Skip to content

 

ডেইরি খামার ব্যবস্থাপনা: গাভীর দুধ দোহন, দুধ উৎপাদন ও সংরক্ষণ পদ্ধতি

ডেইরি খামার ব্যবস্থাপনা: গাভীর দুধ দোহন, দুধ উৎপাদন ও সংরক্ষণ পদ্ধতি

এই পোষ্ট শেষ অবধি পড়লে আপনি বিশুদ্ধ দুধ উৎপাদনের শর্তসমূহ জানবেন। ভেজাল দুধ চিহ্নিত করতে পারবেন। কি উপাদান দ্বারা দুধ ভেজাল করা হয়েছে তা বলতে পারবেন। দুধ সংরক্ষনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবগত হবে। দুধ শীতলীকরনের প্রক্রিয়াসমূহ জানবেন। দুধ সংরক্ষনের গ্রামীন পদ্ধতিগুলো।

দুধ উৎপাদন ও সংরক্ষণ :

স্বাস্থ্যবতী গাভীর বাচ্চা প্রসবের ১৫ দিন পূর্বে এবং বাচ্চা প্রসবের ৫ দিন পরে গাভীর ওলান হতে নিঃসৃত কলস্ট্রাম মুক্ত যে তরল পদার্থ পাওয়া যায় তাকে দুধ বলে।

দুধ একটি আদর্শ খাদ্য। এটি শিশু, নারী, বৃদ্ধ এবং সকল বয়সের নারী পুরুষের জন্য প্রযোজ্য। দুধের পুষ্টিগতমান অনেক বেশি। দুধ দেহের মাংসপেশি, হাড় তৈরি করতে এবং শক্তি যোগাতে সাহায্য করে। দুধ শিশুদের মস্তিস্ক বিকাশে সাহায্য করে।

দুধে এমন কতগুলো খাদ্যপ্রাণ আছে যা অন্য কোনো খাদ্যে পাওয়া যায়না।। দুধে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এ, ডি, এবং রাইকেফ্ল্যাভিন আছে যা শিশুদের হাড় ও দাঁত মজবুত করে এবং দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি। করে। দুধ মদ মিষ্ট ও অতি সামন্য লবনাক্ত। প্রকতির শ্রেষ্ঠ খাদ্য হিসাবে দুধের গুরত্ব অপরিসীম।

শিশুর বুদ্ধি, যুবকের শক্তি বৃদ্ধের জীবন ধারন এবং অসুস্থ ব্যক্তির পথ্যের ক্ষেত্রে দুধের ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্য। সুতরাং দুগ্ধ উৎপাদনকারী, প্রক্রিয়াজাতকারী, বিতরনকারী এবং খুচরা বিক্রেতাগণের প্রধান উদ্দেশ্য হবে দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে উচ্চমান সম্পন্ন অবস্থায় ভোক্তাদের নিকট পৌছে দেয়া।

বিশুদ্ধ দুধ উৎপাদনের শর্তসমূহ পানি :

গরুর জন্য ব্যবহৃত পানি অবশ্যই বিশুদ্ধ ও পরিষ্কার হতে হবে। বিশুদ্ধ ও জীবাণুমুক্ত পানি গরুর পানের জন্য ব্যবহার করতে হবে। গরুর গোসলের পানি ও খামার পরিষ্কারের পানি অবশ্যই জীবাণুমুক্ত হতে হবে।

বিষমুক্ত সুষম খাবার :

গরুর স্বাস্থ্য রক্ষা ও দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন সুষম খাদ্য যাতে সকল প্রকার পুষ্টি বিদ্যমান থাকবে। যা সহজে পচ্য, দাম তুলনা মূলক কম ও গরুর পছন্দনীয় হবে।

স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান :

আরামদায়ক পরিবেশ প্রদান। বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা থেকে রক্ষা করবে। পরিচর্যা ও স্বাস্থ্য সম্মত খাদ্য গ্রহনের জন্য বাসস্থান অপরিহার্য।

পাত্রের পরিচ্ছন্নতা :

খাদ্যের পাত্র প্রতিদিন পরিষ্কার রাখতে হবে। দুধ দোহনের পাত্র পরিষ্কার ও শুকনো হতে হবে। প্রয়োজনে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে।

See also  গরু মহিষের বাসস্থান নির্মাণঃ- বিশেষ সতর্কতা, গোয়াল ঘর অন্যান্য বিবেচ্য বিষয়াদি, পশুর অবস্থা ভেদে (4 প্রকার) গোয়াল ঘর তৈরির নিয় : বাছুরের গোয়াল ঘর, আসন্ন প্রসবা গাভীর গোয়াল ঘর, ষাঁড়ের ঘর, গরুর খামার ঘর তৈরির নিয়ম।

দুগ্ধ দোহনকারীর পরিচ্ছন্নতা :

যিনি দুধ দোহন করবেন তার শরীর ও হাত পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। দোহনকারীর হাতের নখ অবশ্যই ছোট রাখতে হবে।

বাসস্থানের চালার পরিচ্ছন্নতা :

যে ঘরে গাভীর দুধ দোহন করা হবে সেটি অবশ্যই পরিষ্কার, শুকনো, ধুলাবালি বিহীন এবং ঠান্ডা বা ছায়াযুক্ত হতে হবে।

স্তন প্রদাহ পরিক্ষা পদ্ধতি :

গাভীর দুধের বাট ও ওলান নিয়মিত বিরতিতে পরীক্ষা করতে হবে। স্তন প্রদাহ আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে। যদি থাকে তাহলে চিকিৎসকের দেয়া নির্দেশনা মোতাবেক দুধ সংগ্রহ ও গরুর পরিচর্যা করতে হবে। ৬.২ কাঁচা দুধ পরীক্ষা পরীক্ষার জন্য দুধ স্যাম্পলিং (নমুনা সংগ্রহ) সঠিক স্যাম্পলিং এর পূর্বশর্ত হলো ছোট দুধের পাত্র বা বড় ট্যাঙ্কারের মধ্যে তরল দুধ সঠিকভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। তবে এ কাজটি স্যাম্পলিং করার আগে করতে হবে যেন দুধের গুণগত মান সঠিকভাবে পরীক্ষা করা যায়। ইন্দ্রিয় ভিত্তিক পরীক্ষা (organoleptic test)। ইন্দ্রিয় ভিত্তিক পরীক্ষা সহজে ও দ্রুত খাটি দুধ ও ভেজাল দুধ পৃথক করতে সাহায্য করে। ইন্দ্রিয় ভিত্তিক পরীক্ষার জন্য কোন যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না। শুধু যে ব্যক্তি ইন্দ্রিয় ভিত্তিক পরীক্ষা করবে তার দুধের দর্শন, গন্ধ ও স্বাদ সমন্ধে ভাল ধারনা থাকতে হবে।

১) প্রথমে দুধের বোতল বা জারের মুখ খুলতে হবে।

২) দ্রুততার সাথে দুধের গন্ধ বা স্বাদ নিতে হবে।

৩) দুধের বাহ্যিক গঠন অনুসন্ধান করতে হবে।

৪) যদি এর পরে ও কোন সন্দেহ থাকে তবে তা পান না করে দুধের নমুনা মুখে নিয়ে স্বাদ গ্রহন করতে হবে, কিন্তু গিলে ফেলা যাবে না।

দুধের রাসায়নিক পরীক্ষা : সি এল আর (CLR) পরীক্ষা/আপেক্ষিক গুরুত্বের পরীক্ষা পদ্ধতি

১. নমুনা দুধের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এ সমন্বয় করতে হবে।

২. প্রথমে একটি পরিষ্কার শুষ্ক কাচের জারে ২/৩ অংশ দুধ দ্বারা পূর্ণ করতে হবে।

৩. এরপর অবাধে জারের পাশ স্পর্শ ছাড়া ল্যাকটোমিটার এমনভাবে ভাসাতে হবে যেন তা দুধ স্পর্শ করে ভেসে থাকে।

৪. এরপর জার সম্পূর্ন রুপে দুধ দ্বারা পূর্ন করতে হবে।

৫. এক মিনিটের মধ্যে ল্যাকটোমিটারে পাঠ নিতে হবে।

৬. দুধের তাপমাত্রা রেকর্ড করতে হবে।

গণনা দুধের আপেক্ষিক গুরুত্ব নিম্নলিখিত সূত্র দ্বারা নির্ণয় করা যায় :

  • আপেক্ষিক গুরুত্ব=  + ১
  • ১০০০ সংশোধিত ল্যাকটোমিটার যন্ত্রের পাঠ = এল, আর + সি.এফ (এল. আর : ল্যাকটোমিটার রিডিং + সি.এফ : কারেকশন ফ্যাক্টর) সি, এফ (+)= ০.২ x দুধের তাপমাত্রা ২০° সেলসিয়াস থেকে যতটুকু বেশি সি, এফ (-) = ০.২ x দুধের মাপমাত্রা ২০° সেলসিয়াস থেকে যতটুকু কম।
  • দুধ সংরক্ষণ সুস্থ সবল গাভীর ওলানের দুধে সামান্য কিছু ব্যাকটেরিয়া থাকে। দুধ সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ করার মধ্যবর্তী সময়ে দুধে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই সব ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা নির্ভর করে দুধ দোহন পদ্ধতি ও দুধ পরিবহনের মানের উপরে। ব্যাকটেরি দ্ধির হার ও দুধের পচনের উপর দুধের তাপমাত্রার গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সাধারনত বলা যায় যে, যদি দুধ ঠান্ডা/শীতল না করা হয় ও দুধ দোহনের পরবর্তী ৫ ঘন্টার মধ্যেও সংরক্ষণ করা হয়, তবে সেই দুধ আর প্রক্রিয়াজাত করার উপযোগী থাকে না।
  • বাংলাদেশের এমন অনেক এলাকা রয়েছে যেখানে বিশুদ্ধ/টাটকা দুধ শীতলীকরন কষ্টদায়ক। দুধ দোহনের পর প্রক্রিয়াজাতকরন শিল্পে পৌছানোর মধ্যবর্তী সময়টা খুবই সংকটাপূর্ণ কারন এই সময়ের মধ্যে দুধের পচন শুরু হয় ও গুনগতমান অধিকতর মন্দ হতে থাকে।
  • বাংলাদেশে বেশিরভাগ দুধই উৎপাদন হয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী/কৃষক দ্বারা এবং এই অল্প পরিমানের দুধ সংগ্রহ ও বিলি করা সময়মাপেক্ষ ব্যাপার এবং কঠিন। এখানে কৃষক দুধ একটি নির্দিষ্ট সংগ্রহ কেন্দ্রে জমা দেয় যেখানে দুধ পরিমাপও রেকর্ড গ্রহন করা হয় এবং মাঝে মধ্যে দুধ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে এর গুনগতমান যাচাই করা হয়।
  • এই সমস্ত দুধ পরবর্তীতে শীতলীকরন হয়। পরে এই সংগ্রহীকৃত শীতলীকৃত দুধ ট্রাকের মাধ্যমে দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে পাঠানো হয়। এই ভাবে দুধ সংগ্রহ থেকে। প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে পৌছাতে সময় লাগে পাঁচ ঘন্টারও বেশি, ফলে দুধের গুনগতমানের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং প্রায়ই প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প এই সমস্ত দুধ প্রত্যাখান করে এবং এই সমস্ত দুধ ভোক্তাদের কাছেও গ্রহনযোগ্য হয়।
  • ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি কমানোর জন্য শীতলীকরন সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি। শীতলীকরন পদ্ধতিতে দুধের গুনগত মান বজায় থাকে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই পদ্ধতিটি খুবই ব্যয়বহুল ও সংবেদনশীল। আবার কোন কোন দেশে এটি অসম্ভব পদ্ধতি। যেখানে শীতলীকরন পদ্ধতি সম্ভবপর নয় সেখানে কিছু বিকল্প পদ্ধতির ব্যবহার করা খুবই জরুরি।
See also  বাংলাদেশে গরুর জাত কত প্রকার? গরুর জাতের নাম ও গরুর জাত পরিচিতি। বাংলাদেশে বিদ্যমান গরুর জাত সমূহ কি কি?

দুধ সংরক্ষণ পদ্ধতিসমূহ :

দুধ সংরক্ষণ পদ্ধতিগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

1. মাটির কলসিতে করে দুধ রাখালে দুধের তাপমাত্রা প্রকৃতির তাপমাত্রার তুলনায় তুলনামূলক ভাবে অনেক কম থাকে ফলে গুনগত মান ও অক্ষুন্ন থাকে। মাটির কলসিতে করে দুধ রাখালে কয়েক ঘন্টা সংরক্ষণ করা যায়।

২. টিউবয়েলের নিকট মাটি চাপা দিয়ে কোন মুখবন্ধ পাত্রে দুধ নিয়ে সেটি যদি টিউবয়েলের নিকট ভেজা মাটি দিয়ে চাপা দেয়া হয় তবে দুধের তাপমাত্রা অনেক কম থাকে ও দুধ প্রায় কয়েক ঘন্টা ভাল থাকে।

৩. কলাপাতা ও খেজুরের পাতার ব্যবহার: দুধ দোহনের পর কলাপাতা ও খেজুরের পাতা দিয়ে রাখালে পাতার সাদা সাদা চুনের মত পদার্থ দুধের অম্লত্ব কমায়। কারন এগুলো ক্ষারীয় পদার্থ ফলে দুধের সংরক্ষনকাল স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়। ল্যাকটো পারঅক্সিডেজ পদ্ধতি: ল্যাকটো পারঅক্সিডেজ দুধের একটি এনজাইম যেটি স্বাভাবিক ভাবেই দুধের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। ল্যাকটো পারঅক্সিডেজ সক্রিয়করন পদ্ধতিটি থায়ো সায়ানেট (১৫ পিপি এম) ও হাইড্রোজেন পারঅক্সিডেজ (৮.৫ পিপিএম) দুধের মধ্যে যুক্ত করার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় দুধের স্থায়ীত্বকাল বেড়ে সাত থেকে আট ঘন্টা হয়।

শেষকথা :

দুধ প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি অন্যতম শ্রেষ্ঠ খাবার। দুধে ৩-৫ ননী বা চর্বি এবং ৮.৫% ননীমুক্ত অন্যান্য উপাদান থাকে। বিশুদ্ধ দুধ উৎপাদনের জন্য দুগ্ধবতী গাভীকে পর্যাপ্ত পরিমান পানি, সুষম খাদ্য এবং পরিচ্ছন্নতার প্রতি সজাগ থাকতে হবে। কাঁচা দুধ ইন্দ্রিয়ভিত্তিক এবং রাসায়নিক ভাবে পরীক্ষা করা যায়। ইন্দ্রিয় ভিত্তিক পরীক্ষার মাধ্যমে দুধের দর্শন, গন্ধ ও স্বাদ সম্বন্ধে দ্রুত ধারনা পাওয়া যায়। রাসায়নিক পরীক্ষার মাধ্যমে দুধের বিশুদ্ধতা এবং ভেজাল নির্নয় করা যায়। দুধ সংগ্রহের পরবর্তী ৫ ঘন্টার মধ্যে সংরক্ষন না করা হলে দুধ নষ্ট হয়ে যায়। শীতলীকরন পদ্ধতিতে দুধের গুনগত মান বজায় থাকে। মাটির কলসি টিউবয়েলের নিকট মাটি চাপা দিয়ে কিংবা কলা পাতা ও খেজুর পাতা ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রামে কুব সহজেই দুধ শীতল রাখা যায়। ল্যকটো পার অক্সিডেজ এনজাইম ব্যবহারের মাধ্যমেও দুধ সংরক্ষন করা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Copyright Notice

কপি করা নিষিদ্ধ!