আজকে আমরা আলোচনা করবঃ
খরগোশ পালনঃ
খরগোশ তৃণভোজী শান্ত ও নিরীহ স্বভাবের প্রাণি। এখনো বাংলাদেশে খরগোশ পালন ব্যাপক আকারে হয়ে ওঠেনি। তবে বাণিজ্যিকভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খরগোশ পালন অনেক লাভজনক। তার আগে জেনে নিতে হবে খরগোশ পালনের নিয়ম-কানুন।
- খরগোশ ছোট আকৃতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।
- গৃহপালিত খরগোশের পূর্ব পুরুষ ইউরোপের বন্য খরগোশ যা জনপ্রিয় গেম অ্যানিম্যাল।
- অনেক দেশে মানুষ খরগোশের মাংস খায়।
- বর্তমান যুগেও খরগোশ এশিয়া ও দক্ষিণমেরু অঞ্চল ছাড়া প্রায় সকল মহাদেশে বন্য প্রাণী হিসেবে রয়েছে।
- বন্য খরগোশকে কৃষি ফসলের আপদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এরা শস্য খায় এবং খামারভুক্ত পশুর খাদ্য খেয়ে ফেলে।
- এক হাজার বছরের অধিক সময় থেকে খরগোশ গৃহপালিত ও নির্বাচিত প্রজননের মাধ্যমে পালন করা হচ্ছে।
- খরগোশ মাংস, চামড়া এবং পশমের জন্য ছাড়াও গবেষণাগারের প্রাণী হিসেবে পালন করা হয়।
খরগোশের ইতিহাসঃ
▻ রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বে খরগোশ গৃহপালিত হয়নি। হাজার হাজার বছর পূর্বে ইউরোপের মানুষ বন্য খরগোশ শিকার করে মাংস খেত।
▻ খ্রিস্টের জন্মের ১১০০ বছর পূর্বে ফিনিশিয়্যান নাবিক (Phoenician sailors) স্পেনের উপকূল ভ্রমণ করে মানুষ ও খরগোশের সম্পর্ক সনাক্ত করে। ইউরোপিয়ান খরগোশ (Oryctolagus cuniculus) সর্বপ্রথম প্রাচীর দিয়ে ইটালীতে কলোনি হিসেবে পালন আরম্ভ হয়।
▻ ১৮০০ সনের দিকে সৌখিন পশু পালনকারীদের আবির্ভাব ঘটে এবং পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকায় শৌখিন খরগোশ পালনকারীদের খরগোশ প্রদর্শন আরম্ভ হয়।
▻ যদিও হাজার হাজার বছর পূর্বে থেকে মানুষ খরগোশের মাংস খেতে আরম্ভ করে কিন্তু এখনও খরগোশের মাংস জনপ্রিয় নয় এবং অধিকাংশ দেশের বাজারে এর মাংস কিনতে পাওয়া যায়না।
খরগোশের নামকরণঃ
▶ বিশেষত ছেলে মেয়েরা খরগোশকে অনেক আদর করে ‘বানিস’ (Bunnies) বলে ডাকে। যদিও অনেকে র্যাবিট (‘Rabbit’) এবং অনেক আদরের নাম ‘বানি’ (Bunny) ব্যবহার করে। প্রয়োগিক ক্ষেত্রে অল্প বয়স্ক বা তরুণ খরগোশকে বানি বলা হয় ।
▶ খরগোশ শাবককে ‘কিটেন’ (Kitten) এবং সংক্ষেপে ‘কিট’ (Kit) বলা হয়। অবশ্য বিড়াল ছানাকে ‘কিটন’ বলা হয়।
▶ প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ খরগোশকে বাক্ (Buck) এবং প্রাপ্ত বয়স্ক স্ত্রী খরগোশকে ‘ডো’ (Doe) বলা হয়। অবশ্য পুরুষ জাতীয় মৃগকে বাক এবং এদের স্ত্রী জাতীয় জন্তুকে ‘ডো’ বলা হয়।

খরগোশের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যঃ
- খরগোশের আকার (সাইজ) এবং দৈহিক ওজন পরিবর্তনশীল। এদের উপর চোয়ালে ৪টি ছেদন-দন্ত (Incisors) এবং নিচের চোয়ালে ২টি ছেদন-দন্ত থাকে যা সমগ্র জীবনকালে ধারাবাহিকভাবে বর্ধিত হয়।
- খরগোশের লম্বা কান, পিছনের পা-দ্বয় বড় এবং কোমল লোম বিশিষ্ট ছোট লেজ ।
- রোডেন্ট থেকে তাদের পার্থক্য এই যে, রোডেন্ট প্রাণীর (ইঁদুর, মাইস) উপর ও নিচ চোয়ালে দু’টি করে দাঁত থাকে।
- বাড়ন্ত বয়সে খরগোশে লাফিয়ে চলার পরিবর্তে হেঁটে চলতে পারে ।
- খরগোশ মাটির গর্তে বাসা তৈরি করতে সক্ষম। যখন খায়না তখন বাসার মধ্যে থাকে।
- খরগোশ তার লম্বা ও শক্তিশালী পিছনের পা-দ্বয় দিয়ে লাফিয়ে চলে।
- খরগোশের চারটি আঙ্গুলই লম্বা এবং জোড়া লাগানো । তাই মাটিতে বিছিয়ে সহজেই লাফ দিতে পারে।
- সামনের পায়ে ৫টি নখরযুক্ত থাকে।
- প্রজাতির উপর ভিত্তি করে খরগোশ ঘণ্টায় ৩৫ থেকে ৪৫ মাইল বেগে পথ অতিক্রম করতে পারে।
খরগোশের প্রকারভেদঃ
পালনের উদ্দেশ্য অনুযায়ী খরগোশকে নিম্নোক্ত তিন প্রকারে ভাগ করা যায়
১। মাংসের জন্য পালিত খরগোশ ( Meat type rabbits)
- মাংস উৎপাদনের খরগোশ বেশ বড় আকারের হয়। যেমন- নিউজিয়াল্যান্ড হোয়াউট এবং ক্যালিফরনিয়ান জাতের খরগোশ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাংস উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়।
- মাংস উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত এসব জাতের খরগোশের মেটাবলিজম বেশ সক্রিয় ও দ্রুত বর্ধনশীল এবং ৮ থেকে ১২ সপ্তাহ বয়সে খাবার জন্য জবাই করা যায়। খরগোশের মাংস বিভিন্নভাবে রান্না করা যায় এবং কিছুটা সাদা মুরগির মাংসের ন্যায় স্বাদযুক্ত।
২। কোমল লোমবিশিষ্ট খরগোশ (Fur rabbits)
- কোমল ও ঘন লোম বিশিষ্ট খরগোশ প্রজনন করা হয় এবং এদের কোমল লোম ফার কোট (Fur coats) ও
- পোষাক পরিপাটী বা সুসজ্জিত করতে ব্যবহৃত হয়।
- কোমল লোমবিশিষ্ট খরগোশ বিভিন্ন সাইজের হয় এবং কিছু এ শ্রেণির খরগোশ মাংসের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- রেক্স এবং মিনি-রেক্স (Mini-rex) কোমল লোম বিশিষ্ট খরগোশের জাত ।
৩। পশম বিশিষ্ট খরগোশ (Wool rabbits)
- খরগোশের দেহ থেকে ছাঁটাই অথবা আস্তে আস্তে শিথিল পশম তুলে নেয়া যায় ।
- মেষের ন্যায় কতিপয় খরগোশ যেমন এ্যানগোরা (Angoras) এবং জার্সি উলিস (Jersey woolies) জাতের খরগোশ থেকে পশম পাওয়া যায়। ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ এবং জার্মান এ্যানগোরা প্রধানত পশম বিশিষ্ট খরগোশের জাত।
- পাশ্চাত্যে অনেক দেশে পোষাকের দোকানে এ্যানগোরা পশমের তৈরি সুয়েটার কিনতে পাওয়া যায় ।
খরগোশ পালনের সুবিধা :
- খাদ্য দক্ষতা অপেক্ষাকৃত ভালো ।
- মাংস উৎপাদনে পোল্ট্রির পরেই খরগোশের অবস্থান।
- কম জায়গায় কম খাবারে পালন করা যায়।
- কম খরচে বেশি উৎপাদন সম্ভব ।
- খরগোশের মাংস বেশি পুষ্টিগুণ সম্পন্ন।
- রান্না ঘরের উচ্ছিষ্ট, ঘাস ও লতা-পাতা এর খাবার।
- পারিবারিক শ্রমের সফল ব্যবহার করা সম্ভব।
- হোটেল, রেস্তোরাঁ বা ভোজসভায় এর মাংসের অনেক কদর।
- দ্রুত বর্ধনশীল প্রাণি ।
- একসাথে ২-৮টি বাচ্চা প্রসব করে।
- একমাস পরপর বাচ্চা প্রসব করে।

খরগোশ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিঃ
▪ ইউরোপীয় খরগোশ থেকে বিভিন্ন প্রকারের (Varities) খরগোশ গৃহপালিত হয়েছে। এসমস্ত খরগোশের মাংস, কোমল লোম বা কোমল লোমবিশিষ্ট চর্ম এবং পোষা প্রাণী হিসেবে পালন করা হয়। খরগোশ যত্নের সাথে পালন করলে, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং আমোদপ্রিয় পোষা প্রাণী হিসেবে বেশ চমৎকার।
▪ গৃহের বাহিরে পালিত খরগোশের ক্ষেত্রে শীতকালের শীত এবং গরমকালে গরম থেকে রক্ষার জন্য আশ্রয়স্থল বা রক্ষাস্থলের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
▪ গৃহপালিত খরগোশ ১০ থেকে ২১° সেন্টিগ্রেড (৫০-৭০° ফারেনহাইট) তাপমাত্রায় অধিক আরামদায়ক এবং ৩২° সেন্টিগ্রেড (৯০° ফারেনহাইট) এর অধিক তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে না।
▪ সাফল্যের সাথে খরগোশ পালনের জন্য প্রয়োজন বাসস্থান, সুষম খাদ্য, প্রজনন, স্বাস্থ্যকর ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
▪ বিভিন্ন বর্ণ এবং আকারের খরগোশ রয়েছে এবং বাছাইকৃত প্রজননের মাধ্যমে শতশত বিভিন্ন জাতের খরগোশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে।
▪ গৃহের বাহির এবং ভিতরে খরগোশ পালন করা হয়। তবে গৃহের বাহিরে পালিত খরগোশ অপেক্ষা ভিতরে পালিত খরগোশ সাধারণত অধিক স্বাস্থ্যবান ও বন্ধুভাবাপন্ন হয়।
খরগোশের খাদ্য ও খাদ্য খাওয়ানোঃ
✔ কচি ঘাস, লতা-পাতা, গাজর, মুলা, শস্যদানা, মিষ্টি আলু, শসা, খড়কুটো, তরকারির ফেলনা অংশ, গম, ভুসি, সয়াবিন, দুধ, পাউরুটি, ছোলা নিত্যদিনের খাবার। ঘাস ও শাক সবসময় শুকনা বা ঝকঝকে অবস্থায় দিতে হবে। ভেজানো গম বা ছোলা অল্প সেদ্ধ করে এর সাথে ভুসি মিশিয়ে দিলে ভালো হয়।
✔ মূলা এবং গাজর, শালগম বা ওলকপি, মিষ্টি আলু এবং শুষ্ক ক্যাসাভা চিপস খরগোশের খাদ্য হিসেবে উপযোগী।
✔ সবুজ খাদ্য সামগ্রী, সরস সুস্বাদু ঘাস, শাক-সবজি, নেপিয়ার ঘাস, সবুজ ভুট্টা, সবুজ জই (ওট), কাউ-পীস (Cow-peas), সয়াবিন ইত্যাদি খরগোশের রুচিকর খাদ্য।
✔ কোন সময় খরগোশকে টমাটো এবং আইরিশ পটাটো ভিনস (Vines) খাওয়ানো উচিৎ নয় কারণ এসব খাদ্য বিষক্রিয়া সৃষ্টি করবে।
✔ দানাদার খাদ্য- সবুজ শাক-সবজি এবং মূল বা শিকড় জাতীয় খাদ্যদ্রব্য খরগোশ মাঝারি ধরনের উৎপাদন সম্ভব। তবে সুস্বাস্থ্য এবং অধিক উৎপাদনের জন্য কিছু দানাদার খাদ্য সরবরাহ করা প্রয়োজন। বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত পিলেট বা বড়ি খাদ্য অথবা খাদ্য শস্যের সাথে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন- কটন-সীড কেক, গ্রাউন্ড-নাট কেক্ অথবা ফিস মিল মিশিয়ে খাওয়ানো যায় ।
✔ সাধারণত প্রত্যহ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র ২০ ঘণ্টা খরগোশের খাঁচায় খাদ্য সরবরাহ এবং বাকী ৪ ঘণ্টা খাদ্যবিহীন অবস্থায় পালন করা উত্তম।
✔ উপযুক্তভাবে খাদ্য খাওয়ানো একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। যদি খরগোশকে কেবলমাত্র তৃণাদি খাদ্য খাওয়ানো হয় তবে দৈহিক বৃদ্ধি তেমন হয়না। অবশ্য খরগোশের খাদ্য তালিকায় সম্পূর্ণ উদ্ভিদ উৎস থেকে সরবরাহ হয়।
✔ খরগোশ বিশেষজ্ঞ ভেটেরিনারিয়ান কর্তৃক সুপারিশকৃত খাদ্য তালিকা খাওয়ানো প্রয়োজন।
খরগোশের খাদ্য তালিকায় : হে, পত্রময় সবুজ শাক-শবজি, পানি এবং অল্প পরিমাণে পিলেট থাকা প্রয়োজন। খরগোশের জন্য তার খাঁচায় এক খন্ড সৈন্ধব লবণ (Rock salt) রাখতে হয়। খরগোশকে সকাল ও সন্ধায় দিনে দু’বার করে খাদ্য সরবরাহ করতে হয়।
খরগোশ কপ্রোফেগী বা সিউডো-রুমিন্যান্টঃ
⇥ খরগোশের মল খাওয়া অভ্যাস আরম্ভ হয় বয়সের ২য় এবং ৩য় সপ্তাহে এবং বিশেষ করে খরগোশের বাচ্চার শক্ত খাদ্য খাওয়া আরম্ভের সাথে সাথে।
⇥ খরগোশ স্বাভাবিক অবস্থায় দিনের বেলায় দৃঢ়, সম্পূর্ণ গঠিত বটিকা বা বড়ি আকৃতির মল ত্যাগ করে এবং কদাচিৎ রাত্রের সময় নরম বড়ি আকৃতির মল ত্যাগ করে।
⇥ খরগোশ রাত্রের নরম মলের আস্ত বটিকা সম্পূর্ণ খেয়ে ফেলে।
⇥ খরগোশের মলে পর্যাপ্ত জীবাণু ছাড়াও অন্ত্রে সংশ্লেষিত বি-ভিটামিন, প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টিকর পদার্থ থাকে খরগোশের অন্ত্রের জীবাণুর স্থায়িত্ব স্বাভাবিক কপ্রোফেগী অভ্যাসগত পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল।
⇥ খরগোশ তার নিজের মলদ্বার থেকে সরাসরি নিজের মল খাওয়ার অভ্যাসের কারণে তাদের সিউডো-রুমিন্যান্ট বলা হয় ।
⇥ খরগোশ তার নিজের মল খায় ব্যাপারটি স্বাভাবিক। মল খাওয়া অভ্যাস কোন পুষ্টির অভাব জনিত কারণে নয়।
⇥ খুব সকালে অথবা রাত্রে খরগোশ যখন অপর্যবেক্ষণ অবস্থায় থাকে সে সময় মাথাকে বাঁকিয়ে মলদ্বারে মুখ দিয়ে নিজের মল খায় ।

খরগোশের ঘর বা বাসগৃহঃ
খরগোশকে বৃষ্টি, ঝড় ও রৌদ্র থেকে রক্ষা এবং শিকারী যেমন কুকুর, বিড়াল ইত্যাদির কবল থেকে নিরাপদ রাখার জন্য বাসগৃহ প্রয়োজন। খরগোশের ঘরের প্রয়োজনীয় উপকরণ আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল। অপ্রশস্ত দালান ঘর বায়ু চলাচলের জন্য যেমন উপযোগী তেমনি বর্ধিত করার জন্য সুবিধাজনক।
গরম অঞ্চল (Hot areas) :
- প্রতিটি খাঁচায় খাদ্য ও পানি সরবরাহের সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- খাঁচার মেঝে কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি করা যায়। তবে মলমূত্র নিষ্কাশনের জন্য উপযুক্ত সংখ্যায় ছিদ্রের ব্যবস্থা করতে হবে।
- বাচ্চা প্রসবের বাক্স (Nest boxes) এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন খাঁচার ভিতরে ভালভাবে স্থাপন করা যায়। এছাড়া দু’বার বাচ্চা প্রসবের মধ্যবর্তী সময়ে নেস্ট বাক্স পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করার জন্য বের ও পুনঃস্থাপন করা যায় তার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
- মাঝারি সাইজের খরগোশের জন্য একটি আদর্শ নেট বাক্সের সাইজ হল = ১৬ × ৮ ইঞ্চি (৪০ × ২৫ সেন্টিমিটার) উচ্চতা বিশিষ্ট ।
- ছায়ার জন্য এক চালা ঘর এবং শিকারীর বিপদ থেকে প্রতিরোধের জন্য খরগোশের ঘরের চারিপার্শ্বে বেড়া দেয়া যেতে পারে।
- খাঁচার ফ্রেম তৈরি করে তারের নেট দিয়ে আবৃত করতে হবে। ফ্রেমের উপরিভাগ এবং পার্শ্বে ২.৫ সেন্টিমিটার ফাঁক বিশিষ্ট নেট এবং খাঁচার মেঝেতে ১ হতে ১.৫ সেন্টিমিটার ফাঁক বিশিষ্ট নেট ব্যবহার করতে হবে।
- খরগোশের একটি আদর্শ খাঁচার মাপ হল = ৩০ × ৩৬ ইঞ্চি (৭৫ × ৯০ সেন্টিমিটার) উচ্চতা বিশিষ্ট খাঁচা।
ঠান্ডা অঞ্চল (Cold areas) :
- খরগোশের বিশ্রাম ও ঘুমানোর জন্য খাঁচার মেঝে কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি করা যায় এবং দৌড়ানোর জায়গা তারের জালি দিয়ে তৈরি করা যায়।
- খরগোশের ঘরের সাইজ ১২০ × ৬০ × ৬০ সেন্টিমিটার।
যেভাবে পালন করবেন : বাড়ির ছাদ, আঙিনা বা বারান্দায় ছোট আকারের শেড তৈরি করে খরগোশ পালন করা যায়।
লিটার পদ্ধতিতে খরগোশ পালনঃ
কমসংখ্যক খরগোশ পালনের জন্য এ পদ্ধতি উপযোগী। এর জন্য মেঝে কংক্রিটের হওয়া উচিত। খরগোশ মাটি খুঁড়ে গর্ত বানায়। লিটার পদ্ধতিতে মেঝের ওপর ৪-৫ ইঞ্চি পুরু করে তুষ, কাঠের ছিলকা অথবা ধানের খড় ছড়িয়ে দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে খরগোশ পালন করতে হলে একসাথে ৩০টির বেশি খরগোশ পালন করা ঠিক নয়। পুরুষ খরগোশ আলাদা ঘরে রাখতে হবে। কারণ খরগোশ সামলানো খুব কঠিন। শুধু প্রজননের জন্য পুরুষ খরগোশকে স্ত্রী খরগোশের কাছে ১০-১৫ মিনিট ছেড়ে দেওয়া হয়।
খরগোশের প্রয়োজনীয় জায়গাঃ
- একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ খরগোশের জন্য ৪ বর্গফুট জায়গা দরকার ।
- পূর্ণবয়স্ক মা খরগোশের জন্য দরকার ৬ বর্গফুট (প্রসূতি ঘরসহ)।
- বাচ্চা খরগোশের জন্য ১.৫ বর্গফুট দরকার।
স্ত্রী খরগোশ গরম হবার লক্ষণসমূহঃ
(ক) অস্থির বা চঞ্চল হয়।
(খ) জনন অঙ্গ স্ফীত হয়।
(গ) খাঁচার প্রাচীর এবং খাদ্যের পাত্রকে ঘর্ষণ করবে।
(ঘ) পরবর্তী খাঁচার খরগোশের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবে।
খরগোশের প্রজননঃ
- পুরুষ খরগোশের খাঁচায় সর্বদা পুরুষ খরগোশ রাখতে নেই। কারণ এতে পুরুষ খরগোশের মেজাজ বিগড়ানোর সম্ভাবনা থাকে।
- স্ত্রী এবং পুরুষ খরগোশের মিলন ১৪ থেকে ১৬ দিন পরপর সংঘটিত হয়। গর্ভাবস্থায় সংগম হয়।
- বছরে প্রতিটি স্ত্রী খরগোশের চারবার বাচ্চা প্রসব করানো যায় এবং প্রতিটি মা খরগোশের ৭টি করে বাচ্চা পালন সহজ হয়।
- বাচ্চা প্রসবের পর যে কোন সময় পুনঃপ্রজনন করা যায়। বাণিজ্যিক খামারে প্রসবের ৭-২১ দিন পর এবং প্রদর্শন ও শখের খরগোশকে ৩৫-৪২ দিন পরে প্রজনন করা হয়।
- যে সব মা খরগোশের দৈহিক আকার ও আকৃতি ভালো সেসব খরগোশকে প্রজননের জন্য বাছাই করা প্রয়োজন।
- খরগোশের প্রজননের বয়স ৫ থেকে ৭ মাস এবং গর্ভাবস্থা ৩ থেকে ৩৩ দিন।
- প্রতি ১০টি স্ত্রী খরগোশের জন্য ১টি প্রজননক্ষম পুরুষ খরগোশ রাখতে হয় এবং পুরুষ খরগোশ প্রজননে ব্যবহার করা যায়।

খরগোশের বাচ্চা প্রসবের বাসাঃ
- খরগোশের বাচ্চা প্রসবের কয়েকদিন পূর্বে থেকে খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ করে দেয়। তাই এসময় রুচিকর নরম খাদ্য সরবরাহ করা প্রয়োজন ।
- প্রজননের ২৮/২৯ দিন পর বাচ্চা প্রসবের বাক্স খাঁচার মধ্যে রাখতে হবে।
- বাচ্চা প্রসবের এক বা দু’দিন পূর্বে খরগোশ তার শরীরের কোমল লোম তুলে নেস্ট বাক্সে বাসা তৈরি করে।
খরগোশের বাচ্চার যত্নঃ
- খরগোশের নবজাত বাচ্চা অনাবৃত (লোমহীন), অন্ধ এবং বধির অবস্থায় জন্ম গ্রহণ করে। বাচ্চা পরীক্ষার জন্য প্রথমে বাচ্চার মাকে সরিয়ে পরীক্ষা করতে হয়। মৃত এবং অত্যাধিক দুর্বল বাচ্চা থাকলে সরিয়ে নিতে হবে।
- বাচ্চাকে দুধদানকালীন সময়ে কিছু অতিরিক্ত দানাদার খাদ্য, দুধ ও পাউরুটি খাওয়ানো যায়।
- অধিকাংশ মধ্যম আকারের স্ত্রী খরগোশের ৮ থেকে ১০টি স্তনের বোঁটা থাকে এবং একটি খরগোশ ১২ থেকে ১৫টি বাচ্চা প্রসব করে। সুতরাং কিছু বাচ্চাকে অন্য সদ্যপ্রসবকৃত খরগোশের মাধ্যমে লালন-পালন করতে হয়। জন্মের ২/৩ দিন পর থেকে বাচ্চার দেহে লোম গজাতে আরম্ভ করে এবং ১০দিন বয়সে তাদের চোখ ফোটে এবং কান খোলে বা শুনতে পায়।
- বাচ্চা প্রসবের পরে মা খরগোশের দেহ হালকা-পাতলা দেখায়, নেস্ট বক্সের প্রবেশ পথের চারিপার্শ্বে কোমল লোম ও আবর্জনা থাকে এবং নেস্ট বক্সে অন্ধকার প্রান্তে কিছু একটার নড়াচড়া দেখা যাবে।
- কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা প্রসবকৃত খরগোশকে বিরক্ত না করে একা থাকতে দিতে হবে। অনেক সময় মা খরগোশের মেজাজ বিগড়িয়ে যেতে পারে এবং সেক্ষেত্রে নিজের সদ্যজাত বাচ্চাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে।
মাই ছাড়ানোঃ
প্রায় আট সপ্তাহ বয়সে মায়ের দুধ খাওয়ানো ছাড়াতে হয়। অর্থাৎ বাচ্চার ৮ সপ্তাহ বয়সে মা খরগোশকে পৃথক খাঁচায় রাখতে হবে। তবে বাচ্চাকে না সরিয়ে পূর্বের খাঁচায় রাখা প্রয়োজন। কারণ বাচ্চা সরালে মেজাজ বিগড়ানোর সম্ভাবনা থাকে।
তথ্য রেকর্ড ও হাতানোঃ
- খুব যত্নসহকারে খরগোশকে ধরতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সাধারণত এক হাত দিয়ে স্কন্ধ বা কাঁধের শিথিল বা ঢিলা ত্বক দৃঢ়ভাবে ধরে এবং অন্য হাত মেরুদন্ডের প্রান্তভাগ-নিতম্ব বা পাছার নিচে রেখে দেহের ওজন ধারণ করতে হয়।
- খরগোশকে যদি সঠিক পদ্ধতিতে এবং দৃঢ়রূপে ধরা না হয় তবে খরগোশের পিছনের পায়ের আঙ্গুলের নখ দিয়ে নিয়ন্ত্রণকারীর হাতের অরক্ষিত অংশে তীব্রভাবে আঁচড়িয়ে দিতে পারে।
- খরগোশের বাচ্চাকে কখনও হাতানো উচিত নয় কারণ হাতালে তার মা পরিত্যাগ করে।
- প্রজনন স্টক নির্বাচনের উদ্দেশ্যে প্রজনন, খাদ্য ও দৈহিক ওজন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
খরগোশ বাজারজাতকরণঃ
- মাংসের জন্য চার মাস বয়সে খরগোশকে জবাই করা হয়। জবাইয়ের আগের মাসের খরগোশকে মোটাতাজা করার জন্য খাদ্য শস্যের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং সবুজ খাদ্যের পরিমাণ হ্রাস করতে হয়।
- খরগোশের চামড়া একটি কাঠের তক্তায় টেনে প্রসারিত করে আটকিয়ে অতিরিক্ত কোষকলা চেছে ও ঘষে তুলে ফেলে শুকাতে হয়।
খরগোশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাঃ
- কয়েকদিন পরপর খরগোশের খাদ্যের এবং পানির পাত্র বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার ও রৌদ্রে শুকিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
- খরগোশ পালনের জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- প্রতি মাসে অথবা যখন খরগোশের খাঁচা খালি হবে তখনই খাঁচা ধৌত ও জীবাণুনাশক পদার্থ দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
- প্রতিদিন খরগোশের খাঁচা থেকে মলমূত্র এবং অপরিষ্কার নোংরা বিছানাপত্র ও আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে।
- রোগাক্রান্ত খরগোশকে সুস্থ খরগোশ থেকে পৃথক করে আলাদাভাবে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।