বিষয়: জীবের শ্রেণিবিন্যাস ও জীবজগৎ, জীবের শ্রেণিবিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা কী? শ্রেণিবিন্যাসের ধাপগুলো উল্লেখ কর।
আজ পর্যন্ত বিভিন্ন উদ্ভিদের প্রায় চার লক্ষ এবং প্রাণীর প্রায় তের লক্ষ প্রজাতির নামকরণ ও বর্ণনা করা হয়েছে। তবে এ সংখ্যা চূড়ান্ত নয়, কেননা প্রায় প্রতিদিনই আরও নতুন নতুন প্রজাতির বর্ণনা সংযুক্ত হচ্ছে। অনুমান করা হয়, ভবিষ্যতে সব জীবের বর্ণনা শেষ হলে (যদি সত্যি কখনো শেষ করা যায়) এর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় এক কোটিতে।
জানা, বোঝা এবং শেখার সুবিধার জন্য এই অসংখ্য জীবকে সুষ্ঠুভাবে বিন্যাস করা বা সাজানোর প্রয়োজন। জীবজগৎকে একটি স্বাভাবিক নিয়মে শ্রেণিবিন্যাস করার প্রয়োজনীয়তা অবশ্য অনেক আগে থেকেই প্রকৃতিবিদগণ অনুভব করেছিলেন। সেই প্রয়োজনের তাগিদেই জীববিজ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাখা গড়ে উঠেছে, যার নাম ট্যাক্সোনমি বা শ্রেণিবিন্যাসবিদ্যা।
শ্রেণিবিন্যাসের লক্ষ্য মূলত একটাই। তা হচ্ছে এই বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় জীবজগৎকে সহজভাবে অল্প পরিশ্রমে এবং অল্প সময়ে সঠিকভাবে জানা।
জীবের শ্রেণিবিন্যাসে কার অবদান বেশি:
শ্রেণিবিন্যাসে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন সুইডিস প্রকৃতিবিদ ক্যারোলাস লিনিয়াস (1707-1778)। 1735 সালে আপসালা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভের পর তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানাটমির অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছিলেন। বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ, বিশেষ করে ফুল সংগ্রহ আর জীবের শ্রেণিবিন্যাসে তার অনেক আগ্রহ ছিল। তিনিই প্রথম জীবের পূর্ণ শ্রেণিবিন্যাসের এবং নামকরণের ভিত্তি প্রবর্তন করেন। অসংখ্য নমুনা জীবের বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে তিনি জীবজগৎকে দুটি ভাগে, যথা উদ্ভিদজগৎ এবং প্রাণিজগৎ হিসেবে বিন্যস্ত করেন।
জীবের শ্রেণিবিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা:
শ্রেণিবিন্যাসের উদ্দেশ্য হলো প্রতিটি জীবের দল ও উপদল সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করা। জীবজগতের ভিন্নতার দিকে আলোকপাত করে আহরিত জ্ঞানকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা, পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানকে সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করা এবং প্রতিটি জীবকে শনাক্ত করে তার নামকরণের ব্যবস্থা করা, সর্বোপরি জীবজগৎ এবং মানবকল্যাণে প্রয়োজনীয় জীবগুলোকে শনাক্ত করে তাদের সংরক্ষণে সচেতন হওয়া।
জীবজগৎ:
জীবজগৎ:-
(1) সুপার কিংডম 1 প্রোক্যারিওটা
a. রাজ্য 1 মনেরা
(2) সুপার কিডম 2 ইউক্যারিওটা
a. রাজ্য 2 প্রোটিস্টা
b. রাজ্য 3 ফানজাই
c. রাজ্য 4 প্লাস্টি
d. রাজ্য 5 অ্যানিমেলিয়া
ক্যারোলাস লিনিয়াসের সময়কাল থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত জীবজগৎকে উদ্ভিদজগৎ এবং প্রাণিজগৎ হিসেবে বিবেচনা করে দুটি রাজ্যে (Kingdom) শ্রেণিবিন্যাস করা হতো।
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় বর্তমানে কোষের DNA এবং RNA-এর প্রকারভেদ, জীবদেহে কোষের বৈশিষ্ট্য, কোষের সংখ্যা ও খাদ্যাভ্যাসের তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে আর. এইচ. হুইটেকার (R. H. Whittaker) 1969 সালে জীবজপথকে পাঁচটি রাজ্য বা ফাইভ কিংডমে (Flve Kingdom) ভাগ করার প্রস্তাব করেন। পরবর্তীকালে মারগুলিস (Margulis) 1974 সালে Whittaker-এর শ্রেণিবিন্যাসের পরিবর্তিত ও বিস্তারিত রূপ দেন। তিনি সমস্ত জীবজগৎকে দুটি সুপার কিংডমে ভাগ করেন এবং পাঁচটি রাজ্যকে এই দুটি সুপার কিংডমের আওতাভুক্ত করেন।
(1) সুপার কিংডম 1 প্রোক্যারিওটা (Prokaryotae):
এরা আদিকোষ (নিউক্লিয়াস সুগঠিত নয়) বিশিষ্ট এককোষী, আণুবীক্ষণিক জীব।
(a) রাজ্য 1: মনের (Monera) বৈশিষ্ট্য:
- এরা এককোষী, ফিলামেন্টাস (একটির পর একটি কোষ লম্বালম্বিভাবে যুক্ত হয়ে ফিলামেন্ট গঠন করে), কলোনিয়াল। কোষে ক্রোমাটিন বস্তু থাকে কিন্তু নিউক্লিওলাস ও নিউক্লিয়ার পর্দা নেই।
- এদের কোষে প্লাস্টিড, মাইটোকন্ড্রিয়া, এন্ডোপ্লাজমিক জালিকা ইত্যাদি নেই, কিন্তু রাইবোজোম আছে।
- কোন বিভাজন দ্বিবিভাজন প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। প্রধানত শোষণ পদ্ধতিতে খাদ্যগ্রহণ করে। তবে কেউ কেউ ফটোসিনথেসিস বা সালোকসংশ্লেষণ পদ্ধতিতে খাদ্য প্রস্তুত করে।
- উদাহরণ: নীলাভ সবুজ শৈবাল, ব্যাকটেরিয়া।
(2) সুপার কিংডম 2 ইউক্যারিওটা (Eukaryota):
এরা প্রকৃতকোষ (নিউক্লিয়াস সুগঠিত) বিশিষ্ট এককোষী বা বহুকোষী জীব। এরা এককভাবে অথবা কলোনি আকারে দলবদ্ধভাবে বসবাস করে।
(b) রাজ্য-2: প্রোটিস্টা (Protista) বৈশিষ্ট্য:
- এরা এককোষী বা বহুকোষী, একক বা কলোনিয়াল (দলবদ্ধ) বা ফিলামেন্টাস এবং সুগঠিত নিউক্লিয়াস বিশিষ্ট।
- কোষে ক্রোমাটিন বস্তু নিউক্লিয়ার পর্দা দ্বারা পরিবৃত্ত থাকে। ক্রোমাটিন বস্তুতে DNA, RNA এবং প্রোটিন থাকে। কোষে সকল ধরনের অঙ্গাণু থাকে।
- খাদ্যগ্রহণ শোষণ, গ্রহণ বা ফটোসিনথেটিক পদ্ধতিতে ঘটে। মাইটোসিস কোষ বিভাজনের মাধ্যমে অধৌন প্রজনন ঘটে এবং কনজুগেশনের মাধ্যমে অর্থাৎ জৈবনিকভাবে ভিন্ন কিন্তু গঠনগতভাবে এক, এরূপ দুটি গ্যামেটের মিলনের মাধ্যমে যৌন প্রজনন ঘটে। কোনো ভ্রুণ গঠিত হয় না।
- উদাহরণ: অ্যামিবা, প্যারামেসিয়াম, এককোষী ও বহুকোষী শৈবাল।
(c) রাজ্য 3: ফানজাই (Fungi) বৈশিষ্ট্য:
- অধিকাংশই স্থলজ, মৃতজীবী বা পরজীবী। দেহ এককোষী অথবা মাইসেলিয়াম (সরু সুতার মতো অংশ) দিয়ে গঠিত।
- এগুলোর নিউক্লিয়াস সুগঠিত।
- কোষপ্রাচীর কাইটিন বস্তু দিয়ে গঠিত। খাদ্যগ্রহণ শোষণ পদ্ধতিতে ঘটে। ক্লোরোপ্লাস্ট অনুপস্থিত।
- হ্যাপ্লয়েড স্পোর দিয়ে বংশবৃদ্ধি ঘটে।
- উদাহরণ: ইস্ট, Penicillium, মাশরুম ইত্যাদি।
(d) রাজ্য 4: গ্লানটি (Plantae) বৈশিষ্ট্য:
এরা প্রকৃত নিউক্লিয়াসযুক্ত সালোকসংশ্লেষণকারী উদ্ভিদ। এদের দেহে উন্নত টিস্যুতন্ত্র বিদ্যমান।
এদের ভ্রূণ সৃষ্টি হয় এবং তা থেকে ডিপ্লয়েড পর্যায় শুরু হয়। প্রধানত স্থলজ, তবে অসংখ্য জলজ প্রজাতি আছে।
এদের যৌন জনন অ্যানাইসোগ্যামাস (anisogamous ) অর্থাৎ আকার, আকৃতি অথবা শারীরবৃত্তীয় পার্থক্যবিশিষ্ট ভিন্নধর্মী দুটি প্যামেটের মিলনের মাধ্যমে যৌন জনন সম্পন্ন হয়।
এরা আর্কিখোনিয়েট অর্থাৎ আর্কিপোনিয়াম বা স্ত্রীজনন অঙ্গবিশিষ্ট উদ্ভিদ। এরা সপুষ্পক।
উদাহরণ: উন্নত সবুজ উদ্ভিদ।
প্লানটির বিভাগগুলো ছকের মাধ্যমে দেখানো হলো–
(1) প্লানটি
a. মসবর্গীয় উদ্ভিদ
b. ফার্নবর্গীয় উদ্ভিদ
c. নগ্নবীজী উদ্ভিদ
d. আবৃতবীজী উদ্ভিদ
(iv) 5: অ্যামেলিয়া (Animalia) বৈশিষ্ট্য:
- এরা নিউক্লিয়াসবিশিষ্ট ও বহুকোষী প্রাণী।
- এদের কোষে কোনো জড় কোষপ্রাচীর, প্লাস্টিড ও কোষগহ্বর নেই।
- প্লাস্টিড না থাকায় এরা হেটারোট্রোফিক অর্থাৎ পরভোজী এবং খাদ্য গলাধাকরণ করে, দেহে জটিল টিস্যুতন্ত্র বিদ্যমান। এরা প্রধানত যৌন জননের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে। পরিণত ডিপ্লয়েড পুরুষ এবং দ্বী প্রাণীর জনানা থেকে হ্যাপ্লয়েড গ্যামেট উৎপন্ন হয়। ভ্রুপ বিকাশকালীন সময়ে স্তূর্ণীয় স্তর সৃষ্টি হয়।
- উদাহরণ: প্রোটোজোয়া ব্যতীত সকল অমেরুদণ্ডী এবং মেরুদণ্ডী প্রাণী।
2004 সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টমাস কেন্দ্রলিয়ার স্মিথ (Thomas Cavalier-Smith) জীবজগতের প্রোটিস্টাকে প্রোটোজোয়া (Protozoa) এবং ক্রোমিস্টা (Chromista) নামে দুটি ভাগে ভাগ করেন এবং মনেরাকে ব্যাকটেরিয়া রাজ্য হিসেবে পুনঃ নামকরণ করেন। এভাবে তিনি জীবজগৎকে মোট ছয়টি রাজ্যে ভাগ করেছেন।
শ্রেণিবিন্যাসের ধাপগুলো উল্লেখ কর:
শ্রেণিবিন্যাসের প্রতিটি ধাপে তার আগের ধাপের বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ হয়। যত উপরের ধাপ, তার অন্তর্ভুক্ত বৈশিষ্ট্যের সংখ্যা তত কম এবং অন্তর্ভুক্ত জীবের সংখ্যা তত বেশি। আবার যত নিচের ধাপ, তার অন্তর্ভুক্ত বৈশিষ্ট্যের সংখ্যা তত বেশি এবং অন্তর্ভুক্ত জীবের সংখ্যা তত কম।
একটি জীবকে প্রজাতি পর্যায়ে বিন্যাসে মূলত আন্তর্জাতিক কোড চিহ্নিত সাতটি ধাপ আছে।
রাজ্য (Kingdom)
↓
পর্ব (Phylum)/বিভাগ (Division)
↓
শ্রেণী (Class)
↓
বৰ্গ (Order)
↓
গোত্র (Family)
↓
গণ (Genus)
↓
প্রজাতি (Specles)
উপরের ধাপ যেন বড় একটা সেট আর তার নিচের ধাপ হলো তার উপসেট। রাজ্যের উপসেট হলো পর্ব, পর্বের উপসেট হলো শ্রেণি, শ্রেণির উপসেট হলো বর্গ… ইত্যাদি। শ্রেণিবিন্যাসের এই পদ্ধতিকে বলে নেস্টেড হায়ারার্কি (nested hierarchy)।
অনেক সময় পুনরাবৃত্তি এড়ানোর জন্য আগের ধাপের যেসব বৈশিষ্ট্য পরের ধাপেও থাকে, সেগুলো ঊহ্য রাখা হয়। সেভাবে লিখলে মানুষের (Homo sapiens) শ্রেণিবিন্যাস হবে এরকম-
মানুষের (Homo sapiens) শ্রেণিবিন্যাস:
রাজ্য (Kingdom): Animalia;
কারণ, সুকেন্দ্রিক কোষবিশিষ্ট, বহুকোষী, পরভোজী এবং জটিল টিস্যুতন্ত্র আছে।
পর্ব (Phylum): Chordata;
কারণ, জীবনের কোনো এক পর্যায়ে নটোকর্ড থাকে।
( Class) : Mammalia;
কারণ, বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ায় এবং লোম/চুল আছে।
বর্গ (Order): Primate;
কারণ, আঁকড়ে ধরার উপযোগী হাত এবং ঘ্রাণ অপেক্ষা দৃষ্টিশক্তি বেশি উন্নত।
গোত্র (Family): Hominidae;
কারণ, শিম্পাঞ্জি, গরিলা, বানর প্রভৃতির সাথে সাদৃশ্য আছে।
গণ (Genus): Homo;
কারণ, দেহের অনুপাতে মস্তিষ্ক সবচেয়ে বড় এবং খাড়াভাবে দুই পায়ে হাঁটতে পারে।
প্রজাতি (Species):
Homo sapiens; কারণ, চওড়া এবং খাড়া কপাল, খুলির হাড় Homo গণের অন্য প্রজাতির তুলনায় পাতলা এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে উন্নত।
সমাপ্ত:
কোনো প্রজাতিকে শ্রেণিবিন্যাসের কোন ধাপে কেন অন্তর্ভুক্ত করা হলো, তার কারণগুলো জীববিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে জেনে নিতে হয়, কারণ কোনো একটা প্রজাতির শ্রেণিবিন্যাস লেখার সবচেয়ে প্রচলিত রীতি এটাই, যেখানে আলাদা করে কারণগুলো লেখা হয় না।
আজকের খামারিয়ান ব্লগ পোষ্টটি এখানেই শেষ করছি, আশা পোষ্ট আপনার উপকারে আসেছে, সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।