দুধ, মাংস ও ডিম দ্বারা প্রাণিজ আমিষের চাহিদা মেটানো, চাষাবাদ, জৈবসার এবং জ্বালানি সরবরাহের লক্ষ্যে আবহমান কাল থেকে মানুষ গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি ইত্যাদি পালন করে আসছে। বর্তমানে হাঁস-মুরগি এবং গবাদিপশু শিল্পের প্রসার ঘটার ফলে কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও উৎপাদনে নারীর সম্পৃক্তকরণের উল্লেখযোগ্য খাত হচ্ছে প্রাণিসম্পদ।
আজকে আমরা আলোচনা করবঃ
গরু পালনঃ
আমাদের দেশে গৃহপালিত প্রাণীর মধ্যে গরুই প্রধান। দুধ ও মাংসের জন্য গরু পালন করা হয়। এদেশের গ্রাম অঞ্চলে গরু পালনের পাশাপাশি বর্তমান শহরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খামারে গরু পালন করা হচ্ছে। গরুর জাত বর্তমানে আমাদের দেশে সাধারণত ৩ জাতের গরু দেখা যায় যথা :
১. দেশি জাতের গরু: দেশি জাতের গরুর মধ্যে পাবনা, রেড চিটাগাং (আরসিসি), মুন্সিগঞ্জ, নর্থ বেঙ্গল গ্রে গরু অন্যতম। এরা ২-৫ লিটার দুধ দিয়ে থাকে।
২. উন্নত বিদেশি জাতের গরু: দুধালো জাতের মধ্যে হলস্টেইন ফ্রিজিয়ান, জার্সি এবং মাংসল জাতের গরুর মধ্যে ব্রাহমান, বিফ মাস্টার, রেড অ্যাংগাস, ইত্যাদি। এরা প্রতিদিন প্রায় ১৫-৪০ লিটার পর্যন্ত দুধ উৎপাদন করে।
৩. সংকর জাতের গরু: অধিক উৎপাদনের জন্য কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে আমাদের দেশি জাতের গরুর সাথে উন্নত জাতের গরুর সাথে সংকরায়ন করা হয়। এগুলোকে সংকর জাতের গরু বলে। এদের উৎপাদন দক্ষতা দেশি গরুর তুলনায় অধিক।
গরুর খাদ্য ও পুষ্টি: গরুকে আঁশ এবং দানাদার জাতীয় খাদ্যের মাধ্যমে তাদের পুষ্টি সরবরাহ করা হয়। তবে আঁশ জাতীয় খাদ্য হিসেবে খড় ও কাঁচা ঘাস এবং দানাদার জাতীয় খাদ্য হিসেবে গম, ভুষি, খৈল, কুঁড়া, খনিজ মিশ্রণ, লবণ সরবরাহ করা হয়। কাঁচা ঘাস হিসেবে উন্নত জাতের ঘাস যেমন – নেপিয়ার, পারা, জার্মান, ভুট্টা সরবরাহ করা।
ৰাসস্থান: এদেশে গ্রাম অঞ্চলে চালাঘরে গরু রাখা হয়। তবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গরু পালন করলে বহিঃমুখী ও অন্তঃমুখী বাঁধা ঘর তৈরি করা হয়।
রোগ বালাই: এনথ্রাক্স, ক্ষুরারোগ, ওলান পাকা রোগ, বাদলা, গলাফুলা, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগ ব্যাধি হয়ে থাকে।
ছাগল পালনঃ
- ছাগল আকারে ছোট, কম খাদ্য খায়
- বছরে কমপক্ষে দুই বার চারটি বাচ্চা দেয়, কম বয়সে প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করে।
- ছাগলের মাংস অপেক্ষাকৃত সুস্বাদু।
- এসব বিবেচনায় ছাপলকে “গরিবের গাভী” বলা হয়।
- বাংলাদেশে বহুল পরিচিত এবং পালিত ২টি ছাগলের জাভ হলো ব্ল্যাক বেঙ্গল এবং যমুনাপারি।
বাসস্থান: ছাগল ছেড়ে, অর্ধ ছেড়ে এবং আবদ্ধ অবস্থায় (স্টল ফিডিং) পালন করা যায়। ছাগলের পালনে ২ ধরনের ঘর ব্যবহার করা হয় সেগুলো হলো- ১. ভূমির উপর ঘর ২. মাচার উপর ঘর।
খাদ্য: ছাগল তার ওজনের ৪-৫% হারে খেয়ে থাকে, মোট খাবারের ৬০-৮০% আঁশ জাতীয় খাবার (ঘাস, লতা, পাতা, খড় ইত্যাদি) এবং ২০-৪০% দানাদার খাবার (কুঁড়া, ভুষি, চাল, ডাল)। ছাগলের বয়সের এবং উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন খাবার সরবরাহ করা হয় সেগুলো হলো ৰাচ্চা অবস্থায় খাদ্য, বাড়ন্ত অবস্থায় খাদ্য প্রজননক্ষম ছাগল ও পাঁঠার খাদ্য, গর্ভবতী অবস্থায় খাদ্য।
রোগ বালাই: ছাগলে অন্যতম রোগ সমূহ হচ্ছে পিপিআর, পোটাপন্ন, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ইত্যাদি।
ভেড়া পালনঃ
- যেসব সব এলাকায় কমবেশি ভেড়া পালন করা হয়। তবে সমুদ্র উপকূল, রাজশাহীর বরেন্দ্র এলাকা ও পাহাড়ি এলাকার ভেড়া বেশি পালন করা হয়।
- ভেড়া থেকে মাংস, দুধ ও পশম পাওয়া যায়। ভেড়া পরিবেশের সাথে সহজেই খাপ খাইয়ে চলতে পারে।
- কয়েকটি উন্নত জাতের ভেড়া হলো মেরিনো, ডরসেট, ডামারা, সাফোক, র্যামবুলেট ইত্যাদি। বাসস্থান।
- ভেড়ার ঘর খড়, ছন, টিন বা ইটের তৈরি হতে পারে। ভেড়া বাঁশ বা কাঠের মাচায় রাখলে রোগবালাই কম হয়।
খাদ্য ও পুষ্টি: ভেড়া মাটিতে চড়ে খেতে পছন্দ করে। এরা ঘাস, লতাপাতা, সাইলেজ, হে, খড়, দানাদার খাদ্য ইত্যাদি খেয়ে থাকে। খাদ্যভাবের সময় এরা মোলাসেস মিশ্রিত খড়, নাড়া ইত্যাদিও খায়।
রোগ বালাই: সাধারণত ভেড়ার রোগবালাই খুব একটা দেখা যায় না। বিভিন্ন রোগসমূহের মধ্যে পরজীবীজনিত রোগ যেমন চর্মরোগ, লোম উঠা ইত্যাদি দেখা যায়। তাছাড়াও কিছু কিছু রোগ যেমন ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, পিপিআর, কন্টাজিয়াস একথাইমা ইত্যাদি রোগ দেখা যায়। ভেড়ার খামারের জন্য বছরব্যাপী ডিওয়ার্মিং, ডিপিং ও ভ্যাকসিনেশন কর্মসূচী নিকটস্ত উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার পরামর্শ অনুযায়ী পালন করতে হবে।
হাঁস পালনঃ
- হাঁস পালন করলে পারিবারিক আয় বৃদ্ধিতে, পুষ্টির অবস্থার উন্নয়নে তথা দারিদ্র্যবিমোচনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এ দেশের নদী-নালা, খাল-বিল হাওর-বাওড়, পুকুর-ডোবা হাঁস পালনের উপযোগী।
- হাঁস প্রাকৃতিক খাদ্য খেয়ে তার খাদ্য চাহিদার অর্ধেকেরও বেশি পূরণ করে থাকে। দেশে প্রচুর খাল-বিল নদী-নালা আছে, তাই একজন খামারি সামান্য পরিমাণ খাদ্য প্রদান করে লাভজনকভাবে হাঁস পালন করতে পারে।
- বাংলাদেশের প্রধান হাঁস পালন এলাকা হচ্ছে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও এর আশপাশের নিচু এলাকা। এ সমস্ত এলাকায় সচরাচর যে সমস্ত হাঁসের জাত দেখা যায় সেগুলো হলো খাকি ক্যাম্ববেল, দেশি, জেন্ডিং, ইন্ডিয়ান রানার ইত্যাদি।
বাসস্থান: হাঁস আবদ্ধ, অর্ধ আবদ্ধ; ছেড়ে, হারডিং এবং ল্যানটিং পদ্ধতিতে পালন করা যায়। হাঁস খুব বেশি গরম ও খুব বেশি ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে না তাই হাঁসের ঘরের জন্য সাধারণত খোলামেলা উঁচু ও রোদ থাকে এমন জায়গা বাসস্থানের জন্য নির্বাচন করা উচিত।
রোগবালাই: হাঁসের ২টি মারাত্মক রোগ হলো ডাক প্লেগ ও ডাক কলেরা। এ দুটি রোগের ভ্যাকসিন সময়মতো ও পরিমাণমতো দিলে এর প্রকোপ হতে অনেকটা রক্ষা পাওয়া যায়।
মুরগি পালনঃ
- পারিবারিক আমিষ পুষ্টির চাহিদা মেটাতে গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবার হাঁস-মুরগি পালন করে আসছে। বর্তমান দেশের বেকার সমস্যার সমাধান, আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি, সর্বোপরি দেশের দারিদ্রবিমোচনে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মুরগি পালনে অবদান রাখছে।
- সম্প্রতি আমাদের দেশে ডিম পাড়া মুরগির জাত “শুভ্রা” আবিষ্কার হয়েছে। এটি খামারি পর্যায়ে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এটি বছরে ২৯০-২৯৪ টি ডিম দেয়।
ব্রয়লার স্ট্রেইন: স্টারব্রো, ট্রপিকব্রো, ইসা বেডেট, ইসা আই ৭৫৭, ইসা ৭৩০ এমপিকে হাবার্ড ক্ল্যাসিক, গোল্ডেন কমেট, লোহয্যান, ভ্রানকব, কাসিলা, কব ৫০৯।
লেয়ার স্ট্রেইন: সোনালি, শেবার ৫৭৯, ইসা ব্রাউন, ইসা হোয়াইট, লোহম্যান ব্রাউন, লোহম্যান হোয়াইট হাইসেক্স ব্রাউন হাইসেক্স হোয়াইট।
ৰাসস্থান: দেশি মুরগি সাধারণত ছেড়ে পালন করা হয়। কিন্তু বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্রয়লার বা লেয়ার আবদ্ধ অবস্থায় পালন করা হয়ে থাকে। আবদ্ধ অবস্থায় অদর মেঝে বা ফ্লোর এবং মাচা পদ্ধতিতে পালন করা হয়।
খাদ্য: ব্রয়লার এবং লেয়ার মুরগিকে বাণিজ্যিক উপায়ে তৈরিকৃত স্টারটার (বাচ্চার খাদ্য), খোয়ার (বাড়ন্ত মুরগির খাদ্য) এবং ফিনিশার (বয়স্ক মুরগির খাদ্য) খাদ্য সরবরাহ করা হয়। এছাড়া মুরগির উৎপাদন এবং বয়সের ভিত্তিতে অনেকে বিভিন্ন খাদ্য উপাদান (গম, ভুট্টা, কুঁড়া, প্রোটিন কনসানট্রেট, খৈল, ভিটামিন-খনিজ মিশ্রণ, লবণ) একত্রে মিশিয়ে খাবার তৈরি করে মুরগিকে সরবরাহ করে থাকে।
রোগ বালাই: মুরগির বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধির মধ্যে গামবোরো, রানীক্ষেত, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফু মারাত্মক রোগ। নিয়মিত টিকাদান এবং খামারের জীবনিরাপত্তার মাধ্যমে এসব রোগ প্রতিরোধ করা যায়।