বিষয়: মাছ চাষে, মাছ সংরক্ষণ, মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ, আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ, চাষ মাছ চাষ করার সহজ উপায়, মাছ চাষের পদ্ধতি, মাছ চাষের নিয়ম।
হ্যাশট্যাগ:#মাছ চাষ#মাছ সংরক্ষণ#মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ#আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ#চাষ মাছ চাষ করার সহজ উপায়#মাছ চাষের পদ্ধতি#মাছ চাষের নিয়ম।
মাছ আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার অপরিহার্য অংশ। আমাদের জাতীয় জীবনে মৎস্য খাতের অবদান অনস্বীকার্য। প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬৩% যোগান দেয় মাছ।
বাংলাদেশে বর্তমানে মাথাপিছু মোট মাছ ভক্ষণের পরিমাণ বছরে প্রায় ১২ কেজি। তবে দৈনন্দিন জীবনে মাছের প্রয়োজন প্রায় ১৮ কেজি।
বর্তমানে বাংলাদেশের ১২৭টি হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা এবং সারা দেশেই বেশ কিছু শুটকী ও লবণাক্ত মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে। উল্লিখিত ১২৭টি কারখানার মধ্যে মান সম্পন্ন লাইসেন্স প্রাপ্ত কারখানার সংখ্যা মাত্র ৫৫টি। বর্তমানে কারখানা পর্যায়ে আহরিত মাছের বা চিংড়ির গুণগত মান বজায় রাখার লক্ষ্যে সরকার চিংড়ি চাষ অঞ্চলে ২১টি সার্ভিস সেন্টার স্থাপন করেছে। এর মাধ্যমে কাঁচামাল প্রাথমিক পরিচর্যার পর কারখানায় প্রেরণ করা হলে কাঁচামালের মান আরো উন্নত হবে।
বর্তমানে বিদেশে বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। EU এবং USFDA এর চাহিদা অনুসারে হ্যাসাপ কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে পণ্যের মানের উন্নতি হয়েছে। এছাড়া সনাতন পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের ফলে ক্রেতা দেশে বাংলাদেশের চিংড়ির চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ কি ও কেন?
সুস্থভাবে বেঁচে থাকার লক্ষ্যে মান সম্পন্ন খাদ্যমান যুক্ত আমিষ সমৃদ্ধ মৎস্য পণ্য খাওয়া সকলের কাম্য। মাছ একটি দ্রুত পচনশীল আমিষ জাতীয় পণ্য। আমাদের দৈনন্দিন আমিষের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে দেশের এক অঞ্চল হতে অন্য অঞ্চলে বাজারজাত করা এবং দেশের বাহিরে বিদেশে বাজারজাত করার জন্য মৎস্য পণ্যের মান ধরে রেখে ক্রেতাদের বা ভোক্তাদের সরবরাহ করাই হচ্ছে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের উদ্দেশ্যে।
মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণে হলো এমন এক বা একাধিক পন্থা যা খাদ্যের পচন প্রতিরোধ করে ভোক্তাদের চাহিদা অনুসারে স্বল্প মেয়াদী বা দীর্ঘমেয়াদীভাবে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে সহায়তা করে।
মাছ পচার কারণ কি?
মাছ সংরক্ষণ করতে হলে কী কী করণে মাছ পচে প্রথমে তা জানা দরকার। প্রধানত ৩টি কারণে মাছ পচে। যথা: ১. ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে, ২. এন্জাইমের ক্রিয়ায় এবং ৩. রাসায়নিক ক্রিয়ায়। মাছের দেহে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া থাকে। জীবিত অবস্থায় এরা মাছের তেমন ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু মাছ মরে গেলে এসব ব্যাকটেরিয়া দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে এবং মরা মাছের দেহে পরিবর্তন আনে। ফলে মাছ পচতে শুরু করে। মাছের শরীরে বিভিন্ন ধরনের এনজাইম রয়েছে। জীবিত অবস্থায় এগুলো মাছের উপকারে আসে। কিন্তু মরা মাছে এসব এনজাইমের ক্রিয়ার মাছের কোষকলা ভেঙে গিয়ে মাছে পচন ধরায়।
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার
- স্বাধীনতার পূর্ব হতেই মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন স্থানীয়ভাবে মৎস্য ও মৎস্যপণ্য বাজারজাত করছে। বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রোটিন হাউজ নামে ঢাকা শহরের হিমায়িত ও তাজা মাছ বাজারজাত করছে। তবে বর্তমানে চাহিদা অনুসারে তাদের সরবরাহের পরিমাণ অত্যন্ত কম।
- অভ্যন্তরীণ বাজারে বাজারজাত করার লক্ষ্যে এবং স্থানীয় জনসাধারণকে মান সম্পন্ন মৎস্য পণ্য সরবরাহ করার জন্য স্থানীয় মৎস্য বাজার, আড়তসমূহের মান উন্নয়ন অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের পণ্যের সুনাম বজায় রাখতে হলে অভ্যন্তরীণ বাজারের মান উন্নয়ন করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চাহিদা এবং WTO সমঝোতা স্মারক অনুসারে আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে মিল রেখে স্থানীয় বাজারের উন্নয়ন করতে হবে। অর্থাৎ SPS (Sanitary & Phytosanitory) বিষয়গুলো রফতানিকারক দেশ এবং আমদানিকারক দেশের মানের সমান হতে হবে।
- বর্তমান বিশ্বের চাহিদা অনুসারে স্বাস্থ্যসম্মত মৎস্য পণ্য উৎপাদন এবং তা রফতানির মাধ্যমে ২০০৫ সালের মধ্যে রফতানির পরিমাণ ৬০,০০০ মেট্রিক টনে উন্নীত করা সম্ভব এবং রফতানি আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব বর্তমানের ২,০০০ কোটি থেকে ৩,০০০ কোটি টাকায়।
- অভ্যন্তরীণ বাজারে বাজারজাত করার জন্য সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা না থাকার কারণে মোট মাছ উৎপাদনের ৪-৫% পণ্য ভোক্তাদের নিকট পৌঁছার পূর্বেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যার মুল্য বর্তমান বাজার দর অনুসারে ৪০০-৫০০ কোটি টাকা।
- এই বিপুল পরিমাণ মৎস্য সম্পদ দূষণ ও পঁচন থেকে রক্ষা করে স্বাস্থ্যসম্মত অবস্থায় সংরক্ষণ ও বাজারজারত করা হলে দেশে আমিষের চাহিদা পুরণে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে।
- বর্তমানে আমাদের উৎপাদিত পণ্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। ই.ইউ-এর দেশসমূহে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান আমাদের মৎস্য পণ্যের প্রধান ক্রেতা। এদের চাহিদা অনুসারে আমাদের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের মধ্যে সমন্বয় আনতে হবে। তাহলেই আন্তর্জাতিক বাজারে ধরে রাখা সম্ভব।
বিভিন্ন প্রকার প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি
মৎস্য ও মৎস্য পণ্যের গুণাগুণ সংরক্ষণ বলতে যে তাজা ধৃত মাছের যে সকল গুণাগুণ রয়েছে তার সকল খাদ্যমান ও গুণাগুণ বজায় রেখে কেতার চাহিদা অনুসারে দীর্ঘ মেয়াদী ও স্বল্প মেয়াদীভাবে সংরক্ষণ করে বাজারজারত করা। মাছ বা চিংড়ি বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণ করা যায়। সাধারণত যে সকল প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করা হয় তা হলো- ১। বরফায়িত করে বা বরফ দ্বারা সংরক্ষণ করা; ২। শুকিয়ে শুটকী তৈরি করা; ৩। হিমায়িত করা; ৪। কৌটাজাত করা।
বরফায়িত বা বরফ দ্বারা সংরক্ষণ
- মাছ ধরার পর পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধোয়ার পর ১ঃ১ হারে মাছ ও বরফ মিশিয়ে মাছকে সংরক্ষণ করা যায়। বরফ মেশানোর ফলে মাছের দেহের তাপমাত্রা ১-৫ সেন্টিগ্রেড এর মধ্যে নেমে আসে। এর ফলে মাছের ভিতরের অনুজীবের বংশ বৃদ্ধি হরাস পায়।
- অভ্যন্তরীণ বাজারজারত করার লক্ষ্যে এ প্রক্রিয়ায় মাছ সংরক্ষণ করতে হয়। এই পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত মাছের গুণাগুণ প্রায় ৭ দিন পর্যন্ত বজায় থাকে।
- কাঠের বা প্লাষ্টিকের বাক্সে মাছ এভাবে সংরক্ষণ কররে মাছের গায়ে চাপ পড়ে না। ফলে অন্যান্য গুণাগুণসহ আকার সুন্দর থাকে। ক্রেতার গ্রাহ্যতা বৃদ্ধি পায়।
- অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য এ পদ্ধতিতে মাছ সংরক্ষণ করে বাজারজাত করা অপরিহার্য। যে পানি দিয়ে বরফ তৈরি করা হয় তার মান স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
হিমায়িত করে সংরক্ষণ
- কারখানায় সংগৃহীত মাছ বা চিংড়ি মাথা ছাড়ানো বা খোসা ছাড়ানো কাজ করার পর ঠাণ্ডা পান উপযোগী পানি দ্বারা ধৌত করার পর ব্লাস্ট ফিজারে বা কন্ট্রাক্ট প্লেট ফ্রিজারে বা আধুনিক আই.কিউ.এফ মেশিনে ৪০ থেকে ৪৫ সে. নিম্ন তাপমাত্রায় হিমায়িত করা হয়। মাছের ভিতরের তাপমাত্রা যখন ১৮ সে. নেমে আসে তখন তাকে ভালোভাবে বায়ূহীন এবং একেবারে ছিদ্রহীন অবস্থায় মোড়কজাত করে ১৮ সে. নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়।
- এ প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজত মাছ ৩ থেকে ১০ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
কৌটাজাত করে সংরক্ষণ
বাংলাদেশে এখনো কৌটাজাত করে মৎস্য ও মৎস্য জাত পণ্য উৎপাদন বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় নি। এ প্রক্রিয়ায় মাছ বা চিংড়ি ক্রেতার চাহিদা অনুসারে, নাড়িভুড়ি বা খোসা পরিষ্কার করার পর পান উপযোগী পানি দ্বারা ধুয়ে নিয়ে প্রয়োজনীয় মশলা বা লবণ ও অন্যান্য দ্রব্যাদি মিশিয়ে ছিদ্রহীন প্লাষ্টিক বা টিনের কৌটায় বায়ুশূন্যভাবে কৌটাজাত করা হয়।
কৌটাজাত করার পর ১২১ সে. তাপমাত্রায় ১৫ পাউন্ড পিএসআই চাপে সিদ্ধ করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাত পণ্য সাধারণ তাপমাত্রায় প্রায় এক বছর ভালো অবস্থায় থাকে। কৌটাজাত মাছ তৈরি করার সময় কৌটার মধ্যে কোনো বাতাস যাতে ঢুকতে না পারে সেভাবে সীল করতে হবে। ইলিশ মাছ এ ধরণের কৌটাজাত করা যেতে পারে।
শুটকি তৈরি করা
শুকিয়ে শুটকী তৈরি করে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য সংরক্ষণ করা খুবই সহজ এবং কম মূলধনে করা যায়। সাধারণত নিম্নলিখিত প্রক্রিয়ায় শুটকী তৈরি করা হয়।
১. মাছ শুধু রোদে শুকিয়ে ২. মাছ লবণ দিয়ে রোদে শুকিয়ে ৩. মাছ শুধু লবণ দিয়ে ৪. ধুমায়িত করে ৫. সোলার ড্রায়ারের সাহায্যে ৬. সিদল বা ফারমেন্টেট করে এবং ৭. যান্ত্রিক ড্রায়ারের সাহায্যে।
মাছ শুধু রোদে শুকিয়ে শুটকী করা
- আমাদের দেশে যখন প্রচুর মাছ ধরা পড়ে তখন শুটকী তৈরি করা হয়। পর্যাপ্ত রোদ না থাকলে রোদে শুকিয়ে লতী শুটকীর মান রক্ষা করা যায় না। বাংলাদেশের কক্সবাজার টেকনাফ, দুবলারচর, ময়মনসিংহ, সিলেট, কিশোরগঞ্জ মৌলভীবাজার, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, ঝালকাঠি এসব এলাকায় বেশ কিছু শুটকী চরফেশন, সুনামগঞ্জ, প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে।
- রোদে শুকিয়ে শুটকী তৈরির সময় মাছকে ভালোভাবে কেটে নাড়ি ভুড়ি ফুলকা ফেলে দিয়ে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হয়। তারপর মাচানে বা চাটাইয়ের উপর রোদ দিতে হয়। কোনো কোনো এলাকায় ঘাসের উপর বালি উপর মাছ বিছিয়ে শুকানো হয়। যা কোনো ক্রমেই স্বাস্থ্যসম্মত উপায় নয়।
- মাছ রোদে শুকিয়ে শুটকী করতে প্রায় ৫ থেকে ৭ দিন সময় লাগে। যদি মাছ শুকানোর পর তার মধ্যে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ১৫-২০% এর মধ্যে থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে ঠিকভাবে শুকিয়েছে।
- এ প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাতকালে শুটকীতে মাছি বা পোকা-মাকড় বসে এবং অনেক সময় মাছি ডিম পাড়ে। যা দ্বারা মানুষ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়।
- আবার অনেকে শুটকীকে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য নানা ধরণের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে। যা মানুষ খাওয়ার ফলে নানা প্রকার রোগসহ ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- স্বাস্থ্যসম্মতভাবে শুটকী তৈরি করতে পারলে এবং স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সংরক্ষণ করলে এর খাদ্যমান অনেক দিন পর্যন্ত বজায় থাকে। কোনো অবস্থাতেই শুটকীতে বিষাক্ত কোনো কীটনাশক ব্যবহার করা যাবে না। এটা আইনত অপরাধ।
লবণাক্ত করে সংরক্ষণ
মাছ ধরার পর নাড়িভুড়ি ফেলে দিয়ে পরিষ্কার পানি দ্বারা ধোয়ার পরিষ্কার পাত্রে বা প্লাষ্টিকের টাবের মধ্যে ৪:১ মাছ ও লবণ মিশিয়ে ২৪ ঘণ্টা মাছকে ডুবিয়ে রাখা হয়। মাছ লবণে ভিজিয়ে রাখার ফলে প্ররিশ্রাবণ প্রক্রিয়ায় মাছের ভিতর লবণ ঢুকে যায় এবং মাছের ভিতরের পানি বের হয়ে যায়। পরে মাছের গায়ের উপরের লবণ পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে বায়ু শূন্য প্লাষ্টিক ব্যাগে সংরক্ষণ করতে হয়। লবণ মাছের পঁচন প্রতিরোধ করে। বাংলাদেশে ইলিশ, পোয়ামাছসহ বেশ কিছু সামুদ্রিক মাছ লবণাক্ত করে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এ সকল প্রক্রিয়াজাত মাছ সাধারণত সিংগাপুর, হংকং ও চিনে রফতানি হয়ে থাকে। আমাদের স্থানীয় বাজারে লোনা ইলিশের চাহিদা প্রচুর।
লবণ ও রোদে শুকিয়ে
১০% লবণ দ্রবণে মাছকে ৩০ থেকে ৬০ মিনিট ভিজিয়ে রাখার পর মাছ রোেদ শুকানো হয়। এ প্রক্রিয়ায় মাছ শুকানোর সময় সাধারণত রোদে শুকিয়ে শুটকী তৈরির চেয়ে সময় কম লাগে এবং এর মানও কিছুটা ভালো থাকে। শুকানোর পর ছিদ্রহীন পলিথিনে +৫ সে. হতে +১০ সে. তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হলে মাছের মান দীর্ঘ দিন ভালো থাকে।
ধূমায়িত করে শুটকী তৈরি
- বাংলাদেশে এ প্রক্রিয়ায় শুটকী করা খুব একটা প্রচলিত নয়। বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে কিছু কিছু মাছ বা চিংড়ি ধুমায়িত করে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এ প্রক্রিয়ায়
- মাটিতে গর্ত করে বা ড্রামে চুল্লি বানিয়ে কাঠ বা ধানের কুড়া দ্বারা ধোঁয়া তৈরি করা হয়। চুল্লির উপর তাকে (সলফ) মাছ সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। ধোঁয়া সঞ্চালনের ফলে মাছের বর্ণ হলুদ হয়ে যায় এবং চুল্লির ভিতরের তাপমাত্রার চেয়ে ৮ থেকে ১০ সে. বৃদ্ধি পায়। ফলে মাছ তাড়াতাড়ি শুকায়।
- মাছ যখন হলুদাভ বর্ণ ধারণ করে, তখন বুঝা যাবে মাছ শুকিয়েছে। এ অবস্থায় তৈরি শুটকী ছিদ্রহীন বায়ুশুন্য ব্যাগে ভরে + ৫ সে. হতে ১০ সে. নিম্ন মাত্রায় সংরক্ষণ হলে উৎপাদিত গুটকী অনেক দিন পর্যন্ত মান বজায় থাকে।
সোলার ড্রয়ারের সাহায্যে
- এটা খুবই স্বাস্থ্যসম্মত পন্থা। এ প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজত শুটকী বিভিন্ন রোগ জীবাণু আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
- বাঁশের মাচানে প্লাষ্টিক দ্বারা তাঁবু বানাতে হয়। তাঁবুর যে দিক দিয়ে সূর্যের আলো পৌঁছাবে তার উল্টোদিকের অংশটুকু কালো হতে হবে যাতে আলো প্রতিফলিত হতে পারে। ফলে তাবুর ভিতরের তাপমাত্রা ৫-৮ সে. বেড়ে যায়, এতে মাছ সনাতন পদ্ধতির শুটকী তৈরির প্রায় অর্ধেক সময়ে শুকায়।
- সূর্যের আলো পর্যাপ্ত হলে এভাবেই প্রক্রিয়াজাত করা সহজ ও খরচ কম। কিন্তু অতিরিক্ত বাতাসে এ প্রক্রিয়াজাত করা যায় না। কেননা বাতাস তাঁবুকে নষ্ট করে দেয়।
যান্ত্রিক ড্রায়ারের সাহায্যে
পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে যান্ত্রিক ড্রায়ারের সাহায্যে মাছ শুকানো হয়। আমাদের দেশে এভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ এখনো চালু হয় নি। এর খরচ বেশি বিধায় আমাদের আর্থ সামাজিক অবস্থায় এটা দ্বারা শুটকী তৈরির পদক্ষেপ কেউ গ্রহণ করেন নি।
শুটকী সংরক্ষণ ব্যবস্থা
- শুটকী তৈরি করে ছিদ্রহীন বায়ুশুন্য পলিথিনে +৫ সে. ১০ সে. নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা
- হয় তাহলে ১২-১৫ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। সিদল বা ফারমেন্টেড শুটকী সাধারণ
- অবস্থায় বায়ুহীন পাত্রে সংরক্ষণ করা হলে ৬-৯ মাস মান সম্পন্নভাবে সংরক্ষণ করা যায়।
সিদল্ বা ফারমেন্টেড শুটকী
বাংলাদেশের বিশেষ করে সিলেট এলাকায় এ পদ্ধতি প্রক্রিয়াজাত করার ক্ষেত্রে পাতিলটি ছিদ্রহীন করে নিতে হয়। প্রথমে মাটির পাতিলটিকে মাছের তেল বা সোয়াবিন তেল দ্বারা ভিতরে মুছে আগুনের হালকা তাপে শুকিয়ে নিতে হয়। তারপর মাছ পাতিলে সারিবদ্ধভাবে বিছিয়ে দিতে হয়। প্রতি এক পরল পর কলাপাতা দিয়ে বায়ুরোধী করা হয়। বায়ুরোধ হওয়ায় মাছ আরো ভালোভাবে ফারমেন্টেড হয়। মাছ পাতিলে ভরার পর এর মুখ কলাপাতা ও মাটির ঢাকনা লাগাতে হয়। ঢাকনাযুক্ত মাছ ভর্তি পাতিল ২-৩ মাস মাটিতে পুতে রাখতে হয়। মাটির নিচে এ মাছ ফারমেন্টেড হয়। ৩ মাস পর মাটি থেকে তুলে উপরের পানি ফেলে দিয়ে পরিষ্কার পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়।
উন্নত ও স্বাস্থ্য সম্মত বাজার ব্যবস্থা
উন্নত ও স্বাস্থ্য সম্মত বাজার ব্যবস্থার বিষয়টি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে খুবই ব্যাপক পরিসরে বিস্তৃত। উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত বাজার ব্যবস্থা বলতে আমরা সাধারণভাবে বুঝি, আমাদের বর্তমান ও সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তন করে কীভাবে মান সম্পন্ন পণ্য বাজারজাত করা যায়। এ প্রেক্ষিতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে:
পরিবহণ ব্যবস্থা
- বাংলাদেশের অধিকাংশ মৎস্য পণ্যই পরিবহণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণেই সাধারণত দূষিত বা নষ্ট হচ্ছে। পরিবহনকালে যে বিষয়গুলো নজর দেওয়া প্রয়োজন তা হলো:
- হোগলা পাতা, চাটাই, বাঁশের ঝুড়িতুে মাছ বা চিংড়ি সংরক্ষণ ও পরিবহন না করা।
- পরিষ্কার তাপ নিরোধক প্লাষ্টিকের বাক্সে মাছ বা চিংড়ি সংরক্ষণ ও পরিবহণের ব্যবস্থা করা।
- বরফবিহীন অবস্থায় মাছ বা চিংড়ি পরিবহন না করা। ৪. মাছের বা চিংড়ির সতেজতা কৃত্রিমভাবে ধরে রাখার জন্য কোনো ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করা।
- অন্তরীত (Insulated van) যান বা হিমায়িত যানে মাছ বাক্সে বরফসহ সংরক্ষণ করে পরিবহণ করা।
অভ্যন্তরীণ বাজার উন্নয়ন
- দেশে মাছের বাজার বলতেই একটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের চিত্র ভেসে ওঠে। অথচ মাছের বাজার তুলনামূলকভাবে বেশি স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া বাঞ্চনীয়। কারণ, বাজারে মাছ সাধারণত মৃত প্রাণির বাজার বিশেষ। যা সহজেই সংক্রমিত হতে পারে। তাই উন্নত স্বাস্থ্যসম্মত বাজার অবকাঠামো দরকার।
- উপজেলা পর্যায় থেকে জেলা শহর পর্যায়ে মাছ বাজারগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। মাছের বাজারে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, উঁচু পাকা প্লাটফর্ম, ঢাকনাযুক্ত ড্রেন, ছাদযুক্ত সেড, চারদিকে তারের জাল যাতে সহজেই মাছি ঢুকতে না পারে ইত্যাদি প্রয়োজন। মাছের বাজারে বরফ সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। এ বাজারে সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা অপরিহার্য।
- মাছের পরিবহণ ও বাজার ব্যবস্থার উন্নতি হলে সার্বিকভাবে দেশের মানুষের কাছে গুণগত মাছের প্রাপ্যতা সহজ হবে।
মাছের গুণগত মান বিনষ্ট হবার কারণ
- নানাবিধ কারণ মাছের গুণগতমান বিনষ্ট বা মাছের পচনকে প্রভাবিত করে। যথা:
- অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মৃত মাছ রাখা।
- আহরণের পর নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণের জন্য বরফের ব্যবহার না করা।
- মাছ ধোয়ার জন্য অস্বাস্থ্যকর ও দূষিত পানি ব্যবহার।
- পরিবহনকালে অপরিষ্কার যানবাহন ব্যবহার করা। কম বরফ ব্যবহার করা এবং বরফ ব্যবহারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতা।
- সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থাসহ বাজারজাতকরণের সুবিধা না থাকা।
মাছ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের গুরুত্ব
- বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মাছের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। রফতানি আয়ে মাছের অবদান অনেক। মাছ, ও মাছজাত পণ্য রফতানির মাধ্যমে ১৯৯৭-৯৮ অর্থ বছরে প্রায় ১,৩৮৭ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে যা মোট রফতানি আয়ের প্রায় ১০%।
- যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে মাছ ও চিংড়ির উৎপাদন যেমন বেড়েছে, দেশে বিদেশে মানসম্পন্ন মাছের চাহিদাও ক্রমশ বাড়ছে।
- আহরণোত্তর পরিচর্যার যে অভাব এতোদিন বিরাজ করছিল বর্তমানে তার উন্নয়ন ঘটেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের মাছ ও চিংড়ির চাহিদা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
- প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজে উন্নয়নের ফলেই এ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এই বিপুল সম্ভাবনাময় সম্পদের গুণগতমান যথাযথভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সঠিক রেখে রফতানি করা হলে বিদেশে এর চাহিদা যেমন আরো বৃদ্ধি পাবে। অপরদিকে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথও প্রসারিত হবে। এতে জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।
- চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মাছের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ লাখ টন আর রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৮ হাজার টন। যা থেকে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৭১ কোটি টাকা। পরিকল্পনার শেষ বছর ১৯৯৪-৯৫ সালে মাছ ও চিংড়ি রফতানি করে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় দেড়গুণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে।
- বর্তমানে আমেরিকার খাদ্য ও ওষুধ নীতির আলোকে মাছ, মাছ জাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে অধিকতর যত্নবান হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে প্রক্রিয়াজাতকরণ কার্যক্রম উন্নয়ন করা হলে প্রতি বছরে ৬৪ হাজার মেট্রিক টন মাছ ও চিংড়ি রফতানি করা এবং তার থেকে ২,০০০ কোটি টাকার অধিক বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে যা দেশেরঅর্থনীতিকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে।
- দেশে মাছের মোট উৎপাদনের প্রায় এক-চতুর্থাংশই ইলিশ। বছরের একটি বিশেষ সময়ে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়ে। যার অধিকাংশই প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে পচে যায়। এগুলো সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করা হলে দেশে আমিষের যোগান আরো বাড়ানো সম্ভব।
- সুতরাং জনগণের পুষ্টিমান বাড়ানো ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মাছ ও চিংড়ির প্রক্রিয়াজতকরণের গুরুত্ব অপরিসীম।
শেষকথা
মাছের স্বাদ ও গুণগতমান অক্ষুণ্ন রাখার জন্য কোনো জলাশয় হতে মাছ আহরণের পর যথাযথভাবে পরিবহন, পরিচর্যা ও সংরক্ষণের এ প্রক্রিয়াকে ‘মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ’ বলা হয়। মাছ অতি দ্রুত পচনশীল জীব। আহরণের একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর হতে মাছের পচন শুরু হয় এবং তা দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এ জন্য মাছ আহরণের পরপরই এর মান বা গুণাগুণ হরাস পেতে শুরু করে। মাছ ধরার পর থেকে শুরু করে বাজারে আনা, বিক্রি ও ভোক্তার খাওয়ার উপযোগী করতে বেশ কিছুটা সময় চলে যায়। এ সময়ের মধ্যে মাছ সংরক্ষণ করা না হলে তা পচে গিয়ে খাবার অনুপযোগী হয়ে যেতে পারে। আর মাছ পচা শুরু করলে কোনোভাবেই তা পূর্বাবস্থায় ফেরানো যায় না। সুতরাং মাছের গুণগতমান নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আহরণের পর থেকে শুরু করে ভোগ করা পর্যন্ত অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পরিবহন, পরিচর্যা ও সংরক্ষণ কার্যাদি সম্পন্ন করা প্রয়োজন।