কেন জাম্বু ঘাস চাষ করবেন?
কারণ এই ঘাস হাটু পানিতেও টিকে থাকে, বাংলাদেশের বন্যা কবলীত একালাকার খামারিদের জন্য এই ঘাস আশীর্বাদ স্বরূপ। জাম্বু ঘাস মিষ্টি তাই গবাদি পশু খেতে ভালোবাসে। জাম্বো ঘাস একটি স্থায়ী সবুজ ঘাস যা যে কোনো আবহাওয়াতে জন্মাতে পারে। তবে যেখানে অল্প বৃষ্টিপাত হয় সেখানে ভাল হয়।
জাম্বো ঘাস ঘাসের কি কি গুণাগুণ রয়েছে?
জাম্বো ঘাস গরুর খাদ্য হিসাবে অতি উত্তম। এ ঘাস ৯-১৮% আমিষ সমৃদ্ধ এবং এর পরিপাচ্যতা (digestibility) ৫৬-৬২%। প্রতি ৩০ দিন অন্তর ২-৩ ফুট হলে কাটা যায়। গরুকে ছোট করে কেটে খাওয়ানো উচিত। এই ঘাসকে সাইলেজ করেও সংরক্ষণ করা যায়। এই ঘাস গরুকে খাওয়ানো হলে গরুর দুধ বৃদ্ধি পায় এবং দুধের চর্বির পরিমাণ (fat %) বেশি হয়। ফলে কৃষকরা লাভবান হন।
জাম্বু ঘাসে প্রোটিন, নিউট্রাল ডিটারজেন্ট ফাইবার, এসিড ডিটারজেন্ট ফাইবার, এসিট ডিটারজেন্ট লিগনিন, হেমিসেলুলোজ, সেলুলোজ, অ্যাশ ইত্যাদি উপাদান বিদ্যামন।
জাম্বু ঘাসের মাঝে থাকা উপাদান সমূহের পরিমানঃ
ড্রাই ম্যাটার ——————- ১৫.৯%
ক্রড প্রোটিন —————— ১১%
নিউট্রাল ডিটারজেন্ট ফাইবার –৭৫.২%
এসিড ডিটারজেন্ট ফাইবার — ৩৯.৭%
এসিট ডিটারজেন্ট লিগনিন — ৪.৩%
হেমিসেলুলোজ ————— ৩৫.৫%
সেলুলোজ ——————– ৩৫.৪%
অ্যাশ ———————— ৮.৫৯%
শক্তি ————————- ৩.২৮%
জাম্বু ঘাস কিভাবে চিনবেন?
জাম্বু ঘাস দেখতে সবুজ রং এর। জাম্বু ঘাস সাধারণত থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এর পাতা ২.৫ থেকে ৪ সেন্টিমিটার চওড়া হয়। এই ঘাস খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এই ঘাসের বীজ ছোট, গোলাকার ও ধূসর রং এর হয়। জাম্বু ঘাসের বেশ কিছু প্রজাতি আছে। বিভিন্ন প্রজাতির গঠন ও বিভিন্ন। কিছু প্রজাতি দেখতে লতা সদৃশ। এক থেকে বহু বর্ষজীবী ঘাস, একবার লাগালে দুই থেকে আড়াই বছর পর্যন্ত উৎপন্ন হয়।
উন্নত জাতের জাম্বো ঘাস চাষ পদ্ধতিঃ
জাম্বো ঘাস চাষ কি ধরণের মাটি দরকার?
বেলে মাটি ব্যতীত সব ধরনের মাটিতেই জাম্বো ঘাস চাষ করা যায়। তবে এটেল ও দোআঁশ মাটিতে ফলন বেশি হয়। মাটির PH ৬-৮ এর মধ্যে হলে ভাল হয়। উত্তমভাবে চাষ করে জমি তৈরি করতে হবে। বন্যা পরবর্তী কাদা মাটিতে লাগানো যেতে পারে। ২-৩ বার মাটি চাষ করে ঘাস রোপণ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
জাম্বো ঘাস বপনের সঠিক সময় কখন?
সারা বৎসর এই ঘাস চাষ করা যায়। তবে নভেম্বর-ডিসেম্বরে চাষ করলে বন্যার পানি আসার পূর্ব পর্যন্ত প্রায় চার থেকে পাঁচ বার কাটা যায়। তাই উত্তম সময় হচ্ছে ফাল্গুন-চৈত্র মাস।
জাম্বো ঘাসের কাটিং ও সেচ কেমন হবে?
কাটিং এর সংখ্যাঃ ৭ কেজি প্রতি হেক্টর বা হেক্টর প্রতি ৩৫-৪০ হাজার কাটিং/মাথা।
কাটিং লাগানোর দূরত্বঃ লাইন থেকে লাইন ৭০ সে. মি. কাটিং থেকে কাটিং- ৩৫ সে.মি.।
সেচঃ খরা মৌসুমে ১৫-২০ দিন পর পর।
জাম্বো ঘাস বপন পদ্ধতি ও বীজের কি পরিমাণ বীজ লাগবে?
এই ঘাসের বীজ ১ ফুট পরপর লাইন করে ৬ ইঞ্চি পরপর ২টি বীজ প্রতি গর্তে বপন করা যায়। এছাড়া ছিটিয়েও বপন করা যায়। প্রতি বিঘা জমিতে লাইন করে বপন করলে ৩-৪ কেজি বীজ লাগে। এছাড়া ছিটিয়ে বোনা হলে ৫-৬ কেজি বীজের দরকার হয়।
জাম্বো ঘাস চাষে কি কি সার প্রয়োগ করতে হয়?
বিঘা প্রতি গোবর সার ১৫০০-২০০০ কেজি, ডিএপি সার ১৫-২০ কেজি ও ইউরিয়া সার ৫ কেজি প্রয়োগ করতে হয়। প্রতি মাসে ঘাস কাটার পর ৫ কেজি ইউরিয়া সার ছিটিয়ে সেচ দিলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
গোবর/জৈব সার ১৫-২০ টন/হেক্টর।
জমি তৈরির সময়ঃ-
ইউরিয়া ৫০ কেজি প্রতি হেক্টর।
টিএসপি ৭০ কেজি প্রতি হেক্টর।
এম পি সার ৩০ কেজি্র প্রতি হেক্টর।
ঘাস লাগানোর ১ মাস পরঃ- ইউরিয়া ৫০-৭৫ কেজি প্রতি হেক্টর।
প্রতি কাটিং কাটার পরপরঃ- ইউরিয়া ৫০-৭৫ কেজি প্রতি হেক্টর।
জাম্বো ঘাস কাটিং কখন সংগ্রহ করা যায়?
বপন করার ৪৫/৫০ দিন পর প্রথম বার কাটা যায় এবং পরে প্রতি মাসে ১ বার করে কাটা যায়। ১ বিঘা জমিতে উৎপাদন প্রায় ৮০০০-১০০০০ কেজি হয়ে থাকে যার মূল্য প্রায় ৫০০০-৬০০০ হাজার টাকা।
ঘাস কাটার সময়ঃ
৩০-৪৫ দিন পর পর গ্রীষ্মকাল।
৪০-৫০ দিন পরপর শীতকালে। (সেচ সুবিধা সাপেক্ষে)
বছরে কতবার কাটা যায়ঃ
প্রথম বছর ৫-৬ বার, দ্বিতীয় বছর ৭-৮ বার।
বছরে কাঁচা ঘাসের উৎপাদনঃ
১০০-১৫০ টন/হেক্টর।
সংরক্ষণঃ
সাইলেজ তৈরি।
জাম্বো ঘাস ঘাসের কি কি পরিচর্চা প্রয়োজন?
এই ঘাসের জন্য কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে না। প্রতিবার কাটার ৭ দিন পর সেচ দিতে হয় এবং ইউরিয়া সার দিলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
খেসারীর সাথে জাম্বো ঘাস চাষ করবেন কিভাবে?
বন্যার পানি যখন নেমে যায় তখন জমিতে পলিমাটি পড়ে। কৃষকরা সাধারণত সেখানে খেসারী ছিটিয়ে বপন করেন। সেই বিনা চাষে খেসারীর সাথে প্রতি বিঘা জমিতে দুই-আড়াই কেজি জাম্বো ঘাসের বীজ ছিটিয়ে বপন করলে খেসারী ও জাম্বো ঘাসের উৎপাদন ভাল হয়। পরীক্ষামূলকভাবে দেখা গেছে, জাম্বো ঘাসকে অবলম্বন করে লতিয়ে লতিয়ে খেসারী গাছ বড় হতে থাকে। খেসারী এবং জাম্বো ঘাস ৪৫/৫০ দিনে কাটা যায়। খেসারী লিগুউমিনাস জাতীয় হওয়ায় এদের শিকড়ে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন বিদ্যমান থাকে। ফলে, কম পরিমাণ ইউরিয়া সার ব্যবহার করে বেশি পরিমাণ জাম্বো ঘাস উৎপাদন করা সম্ভব। এজন্য কৃষকদের উচিত বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় সাথে সাথে খেসারী ও জাম্বো ঘাসের বীজ বপন করা। এতে গো-খাদ্যের অভাব দূর করা যায়। কারণ বন্যার সময় ঘাস নষ্ট হয়ে যায় এবং গবাদিপশু ঠিক মতো খাদ্য পায় না। এছাড়া পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন প্রতিকূলতার ফলে এদের স্বাস্থ্যও খারাপ হয়ে যায়। এ কারণে এদের দুধ উৎপাদনও হ্রাস পায়। তাই খেসারী ও জাম্বো ঘাস এক সাথে চাষ করলে কৃষকের গো-সম্পদ রক্ষা করা যাবে।
ভুট্টার সাথে জাম্বো ঘাস চাষ করবেন কিভাবে?
যে সমস্ত জমিতে আমন ধান কাটা হয় সে সমস্ত জমিতে কৃষকরা ভুট্টার সাথে জাম্বো ঘাসের চাষ করতে পারেন। জমি তৈরি করে ২-৩ চাষ দিয়ে প্রয়োজনীয় গোবর ও ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে হবে। জাম্বো ঘাসের বীজ বিঘা প্রতি ৫/৬ কেজি ও ভুট্টার বীজ ৩/৪ কেজি ছিটিয়ে রোপণ করলে ৪৫/৫০ দিনের মধ্যে প্রথম কাটা যায়। ভুট্টা ও জাম্বো ঘাসের উৎপাদন বিঘা প্রতি ২০০ কেজি করা সম্ভব। যেহেতু জাম্বো ঘাসের প্রথমে বীজ থেকে একটি কুঁড়ি বের হয় সেজন্য প্রথম কাটায় উৎপাদন কম হয়। কিন্তু জাম্বো ও ভুট্টা ঘাসের মিশ্র চাষে প্রথম কাটায় উৎপাদন বেশি করা যায়। দ্বিতীয় কাটাতে ভুট্টা না থাকায় জাম্বো ঘাসে প্রচুর পরিমাণে কুঁড়ি গজায়। এর ফলে জাম্বো ঘাসের উৎপাদন বেশি হয়ে থাকে।সুতরাং এই মিশ্র পদ্ধতিতে ঘাস চাষ করা হলে ঘাসের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
উপসংহারঃ
জাম্বু ঘাসে অনেক পুষ্টিগুন বিদ্যমান। জাম্বু ঘাস সব থেকে ভালো কাজ করে দুগ্ধবতী গাভীর দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে। হজমের সমস্যা হলে বা পরিপাক তন্ত্রের সমস্যা জাম্বু ঘাস অনেক উপকারি।