আজকের এই পোষ্টটিতে আলোচনা করব জীববিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব কী? জীববিজ্ঞানের ভৌত শাখাগুলোর নাম লেখ। জীববিজ্ঞানের ফলিত শাখাগুলোর নাম লেখ সম্পর্কে। আশা করি শেষ অবধি সাথেই থাকবেন। চলুন শুরু করা যাক।
জীববিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব
আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি যে যাদের জীবন আছে তারা জীব, আর যেসব জিনিসের জীবন নেই সেগুলো জড়।
মোটা দাগে বোঝার জন্য বিশ্বের সব পদার্থকে এরকম দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম বিচারে কোথায় জড়-অচেতনের শেষ আর কোথায় জীবনের শুরু, তা অনেক সময়ই বলা মুশকিল।
আসলে, জীবনের ভিত্তিমূলে কাজ করে পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নের সেই একই নিয়ম, যা কিনা জড় জগৎকেও নিয়ন্ত্রণ করে। তাই জীবজগৎকে বুঝতে হলে ভৌতবিজ্ঞান, তথা পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের জ্ঞান জরুরি।
কিন্তু এটা ভাবলে ভুল হবে যে ভৌতবিজ্ঞান জানলে আলাদা করে জীববিজ্ঞান পাঠ নিষ্প্রয়োজন। বরং জীবনকে ভাবা যেতে পারে অনেকগুলো জড়ের এমন এক জটিল সমাবেশ হিসেবে, যেখানে ঐ জটিলতার কারণে নতুন কিছু গুণের উদ্ভব ঘটেছে। ঠিক যেমন হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের নির্দিষ্ট আনুপাতিক সংযোগে পানি তৈরি হয়, যার বৈশিষ্ট্য হাইড্রোজেন বা অক্সিজেন কোনোটার মতোই হয় না।
তাই জড়ের সুনির্দিষ্ট সন্নিবেশে জীব গঠিত হলেও তার মধ্যে এমন সব নতুন ধরনের বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটে, যা তার জড় গাঠনিক উপাদানগুলোর মধ্যে ছিল না।
জীববিজ্ঞান বেশ প্রাচীন বিজ্ঞান। জীববিজ্ঞানকে ইংরেজিতে Biology বলে। এটি গঠিত হয়েছে গ্রিক bios (জীবন) এবং logos (জ্ঞান) শব্দ দুটির সংযোগের মাধ্যমে। যেহেতু চিকিৎসা ও কৃষিসংক্রান্ত ব্যাপারে জীববিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, সেহেতু সভ্যতার একেবারে আদিকাল থেকে গ্রিস, মিশর, মধ্যপ্রাচ্য, ভারতবর্ষ ও চীনসহ বিভিন্ন অঞ্চলের সভ্যতায় জীববিজ্ঞানের কিছু না কিছু চৰ্চা হয়েছে। যদিও সেসব চর্চাকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিচারে ঠিক বিজ্ঞান বলা যায় না, তবু জ্ঞানের এই শাখার বিকাশের জন্য তা অপরিহার্য ছিল।
জীববিজ্ঞানের শাখা
জীবের যে দুটি ধরন আমরা চারপাশে তাকালেই দেখতে পাই, সেগুলো হলো উদ্ভিদ এবং প্রাণী। তাই বহুদিন পর্যন্ত জীববিজ্ঞান পাঠের সুবিধার জন্য একে দুটি শাখায় ভাগ করে নেওয়ার প্রচলন ছিল: উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং প্রাণিবিজ্ঞান। এ রীতি এখনও কিছুটা চালু আছে। যদিও জীববিজ্ঞান আজ এতটাই বিস্তৃতি লাভ করেছে যে শুধু দুটি শাখায় ভাগ করে এখন এর পাঠ আর চলবে না।
এমন অনেক জীব আছে যা উদ্ভিদ বা প্রাণী কোনোটাই নয়। যেমন: ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ইত্যাদি। আবার কখনো কখনো প্রাণী, উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ভাইরাস প্রভৃতির কোনো সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে একসাথে বিশ্লেষণ করার দরকার হয়, তখন আর জীবের ধরনভিত্তিক শাখা লাগসই হয় না। তাই প্রয়োজনের তাগিদে জীববিজ্ঞান এখন বহুসংখ্যক শাখায় বিভক্ত হয়েছে। জ্ঞানের প্রায় প্রতিটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত শাখাগুলোকে ভৌত বা মৌলিক এবং ফলিত এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। জীববিজ্ঞানও তার ব্যতিক্রম নয়।
জীববিজ্ঞান ভৌত শাখা বলতে সেসব শাখা বোঝানো হয়, যেখানে তার তাত্ত্বিক ভিত্তি অনুসন্ধান করাটা প্রয়োগ- সংক্রান্ত দিকের তুলনায় বেশি গুরুত্ব পায়। আর যেখানে প্রয়োগটাই বড়, সেটা হচ্ছে ফলিত শাখা।
জীববিজ্ঞানের ফলিত শাখাগুলোর নাম
ভৌত জীববিজ্ঞান শাখায় তত্ত্বীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে। এতে সাধারণত নিচে উল্লিখিত বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়:
(a) অঙ্গসংস্থান (Morphology): জীবের সার্বিক অঙ্গসংস্থানিক বা দৈহিক গঠন বর্ণনা এ শাখার আলোচ্য বিষয়। দেহের বাহ্যিক বর্ণনার বিষয়কে বহিঃ অঙ্গসংস্থান ( External Morphology) এবং দেহের অভ্যন্তরীণ বর্ণনার বিষয়কে অন্তঃ অঙ্গসংস্থান ( Internal Morphology) বলা হয়।
(b) শ্রেণিবিন্যাসবিদ্যা বা ট্যাক্সোনমি (Taxonomy): জীবের শ্রেণিবিন্যাস এবং তার রীতিনীতিগুলো এ শাখার আলোচিত বিষয়।
(c) শারীরবিদ্যা (Physiology): জীবদেহের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জৈবরাসায়নিক কার্যাদি, যেমন: শ্বসন, রেচন, সালোকসংশ্লেষণ ইত্যাদি বিষয় এ শাখায় আলোচিত হয়। এছাড়া জীবের যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় কাজের বিবরণ এ শাখায় পাওয়া যায়।
(d) হিস্টোলজি (Histology): জীবদেহের টিস্যুসমূহের গঠন, বিন্যাস এবং কার্যাবলি এ শাখায় আলোচনা করা হয়।
(e) ভ্ৰূণবিদ্যা (Embryology): জনন কোষের উৎপত্তি, নিষিক্ত জাইগোট থেকে ভ্রূণের সৃষ্টি, গঠন, পরিস্ফুটন, বিকাশ প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা এ শাখার প্রধান বিষয়।
(f) কোষবিদ্যা (Cytology): জীবদেহের কোষের গঠন, কার্যাবলি ও বিভাজন সম্পর্কে যাবতীয় আলোচনা এ শাখার বিষয়।
(g) বংশগতিবিদ্যা বা জেনেটিক্স (Genetics): জিন ও জীবের বংশগতিধারা সম্পর্কে এ শাখায় আলোচনা করা হয়।
(h) বিবর্তনবিদ্যা (Evolution): পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ, জীবের বিবর্তন এবং ক্রমবিকাশের তথ্যসমূহের আলোচনা এ শাখার বিষয়।
(i) বাস্তুবিদ্যা (Ecology): এ শাখায় প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে জীবের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়।
(j) এন্ডোক্রাইনোলজি (Endocrinology): জীবদেহে হরমোনের (hormone) কার্যকারিতা বিষয়ক আলোচনা এ শাখার বিষয়।
(k) জীবভূগোল (Biogeography): এ শাখায় পৃথিবীর বিভিন্ন ভৌগোলিক সীমারেখায় জীবের বিস্তৃতি, জীবনপাঠ এবং অভিযোজন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। জীবের ভৌগোলিক বিস্তারের সাথে ভূমণ্ডলের শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কিত বিদ্যা।
ফলিত জীববিজ্ঞান এর শাখা
এ শাখায় রয়েছে জীবন-সংশ্লিষ্ট প্রায়োগিক বিষয়গুলো। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শাখার কথা নিচে উল্লেখ করা হলো:
(a) জীবাশ্মবিজ্ঞান (Palaeontology): প্রাগৈতিহাসিক জীবের বিবরণ এবং জীবাশ্ম সম্পর্কিত বিজ্ঞান।
(b) জীবপরিসংখ্যানবিদ্যা (Biostatistics): জীবপরিসংখ্যান বিষয়ক বিজ্ঞান।
(c) পরজীবীবিদ্যা (Parasitology): পরজীবিতা, পরজীবী জীবের জীবনপ্রণালি এবং রোগ সম্পর্কিত বিজ্ঞান।
(d) মৎস্যবিজ্ঞান (Fisheries): মাছ, মাছ উৎপাদন, মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ সম্পর্কিত বিজ্ঞান।
(e) কীটতত্ত্ব (Entomology): কীটপতঙ্গের জীবন, উপকারিতা, অপকারিতা, ক্ষয়ক্ষতি, দমন ইত্যাদি সম্পর্কিত বিজ্ঞান।
(f) অণুজীববিজ্ঞান (Microbiology): ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, আণুবীক্ষণিক ছত্রাক এবং অন্যান্য অণুজীব সম্পর্কিত বিজ্ঞান।
(g) কৃষিবিজ্ঞান (Agriculture): কৃষিবিষয়ক বিজ্ঞান।
(h) চিকিৎসাবিজ্ঞান (Medical Science): মানবদেহ, রোগ, চিকিৎসা ইত্যাদি সম্পর্কিত বিজ্ঞান।
(i) জিনপ্রযুক্তি (Genetic Engineering): জিনপ্রযুক্তি ও এর ব্যবহার সম্পর্কিত বিজ্ঞান।
(j) প্রাণরসায়ন (Biochemistry): জীবের প্রাণরাসায়নিক কার্যপ্রণালি, রোগ ইত্যাদি সম্পর্কিত বিজ্ঞান।
(k) পরিবেশবিজ্ঞান (Environmental Science): পরিবেশ সম্পর্কিত বিজ্ঞান।
(1) সামুদ্রিক জীববিজ্ঞান (Marine Biology): সামুদ্রিক জীব সম্পর্কিত বিজ্ঞান।
(m) বনবিজ্ঞান (Forestry): বন, বন সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং সংরক্ষণ সম্পর্কিত বিজ্ঞান।
(n) জীবপ্রযুক্তি (Biotechnology): মানব এবং পরিবেশের কল্যাণে জীব ব্যবহারের প্রযুক্তি সম্পর্কিত বিজ্ঞান।
(o) ফার্মেসি (Pharmacy): ঔষধশিল্প ও প্রযুক্তিবিষয়ক বিজ্ঞান।
(p) বন্য প্রাণিবিদ্যা (Wildlife): বন্যপ্রাণী বিষয়ক বিজ্ঞান।
(q) বায়োইনফরমেটিকস্ (Bioinformatics): কম্পিউটার প্রযুক্তিনির্ভর জীববিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য, যেমন ক্যান্সার বিশ্লেষণ বিষয়ক বিজ্ঞান।