ভূমিকাঃ
▪ পশু ও ছাগল বিশেষজ্ঞদের মতে, গরু, মহিষ, ভেড়া ইত্যাদি প্রাণী যে সমস্ত খাদ্য খায় না তা খায় ছাগল। অপরদিকে বলা যায়, ছাগল খায় না এধরনের বস্তু বিরল।
▪ প্রশ্নাতীতভাবে সত্য যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা খাদ্যের অভাবজনিত কারণে তারা অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ের পুষ্টিযুক্ত খাদ্য খায় যা সচরাচর অন্য কোনো গৃহপালিত পশু খায় না।
▪ উৎপাদনশীল সব পশু-পাখির জন্যে একই প্রকার খাদ্য ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। তার অর্থ ভালো পুষ্টিযুক্ত সুস্বাদু খাদ্য না হলে তার জীবনযাত্রা সঠিক মাত্রায় হয় না।
▪ অপর দিকে বলতে হয় শরীরের পুষ্টি সাধন না হলে মাংসের মান ও উৎপাদন বৃদ্ধি হয় না, দুধের পরিমাণ বাড়ে না, বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে না, চামড়ার মান উন্নত হয় না এবং পশম কর্কশ আর রুক্ষ হয়। সর্বোপরি বিভিন্ন প্রকার রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তাই অন্যান্য প্রাণীর মতো ছাগলের জন্য এমন সব খাদ্যবস্তু প্রয়োজন যা তার জন্য সুস্বাদু, জীবন ধারণ, শরীরের ক্ষয় পূরণ, দুধ উৎপাদন ও মাংস বৃদ্ধি করার মতো পুষ্টি সমৃদ্ধ।
▪ ছাগল অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু প্রাণী। প্রচণ্ড খরার মধ্যে তারা অনেকক্ষণ পানি ছাড়া থাকতে পারে। তপ্ত দুপুরে প্রখর রোদে তারা নির্লিপ্তভাবে শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিতে পারে।
▪ বংশগতভাবে ভালো উৎপাদনশীল একটা ছাগী না খেলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিজের দেহের সঞ্চিত খাদ্য ও দেহকোষ নিঃসৃত করে তার বাচ্চার জন্য দুধ উৎপাদনে সক্ষম।
▪ ছাগলের খাদ্যের ব্যাপকতা যে-কোনো গৃহপালিত পশু-পাখির চেয়ে বেশি। অন্যান্য তৃণভোজী পশুদের মধ্যে ছাগলের মুখ অত্যধিক শক্ত। তারা তাদের সচল ওপরের ঠোঁট পরিগ্রাহী জিহ্বার সাহায্যে অনায়াসে অত্যাধিক ক্ষুদ্র ঘাস লতা-পাতা, সুরক্ষিত কাটা ঝোপ অন্যান্য বৃক্ষ শাখা পল্লব ইত্যাদি টেনে-ছিঁড়ে খেতে পারে।
▪ একই চারণভূমিতে গরু, ভেড়া, মহিষ চরে যাবার পর ছাগল তার খাদ্য সংগ্রহ করতে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয় না। ফলে ছাগলের একটা বদনাম আছে, তারা যা খায় একেবারে মুড়ে খায় এবং খাওয়ার পর তা আর বাঁচে না।
▪ ছাগল তার খাদ্য-সামগ্রীকে পরিপূর্ণভাবে উৎপাদন সামগ্রীতে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিবর্তন ঘটায়।
ছাগল খামার করে সফল হতে হলে, আধুনিক ও উন্নত মানের ছাগলের খামার গড়তে হলে, ছাগলের খাদ্য বিষয়ে আলোচনার পূর্বে তার পরিপাক যন্ত্র ও হজম প্রক্রিয়া বিষয়ে সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
গৃহপালিত পশুদের মধ্যে রোমান্থনকারী প্রাণীদের পাকস্থলী ৪টি জটিল প্রকোষ্ঠে বিভক্ত যেমন:
- ১. রুমের বা প্রথম প্রকোষ্ঠ
- ২. রোটিকুলাম বা দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠ
- ৩. ওমেসাম বা তৃতীয় প্রকোষ্ঠ
- ৪. এবোমেসাম বা চতুর্থ প্রকোষ্ঠ।
ছাগলের পাকস্থলীর বিভিন্ন প্রকোষ্ঠ ও তার কার্যকারিতাঃ
১. রুমেন বা প্রথম প্রকোষ্ঠ
▪ পাকস্থলীর ৪টি প্রকোষ্ঠের মধ্যে লালার সাথে মিশ্রিত হয়। তাছাড়া তাড়াহুড়ো করে যেসমস্ত খাদ্য ছিঁড়ে খায় সেগুলো সঠিকভাবে চর্বিত না হয়েই রুমেনের মধ্যে জমা হয়।
▪ এ প্রকোষ্ঠ এক ধরনের ক্ষুদ্র জীবাণু দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে। তারা খাদ্যের নিম্নমানের আমিষ উপাদানকে এমোনিয়া (amonia) ও ইউরিয়া (Urea) হিসেবে ভেঙে দেয়।
▪ পাকস্থলীর ক্ষুদ্র জীবাণুদের কার্যকারিতার ফলে ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স তৈরি হয়ে খাদ্য হজমী প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে।
▪ আধা চর্বিত বা আধা হজমী অবস্থায় খাদ্যবস্তু রুমেন হতে পুনরায় মুখের মধ্যে ফিরে আসে। মুখের মধ্যে চর্বিত হবার সময় খাদ্যবস্তু উৎসেচক রসের সাথে মিশে পুনরায় রুমে ফিরে যায়। এ প্রক্রিয়াকে ‘রোমন্থন’ বলে।
▪ ছাগল বিশ্রামের সময় বা ঘুমানোর সময় ধীরে সুস্থে রোমন্থন করতে থাকে। ছাগল যখন পূর্ণ সজাগ থাকে তখন রোমন্থন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।
▪ ছাগলের পাকস্থালীর প্রথম প্রকোষ্ঠের জীবাণুগুলো আমিষ খাদ্য প্রস্তুত কার্যক্রম শুরু করে যখন আঁশযুক্ত খাদ্য পরিপূর্ণ হয়।
▪ জীবাণুরা আঁশ ভেঙে হজমযোগ্য চিনি ও শ্বেতসার উপাদানে পরিণত করে এবং আশের গিটে ও কোষে আটকে থাকা হজমযোগ্য বস্তুকে মুক্ত করে দেয়।
▪ ক্ষুদ্র জীবাণুর দ্বারা আঁশযুক্ত খাদ্যের পর যে বিপাকীয় প্রক্রিয়া সংঘটিত হয় তার ফলে সৃষ্ট তাপ ছাগলকে প্রচণ্ড শীত হতে রক্ষা করে।
▪ ভেড়ার তুলনায় ছাগলের চামড়া পাতলা ও শরীরে লোম ছোট। কিন্তু আঁশযুক্ত বা ছোবড়া জাতীয় খাদ্য পরিপূর্তির জন্য রুমেনের আকৃতি দ্বিগুণ বড়। শীতের দিনে ছাগল আঁশযুক্ত খাদ্য বেশি গ্রহণ করে। ছাগল তার রুমেনের মধ্যে আঁশযুক্ত খাদ্য হতে দেহের দরকারী পুষ্টি উৎপাদনে অনেক বেশি দক্ষ।
▪ আঁশযুক্ত খাদ্যের পরিবর্তে শুধু দানাদার ও মিশ্রণ খাদ্য পরিবেশন করা হলে শীতে রুমেনের মধ্যে ক্ষুদ্র জীবাণুর কার্য্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় এবং হজম প্রক্রিয়া ও বিপাকীয় প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে বিষক্রিয়ার ফলে ছাগলের মৃত্যু ঘটতে পারে। তাই ছাগলের খাদ্যের মধ্যে ধানের কুড়া ছাড়াও আঁশযুক্ত খাদ্য হিসেবে অন্যান্য ছোবড়া জাতীয় খাদ্যের মধ্যে ধানের তুষ অন্য কোনো পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় না।
২. রেটিকুলাম বা দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠ
▪ পাকস্থলীর এ অংশে মাংসল দেতোয়ালে মৌমাছির চাকের মতো চৌক চৌক ঘর থাকে। খাদ্যদ্রব্য রোমন্থন হবার পর রুমনের মধ্যে বিপাকীয় কার্যক্রম শেষে রেটিকুলাম বা দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে। রেটিকুলামকে চেক পোস্টও বলা যায়।
▪ খাদ্যের সাথে যে সমস্ত অবাঞ্ছিত দ্রব্য যেমন বোতাম, হাড়ের টুকরো, লোহার ছোট পেরেক বা বিষাক্ত কোনো দ্রব্য এখানে বাতিল হয়ে থাকে। এ সমস্ত দ্রব্য যদি দেহের কোনো ক্ষতি না করে তবে এ প্রকোষ্ঠে অনেকদিন পর্যন্ত থাকতে পারে। কিন্তু তারা যদি বিশ্রী স্থানে আটকে যায় তাহলে অন্তঃপর্দা ছিদ্র করে হৃদপিণ্ডে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
৩. ওমেসাম বা তৃতীয় প্রকোষ্ঠ
রেটিকুলাম হতে খাদ্য ওমেসামের মধ্যে প্রবেশ করার পর তার জলীয় অংশ আলাদা হয়ে যায়। প্রকোষ্ঠের ভেতর মাংসপেশির ভাঁজ মনে হবে বইয়ের পাতার মতোন পরপর সাজানো। এ মাংসল পর্দাগুলো খাদ্যের জলীয় অংশ আলাদা হতে সাহায্য করে।
৪. এবোমেসাম্ বা চতুর্থ প্রকোষ্ঠ
▪ জন্মের সময় ছাগলের বাচ্চার পাকস্থলীর এ অংশ বিদ্যমান থাকে। খাদ্যদ্রব্য এ অংশে প্রবেশ করার পর জারক রসের সাথে বা উৎসেচক রসের সাথে মিশ্রিত হয়। খাদ্যের সত্যিকারের হজম প্রক্রিয়া চতুর্থ প্রকোষ্ঠে সম্পন্ন হয়।
▪ হজম হবার পর খাদ্যের অনুকণা ক্ষুদ্রান্তের মধ্য দিয়ে বৃহদযন্ত্রের দিকে ধাবিত হওয়ার পথে খাদ্যের সার অংশ ক্ষুদ্রান্তের দেয়ালের অসংখ্য শুড়ের মাধ্যমে শোষিত হয়ে রক্তের সাথে মিশ্রিত হয়। রক্ত তখন বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গে রক্তশিরার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খাদ্যের সার অংশ পৌঁছে দেয়। ফলে পুষ্টি সাধিত হয়।
ছাগলের খাদ্যের সুস্বাদুতাঃ
▪ দেখা যায় যে, ছাগল দিনের মধ্যে ভালো চারণভূমিতে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা চরে খাওয়ার সুযোগ পেলে নিজের জীবনধারণ এবং সেই সাথে বাচ্চার জন্য পরিমিত দুধ উৎপাদন করতে পারে। তাছাড়া তাদের শরীরের বৃদ্ধি ঘটে থাকে অত্যন্ত ধীর গতিতে।
▪ মরিশসের ফিডস্ এন্ড ফিড়িং ও ড. ম্যাসনের এনিম্যাল্ ফিড়িং পদ্ধতি অনুসারে প্রতি ১০০ পাউন্ড (৪৫.৪ কেজি) ওজনের ছাগলের জন্য দৈনিক ৩.৪ পাউন্ড (১.৬ কেজি) ও ২ পাউন্ড (৯ কেজি) শুষ্ক বস্তু বিশিষ্ট খাদ্য পর্যায়ক্রমে কয়েকটি ছাগলকে দেওয়া হয়।
▪ উল্লিখিত নিরীক্ষায় দেখা যায় যে, সবল ছাগলগুলো নিজের খাদ্য শেষ করে অপরের বরাদ্দ খেয়ে ফেলেছে। ফলে তাদের পাকস্থলীতে (প্রথম প্রকোষ্ট) খাদ্য জমাট বেঁধে ফুলে উঠেছে। তাদের মধ্যে কিছু ছাগল মারা যায় অন্যগুলো তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে সুস্থ হয়ে ওঠে।
▪ এখানে উল্লেখ্য যে, ছাগলগুলোকে বিভিন্ন পাত্রে খাবার না দিয়ে একই পাত্রে দেওয়া হয়েছিল। ছাগলের পাকস্থলী ধৈর্যশীল এবং তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেতে পারে।
ছাগলের একটি উন্নত খাদ্যের নমুনাঃ
ছাগলের জন্য সাইলেজ ঘাসঃ
- ঘাস, শুটি জাতীয় গাছ, দানদার ও ডাটাযুক্ত গাছ ইত্যাদি ফুল হওয়ার সময় সাথে সাথে বা পরিপক্ক হবার পূর্বে সবুজ অবস্থায় সংরক্ষণ করাকে সাইলেজ বলে।
- ৫×৫ × ৪ গর্তে কাঁচা ঘাস সাজিয়ে জমা করে সংরক্ষণ করা হয়। গর্তে সাজাবার পূর্বে অনেক সময় চূর্ণ করে বা ছোট ছোট করে কেটে নেওয়া হয়। এ গর্ত কাঁচা বা পাকা উভয় প্রকার করা যায়।
- গর্ত এমন স্থানে করা হয় যে, বর্ষার পানি ভিতরে প্রবেশ করে ঘাস পচিয়ে ফেলতে না পারে।
- গর্তের উপরিভাগ মাটি দিয়ে অথবা পুরানো সাইলেজ ঘাস দিয়ে এমনভাবে ঢেঁকে দিতে হয় যেন আলো-বাতাস প্রবেশ করতে না পারে।
- ঘাস সাইলেজ্ হলে একটা টকটক গন্ধ এবং অত্যন্ত উপাদেয় ও সহজে হজমযোগ্য হয়।
- বর্ষা ও রোদ থেকে রক্ষার জন্য উপরে একটা চালা তৈরি করে দিলে ভালো হয়।
- এ প্রথায় ঘাসের সবুজ অংশ সংরক্ষিত থাকে এবং কাঁচা ঘাসের অভাব ঘটলে তার পরিবর্তে এ ঘাস খাওয়ানো যায়।
- ছাগল আবদ্ধ করে পালতে হলে এ খাদ্য খাওয়ানো অভ্যাস করাতে হয়। শতকরা ৫% হারে ইউরিয়া মিশ্রিত করেও সাইলেজ তৈরি করা যায়।