ছাগল ভেড়া প্রজননঃ
খামারের উদ্দেশ্য ও বাজারের চাহিদানুপাতে খামারে ছাগলের জাত তৈরি করতে হয়। জাত নির্বাচনে পাঠার ভূমিকা অগ্রগণ্য। আমাদের দেশে সাধারণত ছাগল পালা হয় মাংস ও চামড়ার জন্য। মাংস ও চামড়ার জন্য নির্বাচিত ছাগল একমাত্র বাংলাদেশের কালো ছাগল। এ জাত সংরক্ষণ ও বংশবৃদ্ধির জন্য অন্য কোনো জাতের পাঠার সাথে মিলন ঘটানো উচিত নয়। এর ফলে চামড়ার মান, মাংসের গুণাবলি, বাচ্চা উৎপাদনের হার ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটতে পারে।
দুধ উৎপাদনের জন্য যমুনাপাড়ী, অ্যাংলো নোবিয়ানা, বিটল, বারবারি ইত্যাদি ছাগল পালা যায়। আমাদের দেশের আবহাওয়া উপযোগী ভালো দুধ উৎপাদনশীল জাত সৃষ্টির জন্য উন্নত জাতের শঙ্কর ছাগল তৈরি করার প্রয়াস চালানো যেতে পারে।
প্রজননের জন্য পাঠা নির্বাচনঃ
১. পাঠার বংশ পরিচয়ঃ
প্রজননের উদ্দেশ্যকে ফলপ্রসূ করতে হলে পাঠার বংশ পরিচয় অবশ্যই জানা উচিৎ। ভালো দুধ উৎপাদনের জন্য পাঠার মা বা তার বংশের দুধ উৎপাদন ক্ষমতা জানতে হবে। মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য পাঠার মায়ের বাচ্চা উৎপাদনের সংখ্যা ও হার ইত্যাদি যাচাই করতে হয়। বংশের গুণাগুণ পাঠার মাধ্যমে পরবর্তী বংশের মধ্যে সম্প্রসারিত হয়।
২. পরীক্ষিত পাঠাঃ
পাঠার সাহায্যে পর্যায়ক্রমে ৫টি ছাগীর গর্ভে বাচ্চা উৎপাদন করে তার শরীরের গঠন, শারীরিক বৃদ্ধি, দুধ উৎপাদনের পরিমাণ, বাচ্চা উৎপাদনের সংখ্যা ও হার ইত্যাদি যাচাই করতে হয়। যদি উল্লিখিত লক্ষণসমূহ তাদের ‘মা’দের থেকে বাড়ানো সম্ভব হয় তাহলে বুঝতে হবে পাঠাটি উন্নতমানের। তখন ঐ পাঠাকে পরীক্ষিত পাঠা বলে এবং ভবিষ্যৎ প্রজননের জন্য নির্বাচন করা হয়।
প্রত্যেক পাঠার বংশের পরিচয় ও বংশের গুণাবলি লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য ‘পিডিগ্রি কার্ড’ (Pedigree Card) ব্যবহার করা হয়। প্রজননের মাধ্যমে কোনো নতুন জাত সৃষ্টি হলে সেই জাতের গুণাগুণ ও বংশ পরিচয় লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য যে বই ব্যবহার করা হয় তাকে ‘হাৰ্ড বুক” (Hard Book) বলে। উন্নত দেশসমূহে এ সমস্ত গুণাগুণ ও যোগ্যতা যাচাই করার জন্য সংস্থা থাকে। ব্রিটেনে ‘ব্রিটিশ গোট সোসাইটি’ (British Goat Society); ভারতে ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অভ এগ্রিকালচারাল রিসার্স’ ইত্যাদি এ সমস্ত জাতের গুণাগুণ ও যোগ্যতা যাচাই করে।
৩. হাইব্রিড ভিগরঃ
দুটো উন্নতমানের ও উন্নত জাতের স্ত্রী ও পুরুষ ছাগলের মিলনের ফলে উন্নত জাতের বাচ্চা উৎপন্ন হয়। এ বাচ্চার গুণগত মান তাদের পূর্বপুরুষের চেয়ে যদি বেশি হয় তবে ঐ বাচ্চাকে ‘হাইব্রিড ভিগর’ বলে। গুণগত মানের মধ্যে যেমন তারা দ্রুত বড় হয়, দেহগত সৌন্দর্য ও আকারে উন্নত হয়, দুধ, মাংস ও চামড়ার উৎপাদন বাড়ে এবং উন্নত হয়।
ছাগলের প্রজনন কাল ও ছাগলের প্রজনন প্রক্রিয়াঃ
পুরুষ বাচ্চা বা পাঠা ৩ মাস বয়সে যৌবন প্রাপ্ত হয়। এ সময়ে সে তার সঙ্গীর ওপর উঠতে চেষ্টা করে।
প্রজননের জন্য পালিত পাঠাকে আলাদাভাবে খাবার ও পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে হবে। পাঠার বয়স ৬ মাস পূর্ণ না হলে তাকে দিয়ে প্রজনন করানো উচিৎ নয়।
কোনো পরিচিত খামার হতে বা পরিচিত ও বিশ্বাসী ছাগল পালনকারীর নিকট হতে বাচ্চা ক্রয় করে তাকে ছোটবেলা হতে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হয়। বাচ্চা পাঠা ক্রয় করার সময় তার মায়ের স্বাস্থ্য, দুধ উৎপাদনের পরিমাণ, বাচ্চা উৎপাদনের সংখ্যা, বছরে কতবার বাচ্চা গর্ভে ধারণ করে ইত্যাদি যাচাই করে নেওয়া উচিৎ।
ভালো উৎপাদন পেতে হলে ভালো জাতের ছাগী প্রয়োজন। সাধারণত ছাগী ১ বছর বয়সে পাল দেওয়ার উপযুক্ত সময়।
৬ মাস বয়সে স্ত্রী প্রথম যৌবন প্রাপ্ত হয়। বর্তমানে এক বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করার অর্থ সময়ের অপচয়। যদি বাচ্চা বয়স হতে সঠিকভাবে পরিচর্যা ও সুষম খাদ্য পরিবেশন করা হয় তবে ৯ মাস হতে এক বছর বয়স হলেই পাল দেওয়া যায়।
বাংলাদেশের ‘কালো জাতের ছাগল’ ৮ মাস বয়সেই পাল দেবার মতো উপযুক্ত হয়।
পাল দেওয়ার পর খাদ্যের পরিমাণ দুটো বাচ্চার সমপরিমাণ উন্নত করতে হবে এবং বিশেষভাবে পরিচর্যা ব্যবস্থা করতে হবে।
শুধু দুধ উৎপাদনের জন্য বছরে একবার সাধারণত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে যখন ছাগী গরম হয় তখন পাল দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে গরম হলে বাদ দিতে হবে।
মাংস ও চামড়া উৎপাদনের জন্য ছাগল পালতে হলে বছরের যে-কোনো সময় যখন গরম হবে তখনই ছাগীকে পাল দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।
ছাগী গরম হবার ১২ ঘণ্টা পর এবং ১৮ ঘণ্টার মধ্যে পাল দেবার উপযুক্ত সময়। ছাগী একবার গরম হলে ৩ দিন স্থায়ী হয়। উপযুক্ত সময়ে পাল দেওয়া সম্ভব না হলে পরবর্তী ১৮ দিন হতে ২১ দিন পর পুনরায় গরম হলে পাল দেবার ব্যবস্থা নিতে হয়।
ছাগলের প্রজনন পদ্ধতিঃ
অন্যান্য গৃহপালিত পশু-পাখির মতো ছাগলের জন্যও বিভিন্ন প্রজনন পদ্ধতি প্রচলিত আছে।
১. ঘনিষ্ট আত্মীয়ের মধ্যে প্রজননঃ
রক্তের সম্পর্ক আছে এ ধরনের ঘনিষ্ট আত্মীয়দের মধ্যে মিলন। যেমন :
১. সন্তানের সাথে মা বা পিতার মিলন।
২. আপন ভাই-বোনের মধ্যে মিলন |
সুবিধা-
বংশের ভালো গুণাগুণ নিজেদের মধ্যে থেকে যায় এবং বাইরের কোনো গুণাগুণ প্রবেশ করতে পারে না।
অসুবিধা-
নিজেদের মধ্যে রক্তের কোনো দোষ থাকলে অর্থাৎ শুদ্ধ জাতের না হলে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে সেই দোষ থেকে যায় এবং প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। অনেক সময় কোনো সুপ্ত জিন থাকলে তার প্রভাব পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে প্রকট হয়ে ওঠে। একসাথে দুটো সুপ্ত জিন থাকলে মারাত্মক জিন সন্তানের মধ্যে প্রকাশিত হয়। ফলে সন্তানের মৃত্যু ঘটে। এ প্রথায় উৎপাদিত সন্তানের গুণাগুণ পর্যায়ক্রমে বাছাই করে প্রকটমান উন্নতমানের গুণাগুণসম্পন্ন আত্মীয়ের মাঝে মিলন ঘটাতে পারলে ফল ভালো পাওয়া যায়।
২. স্বগোত্র ও দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে প্রজননঃ
সৎ ভাই-বোন, খালাতো, ফুফাতো ও পিশতুতো ভাই বোনদের মিলন। এ নিয়মের সুবিধে অসুবিধে দুটোই কম। যে-কোনো জাতের বংশগত গুণাগুণ ও কর্মধারা পরীক্ষা ও ধরে রাখার জন্যে এ পদ্ধতিতে প্রজননের প্রয়োজন হয়।
৩. ভিন্নজাতের সাথে মিলনঃ
এ পদ্ধতিতে ভিন্ন জাতের স্ত্রী-পুরুষের মাঝে মিলন ঘটে। যেমন দেশি ছাগীর সাথে যমুনাপাড়ী পাঠার মিলন। এ পদ্ধতিতে মা ও পিতার গুণাগুণ সমান অংশে তার বংশধরদের মধ্যে সঞ্চালিত হয়।
ছাগলের কৃত্রিম প্রজননঃ
বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় এ পদ্ধতিতে অনুন্নত পশু-পাখিকে উন্নত জাতের পশু-পাখির সাথে মিলন ঘটিয়ে অনুন্নত জাতকে উন্নত করা হয়। এতে বংশবৃদ্ধিতেও বেশ ভূমিকা পালন করে। ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে, তবে এখনো খামারিদের নিকট সহজ লভ্য হয়নি, খামারিরা প্রাকৃতিক উপায়ে ছাগল প্রজননতে খরচ কম ও সহজ বলে মনে করেন।