Skip to content

 

Wait...❤😘 Show love? ⬇⬇⬇

চরিত্র এবং আত্মশুদ্ধি তথা তাকিয়া/তাসাওউফ বিষয়ক: কয়েকটি আত্মিক গুণ ও তা অর্জনের পন্থা

চরিত্র এবং আত্মশুদ্ধি তথা তাকিয়াতাসাওউফ বিষয়ক কয়েকটি আত্মিক গুণ ও তা অর্জনের পন্থা
Table of contents

বিষয়: চরিত্র এবং আত্মশুদ্ধি তথা তাকিয়া/তাসাওউফ বিষয়ক: কয়েকটি আত্মিক গুণ ও তা অর্জনের পন্থা।
হ্যাশট্যাগ: #চরিত্র এবং আত্মশুদ্ধি #তাকিয়া ওতাসাওউফ #কয়েকটি আত্মিক গুণ ও তা অর্জনের পন্থা।

قد أفلح من زكها وقد خاب من دشها۔

অর্থাৎ, যে আৱশুদ্ধি করে সে সফলকাম হয়। আর যে আৱাকে কলুষিত করে সে ব্যর্থ হয়। (সূরাঃ আশ্-শাম্স- ৯)

নামায, রোযা-প্রভৃতি শরী’আতের জাহিরী বিধানের উপর আমল করা যেমন জরুরী, তদ্রূপ এখলাস, তাকওয়া, ছবর, শোকর প্রভৃতি কলবের গুণাবলী অর্জন এবং রিয়া, তাকাব্বুর প্রভৃতি অন্তরের ব্যাধি দূর করা তথা শরী’আতের বাতিনী বিধানাবলীর উপর আমল করাও জরুরী ও ওয়াজিব। এই বাতিনী বিধানাবলীর উপর আমল করাকে বলা হয় তাকিয়া বা আত্মশুদ্ধি। আত্মশুদ্ধির এই সাধনাকে আধ্যাৱিক সাধনাও বলা হয়। আর এই শাস্ত্রকে বলা হয় তাসাওউফ বা সূফীবাদ।

কয়েকটি আত্মিক গুণ ও তা অর্জনের পন্থাঃ

এখলাস ও সহীহ নিয়ত

ইবাদত একমাত্র আল্লাহ্কে রাজী খুশি করার নিয়তে করা এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে রাজী খুশী করার ইচ্ছা বা নিজের নফসের কোন খাহেশকে মিশ্রিত না করার নাম হল এখলাস তথা খাঁটি নিয়ত। কোন কোন ইবাদতে কিছু কিছু পার্থিব ফায়দাও হাছেল হয়ে থাকে, তবে সেটাকে উদ্দেশ্য বানিয়ে ইবাদত করা ঠিক নয়। এই এখলাস ও খাঁটি নিয়ত না হলে কোন ইবাদতের ছওয়াব পাওয়া যায় না। নিয়ত খাঁটি করা তথা এখলাস হাছিল করার পদ্ধতি হলঃ

১. ইবাদত করার পূর্বে আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে করছি এই চিন্তা করে নেয়া এবং দেলের মধ্য থেকে অন্যান্য বাজে উদ্দেশ্য দূরে নিক্ষেপ করা।

২. অন্তর থেকে ‘রিয়া’ (লোক দেখানো আমল) দূর করার পদ্ধতি গ্রহণ করা। বস্তুতঃ রিয়া দূর করাই হল এখলাস।

তাওয়া ও খোদাভীতি

“তাওয়া” কথাটি দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। (১) ভয়। (২) বিরত থাকা। বস্তুত ভয় আসলেই মানুষ কোন কিছু থেকে বিরত থাকে; তাই ভয় হল বিরত থাকার কারণ আর বিরত থাকা (অর্থাৎ গোনাহ থেকে বিরত থাকা) হল আসল উদ্দেশ্য। তাওয়ার কয়েকটি স্তর রয়েছে। যথাঃ

ক. কুফ্র ও শির্ক থেকে বিরত থাকা।

খ. হারাম ও গোনাহে কবীরা থেকে বিরত থাকা।

গ. গোনাহে ছগীরা থেকে বিরত থাকা।

ঘ. যেখানে হালাল না হারাম-এই সন্দেহ থাকে সেখান থেকে বিরত থাকা।

ঙ. অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকা।

চ. যে সব মোবাহ কাজ গোনাহের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে তা থেকে বিরত থাকা।

তাকওয়া অর্জনের পন্থা হল :

১. আল্লাহ্ আযাব গযবের কথা, পরকালের আযাবের কথা চিন্তা করা এবং স্মরণ করা।

২. বুযুর্গদের সোহবত গ্রহণ করা।

৩. ওলী-আউলিয়াদেরকে কষ্ট না দেয়া।

৪. সঠিক কথা বলা।

ছবর (ধৈর্য্য)

ছবর অর্থ মনকে মজবৃত রাখা, মনকে ধরে রাখা। ছবর কয়েক প্রকারঃ

(ক) ইবাদতের সময় ছবর, অর্থাৎ, ইবাদত ও নেক কাজের উপর মনকে পাবন্দির সাথে ধরে রাখা এবং ধৈর্য সহকারে সহীহ তরীকায় তা আদায় করা।

(খ) গোনাহের সময় ছবর, অর্থাৎ, মনকে গোনাহ থেকে দূরে ধরে রাখা।

(গ) কষ্ট ও বিপদ-আপদের সময় সছবর, অর্থাৎ, কেউ কোন কষ্ট দিলে প্রতিশোধ না নেয়া এবং রোগ-ব্যাধি হলে বা জান মালের ক্ষতি হলে বে-ছবর হয়ে শরী’আতের খেলাফ কোন কথা মুখ থেকে বের না করা বা বয়ান করে ক্রন্দন না করা।

এই ছবর হাছিল করার পন্থা হল :

১. খাহেশাতে নফসানীকে দুর্বল করা।

২. ইবাদত করলে, গোনাহ থেকে বিরত থাকলে এবং কষ্ট ও বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ করলে আল্লাহ তা’আলা যে ছওয়াবের ওয়াদা করেছেন তা স্মরণ করা।

৩. রোগ-ব্যাধি ও জান মালের ক্ষয়-ক্ষতি হলে মনকে এই বলে বুঝানো যে, এ সবই আমার কোন না কোন মঙ্গলের জন্য হচ্ছে, যদিও আমি বুঝছি না। তাছাড়া ধৈর্য ধরলে এতে আমার পাপ মোচন হয়ে দরজা বুলন্দ হবে। তদুপরি আমি ছবর না করলেও তাকদীরে যা আছে তাতো হবেই, আমি বে-ছবরী করে অহেতুক ছওয়াব হারাব কেন?

হিম বা সহনশীলতা

রাগ দমন করার গুণটি যখন স্বভাবে পরিণত হয় এবং স্থায়িত্ব লাভ করে, তখন সে গুণটিকে বলা হয় হিল্ম বা সহনশীলতা। যেমন- রাগের মুহূর্তে উত্তেজনাকে বলপূর্বক দমন করে রাখলে সেটা হবে রাগ দমন আর সর্বক্ষণ এরূপ করতে করতে যখন রাগ দমন করাটা তার স্বভাবে পরিণত হবে তখন সেটা সহনশীলতা বলে আখ্যায়িত হবে। রাগ-দমন করার যে সব পন্থা বর্ণনা করা হয়েছে, উপর্যুপরি সেগুলো অবলম্বন করতে থাকলে সহনশীলতার গুণ অর্জিত হবে। বিশেষ ভাবে সহনশীলতার গুণ আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়- একথাও স্মরণে রাখতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহনশীলতা ও গাম্ভীর্য গুণের প্রশংসা করেছেন।

তাফবীয বা নিজেকে আল্লার উপর সোপর্দ করা

মানুষ তার সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, তারপর তার জাহিরী, বাতিনী, শারীরিক, মানসিক যা কিছু অনুকূল বা প্রতিকূলে ঘটবে সেটাকে সে আল্লাহর হস্তক্ষেপ মনে করবে। এভাবে সে নিজেকে আল্লাহ্র সোপর্দ করবে। মানুষ চেষ্টা করবে কিন্তু ফলাফল আল্লাহ্র হাতে সোপর্দ করবে। এটাকে বলা হয় তাকবীয়। কেউ এরূপ করলে ব্যর্থতা আসলেও তার মনে কষ্ট আসবে না- সর্বাবস্থায় আরাম বোধ হবে। তবে আরামের নিয়তে তাফবী; করা দীন নয় বরং দুনিয়া। এতে তাকবীযের ছওয়াব নষ্ট হয়ে যাবে বরং তাবী করা কর্তব্য এবং এটা আল্লাহ্র হক- এই নিয়তে তাফবীয করতে হবে। এটা হাছিল করার তরীকা হল কোন অযাচিত বা অপছন্দনীয় বিষয় ঘটলে সেটাকে আল্লাহ্ হস্তক্ষেপ মনে করা।

রেযা-বিল কাযা বা আল্লাহর ফয়সালায় রাজী থাকা

আল্লাহ্র ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা এবং আল্লাহ্র ফয়সালার উপর অভিযোগ পরিত্যাগ করাকে বলা হয় ‘রেযা বিল কাযা’। মানুষ আসবাব গ্রহণ করবে, চেষ্টা চরিত্র করবে, দু’আ করবে সুন্নাত এবং আনুগত্য হিসেবে। তারপর আল্লাহ্র পক্ষ থেকে যে ফয়সালা ঘটবে তাতে সন্তুষ্ট থাকবে এবং মুখে বা অন্তরে কোন অভিযোগ আনবে না। স্বয়ং চেষ্টা এবং দু’আ করার সময়ও মনের এই অবস্থা রাখবে যে, উদ্দেশ্য মোতাবেক না ঘটলেও তাতে আমি সন্তুষ্ট। এটাই হল রেযা বিল কাযা। এটা হাছিল করার তরীকা হলঃ

১. আল্লাহর মহব্বত হাছিল হলেই রেযা বিল কাযা হাছিল হয়ে যাবে। অতএব এর জন্য আল্লাহ্র মহব্বত হাছিল করার পন্থা গ্রহণ করতে হবে।

২. নিঃশষভাবে এই চিন্তা করা যে, আল্লাহ ভাল, তাঁর সব কাজই ভাল, তিনি পরম দয়ালু, বিন্দুমাত্র নিষ্ঠুর নন; অতএব তিনি যা করেন তাতেই মঙ্গল নিহিত।

তাওয়াক্কুল (আল্লাহ্র উপর ভরসা)

আল্লাহ্র ইচ্ছা ব্যতীত কোন কিছু হতে পারে না- এই বিশ্বাস রাখা ঈমানের অংশ। যেহেতু তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত কোন কিছু হতে পারে না, তাই শরী’আতের নিয়মানুযায়ী যে কোন চেষ্টা-তদবীর গ্রহণ করার পর কামিয়াবী-র জন্য মনে মনে আল্লাহ্র উপর ভরসা রাখতে হবে। এরূপ ভরসা রাখাকে বলা হয় তাওয়াক্কুল। উল্লেখ্য যে, চেষ্টা তদবীর না করে হাত পা গুটিয়ে অকর্মন্য হয়ে বসে থাকা বা চেষ্টা না করে ফলের আশা করা শরী’আতের বিধান নয় এবং এটাকে তাওয়াক্কুলও বলা হয় না। বরং নিয়ম মত চেষ্টা তদবীর করে, নিয়ম মত আসবাব গ্রহণ করে তার ফলের জন্য এবং কামিয়াবী-র জন্য মনে মনে আল্লাহ্র উপর ভরসা রাখাকেই বলা হয় তাওয়াক্কুল।

তাওয়াক্কুল হাছিল করার পন্থা হল :

১. কিছুক্ষণ সময় নির্ধারিত করে এই চিন্তা করা যে, আল্লাহ তা’আলা সর্বশক্তিমান, আল্লাহ দয়াময়, তিনিই মঙ্গলময়, তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত কারও কিছু করার ক্ষমতা নেই।

২. অতীতে আল্লাহর অনুগ্রহে যে সব কামিয়াবী হাছিল হয়েছে সে গুলোকে স্মরণ ও চিন্তা করা।

শোকর

নেয়ামতকে আল্লাহর পক্ষ থেকে মনে করতে হবে। আর যে ব্যক্তি নেয়ামতকে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে মনে করবে, স্বাভাবিকভাবে তার ফলশ্রুতি স্বরূপ সে আল্লাহ্র প্রতি মনে মনে প্রফুল্ল হবে এবং সর্বাগ্রহে সেই অনুগ্রহ দানকারী আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত হবে, তাঁর নির্দেশ পালনে তৎপর হবে এবং তাঁর দেয়া নেয়ামতকে তাঁর নাফরমানীর কাজে লাগাবে না। এটাকেই বলা হয় শোকর বা নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা।

শোকর হাছিল করার তরীকা হল :

১. আল্লাহ্র নেয়ামত ও অনুগ্রহ সমূহকে স্মরণ করা এবং চিন্তা করা।

২. সব নেয়ামতকে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে মনে করা।

উল্লেখ্য-আল্লাহর কোন নেয়ামতের ভিত্তিতে শুধু মুখে “আলহামদু লিল্লাহ” বললেই শোকর আদায় হয়ে যায় না; বরং প্রকৃত শোকর হল নেয়ামতের ভিত্তিতে মনে মনে আল্লাহর প্রতি প্রফুল্ল হওয়া এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে নেয়ামত দাতা আল্লাহ্র হুকুম পালনে তৎপর হওয়া। তবে এর সাথে সাথে খুশিতে যবান থেকে “আলহামদু লিল্লাহ” বের হলে সেটাও ইবাদত বলে গণ্য হবে এবং ছওয়াবের হবে।

তাওয়াযু’ (বিনয়/নম্ৰতা)

তাওয়ায়ু’ অর্থাৎ, বিনয় বা নম্রতা। তাওয়ায়ু’ বলা হয় নিজেকে ছোট মনে করাকে, নিজের অহমিকাবোধ বিলীন করাকে। সমস্ত মুসলমানের চেয়ে নিজেকে ছোট মনে করতে হবে। যদিও আপাতঃ ও বাহ্যিক দৃষ্টিতে কাউকে নিজের চেয়ে অধিক পাপী ও অপরাধী বলে মনে হয় তবুও তার থেকে নিজেকে ছোট মনে করতে হবে এই ভেবে যে, হতে পারে তার মধ্যে এমন কোন গুণ রয়েছে যার ভিত্তিতে আল্লাহ্র নিকট সে আমার চেয়ে অনেক বেশী পছন্দনীয়, কিংবা ভবিষ্যতে সে আমার চেয়ে অধিক গুণাবলীর অধিকারী হবে এবং সে অবস্থায়ই সে আল্লাহ্র নিকট হাজির হবে। পক্ষান্তরে আমার পরিণতি কি হবে তা আমার জানা নেই। পরিণামের দিকে নজর দিয়ে একজন কাফের থেকেও নিজেকে বড় মনে করার উপায় নেই, কেননা মৃত্যুর পূর্বে তারও ঈমান নসীব হতে পারে। পক্ষান্তরে ঈমানের সাথে আমার মৃত্যু হওয়ার কোন গ্যারান্টি আমার কাছে নেই। তবে বর্তমান অবস্থায় একজন কাফেরের যেহেতু ঈমান নেই আমার ঈমান নসীব হয়েছে, তাই বর্তমানের বিচারে আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ- এই বোধ রাখতে হবে। এটা তাওয়ায়ু’ বা বিনয়ের পরিপন্থী অর্থাৎ, অহংকার নয়, বরং এটা হল দ্বীনী আত্মমর্যাদাবোধ এবং আল্লাহ আমাকে ঈমানের মত বড় নেয়ামত দান করেছেন সেই নেয়ামতের প্রতি বড়ত্ববোধ।

মনে রাখতে হবে তাওয়াযু’ প্রকাশ করতে গিয়ে যেন আল্লাহ্র কোন নেয়ামতের না-শুকরি প্রকাশ হয়ে না পড়ে। এখানে আরও মনে রাখতে হবে যে, ধন-সম্পদ বা পদ পাওয়ার লালসায় কোন ধনী বা পদস্থ লোকের সামনে বিনয়ভাব প্রকাশ করাও বিনয় নয় বরং সেটা হল হীনতাবোধ।

তাওয়ায়ু’ হাছিল করার পন্থা হল :

১. তাকাব্বুর দূর করার পন্থাই হল তাওয়ায়ু’ হাছিল করার পন্থা।

২. অন্তরে আল্লাহ্র ভয় সৃষ্টি করলে তাওয়াযু’ পয়দা হয়।

খুশূ’ খুযূ’ : (স্থিরতা ও একাগ্রতা)

দেহ মন স্থির করে ইবাদত করা, একাগ্রতা সহকারে ইবাদত করা এবং চলা-ফেরা, উঠা-বসায় উগ্রতা পরিহার করাকে বলা হয় খুশূ’ খুযূ’। ইবাদতের মধ্যে দেহ স্থির করার অর্থ হল অপ্রয়োজনীয় নড়াচড়া না  করা। আর মন স্থির করার অর্থ হল ইচ্ছাকৃত ভাবে অন্তরে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুকে উপস্থিত না করা এবং ইবাদতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়া অন্য কিছু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা না করা। অনিচ্ছাকৃত ভাবে যেটা মনে এসে যায়, বান্দা তার জন্য দায়ী নয়।

এই খুশৃ’ খুযূ’ হাছিল করার তরীকা হল :

১. এই চিন্তা করবে যে, আমি আল্লাহ্র সামনে উপস্থিত, আল্লাহ আমার সব কিছু শুনছেন এবং দেখছেন আর আল্লাহ্র কাছে আমাকে ফিরে যেতে হবে।

২. আল্লাহ্র ভয় অন্তরে বসানো।

খাওফ বা আল্লাহ্র ভয়

শরী’আতে খাওফ বা ভয় বলতে নিজের ব্যাপারে আল্লাহ্র আযাবের ভয়-ভীতির সম্ভাবনা বোধ করাকে বুঝানো হয়। এই ভয় এত উত্তম জিনিস যে, এটা এসে গেলে মানুষ থেকে কোন গোনাহ হতে পারে না। খাওফ বা আল্লাহ্র ভয় অর্জন করার উপায় হল আল্লাহ্র আযাব গযবের কথা স্মরণ করা এবং চিন্তা করা।

রজা বা আল্লাহর রহমতের আশা

আল্লাহ্র আযাবের ভয় যেমন রাখতে হবে তেমনিভাবে আল্লাহ্র রহমত, মাগফেরাত, জান্নাত এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভের আশাও মনে থাকতে হবে, নিরাশ হওয়া যাবে না। ভয় এতটা কাম্য নয় যে, আল্লাহ্ রহমতের ব্যাপারে হতাশা জন্মাবে। আবার আল্লাহর রহমতের আশাও এতটা প্রবল হওয়া ঠিক নয় যাতে আল্লাহ্ বিধান লংঘন করার মত দুঃসাহস দেখা দেয়, এই ভেবে যে, আল্লাহ তাআলা রহমত করবেন। বরং ভয় ও আশা এতদুভয়ের মধ্যে ব্যালেন্স ও ভারসাম্য থাকতে হবে। এই রজা হাছিলের উপায় হল আল্লাহর অসীম ও অপার রহমতের কথা চিন্তা করা।

উল্লেখ্য, কেউ যদি শুধু আল্লাহ্র রহমত, মাগফেরাত ও জান্নাত লাভের আশা করে আর তা লাভের পদ্ধতি অর্থাৎ, নেক আমল, তওবা প্রভৃতি অবলম্বন না করে, তাহলে সেটাকে রজা বা আশা বলা হবে না বরং সেটা হবে বীজ বপন না করে ফসল অর্জনের আশা করার মত অলীক কল্পনা।

আল্লাহ্র মহব্বত ও শওক

আল্লাহ্র সঙ্গে মহব্বত বা ভালবাসার অর্থ হল আল্লাহর সন্তুষ্টিকে অন্য সকলের সন্তুষ্টির উপর প্রাধান্য দেয়া। এরূপ মহব্বত রাখা ওয়াজিব। এরূপ মহব্বতের সর্বনিম্ন স্তর হল কুফ্র-এর উপর ঈমান-কে প্রাধান্য দেয়া। এটা না হলে মানুষ মুমিনই থাকে না। তারপরের স্তর হল আল্লাহ্ বিধানকে অন্যের বিধানের উপর প্রাধান্য দেয়া। বিধান যে পর্যায়ের, তার প্রতি ভালবাসা বা সেটাকে প্রাধান্য দেয়ার হুকুমও সেই পর্যায়ের- ওয়াজিব হলে ওয়াজিব, মোস্তাহাব হলে মোস্তাহাব। উপরোক্ত ভালবাসাকে বলা হয় মহব্বতে আক্‌ক্লী বা বুদ্ধিজাত ভালবাসা। আর এক প্রকারের ভালবাসা রয়েছে যাকে মহব্বতে ত্বাব্য়ী বা স্বভাবজাত ভালবাসা বলে। তা হল আল্লাহ্র সঙ্গে প্রাণের টান হয়ে যাওয়া, তাঁর কথা শুনলে তা মানার জন্য মন উদ্বেল হয়ে ওঠা এবং তাঁর নাফরমানী ছেড়ে তাঁর আনুগত্য শুরু করে দেয়া। প্রথম প্রকারের ভালবাসা মানুষের এখতিয়ারভুক্ত এবং তার উপর টিকে থাকলে ধীরে ধীরে দ্বিতীয় পর্যায়ের ভালবাসা মনে সৃষ্টি হয়ে যায়।

কুরআন ও হাদীছের আলোকে আল্লাহ্র মহব্বত সৃষ্টির জন্য বুযুর্গানে দ্বীন নিম্নোক্ত পন্থা সমূহ গ্রহণের কথা বলেছেন :

১. দ্বীনের ইল্ম শিক্ষা করা।

২. হিম্মত সহকারে শরী’আতের জাহিরী বাতিনী সব ধরনের আমলের পাবন্দী করা, জাহের এবং বাতেন উভয়কে শুদ্ধ ও পবিত্র করা।

৩. আমলের মধ্যে যে দিকটি আরামের সে দিকটি গ্রহণ করা। (যদি তা গ্রহণে শরী’আতের কোন বাঁধা না থাকে)।

৪. আল্লাহ্র হুকুম-আহকাম পুরাপুরি মেনে চলা। ফরযসমূহকে পুরাপুরি আদায় করার সাথে সাথে বেশী বেশী নফলে লিপ্ত হওয়া। সাথে সাথে আল্লাহ্র মাহবূব হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পূর্ণ পায়রবী করা।

৫. আল্লাহ্র মহব্বত বৃদ্ধি করার নিয়তে নেক আমলে অটল থাকা।

৬. কিছুক্ষণ নির্জনে বসে ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করা।

৭. আল্লাহ্র সঙ্গে যাদের মহব্বত সৃষ্টি হয়েছে এরূপ বুযুর্গদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করা, তাঁদের সাহচর্য গ্রহণ করা, তাঁদের কাছে যাতায়াত করা, সম্ভব না হলে অন্ততঃ চিঠি-পত্রের মাধ্যমে সম্পর্ক রাখা।

৮. নিজে কি করছি এবং তা সত্ত্বেও আল্লাহ্ কত দয়া এবং নিয়ামত তা স্মরণ করা। (নির্জনে বসে কিছুক্ষণ এটা চিন্তা করবে।)

৯. দু’আ করবে যেন আল্লাহ তা’আলা তাঁর সাথে মহব্বত বৃদ্ধি করে দেন।

১০.এই মোরাকাবা (ধ্যান) করা যে, আল্লাহ তা’আলা আমাকে ভালবাসেন, তিনি আমাকে চান। এর দ্বারা বান্দার অন্তরেও ভালবাসা সৃষ্টি হবে।

১১.আল্লাহ্র আছমায়ে হুছনা (উত্তম নামসমূহ)-এর সাথে মহব্বত পয়দা করা এবং বেশী বেশী সেগুলো পাঠ করা।

১২.বেশী বেশী তওবা করা।

হুব্ব ফিল্লাহ ও বুগ্য ফিল্লাহ

ঈমান পূর্ণ করার জন্য যেমন আল্লাহ্কে ভালবাসতে হবে, আল্লাহ্র প্রতি ভক্তি রাখতে হবে, তদ্রূপ আল্লাহ যে ব্যক্তিকে, যে বস্তুকে বা যে কাজ ও যে গুণকে ভালবাসেন তাকেও ভালবাসতে হবে। একে বলা হয় হুব্ব ফিল্লাহ অর্থাৎ, আল্লাহ্র জন্য দুস্তী রাখা বা আল্লাহ্র ভালবাসার পাত্রকে ভালবাসা। এর বিপরীত আল্লাহ যে ব্যক্তিকে, যে বস্তুকে বা যে কাজ ও যে দোষকে ঘৃণা করেন, না পছন্দ করেন, তাকে অন্তর থেকে ঘৃণা করতে হবে। একে বলে বুগ্য ফিল্লাহ অর্থাৎ, আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে ঘৃণা ও শত্রুতা পোষণ করা বা আল্লাহ্র দুশমনের সঙ্গে দুশমনী রাখা। এমনিভাবে রাসূলের প্রিয় যারা তাঁদেরকে ভালবাসা এবং রাসুলের দুশমন যারা অন্তর থেকে তাদের সাথে দুশমনী রাখাও ঈমানের জন্য জরুরী।

দেশাত্মবোধ বা দেশপ্রেম

নিজের জন্মভূমির প্রতি ভালবাসা ও প্রেমানুভূতিকে বলা হয় দেশাৱবোধ। শরী’আতের দৃষ্টিতে দেশাত্মবোধ একটি প্রশংসনীয় গুণ। তিরমিযী শরীফের হাদীছে বর্ণিত আছে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনা রওয়ানা হন, তখন বার বার মক্কাভূমির দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন এবং বলছিলেনঃ হে মক্কার মাটি, আমার গোত্র যদি আমাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য না করত, তাহলে কখনো তোমায় আমি ছেড়ে যেতাম না। এখানে একথাও উল্লেখ্য যে, দেশ প্রেমের এই প্রেরণা ততক্ষণ পর্যন্ত প্রশংসনীয় যতক্ষণ তা জাতীয় গোঁড়ামী ও বিদ্বেষে পরিণত না হয় এবং মানবীয় ভ্রাতৃত্বের সাথে তার সংঘাত না ঘটে, যেমনটি ঘটেছিল হিটলার ও নাজিবাদের আধুনিক ইউরোপীয় দেশাত্মবোধের ফলশ্রুতিতে এবং যা সূচনা করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের।

দেশাত্মবোধ একটি স্বভাবজাত প্রেরণা। জন্মভূমির প্রতি ভালবাসা ও আকর্ষণকে গভীরতর পর্যায়ে নিয়ে গেলেই তা দেশাত্মবোধে পরিণত হয়। আল্লাহ যে ভূখণ্ডকে আমার জন্মভূমি বানিয়েছেন আমার জীবন কর্মময়তায় মন্ডিত হবে সেখানে, সে-ই আমার আপনভূমি- এরূপ চিন্তা থেকে দেশাত্মবোধ জন্ম নিয়ে থাকে।

গায়রত বা আত্মমর্যাদা বোধ

শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি বা শ্রদ্ধেয় বস্তুর নিন্দা বা অবমাননা দেখলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে একটা ক্রোধভাবের উদ্রেক হয়, এই ক্রোধভাবকে বলা হয় গায়রত বা আত্মমর্যাদা বোধ। যেমন মাতা-পিতাকে কেউ গালি দিলে বা নিন্দা করলে আত্মমর্যাদা বোধে আঘাত লেগে থাকে। এরূপ আল্লাহ, আল্লাহ্র রাসূল, কুরআন, কা’বা, ইসলাম, দ্বীন, ঈমান প্রভৃতির অবমাননা বা তিরস্কার ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য হতে দেখলে মুসলমানদের অন্তরে এই গায়রত জাগ্রত হওয়া উচিত এই গোস্বা দুষণীয় নয় বরং প্রশংসনীয় এবং ঈমানের পরিচায়ক। আর এই চেতনা না থাকা ঈমানহীনতার পরিচায়ক। নিজের সম্মান, পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবের সম্মান এবং দেশ ও জাতির সম্মান সংরক্ষণের জন্য সৃষ্ট ক্রোধের অনুপ্রেরণা এই আত্মমর্যাদা বোধের পরিধিভুক্ত।

দুনিয়ার মোহ ত্যাগ

বৈধ আসবাব ও সম্পদ বর্জন করা নয় বরং সম্পদের মোহ বর্জন করার নাম যুহৃদ। সম্পদ পেলেও খুব আনন্দিত নয়, আবার না পেলেও বা পেয়ে হাতছাড়া হলেও দুঃখিত নয়- মনের এই অবস্থাই হল যুদের উচ্চ স্তর।

একজন যাহেদ বা দুনিয়ার মোহত্যাগকারী ব্যক্তি সম্পদ উপার্জনের জন্য চেষ্টা করবে সম্পদের প্রতি মোহের কারণে নয় বা প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে নয় বরং প্রয়োজন পূরণ করার এবং আল্লাহ্র হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে। তার নজর থাকবে আল্লাহ ও আল্লাহ্র নিকট যে পুরস্কার রয়েছে তার প্রতি-পার্থিব সম্পদের প্রতি নয়।

দুনিয়ার মোহ ত্যাগ হাছিল করার উপায় হল এই চিন্তা করা যে, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী এবং আখেরাত চিরস্থায়ী, দুনিয়ার সব কিছুই ত্রুটিপূর্ণ ও দোষযুক্ত আর পরকারের সবকিছু ত্রুটি ও দোষমুক্ত।

মোরাকাবা (আল্লাহ্ত্র ধ্যান)

প্রত্যেকটা কথা এবং কাজের সময় আল্লাহকে স্মরণ রাখা যে, তিনি আমাকে দেখছেন এবং শুনছেন। তাই কোন মন্দ কথা বা মন্দ কাজ হলে এই ভাবা যে, আল্লাহ এতে অসন্তুষ্ট হবেন এবং শাস্তি দিবেন; দুনিয়াতেই শাস্তি দিবেন না হয় পরকালেতো দিবেনই। পক্ষান্তরে কোন ভাল কথা বা ভাল কাজের ব্যাপারে এই ভাবা যে, আল্লাহ এতে সন্তুষ্ট হবেন এবং পুরস্কৃত করবেন। এরূপ মোরাকাবা বা আল্লাহ্র ধ্যান অমূল্য রতন। এটা হাছিলের তরীকা হলঃ

১. প্রথম দিকে বার বার জোর করে মনে এই চিন্তা টেনে আনা। পরে এটা করা সহজ হয়ে যাবে।

২. মুখে অনবরত আল্লাহ্র যিকির করতে থাকা।

৩. আল্লাহ ওয়ালাদের সোহবতে থাকা।

কানায়াত (অল্পেতুষ্টি)

অল্পে তুষ্ট থাকাকে বলে কানায়াত। জীবিকার ব্যাপারে, অর্থ উপার্জনের ব্যাপারে সদুপায়ে চেষ্টা করতে হবে, কিন্তু সীমাহীন দুরাকাংখাকে মনে স্থান দেয়া যাবে না বরং বৈধ উপায়ে স্বাভাবিক চেষ্টা সাধনার পর যা পাওয়া যাবে তাতেই তুষ্ট থাকতে হবে। এতেই প্রকৃত শান্তি। অন্যথায় কোটি কোটি টাকার উপর শুয়ে থেকেও মনে শান্তি জুটবে না। দুনিয়ার মহব্বত ও সম্পদের মোহ অন্তর থেকে দূরীভূত করতে পারলে এই অল্পেতুষ্টির গুণ অর্জিত হয়।

ফি (চিন্তা-ভাবনা) ও মুহাছাবা (হিসাব-নিকাশ)

ফিক্র বা চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে আরসংশোধনের একটি মৌলিক বুনিয়াদ। প্রত্যেকটা কথা এবং কাজের শুরুতে চিন্তা-ভাবনা করে নিতে হবে যে, এর পরিণাম কি হবে, এটা করা উচিত হবে কি-না, এতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন না অসন্তুষ্ট। এমনি ভাবে আরও চিন্তা করা উচিত যে, দিন দিন আমার আমলের উন্নতি হচ্ছে না অবনতি। এর জন্য প্রতি দিন নিজের আমলের মুহাছাবা অর্থাৎ, হিসাব-নিকাশ নিতে হবে এবং যা কিছু নেক কাজ হয়েছে তার জন্য আল্লাহ্র শোকর আদায় করতে হবে, আর যা গোনাহ হয়েছে তার জন্য তওবা করতে হবে এবং আগামীতে তা না করার সংকল্প করতে হবে। বিশেষভাবে ফিরে আখিরাত বা পরকালের চিন্তা মানুষকে গোনাহ থেকে বিরত রাখে এবং নেক কাজে উদ্বুদ্ধ করে।

ফি হাছেল করার পন্থা হল :

১. দুনিয়া এবং আখেরাত উভয় জগতের স্বরূপ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা।

২. বিশেষ ভাবে ফিরে আখেরাত আসবে মৃত্যুকে স্মরণ করলে।

সমাপ্ত: চরিত্র এবং আত্মশুদ্ধি তথা তাকিয়া/তাসাওউফ বিষয়ক: কয়েকটি আত্মিক গুণ ও তা অর্জনের পন্থা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Copyright Notice

কপি করা নিষিদ্ধ!