংসের পিকেল তৈরি করা যায়। যথা : ১. ভিনেগারভিত্তিক মিট পিকেল ও ২. তেলভিত্তিক মিট পিকেল।
২. ফ্রাইড কোয়েল (Fried quail)
আকারে ছোট হওয়ায় আস্ত কোয়েলকেই ফ্রাই করা যায়। প্রথমে কোয়েল জবাই করে পালক, চামড়া, নাড়িভুঁড়ি ও খাওয়ার অনুপযোগী অংশসমূহ ফেলে দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নেয়া হয়। বরফগলা পানি বা শীতল পানিতে (১০° সে.) ৫% খাবার লবণ অথবা ৫% খাবার লবণ ও ২% সোডিয়াম ট্রাইপলিফসফেট মিশিয়ে তাতে কোয়েলটি ডুবিয়ে ৪-৫° সে. তাপমাত্রায় ২৪ ঘণ্টা রেখে দেয়া হয়। এরপর দ্রবণ থেকে তুলে তাতে ৩.৫% মাত্রায় আদর্শ মসলা মিশিয়ে ঘরের তাপমাত্রায় রেখে দেয়া হয়। অত:পর মসলা মাখানো কোয়েলকে হাইড্রোজিনেটেড উদ্ভিজ্জ ঘি-এ (১৫০ মি.লি./কেজি কোয়েল ১০ মিনিট ভাজা হয়। ভাজার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন মাংসের ভেতরের তাপমাত্রা ৮১°১° সে. থাকে। এভাবে তৈরি করা ফ্রাইড কোয়েল সাথে সাথেই পরিবেশন করা যায়।

কয়েল পাখির ডিম সংগ্রহ ও সংরক্ষণের পদ্ধতিঃ
১. ডিমের কুসুম হলুদ করতে করণীয় :
কোয়েলের ডিমের কুসুম খামারের মুরগির ডিমের মতো বিবর্ণ হয়ে যেতে পারে যদি ব্যবস্থাপনা উন্নত না হয়। অতএব এদের খাদ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যারোটিনসমৃদ্ধ সবুজ ঘাস, লতাপাতা, গাজরের টুকরা (শুকিয়েও সরবরাহ করা যায়), ভুট্টার গুঁড়া, লাল শাকের টুকরা ইত্যাদি সরবরাহ করা উচিত। এতে কুসুমের রঙ হলদে হয়ে আসবে।
২. ডিম সংগ্রহ :
দিনে অন্তত দু বার ডিম সংগ্রহ করতে হবে। প্রথমবার সন্ধ্যা ৬-৬.৩০ টায় এবং দ্বিতীয়বার রাত ৯-৯.৩০টায়। এতে ডিমে সালমোনেলা জীবাণুর (Salmonella sp.) দূষণ রোধ হবে। পাশাপাশি গুণগত মানও ঠিক থাকবে। ডিমে কোন ময়লা লেগে থাকলে তা আলতোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। কারণ, ডিমের খোসা পাতলা হওয়ায় জোরে চাপ পড়লে তা ভেঙে যাবে। তাছাড়া ডিম বেশি নাড়াচাড়া করলে এর মানও খারাপ হয়ে যাবে।
৩. ডিম সংরক্ষণ :
ডিম সংগ্রহের পরপরই তা সংরক্ষণ করতে হবে। সংরক্ষণ ঘরের তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা যথাক্রমে ১৩°-১৫° সে. (৫৫.৪°-৬৬.২° ফা.) ও ৭৫-৮০% হওয়া উচিত। এমনিতে শীতল ঘরে ডিম দশদিন পর্যন্ত ভালো থাকে। রেফ্রিজারেটরে ১৩° সে. (৫৫.৪° ফা.) তাপমাত্রায় রাখলে একমাস পর্যন্ত ভালো থাকে। মনে রাখা উচিত, ডিম সংরক্ষণের জায়গার তাপমাত্রা ১৫° সে.-এর (৬৬.২° ফা.) বেশি হলে ৩-৪ দিনের মধ্যেই ডিম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যত দ্রুত ও সঠিকভাবে ডিম সংরক্ষণ করা যাবে তত বেশিদিন এর গুণাগুণ বজায় থাকবে।
খামারিয়ান.কম কয়েল পাখি পালন সিরিজঃ
- কোয়েল পাখি সম্পর্কে a to z (30 টি প্রশ্নের উত্তর):-
https://khamarian.com/কোয়েল-পাখি/
- কোয়েল পাখির ডিমের উপকারিতা, কোয়েল পাখির মাংসের উপকারিতা, কোয়েল পাখির ডিমের পুষ্টিগুণ ও কয়েল পাখির ডিম খাওয়ার নিয়ম, কোয়েল পাখির ডিম ও মুরগির ডিমের তুলনাঃ
- https://khamarian.com/কোয়েল-পাখির-ডিমের-উপকার/
- ব্রয়লার কোয়েল পালন পদ্ধতি, কিভাবে কোয়েল পালন করা যায়, বাংলাদেশে কোয়েল পালন (কোয়েল পালন):-
https://khamarian.com/কোয়েল-পাখি-পালন-পদ্ধতি/
- জেনে নিনঃ খাচায় কোয়েল পাখি পালন পদ্ধতি/কোয়েল পাখির খাঁচা তৈরি/কোয়েল পাখির খাঁচা তৈরি মাপঃ-
https://khamarian.com/খাচায়-কোয়েল-পাখি-পালন-প/
- কোয়েল পাখির খাবার তালিকা-১, বয়স অনুযায়ী কোয়েল পাখির খাদ্য তালিকা-২, কোয়েল পাখি কি কি খাবার খায় এবং কোয়েল পাখির খাবার তৈরি/কোয়েলের খাদ্য তৈরিঃ-
https://khamarian.com/কোয়েল-পাখির-খাবার-তালিক/
- কোয়েল পাখির বাচ্চা উৎপাদনঃ (কোয়েল পাখির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো):-
https://khamarian.com/কোয়েল-পাখির-বাচ্চা-উৎপা/
- কোয়েল পালন ও চিকিৎসা, কোয়েল পাখির রোগ ও চিকিৎসা, কোয়েল পাখির চিকিৎসা, কোয়েল পাখির ঔষধ, কোয়েল পাখির ভ্যাকসিন, কোয়েল পাখির চোখের রোগ, কোয়েল পাখির চুনা পায়খানা, কোয়েল পাখির রোগ-ব্যাধি ও প্রতিকারঃ
https://khamarian.com/কোয়েল-পালন-ও-চিকিৎসা-কোয/
- কোয়েল পাখির খামার ব্যবস্থাপনা, কোয়েল পাখি চাষ, কোয়েল পাখির চাষ করে সফল হতে চাইলে ৮টি পয়েন্ট জেনে নিন!!! কোয়েল পাখি চাষের পদ্ধতিঃ-
https://khamarian.com/কোয়েল-পাখির-খামার-চাষ/