গরুর দানাদার খাদ্য কি?
যেসব খাদ্যে আয়তনের তুলনায় খাদ্যমান অপেক্ষাকৃত বেশি এবং সহজপাচ্য তাকে দানাদার খাদ্য বলা হয়। দানাদার গোখাদ্যগুলো হলো চালের কুঁড়া গমের ভুসি, ভুট্টা, বিভিন্ন প্রকার খৈল, কলাই, ছোলা, খেসারি, সয়াবিন ও শুকনো মাছের গুঁড়া এসব। আমিষের পরিমাণ ভিত্তিতে দানাদার খাদ্যগুলো তিন ভাগে করা যায়। ক. কম আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন- কুঁড়া, ভুসি (৫-১৫% আমিষ)। খ. মধ্যম আমিষসমৃদ্ধ খাদ্য যেমন- খৈল, কলাই, ছোলা ২০-২৫% আমিষ। গ. উচ্চ আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য শুকনো মাছের গুঁড়া, কসাই খানার মাংসের কণা, রক্তের গুঁড়া ৩৫-৪৫% আমিষ।
ভুট্টা, সয়াবিন মিল, চাউলের কুড়া, গমের ভূষি, চাউলের খুদ, খৈল, কলাই, মটর, খেশারী ইত্যাদি আমাদের দেশের প্রধান দানাদার খাদ্য উপাদান। এগুলোর সাথে পরিমানমত বিভিন্ন সাপ্লিমেন্ট, ভিটামিন ও মিনারেল মিশিয়ে সুষম দানাদার খাদ্য তৈরি করা হয়। তবে গরু মোটাতাজাকরণ খাদ্য তৈরি তে খাদ্যের গুনগত মানের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। খাদ্যের প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহায়ড্রেট ইত্যাদির পরিমান চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যের মাধ্যমে সরবরাহ হচ্ছে কি-না দেখতে হবে। গরু মোটাতাজাকরণ খাদ্য মোটাতাজাকরণের গরুকে নিয়মিত খাওয়ানোর মাধ্যমে আশানুরূপ উৎপাদন পাওয়া সম্ভব হয়।
মোটাতাজা করতে গরুর খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ
প্রথম ডোজ ক্রিমির ট্যাবলেট খাওয়ানোর ৮ তম দিন থেকে গরুকে স্বাভাবিক খাবারের সাথে অল্প পরিমানে উন্নত খাবার দিতে হবে। উন্নত খাবার বলতে গমের ভূষি, ডাউল ভাংগা, চাউলের কুড়া, সয়ামিল, খৈল, লবন ইত্যাদির মিশ্রন কে বোঝানো হয়েছে তবে বাজারে অনেক কম্পান্নির রেডিমিক্স উন্নত মানের গরুর দানাদার খাদ্য পাওয়া যাই সেটাও খাওয়ানো যেতে পারে। খাবারের সাথে গরু মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়া অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। দানাদার খাদ্য এক পোয়া থেকে খাওয়ানো শুরু করে সাত দিনের মাঝে ১ কেজি করে খাওয়ানো শুরু করতে হবে। এবং আস্তে আস্তে তা বাড়িয়ে এমন পর্যায়ে নিতে হবে যেনো গরু পাতলা পায়খানা না করে। পায়খানা নরম হলে দানাদার খাবারের পরিমাণ আস্তে আস্তে কমিয়ে দিতে হবে। দানাদার খাদ্য সকাল বিকাল ভাগ করে ২ বারে খাওয়াতে হবে। ১৫০-২০০ কেজি ওজনের একটি গরুকে দিনে ৩-৪ কেজি দানাদার খাদ্য খাওয়ানো যেতে পারে। দানাদার খাদ্যের সাথে লবণ, ডিসিপি বা ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ও মিনারেল প্রমিক্স অবশ্যই মিশিয়ে মোটা তাজা করণ গরুকে খাওয়াতে হবে। অন্যদিকে দুপুরে গরুকে পরিমাণ মতো খুদের জাও খাওয়ানো যেতে পারে।
গরু মোটাতাজাকরণ খাদ্য সরবরাহ পদ্ধতিঃ
গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পে গবাদি পশুর জন্য পরিমাণ মত সুষম গরু মোটাতাজাকরণ খাদ্য সরবরাহ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খাবারের তালিকায় শর্করা (Carbohydrates), আমিষ (Protein), চর্বি (Fat) ও ভিটামিন-মিনারেল এর পরিমান সাধারণত খাদ্যের চেয়ে বেশি থাকতে হবে। প্রচুর পরিমাণ টিউবয়েলের টাটকা পানি সরবরাহ করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে গবাদি প্রাণির সবচেয়ে সহজলভ্য ও সাধারণ খাদ্য হলো খড়, যার ভিতর আমিষ, শর্করা ও খবিজের ব্যাপক অভাব রয়েছে। তাই খড়কে ইউরিয়া ও মোলাসাস(চিটাগুর) দ্বারা প্রকৃয়াজাত করে খাওয়াতে হয়। সেই সাথে সুষম দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
- মোট খাদ্য চাহিদার ৪০-৫০ ভাগ দানাদার ও ৫০-৬০ ভাগ আঁশ জাতীয় খাদ্য যেমন খড়, ঘাস ইত্যদি দিতে হবে।
- সাইলেজ অথবা ইউএমএস অথবা ফর্মান্টেড ভুট্টা খাওয়াতে হবে।
- প্রতিদিন একই সময়ে একই ধরনের খাদ্য সরবরাগ করতে হবে। খাদ্য ও খাদ্য প্রদানের সময় কোনটা পরিবর্তন করা যাবে না।
- খাদ্য টাটকা ও ধুলো বালি মুক্ত হতে হবে।
- খাদ্য সহজ পাচ্য হতে হবে।
১০০ কেজি খাদ্য তৈরির জন্য গরু মোটাতাজাকরণ খাদ্য তালিকা দেওয়া হলোঃ
ভুট্টা ভংগা | ৩৫ কেজি |
গম ভাংগা | ১৫ কেজি |
সয়াবিন খৈল | ২০ কেজি |
চাউলের কুড়া/রাইচ ব্রান | ২৫ কেজি |
লাইম স্টোন | ১ কেজি |
ডিসিপি/এমসিপি | ৫০০ গ্রাম |
লবন | ২ কেজি |
ভিটামিন-মিনারেল প্রিমিক্স | ১৫০ গ্রাম |
সোডিয়াম বাই-কার্বনেট | ৫০০ গ্রাম |
এনজাইম | ৫০ গ্রাম |
(০১) ইউরিয়া মোলাসেস মিনারেল ব্লকঃ
ইউরিয়া মোলাসেস মিনারেল ব্লক বা UMMB গরু মোটাতাজাকরণের জন্য সহজ সমাধান। এই ব্লকে থাকে প্রোটিন ও ভিটামিন-মিনারেল যা গরুর মাংস বৃদ্ধিতে সরাসরি সাহায্য করে। এই গরু মোটাতাজাকরণ খাদ্য গরু চেটে চেটে খায় আর তাই গরুর ইউরিয়া টক্সিসিটি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কমে যায়।
ইউরিয়া মোলাসেস মিনারেল ব্লক বা UMMB তৈরী করতে যেসকল উপকরণের প্রয়োজন হয় তাহলো- গমের ভুসি ৩ কেজি, ঝোলাগুড় বা চিটাগুড় ৬ কেজি, ইউরিয়া ৯০ গ্রাম, আয়োডিন যুক্ত লবণ ৩৫ গ্রাম, ৫০০ গ্রাম খাবার চুন, ভিটামিন মিনারেল মিক্সার এবং কাঠ বা লোহার ছাপ। প্রথমে চিটাগুড়ের সাথে ইউরিয়া, লবন, চুন, সিমেন্ট, ভিটামিন মিনারেল মিক্সার এগুলো ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। এর পর এই মিশ্রণের সাথে গমের ভুসি ও অন্যান্য ইপকরণ মিশিয়ে একটি শক্ত কাঠ বা লোহার ছাচে ফেলে ব্লক তৈরী করা হয়। এই ব্লক রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়।
(০২) দানাদার খাদ্যে সরাসরি ইউরিয়া ব্যবহারঃ
দানাদার খাদ্যে ইউরিয়া ব্যবহার করে খাদ্যের প্রোটিন মান বৃদ্ধি করা যায়। ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের গবাদিপশুর ইউরিয়া মিশ্রিত খাদ্য তালিকা, উপকরণ ও পরিমানঃ
- ধানের শুকনো খড় = ২ কেজি
- সবুজ ঘাস = ২ কেজি (ঘাস না থাকলে ৪ কেজি খড় ব্যবহার করতে হবে)
- দানদার খাদ্য মিশ্রন = ১.২-২.৫ কেজি
- ইউরিয়া = ৩৫ গ্রাম
- চিটাগুড়া বা রাব বা লালি = ২০০-৪০০ গ্রাম
- লবণ = ২৫ গ্রাম
দানাদার খাদ্যের সাথে লবন, ইউরিয়া, চিটাগুড়, ধানের খড়, কাঁচা ঘাস ছোট ছোট করে কেটে এক সঙ্গে মিশিয়ে দিনে ২ বার এই গরু মোটাতাজাকরণ খাদ্য খাওয়াতে হবে।
(0৩) মোটাতাজাকরণ গরুর আঁশযুক্ত খাদ্যঃ
মোটাতাজাকরণ গরুকে তার চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত রাফেজ বা আঁশযুক্ত খাদ্য অবশ্যই দিতে হবে। কিছু কিছু খামারি মনে করে খর, বিছালি বা কাচা ঘাস কম খাইয়ে দানাদার খাবার বেশি খাইয়ে গরুকে দ্রুত মোটাতাজাকরণ করা সম্ভব। কিন্তু আসলে তা সঠিক নয়। কখনো কখনো প্রচুর ঔষধ -পত্র প্রয়োগ করে হয়তো সম্ভব কিন্তু এতে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি পড়ে।
গরুর চার প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট পাকস্থলী কে ইংরেজিতে রুমেন বলা হয়। আর এধরনের প্রাণীদের বলা হয় রুমিনান্ট। সকল রুমিনান্টস তথা গরুর রুমেন তৈরিই হয়েছে আঁশ বা রাফেজ জাতীয় খাদ্যের জন্য। গরু বা ছাগল পর্যাপ্ত আঁশ জাতীয় খাবার না খেলে রুমেনে হজমে সমস্যা হয়।
গরু মোটাতাজাকরণ খাদ্য এ পর্যাপ্ত ফাইবার বা আঁশের অভাব থাকলে নিম্নোক্ত সমস্যার সৃষ্টি হয়।
- পেটে এসিডিটি তৈরি হয়।
- হজম ক্ষমতা কমে যায়।
- খাদ্যে অরুচি দেখা দেয়।
- গরুর উৎপাদন কমে যায়।
(০৪) ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র বা ইউএমএসঃ
ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র বা UMS বানান খুবই সহজ পদ্ধতি। গরু মোটাতাজাকরণ খাদ্য সারা পৃথিবিতে এটি জনপ্রীয়। এটি তৈরী করতে তিন টি উপকরণ প্রয়োজন হয় খড়, চিটাগুর ও ইউরিরয়া। সাধারণ খরের পুষ্টিগুণ খুব কম থাকে তাই খড়ের গুষ্টিগুণ বৃদ্ধি করতে আইএমএস তৈরি করে খাওয়ালে গরু দ্রুত মোটাতাজাকরণ হয় এবং খাদ্য খরচ অনেক কম পরে। ছোট ছোট করে কাটা ১০০ কেজি শুকনো খড়, ৫০ কেজি বিশুদ্ধ পানি, ২৫ কেজি চিটাগুড় ও ৩ কেজি ইউরিয়া সার মিশিয়ে এটি তৈরী করতে হয়।
(০৫) ফার্মেন্টেটেড কর্ণঃ
প্রথমে ভুট্টার গুড়া করে নিতে হবে যা একটু মোটা হবে সুজির দানার মতো হলে ভালো হয়। পর্যাপ্ত পানিতে মিশিয়ে ভুট্টার গুড়া মাখা মাখা করতে হবে। এবার একটি কাপে বা গ্লাসে এক কাপ কুসুম গরম পানিতে ১ চা চামচ চিটাগুড় বা মোলাসেস মিশিয়ে নিতে হবে। এর পর ১ চা চামচ বেকারি ইস্ট (স্যাকারোমাইসিস সেরাভেসিয়া) কাপের চিটাগুড় মিশ্রিত পানিতে ঢেলে ভালো করে সব মিশিয়ে নিতে হবে।
এর পর ১০-১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। ড্রাই ঈস্ট কাপের পানিতে লাইভ বা জিবিত হয়ে ফুলে উঠবে। এই কাপের পানিতে মিশানো ঈস্ট আগে থেকে মাখা মাখা করে মেশানো ভুট্টার গুড়ার সাথে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। এবং এই ঈস্ট মেশান ভুট্টার গুড়া একটা বালতি বা পাত্রে বায়ুনিরোধী করে রেখে দিন মাত্র ৮-১০ ঘন্টার জন্য। ব্যাস তৈরী হয়ে গেল ঈস্ট ফার্মেন্টেটেড কর্ণ এখন এটা গরুর দানাদার ও খড় বা ঘাসের সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হবে।
গরুকে পানি ও খাদ্য খাওয়ানোর নিয়মঃ
» গরুকে গুড়, লবন ও কুড়া যোগে পানি না খাইয়ে ফ্রি চুজে বা ইচ্ছা মতো পানি খেতে দিতে হবে। একটি পাত্রে সবসময় পরিষ্কার সাদা পানি রেখে দিতে হবে যাতে গরু ইচ্ছা মতো পানি খেতে পারে। অপর দিকে খড় বা পল ও ঘাস গরুকে দিনে ২-৩ বার দিতে হবে এবং দানাদার খাদ্য সকাল বিকাল ২ বার দিতে হবে। দুপুরে খুদের জাও দেওয়া যেতে পারে। গরুকে সবসময় না খাইয়ে জাবর কাটার টাইম বা বিশ্রাম দিতে হবে। সন্ধ্যা ৭ টার পর গরুকে কোনো খাবার না দেওয়াই উত্তম। মোটাতাজাকরণ কর্মসূচীতে ফ্রি চুজ পানির ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
» গরুকে শুধু খড় খাওয়ালে সাথে মোলাসেস ব্লক দেওয়া প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের গরুকে ২০০ গ্রাম ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক, ১০০-১৫০ কেজি ওজনের জন্য ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক এবং ১৫০-২০০ কেজি কেজি ওজনের জন্য ৩০০-৪০০ গ্রাম ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক প্রতিদিন দিতে হবে।
» দানাদার খাদ্য সমান ২ ভাগে ভাগ করে ১ ভাগ সকালে আর আরেক ভাগ বিকালে দিতে হবে।
» বাকি অবসর সময়ে গরুকে কাঁচা ঘাস এবং ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র অথবা শুধু খড় দিতে হবে।