খামার কিভাবে করতে হয়?
▪ পার্বত্য ও মরু অঞ্চলের খোলা প্রান্তরে ছাগলের আদি বাসস্থান। স্বভাবত কারণেই তারা আবদ্ধ স্থানে থাকতে পছন্দ করে না। তারা পর্যাপ্ত খোলামেলা পরিবেশে ও শুকনো খটখটে স্থানে ঘুমাতে ও থাকতে পছন্দ করে।
▪ ছাগলের খামার স্থাপনা অসম্পূর্ণ থেকে যায় যদি না তাদের স্বাস্থ্য ও স্বভাব উপযোগী থাকার ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হয়।
▪ আমাদের ঘর-বাড়ি তৈরির জন্য বিশেষ চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। খামারের ঘর-বাড়ি একটি স্থায়ী সম্পদ। ইচ্ছেমতো বার বার ভেঙেচুরে স্থানান্তর করা সম্ভব নয়। এখানে নগদ অর্থের চেয়ে সদুপদেশ অনেক বেশি মূল্যবান।
▪ খামারের ঘর-বাড়ি ও ছাগল রাখার সেডগুলো এমন পরিকল্পিত ব্যবস্থাধীনে থাকা উচিত যেন কম মজুর খরচে অল্প সময়ের মধ্যে পরিচর্যার সুবিধে হয়। ঘরগুলো এলোপাথাড়ী হলে খামারের সৌন্দার্য যেমন নষ্ট নয় তেমনি ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার জন্য সময়ও খরচ বেশি হয়।
▪ ছাগলের খামারে কী কী ঘরের প্রয়োজন হয় এবং ঘরগুলো কোথায় কীভাবে স্থাপন করতে হবে, ভবিষ্যতে খামার সম্প্রসারণ করতে হলে কীভাবে করা যাবে, তার একটা নীলনকসা প্রস্তুত করা প্রয়োজন।
ছাগল খামার ঘর তৈরিঃ
ছাগলের খামারে ১১টি প্রয়োজনীয় ঘরের তালিকা নিচে দেওয়া হলোঃ
- ১. দুগ্ধবতী ছাগী রাখার ঘর।
- ২. মাংস উৎপাদনের জন্য ছাগল রাখার ঘর।
- ৩. বাচ্চা পালন করার ঘর।
- ৪. পাঠা পালন করার ঘর।
- ৫. অসুস্থ ও প্রসূতি ঘর।
- ৬. খাদ্য গুদাম ঘর।
- ৭. শুটি জাতীয় ও ছোবড়া জাতীয় শুকনো খাবার ঘর।
- ৮. কাঁচা শুটি ও ছোবড়া জাতীয় শুকনো খাবার ঘর।
- ৯. যন্ত্রপাতি ও খামারের আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র রাখার ঘর।
- ১০. সার্বিক হিসাব রক্ষণের অফিস ঘর।
- ১১. কর্মচারীদের বাসস্থান।
ছাগলের খামার করার জন্য স্থান নির্বাচনের নিয়মঃ
১. উঁচু স্থান, যেখানে বর্ষাকালে পানি জমে না।
২. কাঁকর ও বালি মিশ্রিত স্থান, যেখানে বর্ষার পানি সহজেই মাটিতে শুকিয়ে যায়।
৩. চারদিকে পারতপক্ষে ফাঁকা স্থান এবং প্রচুর আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। খামারের ভিতরে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, আমলকী, তুত, পেয়ারা ইত্যাদির বাগান করা যায়। এ খামার চা বাগান ও ডেয়ারি ফার্ম সংলগ্ন করতে পারলে পরস্পর নির্ভরশীল অনেক সুবিধে পাওয়া যায়।
৪. খামারের ছাগল চরার মতো স্থান সংকুলান করা না গেলে খাদ্য উৎপাদনের জন্য স্থান অবশ্যই থাকতে হবে।
৫. পানি নিষ্কাষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৬. কর্মচারীদের বাসস্থান নির্মাণের স্থান থাকতে হবে।
খামারে ছাগলের ঘুমানোর ব্যবস্থাঃ
▪ ছাগল ঘুমানের জন্য মেঝেতে খড়ের বিছানা করা যায়। প্রতিদিন প্রচুর খড়ের প্রয়োজন পড়ে। পায়খানা পেশাবের জন্য খড় নষ্ট হওয়ার ফলে পরিষ্কার করতে অতিরিক্ত লোকের প্রয়োজন হয় তেমনি খড়ে ড্রেন বন্ধ হয়ে যায় এবং পরিষ্কার করতে ঝামেলার সৃষ্টি হয়। ছাগলের ঘরে ঘুমানোর জন্য মাঁচা তৈরি করা হলে এ সমস্যা আর থাকে না।
▪ ছাগল স্বভাবগতভাবে উঁচু স্থানে থাকতে পছন্দ করে। এ মাঁচা কাঠের তক্তা বা বাঁশের চট দ্বারা তৈরি করা যায়। মাঁচা থাকলে ঘর প্রতিদিন পরিষ্কার করতে অনেক সুবিধে। পায়খানা-পেশাব খড় নোংরা করতে পারে না এবং ছাগলের মেঝে হতে ঠাণ্ডা লাগার সম্ভাবনা থাকে না।
▪ ঘরের মধ্যে দেওয়ালের ১ ফুট দূরে লম্বা মাঁচা তৈরি করে দিলে তার উপর ছাগল আরামে ঘুমাতে পারে। এ মাঁচা মেঝে হতে কমপক্ষে ১ ফুট এবং সর্বাধিক ২ ফুট উঁচুতে প্রতি বড় বিদেশি ছাগলের জন্য ৩ ফুট লম্বা ও ২ ফুট চওড়া এবং দেশি বড় ছাগলের জন্য ২ ফুট লম্বা ও ১ ফুট ৬ ইঞ্জি চওড়া মাঁচা প্রয়োজন হয়।
▪ ছাগলের সংখ্যানুপাতে লম্বা মাঁচা তৈরি করলে একত্রে ঘুমাতে পারে। বাচ্চাদের জন্য এ মাঁচা দ্বিতল বিশিষ্ট তৈরি করা যায়।
ছাগলের খামারের ঘরের মেঝেঃ
▪ মেঝে কাঁচা-পাকা উভয়ভাবে করা যায়। তবে অল্প খরচে ইট বিছিয়ে সোলিং করে মেঝে করা যায়।
▪ ইটের মাঝে বালু-সিমেন্ট দ্বারা ফাঁক বন্ধ করে দেওয়া যায়। ইটের মেঝেতে ছাগলের পা পিছলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কারণ, মেঝেতে মলমূত্রে পিচ্ছিল হয়ে যায়। মেঝে ড্রেনের দিকে ঢলে করলে পরিষ্কার করতে সুবিধে হয়।
ঘরের মেঝে তৈরি করার নিয়মঃ
▪ এ প্রথায় ঘরের মেঝে একদিকে একটু ঢালু করে কাঠের তক্তার সাহায্যে তৈরি করা যায়। ফলে ঘুমানো বা বিশ্রামের জন্য কোনো মাঁচার প্রয়োজন হয় না। অবশ্য ভালো জাতের কাঠ না হলে পেশাব-পায়খানা ও পানি লেগে তাড়াতাড়ি পঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
▪ ভালো কাঠ না হলে কাঠের পরিবর্তে পাকা মেঝেই ভালো। ঘরের মেঝে পাকা হলে তাদের বিশ্রাম ও ঘুমানোর জন্য আলাদা মাঁচা তৈরি করতে হবে।
▪ ছাগলের ওজন ও আকার অনুপাতে ৫ × ৩, ৬ × ৪, ৭ × ৪ অথবা ৮ × ৪ আকারের মেঝে তৈরি করা প্রয়োজন।
ছাগলের ঘরের দেওয়াল বা বেড়াঃ
▪ অল্প খরচে মুলিবাঁশের বেড়া তৈরি করা যায়। তবে বেড়ার নিচে অন্তত ১ ফুট পরিমাণ ইট দ্বারা পাকা করলে ছাগলের মলমূত্র এবং ঘর ধোয়ার পানি লেগে বেড়া নষ্ট হতে পারে না।
▪ গ্রামে মাটির দেওয়াল তৈরি করারও রেওয়াজ আছে। বেড়া বা দেওয়াল মেঝে হতে ৪ ফুট পরিমাণ ভট হতে হবে এবং উপরের অংশ তারের বা চটার জালি অথবা ফাঁকা ফাঁকা করে ইটের গাঁথুনি করা যায়।
▪ ছাগলের ঘরের উচ্চতা ৭ ফুট হতে ১০ ফুট হলেই যথেষ্ট হয়।
ছাগলের ঘরের চালাঃ
ঘরের চা গোলপাতা, খড়, মাটির টালি, এসবেস্ট্রন বা টিন দ্বারা দো-চালা ঘর করা যায়। টিনের চালা হলে চালার নিচে চাটাই দ্বারা সিলিং দিলে রোদে ঘর গরম কম হয়।
ছাগলের খামারে তার ঘরের অবস্থানঃ
ঘরগুলো এমনভাবে স্থাপিত হওয়া প্রয়োজন যেন সামনে পর্যাপ্ত রোদ পড়ে। বিশেষ করে ভোর বেলার রোদ ছাগলের শরীরে ভিটামিন ‘ডি’ উৎপাদনের সাহায্য করে। ঘরগুলো তাই দক্ষিণ অথবা পূর্বমুখী হওয়া উচিত।
ছাগলের খোয়াড়ঃ
▪ দিনের বেলা ছাগল রাখার জন্য ঘরের সামনে খোয়াড় তৈরি করতে হয়। ঘরের প্রস্থ অনুপাতে দ্বিগুণ চওড়া এবং ঘরের দৈর্ঘ্যের সমান লম্বা খোয়াড় তৈরি করতে হয়। খোয়াড়ের বেড়ার উচ্চতা ৪ ফুট হলেই চলে।
▪ খোয়াড়ের খুঁটি কাঠ অথবা বাঁশ দিয়ে তৈরি করা যায়। খোয়াড়ের ভিতর বালু অথবা কাঁকরযুক্ত মাটি বিছিয়ে দিলে সামান্য বৃষ্টিতে এবং ছাগলের মলমূত্র মিলে কর্দমাক্ত ও পিছিল হয় না।
▪ খোয়াড়ের ভিতর অথবা সীমানায় বড় গাছ থাকলে ছায়া হয় ফলে ছাগল রোদে কষ্ট পায় না। গাছের ঝরা পাতা ছাগলে খায়। গাছ-পালা না থাকলে খড়ের উপর নারকেল, খেজুর অথবা গোলপাতা দ্বারা ছায়া তৈরি করে দিতে হয়।
ছাগল খামারের খোয়াড় পরিকল্পনাঃ
প্রতি স্টল সংলগ্ন সামনের দিকে দিনের বেলা পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ও সূর্যকিরণ পাওয়ার জন্য তৈরি করতে হয়। পানির পাত্র, খাবার পাত্র, ছোবড়া ও আঁশযুক্তখাদ্য পরিবেশন পাত্র এসব পরিবেশন গলি পথে স্টল সংলগ্ন পাত্রসমূহে খাদ্য দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। স্টলের বেড়ার সাথে ঝুলানো আংটায় বালতিতে করে আলাদা আলাদাভাবে দানাদার খাদ্য ও পানির দিতে হয়। স্টলের বেড়ার সাথে বিশেষভাবে তৈরি এক প্রকার ঝুড়ির থাকে। ঝুড়ির উপর দিয়ে ছোবড়া ও আঁশযুক্ত খাবার দিতে হয়। জুড়ির নিচ হতে ছাগলে টেনে-ছিঁড়ে এ সমস্ত খাবার খেতে পছন করে। এ ঝুড়িকে ‘হে ব্যাক’ বলে। বাঁশ বা কাঠের সাহায্য তৈরি এ ঝুড়ির মাপ ২ ফুট × ১.৫ এবং গভীরতা ২ ফুট।
ছাগলের খাদ্য ও পানির পাত্রঃ
খোয়াড়ের মধ্যে মাঝে মাঝে কয়েকটা বালতি ভরে ছাগলের পান করার জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে হয়। দানাদার খাদ্য দেওয়ার জন্য খোয়াড়ের মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে যেন একে অন্যের খাদ্য খেতে না পারে। ঝুড়ি ভরে রুটিন মতো ছোবড়া ঘাস ও আঁশযুক্ত খাদ্য এবং পাতাসহ গাছের ডাল মাঝে মাঝে ঝুলিয়ে দেওয়া যায়।
ছাগলের বাচ্চার ঘরঃ
▪ একই উপায়ে বাচ্চার ঘর তৈরি করতে হয় অথবা ঘরের মধ্যে বেড়া দ্বারা পার্টিশন করা যায়। এ বেড়া কাঠের বাতা বা বাঁশের চটা দ্বারা তৈরি করা যায়।
▪ বাচ্চা এমনভাবে আলাদা অবস্থায় রাখতে হয় যেন মা ও বাচ্চা পরস্পর দেখতে পারে অন্যথায় উভয়ে ডাকাডাকি করে।
▪ একটি ঘরে প্রতিটি ছাগলের জন্য আলাদা খোপ বা রুম ব্যবস্থাকে স্টল বলে। দুগ্ধবতী গাভীন ও প্রসবকালীন ছাগীর জন্য এ প্রথা সুবিধেজনক। কারণ, এ সময়ে আবশ্যিকভাবে তাদের দানাদার খাদ্য খাওয়াতে হয়। পাঠা পলন করার জন্যে স্টল ঘর তৈরি করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।
▪ ১০০ পাউন্ড (৪৫.৪ কেজি) ওজনের একটি দুগ্ধবতী ছাগীর জন্য সর্বনিম্ন পরিমাণ ২০ বর্গফুট হতে ৩০ বর্গফুট পরিমাণ স্থান যুক্ত মেঝে থাকতে হবে। যদিও চলা ফেরা তার জন্য সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয় তবুও সে অত্যন্ত উৎপাদনশীল থাকে।
ছাগলের খামার পরিকল্পনার অন্যান্য বিষয়বস্তুঃ
পরিবেশন গলিপথঃ
▪ ঘরের মধ্যে যদি উভয় দিকে স্টল থাকে তবে পরিবেশন গলি উভয় সারির মধ্য বরাবর থাকা সুবিধেজনক। এ ব্যবস্থায় ছাগলের পরিচর্যা করতে সুবিধে হয়। স্টলের মেঝে পরিবেশন গলি পথের দিকে ঢালু করে তৈরি করা হয়। ফলে একটি ড্রেন তৈরি করলে যথেষ্ট হয়।
▪ এক সারি বিশিষ্ট স্টল হলে ঘরের সামনের দিকে পরিবেশন পথ থাকে। প্রতি স্টলের মাঝে বিভক্তকারী বেড়ার উচ্চতা ৪ ফুট হতে ৫ ফুট উচু হয়। বেড়া কাঠের বাতা বা বাঁশের চটা দ্বারা তৈরি করা যায়।
রক সল্ট দেওয়ার ব্যবস্থাঃ
আমরা পূর্বেই জানি যে ছাগলের জন্য আলাদা লবণ দিতে হয়। ঘরের মেঝের একদিকে একটি পাত্রে রকসল্ট এর দলা রাখলে প্রয়োজন অনুসারে ছাগলের চেটে খেতে পারে।
ড্রেন বা নর্দমাঃ
পরিচর্যাকারীর চলাচল পরিবেশন গলি পথের উপর দিয়ে নর্দমা তৈরি করা হয়। ছাগলের ঘর হতে এ নর্দমা সরাসরি ‘সার পিটের’ সাথে সংযুক্ত থাকে। পায়খানা পেশাব নর্দমা পরিষ্কার করে পিঠের মধ্যে জমা করা হয়। পিঠের উপরে সূর্যকিরণ ও বৃষ্টি হতে রক্ষা করার জন্য একটি চালা থাকে।