Skip to content

 

তওবা করার নিয়মঃ তওবা ইস্তেগফার কেন ও কিভাবে? তওবা সম্পর্কে আয়াত ও হাদীস।

তওবা করার নিয়মঃ তওবা ইস্তেগফার কেন ও কিভাবে তওবা সম্পর্কে আয়াত ও হাদীস।

মূল লেখক- আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান

তওবা কেন ও কিভাবেঃ

আলেমগণ বলেন, সকল প্রকার পাপ, অপরাধ থেকে তাওবা করা ওয়াজিব তথা অবশ্য করণীয়।

তওবা শব্দের আভিধানিক অর্থ – ফিরে আসা।

পরিভাষায় তওবা হল : যে সকল কথা ও কাজ মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয় তা থেকে ফিরে এসে ঐ সকল কথা ও কাজে লেগে যাওয়া, যা দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় ও তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে থাকা যায়।

এক কথায় পাপ-কর্ম থেকে ফিরে এসে সৎকাজে প্রবৃত্ত হওয়া।

পাপ বা অপরাধ দু ধরনের হয়ে থাকেঃ

এক. যে সকল পাপ শুধুমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হক বা অধিকার  সম্পর্কিত। যেমন শিরক করা, নামাজ আদায় না করা, মদ্যপান করা, সুদের লেনদেন করা ইত্যাদি।

দুই. যে সকল পাপ বা অপরাধ মানুষের অধিকার সম্পর্কিত। যে পাপ করলে কোন না কোন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন, জুলুম-অত্যাচার, চুরি-ডাকাতি, ঘুষ খাওয়া, অন্যায়ভাবে সম্পদ আত্নসাৎ ইত্যাদি।

প্রথম প্রকার পাপ থেকে আল্লাহর কাছে তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করার সাথে তিনটি শর্তের উপসি’তি জরুরী।

প্রথম প্রকার পাপ থেকে তওবা করার নিয়ম বা শর্ত তিনটি হলঃ

(১) পাপ কাজটি পরিহার করা।

(২) কৃত পাপটিতে লিপ্ত হওয়ার কারণে আন-রিকভাবে অনুতপ্ত হওয়া।

(৩) ভবিষ্যতে আর এ পাপ করব না বলে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা।

দ্বিতীয় প্রকার পাপ থেকে তাওবা করার শর্ত হল মোট চারটিঃ

(১) পাপ কাজটি পরিহার করা।

(২) কৃত পাপটিতে লিপ্ত হওয়ার কারণে আন-রিকভাবে অনুতপ্ত হওয়া।

(৩) ভবিষ্যতে আর এ পাপ করব না বলে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা।

(৪) পাপের কারণে যে মানুষটির অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়েছে বা যে লোকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার পাওনা পরিশোধ করা বা যথাযথ ক্ষতিপুরণ দিয়ে তার সাথে মিটমাট করে নেয়া অথবা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে দাবী ছাড়িয়ে নেয়া।

মানুষের কর্তব্য হল, সে সকল প্রকার পাপ থেকে তাওবা করবে, যা সে করেছে। যদি সে এক ধরনের পাপ থেকে তাওবা করে, অন্য ধরনের পাপ থেকে তাওবা না করে তাহলেও সে পাপটি থেকে তাওবা হয়ে যাবে। তবে অন্যান্য পাপ থেকে তওবা তার দায়িত্বে থেকে যাবে। একটি বা দুটো পাপ থেকে তাওবা করলে সকল পাপ থেকে তাওবা বলে গণ্য হয় না। যেমন এক ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলে, ব্যভিচার করে, মদ্যপান করে। সে যদি মিথ্যা কথা ও ব্যভিচার থেকে যথাযথভাবে তওবা করে তাহলে এ দুটো পাপ থেকে তওবা হয়ে যাবে ঠিকই। কিন্তু মদ্যপানের পাপ থেকে তওবা হবে না। এর জন্য আলাদা তওবা করতে হবে। আর যদি তাওবার শর্তাবলী পালন করে সকল পাপ থেকে এক সাথে তাওবা করে তাহলেও তা আদায় হয়ে যাবে।

তওবা করে আবার পাপে লিপ্ত হয়ে পড়লে আবারও তাওবা করতে হবে। তওবা রক্ষা করা যায় না বা বারবার তওবা ভেঙ্গে যায় এ অজুহাতে তওবা না করা শয়তানের একটি ধোকা বৈ নয়। অন্তর দিয়ে তওবা করে তার উপর অটল থাকতে আল্লাহ তাআলার কাছে তাওফীক কামনা করা যেতে পারে। এটা তাওবার উপর অটল থাকতে সহায়তা করে।

কুরআন, হাদীস ও উম্মাতের ঐক্যমতে প্রমাণিত হয়েছে যে, পাপ থেকে তাওবা করা ওয়াজিব।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

হে ঈমানদারগন! তোমরা সকলে তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।

(সূরা আন-নূর : ৩১)

তিনি আরো বলেন:

আর তোমরা নিজেদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তাওবা কর।

(সূরা হুদ : ৩)

তিনি আরো বলেন:

হে ঈমানদারগন! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা কর, বিশুদ্ধ তাওবা।

(সূরা আত-তাহরীম : ৮)

এ আয়াতসমূহ থেকে আমরা যা শিখতে পারি:

১- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল ঈমানদারকে তাওবা করার নির্দেশ দিয়েছেন।

২- তাওবা দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য লাভের মাধ্যম।

৩- তাওবার আগে ইসে-গফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। তারপর তাওবা। ভবিষ্যতে এমন পাপ করব না বলে তাওবা করলাম কিন’ অতীতে যা করেছি এ সম্পর্কে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম না। মনে মনে ভাবলাম যা করেছি তা করার দরকার ছিল, ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন কি? তাহলে তাওবা কবুল হবে না। যেমন দ্বিতীয় আয়াতটিতে আমরা দেখি, আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আর তোমরা নিজেদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, তারপর তাওবা কর।

৪- তওবা ও ইসে-গফার হল পার্থিব জীবনে সুখ শানি- লাভের একটি মাধ্যম।

যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :

আর তোমরা নিজেদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর তৎপর তাওবা কর, তিনি তোমাদের নির্দিষ্ট কাল পর্যন- সুখ-সম্ভোগ দান করবেন। (সূরা হুদ : ৩)

নূহ আলাইহিস সালাম তার সমপ্রদায়কে  বলেছিলেন :

আমি বললাম, তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, তিনি তো ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত বর্ষণ করবেন। তিনি তোমাদের সমৃদ্ধি দান করবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতিতে এবং তোমাদের জন্য সৃষ্টি করবেন উদ্যান ও প্রবাহিত করবেন নদী-নালা। (সূরা নূহ : ১০-১২)

৫- আল্লাহ তাআলা বিশুদ্ধ তাওবা করতে আদেশ করেছেন। বিশুদ্ধ তাওবা হল যে তাওবা করা হয় সকল শর্তাবলী পালন করে। শর্তসমূহ ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে।

তওবা সম্পর্কে হাদীস সমূহঃ

আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে বলতে শুনেছি : আমি দিনের মধ্যে সত্তর বারেরও বেশী আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা (ইস্তেগফার) করি ও তাওবা করি। বর্ণনায় : বুখারী

হাদীসটি থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল :

১- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  ছিলেন মাসূম অর্থাৎ সকল পাপ থেকে মুক্ত। তারপরও তিনি কেন ইস্তেগফার ও তওবা করেছেন? উত্তর হলঃ

(ক) তিনি উম্মতকে ইস্তেগফার ও তাওবার গুরুত্ব অনুধাবন করানোর জন্য নিজে তা আমল করেছেন।

(খ) পাপ না থাকলেও তাওবা ইস্তেগফার করা যায়। এটা বুঝাতে তিনি এ আমল করেছেন। আর তখন তওবা ও ইসে-গফারের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার কাছে মর্যাদা বৃদ্ধি হয়।

(গ) ইস্তেগফার ও তওবা হল ইবাদত। পাপ না করলে তা করা যাবে না এমন কোন নিয়ম নেই। কেহ যদি তার নজরে কোন পাপ নাও দেখে তবুও সে যেন ইসে-গফার ও তওবা করতে থাকে। হতে পারে অজান্তে কোন পাপ তার দ্বারা সংঘটিত হয়ে গেছে বা কোন পাপ করে সে ভুলে গেছে।

২- সত্তর সংখ্যাটি আধিক্য বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। নির্দিষ্ট সংখ্যা বুঝাতে নয়।

৩- ইস্তেগফার ও তওবা আমলটি সর্বদা অব্যাহত রাখা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত।

আগার ইবনে ইয়াসার আল-মুযানী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন : হে মানব সকল তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা কর। আর আমি দিনে একশত বারের বেশী তাওবা করে থাকি।

বর্ণনায় : মুসলিম

শিক্ষা ও মাসায়েল :

১- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  ছিলেন মাসূম অর্থ্যাৎ সকল পাপ থেকে মুক্ত। তারপরও তিনি সর্বদা ইসে-গফার ও তাওবা করেছেন। কারণ, তিনি উম্মাতকে ইসে-গফার ও তাওবার গুরুত্ব অনুধাবন করাতে চেয়েছেন। পাপ না থাকলেও তাওবা ইসে-গফার করা যায়, এবং এর মাধম্যে আল্লাহ তাআলার কাছে মর্যাদা বৃদ্ধি হয়, এটা উম্মাতকে শিখিয়েছেন।

২- ইস্তেগফার ও তওবা হল ইবাদত। পাপ না করলে তা করা যাবে না এমন কোন নিয়ম নেই। কেহ যদি তার নজরে কোন পাপ নাও দেখে তবুও সে যেন ইসে-গফার ও তাওবা পরিহার না করে। হতে পারে তার দ্বারা অজানে- কোন পাপ সংঘটিত হয়ে গেছে বা কোন পাপ করে সে ভুলে গেছে।

৩- হাদীসে একশ সংখ্যাটি আধিক্য বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। নির্দিষ্ট সংখ্যা বুঝাতে ব্যবহার করা হয়নি। তাইতো দেখা যায় কোন হাদীসে সত্তর বারের কথা এসেছে, আবার কোন হাদীসে একশ বারের কথা এসেছে।

৪- ইসে-গফার ও তাওবা আমলটি সর্বদা অব্যাহত রাখা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত।

হাদীস-১৫. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খাদেম আবু হামযা আনাস ইবেন মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: তোমাদের তাওবায় আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির চেয়েও বেশী আনন্দিত হন যে ব্যক্তি তার উট জনমানবহীন প্রান-রে হারিয়ে যাওয়ার পর আবার তা ফিরে পেয়েছে।

বর্ণনায়ঃ বুখারী ও মুসলিম

তবে সহীহ মুসলিমের অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, আল্লাহ তার বান্দার তাওবায় ঐ ব্যক্তির চেয়েও অধিক আনন্দিত হন, যার উট খাদ্য ও পানীয়সহ জনমানবহীন মরুভূমিতে হারিয়ে গেছে। এ কারণে সে জীবন থেকে নিরাশ হয়ে কোন এক গাছের নীচে শুয়ে পড়ল। এমন নৈরাশ্য জনক অবস্থায় হঠাৎ তার কাছে উটটিকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেয়ে এর লাগাম ধরে আনন্দে আত্নহারা হয়ে বলে ফেলল, হে আল্লাহ! তুমি আবার বান্দা, আমি তোমার প্রভূ। অর্থ্যাত সে এ ভুলটি করেছে আনন্দের আধিক্যে।

শিক্ষা ও মাসায়েল :

১- আল্লাহ তাআলা কত বড় মেহেরবান যে, তিনি বান্দার তাওবা কবুল করে থাকেন ও তাওবাকারীকে ভালোবাসেন। যেমন তিনি নিজেই বলেছেন :

নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন পবিত্রতা অর্জনকারীদের। সূরা আল-বাকারা, আয়াত- ২২২

২- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মাতকে তাওবা করতে উৎসাহ দিয়েছেন।

৩- অনিচ্ছাকৃত পাপ বা ভুলের শাস্তি আল্লাহ দেবেন না। যেমন উল্লেখিত ব্যক্তি অনিচ্ছায় আল্লাহকে বান্দা বলে ফেলেছে।

৪- ওয়াজ-নসীহতে ও শিক্ষা দানে বিভিন্ন উদাহরণ, উপমা  দেয়া দোষের কিছু নয়। বরং উত্তম। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীসে এক ব্যক্তির উপমা দিয়েছেন।

হাদীস-১৬. আবু মূসা আব্দুল্লাহ বিন কায়েস আশআরী রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেন : আল্লাহ তাআলা রাত্রি বেলা তার ক্ষমার হাত প্রসারিত করেন, যেন দিনের বেলা যারা পাপ করেছে তারা তাওবা করে নেয়। দিনের বেলাও তিনি ক্ষমার হাত প্রসারিত করেন যাতে রাতের পাপীরা তাওবা করে নেয়। এমনিভাবে (তার তাওবার দরজা) উম্মুক্ত থাকবে যতক্ষণ না সূর্য পশ্চিম দিক দিয়ে উদিত হয়। বর্ণনায় : মুসলিম

শিক্ষা ও মাসায়েল :

১- আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের রহমত সকল সময় ব্যাপী। কোন সময়ের সাথে খাছ নয়। যদিও কোন কোন সময়ের আলাদা ফজিলত রয়েছে।

২- দেরি না করে তাড়াতাড়ি তাওবা করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে।

৩- তাওবার দ্বার সর্বদা উম্মুক্ত। যে কোন সময় তাওবা করা যেতে পারে। তবে মৃত্যু বা কেয়ামতের লক্ষণ প্রকাশ পেলে তাওবার দ্বার বন্ধ হয়ে যায়।

হাদীস-১৭. আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি পশ্চিম দিক দিয়ে সূর্য উদয়ের পূর্বে (কেয়ামত শুরুর পূর্বে) তাওবা করবে আল্লাহ তাআলা তার তাওবা গ্রহণ করবেন। বর্ণনায় : মুসলিম

শিক্ষা ও মাসায়েল :

১- চূড়ান্ত মুহুর্তের অপেক্ষা না করে এক্ষুনি তওবা করা কর্তব্য।

২- তওবার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে এ হাদীসে।

৩- কেয়ামতের একটি বড় আলামত হল সূর্য পশ্চিম দিক দিয়ে উদিত হওয়া।

৪- তওবা কবুলের সময়টা ব্যাপক বিস্তৃত। এমনকি তা কেয়ামতের পূর্বক্ষণে হলেও তওবা গ্রহণ করা হবে।

হাদীস-১৮. আব্দুল্লাহ বিন উমার রা. থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন : অবশ্যই আল্লাহ তাআলা তার বান্দার তাওবা কবুল করেন গড়গড় করার (মৃত্যুর লক্ষণ প্রকাশের) পূর্ব পর্যন্ত। বর্ণনায় : তিরমিজী

শিক্ষা ও মাসায়েল :

১- তাওবার একটি শর্ত হল, তাওবা করতে হবে মৃত্যুর আলামত প্রকাশের পূর্বে। মৃত্যুর আলামত প্রকাশ পেতে শুরু করলে তাওবা কবুল হবে না। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :

তাদের জন্য তাওবা নেই, যারা ঐ পর্যন্ত পাপ করতে থাকে, যখন তাদের কারো নিকট মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন বলে নিশ্চয়ই আমি এখন তওবা করলাম। (সূরা আন-নিসা, আয়াত- ১৮)

২- সুস্থ জীবন তওবার উপযুক্ত সময়। জীবন থেকে নিরাশ হওয়ার পর তওবার উপযুক্ত সময় আর থাকে না। এমনিভাবে পাপ করার সামর্থ থাকাকালীন সময়টা হল তওবার উপযুক্ত সময়। পাপ করার ক্ষমতা লোপ পেয়ে গেলে তওবা করা যথোপযুক্ত নয়। তবুও তওবা করা উচিত।

হাদীস-১৯. যির ইবনে হুবাইশ বলেনঃ মোজার উপর মাসেহ সম্পর্কে জানার জন্য আমি সাফওয়ান ইবনে আসসাল রা. এর কাছে আসলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন হে যির! তুমি কি উদ্দেশ্যে এসেছ? আমি বললাম জ্ঞান অর্জনের জন্য এসেছি। তিনি বললেন, ফেরেশ্‌তাগণ জ্ঞান অর্জনকারীর জ্ঞান অন্বেষণে সন্তুষ্ট হয়ে তার সম্মানে তাদের ডানা বিছিয়ে দেয়। আমি বললাম, মল-মুত্র ত্যাগের পর মোজার উপর মাসেহ করা সম্পর্কে আমার মনে খটকা লাগে। আপনিতো নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একজন সাহাবী। তাই এ ব্যাপারে আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছি। আপনি কি এ ব্যাপারে তাঁর থেকে কিছু শুনেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, যখন আমরা সফরে থাকতাম তখন তিন দিন ও তিন রাত পর্যন্ত তিনি মল-মুত্র ত্যাগের পর, নিদ্রা থেকে জাগার পর মোজা না খোলার জন্য বলেছেন। তবে গোসল ফরজ হলে অন্য কথা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভালোবাসা সম্পর্কে তাকে কিছু বলতে শুনেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এর সাথে কোন এক সফরে ছিলাম। হঠাৎ একজন বেদুইন এসে উঁচুস্বরে ডাক দিয়ে বলল, হে মুহাম্মাদ!। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার মত উচ্চস্বরে ডাক দিয়ে বললেন : এগিয়ে এসো! আমি তাকে বললাম, তোমার জন্য দুঃখ হয়, তোমার আওয়াজ নীচু কর। তুমিতো নবীর দরবারে এসেছ। তার দরবারে আওয়াজ বড় করতে নিষেধ করা হয়েছে। বেদুইন লোকটি বলল, আমি আমার আওয়ায ছোট করতে পারছি না। কোন ব্যক্তি যখন কোন দলকে ভালোবাসে অথচ এখনও তাদের সাথে সাক্ষাত করতে পারেনি? (সে অস্থির হতেই পারে, এতে দোষের কি?)

তার কথা শুনে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বললেনঃ যে যাকে ভালোবাসে কেয়ামতের দিন সে তার সাথে থাকবে। এভাবে তিনি কথা বলতে বলতে পশ্চিম দিকের একটি দরজার কথা বললেন। যার প্রস্থের দূরত্ব অতিক্রমে পায়ে হেটে গেলে বা যানবাহনে গেলে চল্লিশ বা সত্তর বছর সময় লাগবে। হাদীস বর্ণনাকারী সুফিয়ান এ কথার ব্যাখ্যায় বলেন, যে দিন আল্লাহ আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, সেদিন থেকে শাম (সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, জর্দান) অঞ্চলের দিক দিয়ে এ দরজা তাওবার জন্য উম্মুক্ত রেখেছেন। পশ্চিম দিক দিয়ে সুর্যোদয় না হওয়া পর্যন- এ দরজা বন্ধ করা হবে না।

বর্ণনায় : তিরমিজী।

শিক্ষা ও মাসায়েল :

১- ধর্মীয় জ্ঞান অন্বেষণ করার জন্য উৎসাহিত করেছে এ হাদীস। যারা ধর্মীয় জ্ঞান অন্বেষনে লিপ্ত থাকে, তাদের ফজিলত উল্যেখ করা হয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তা হল ধর্মীয় জ্ঞান। যারা এ জ্ঞান অন্বেষনে লিপ্ত ফেরেশ্‌তাগন তাদের সম্মান করে থাকেন।

২- মোজার উপর মাসেহ করার সুন্নাত প্রমাণিত। কিছু শর্ত স্বাপেক্ষে অজু করার সময় মোজা না খুলে মোজার উপর মাসেহ করা যায়। পা ধৌত করার প্রয়োজন হয় না। মোজার উপর মাসেহ করা শর্তসমূহ হল:

(ক) অজু থাকা অবস্থায় মোজা পরিধান করতে হবে।

(খ) মোজা পায়ের গোড়ালী ঢেকে রাখে এমন হতে হবে।

(গ) পায়ে পানি প্রবেশ প্রতিরোধ করে এমন মোজা হতে হবে।

(ঘ) দীর্ঘ সময় হাটা-চলা করলেও মোজা ফেটে যায় না বা ছিড়ে যায় না, এমন ধরণের মোজা হতে হবে।

(ঙ) অজুর সময়ে মোজার উপর মসেহ করার বিধান সীমিত। ফরজ গোসলে নয়।

(চ) মুকীম অর্থাৎ নিজ বাড়ীতে অবস্থান রত ব্যক্তি পবিত্র অবস্থায় মোজা পরিধানের পর থেকে একদিন ও এক রাত সময় পর্যন্ত মোজার উপর মাসেহ করার সুযোগ লাভ করবেন। আর মুসাফির তিন দিন তিন রাত মাসেহ করার সুযোগ পাবেন।

৩- আলেম ও বিদ্বানদের সম্মান করা। তাদের মজলিসে উচ্চস্বরে কথা না বলা।

৪- অজ্ঞ ব্যক্তিকে শিক্ষাদানে বিনম্র পন্থা অবলম্বন করা ও কঠোরতা পরিহার করা।

৫- আলেম-উলামাদের ভালোবাসা ও তাদের সম্মান করা এবং তাদের সহচর্য লাভ করার চেষ্টা করা।

৬- ভালোবাসার দাবী হল, যাকে ভালোবাসবে তার আদর্শের অনুসরণ করবে।

৭- এমন লোকদের ভালোবাসা উচিত যার সাথে হাশর হলে সে ভাগ্যবান বলে বিবেচিত হবে। এমন কাউকে ভালোবাসা উচিত নয় যে আখেরাতে হতভাগা বলে বিবেচিত হবে।

৮- ইসলামের কোন বিষয়ে মনে সংশয় সৃষ্টি হলে বা খটকা লাগলে তা আলেমদের কাছে যেয়ে বা প্রশ্ন করে নিরসন করা দরকার। যেমন সফওয়ান বলেছেন আমার মনে খটকা লাগে। তিনি তার সংশয় দূর করতে দীর্ঘ সফর করেছেন।

৯- তাওবার দরজা সর্বদা খোলা আছে। এ বিষয়টি উল্লেখ করার কারণে হাদীসটি তাওবা অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে।

আবু সাঈদ সাদ ইবনে মালেক ইবনু সিনান আল-খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: তোমাদের পূর্বের এক যুগে এক ব্যক্তি নিরানব্বই জন মানুষকে হত্যা করল। এরপর সে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আলেমের অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। তাকে এক পাদ্রীকে দেখিয়ে দেয়া হল। সে তার কাছে গিয়ে বলল, সে নিরানব্বই জন মানুষকে খুন করেছে তার তাওবার কোন ব্য আছে কি না? পাদ্রী উত্তর দিল, নেই। এতে লোকটি ক্ষিপ্ত হয়ে পাদ্রীকে হত্যা করে একশত সংখ্যা পুরণ করল। এরপর আবার সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আলেম সম্পর্কে জানতে চাইল। তাকে এক আলেমেকে দেখিয়ে দেয়া হল। সে আলেমের কাছে যেয়ে জিজ্ঞাসা করল, সে একশত মানুষকে খুন করেছে, তার তাওবা করার কোন সুযোগ আছে কিনা? আলেম বললেন, হ্যাঁ, তাওবার সুযোগ আছে। এ ব্যক্তি আর তাওবার মধ্যে কি বাধা থাকতে পারে? তুমি অমুক স্থানে চলে যাও। সেখানে কিছু মানুষ আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী করছে। তুমি তাদের সাথে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করতে থাকো। আর তোমার দেশে ফিরে যেও না। সেটা খারাপ স্থান। লোকটি নির্দেশিত স্থানের দিকে পথ চলতে শুরু করল। যখন অর্ধেক পথ অতিক্রম করল তখন তার মৃত্যুর সময় এসে গেল। তার মৃত্যু নিয়ে রহমতের ফেরেশ্‌তা ও শাস্তির ফেরেশ্‌তাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হল। রহমতের ফেরেশ্‌তাগন বললেন, এ লোকটি আন-রিকভাবে তাওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে এসেছে। আর শাসি-র ফেরেশ্‌তাগন বললেন, লোকটি কখনো কোন ভাল কাজ করেনি। তখন এক ফেরেশ্‌তা মানুষের আকৃতিতে তাদের কাছে এল। উভয় দল তাকে ফয়সালাকারী হিসাবে মেনে নিল। সে বলল, তোমরা উভয় দিকে স্থানের দূরত্ব মেপে দেখ। যে দুরত্বটি কম হবে তাকে সে দিকের লোক বলে ধরা হবে। দূরত্ব পরিমাপের পর যে দিকের উদ্দেশ্যে সে এসেছিল তাকে সে দিকটির নিকটবর্তী পাওয়া গেল। এ কারণে রহমতের ফেরেশ্‌তাগণই তার জান কবজ করল। বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম

বুখারীর অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, সে ভাল মানুষদের স্থানের দিকে মাত্র অর্ধহাত বেশী পথ অতিক্রম করেছিল, তাই তাকে তাদের অন্তর্ভূক্ত বলে ধরা হয়েছে। বুখারীর আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ যমীনকে নির্দেশ দিলেন, যেন ভাল দিকের অংশটা নিকটতর করে দেয়। আর খারাপ দিকের অংশটার দুরত্ব বাড়িয়ে দেয়। পরে সে বলল, এখন তোমরা উভয় দুরত্ব পরিমাপ করো। দেখা গেল সে মাত্র অর্ধ হাত পথ বেশী অতিক্রম করেছে। এ কারণে আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দিলেন।

শিক্ষা ও মাসায়েল :

১- ওয়াজ, বক্তৃতা ও শিক্ষা প্রদানে বাস-ব উদাহরণ পেশ করার অনুপম দৃষ্টান- রেখেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

২- যার ইবাদত কম কিন্তু ইলম বেশী, সে শ্রেষ্ঠ ঐ ব্যক্তির চেয়ে, যার ইবাদত বেশী ইলম কম। যেমন এ হাদীসে দেখা গেল যে ব্যক্তি ফতোয়া দিল যে তোমার তাওবা নেই সে আলেম ছিল না, ছিল একজন ভাল আবেদ। তার কথা সঠিক ছিল না। আর যে তাওবার সুযোগ আছে বলে জানাল, সে ছিল একজন ভাল আলেম। তার কথাই সঠিক প্রমাণিত হল।

৩- বিভিন্ন ওয়াজ, নসীহত, বক্তৃতা, লেখনীতে পূর্ববর্তী জাতিদের ঘটনা তুলে ধরা যেতে পারে। তবে তা যেন কুরআন-সুন্নাহ বা ইসলামী কোন আকীদার পরিপনি’ না হয়।

৪- গুনাহ বা পাপ যত মারাত্নকই হোকনা কেন, তা থেকে তাওবা করা সম্ভব।

৫- দাঈ অর্থাত ইসলামের দাওয়াত-কর্মীদের এমন কথা বার্তা বলা দরকার যাতে মানুষ আশান্বিত হয়। মানুষ নিরাশ হয়ে যায়, এমন ধরনের কথা বলা ঠিক নয়।

৬-  সর্বদা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা আর নৈতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করা আলেম ও দায়ীদের একটি বড় গুণ।

৭- অসৎ ব্যক্তি ও অসুস্থ সমাজের সঙ্গ বর্জন করা। এবং সৎ ব্যক্তি ও সৎ সমাজের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করা কর্তব্য।

৮- ফেরেশতাগন বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করতে পারেন।

৯- যে আল্লাহর পথে চলার চেষ্টা করে আল্লাহর রহমত তার দিকে এগিয়ে আসে। তাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন এবং পথ চলা সহজ করে দেন।

১০- আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের ক্ষমা করে দেয়ার দিকটা  প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।

১১- আল্লাহ তাআলা পরাক্রমশালী হওয়া সত্বেও আদল ও ইনসাফ পছন্দ করেন। তাই দু দল ফেরেশতার বিতর্ক একটি ন্যায়ানুগ পন্থায় ফয়সালা করার জন্য অন্য ফেরেশতা পাঠালেন।

১২- হাদীসটি দিয়ে বুঝে আসে, যে মানুষ হত্যা করার অপরাধে অপরাধী আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন যদি সে তাওবা করে। অথচ অন্য অনেক সহীহ হাদীস স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে যে, আল্লাহ মানুষের অধিকার হরণকারীকে ক্ষমা করেন না। অতএব যে কাউকে হত্যা করল সে তো অন্য মানুষের বেচে থাকার অধিকার হরণ করে নিল। আল্লাহ তাকে কিভাবে ক্ষমা করবেন?

এর উত্তর হল : যে ব্যক্তি কোন মানুষকে হত্যা করল সে তিন জনের হক (অধিকার) ক্ষুন্ন করল। এক. আল্লাহর অধিকার বা হক। কারণ আল্লাহ মানুষ হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। মানুষকে নিরাপত্তা দিতে আদেশ করেছেন। হত্যাকারী আল্লাহর নির্দেশ লংঘন করে সে তাঁর অধিকার ক্ষুন্ন করেছে। দুই. নিহত ব্যক্তির অধিকার। তাকে হত্যা করে হত্যাকারী তার বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করেছে। তিন. নিহত ব্যক্তির আত্নীয়-স্বজন, পরিবার ও সন্তানদের অধিকার। হত্যাকারী ব্যক্তিকে হত্যা করে তার পরিবারের লোকজন থেকে ভরণ-পোষণ, ভালোবাসা-মুহব্বাত, আদর-স্নেহ পাবার অধিকার থেকে চিরতরে বঞ্চিত করেছে।

হত্যাকারী এ তিন ধরণের অধিকার হরণের অপরাধ করেছে। আল্লাহর কাছে তাওবা করলে আল্লাহ শুধু প্রথম অধিকার -যা তাঁর নিজের সাথে সংশ্লিষ্ট- নষ্ট করার অপরাধ ক্ষমা করবেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অপরাধ ক্ষমা করবেন না। এ হাদীসে প্রথম ধরনের অপরাধ ক্ষমা করার কথা বলা হয়েছে। (শরহু রিয়াদিস সালেহীন মিন কালামে সাইয়েদিল মুরসালীন : মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল-উসাইমীন রহ.)

আব্দুল্লাহ ইবনে কাআব ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত। সাহাবী কাআব রাদিয়াল্লাহু আনহু অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তার ছেলেদের মধ্যে আব্দুল্লাহ তাকে পথ চলতে সাহায্য করতেন। এই আব্দুল্লাহ বর্ণনা করেন যে, আমি আমার পিতা কাআব ইবনে মালেকের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর  সাথে তাবুক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করা সম্পর্কে বর্ণনা করতে শুনেছি। কাআব রা. বলেছেন, তাবুকের যুদ্ধ ব্যতীত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে আমি অন্য কোন যুদ্ধে পশ্চাতে থাকিনি। অবশ্য বদরের যুদ্ধে আমি অংশ নেইনি। কিন্তু এ যুদ্ধে যারা অংশ নেয়নি তাদের তিরস্কার করা হয়নি। কারণ, সে যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  কুরাইশ কাফেলাকে বাধা দানের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন (যুদ্ধ ঘোষণা হয়নি)। অবশেষে আল্লাহ তাআলা অনির্ধারিতভাবে তাদের শত্রুদের সাথে লড়াই করার সম্মুখীন করে দিলেন। আমরা আকাবার শপথের রাতে যখন ইসলামে অটল থাকার অঙ্গীকার করেছিলাম, তখন আমিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এর সাথে উপস্থিত ছিলাম। যদিও বদর যুদ্ধ মানুষের কাছে অধিক আলোচিত বিষয়, তবুও আমি আকাবার শপথে উপসি’তির পরিবর্তে বদর যুদ্ধে উপসি’তি সর্বাধিক প্রাধান্য দেয়া উত্তম মনে করি না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এর সাথে তাবুক যুদ্ধে আমার অংশ না নিতে পারার কারণটা হচ্ছে এই যে, এ যুদ্ধের সময় আমি যতটা শক্তিশালী ও ধনী ছিলাম এতটা ইতিপূর্বে ছিলাম না। আল্লাহর কসম! এ যুদ্ধের সময় আমার দুটো উট ছিল। এর পূর্বে আমার দুটো উট কখনো ছিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  কোথাও অভিযানে বের হবার ইচ্ছা করলে অন্য স্থানের কথা বলে গন-ব্যের কথা গোপন রাখতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  অত্যাধিক গরমের সময় এ যুদ্ধের প্রস-তি গ্রহণ করেন। সফর ছিল অনেক দূরের পথে। পথিমধ্যে অনেক মরুভুমি অতিক্রম করা ছিল অনিবার্য। আর শত্রু পক্ষের সংখ্যাও ছিল বেশী। তাই তিনি এ যুদ্ধের কথা মুসলমানদের কাছে খোলাখুলিভাবে বলে দিলেন। যেন তারা যুদ্ধের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। তিনি তাদেরকে তার গন-ব্যের কথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন। বহু মুসলিম যোদ্ধা এ অভিযানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এর সহযাত্রী হলেন। তখন তাদের নাম তালিকাভূক্ত করার জন্য কোন রেজিষ্টার বই ছিল না। কাআব রা. বলেন, অনেক কম লোকই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ থেকে অনুপস্থিত থাকত। যে ব্যক্তি অংশ গ্রহণ না করে নিজেকে গোপন করে রাখতে চাইত, সে অবশ্যই মনে করত যে, যতক্ষণ পর্যন- তার সম্পর্কে অহী অবতীর্ণ না হবে  ততক্ষণ পর্যন- তার ভূমিকা গোপন থাকবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  যখন এ অভিযানে বের হচ্ছিলেন তখন খেজুর ফলে পাক ধরছিল। গাছ পালার ছায়া শানি-দায়ক হয়ে উঠছিল। আর আমি এ সবের প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম। সে যাই হোক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  ও তার সাথে মুসলিমগন যুদ্ধে বের হবার প্রস্তুতি আরম্ভ করলেন। আমিও তার সাথে বের হবার প্রস্তুতি গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে ভোরে যেতাম আর কোন কিছু সম্পন্ন না করেই ফিরে আসতাম। আর মনে মনে আমি ভাবতাম, ইচ্ছা করলেই এ কাজ (যুদ্ধ থেকে পালিয়ে থাকা) সহজেই করতে পারব। এভাবে আমি গড়িমসি করতে থাকলাম। লোকেরা যুদ্ধ সফরের জোর প্রস্তুতি গ্রহণ করে ফেলল। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকজনদের নিয়ে একদিন সকালে তাবুকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। অথচ আমি কোন প্রস্তুতি গ্রহণ করিনি। আমি আবার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে লাগলাম। কিন’ কিছুই করলাম না। আমার এ দো-টানা ভাব অব্যাহত থাকল। এ দিকে লোকেরা যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে থাকল। আমি তখন মনে মনে ভাবলাম যে, রওয়ানা হয়ে গিয়ে তাদের সাথে মিলে যাব। আহ! আমি যদি তা করতাম। এরপর আর তা আমার ভাগ্যে জুটলনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  অভিযানে বের হবার পর আমি যখন মানুষদের মধ্যে চলাফেরা করতাম, তখন যাদেরকে মুনাফিক বলে ধরা হত এবং যাদেরকে আল্লাহ অক্ষম ও দুর্বল বলে গণ্য করেছিলেন, সে রকম লোক ব্যতীত আর কাউকে আমার ভুমিকায় দেখতে পেতাম না। এ অবস্থা আমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলল। তাবুক পৌছা পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কথা মনে করেননি। তাবুকে তিনি লোকজনের মাঝে বসা অবস্থায় জিজ্ঞেস করলেন, কাব ইবনে মালেক কি করল? বনি সালেম গ্রোত্রের এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাকে তার চাদর ও দু পার্শ্বদেশ দর্শন আটকে রেখেছে। মুআজ ইবনে জাবাল রা. বললেন, তুমি যা বলেছ তা খুবই খারাপ কথা। আল্লাহর কসম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা তার ব্যাপারে ভাল ব্যতীত আর কিছুই জানি না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  নীরব থাকলেন। এমন সময় সাদা পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তিকে মরুভুমির মরিচিকার ভিতর দিয়ে আসতে দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বললেন, তুমিযেন আবু খাইসামা হও! দেখা গেল সত্যিই সে আবু খাইসামা আনসারী। আর আবু খাইসামা হল সেই ব্যক্তি, যে এক সা খেজুর ছদকাহ করার করায় মুনাফিকরা যাকে তিরস্কার করেছিল। কাআব রা. বলেন, যখন জানতে পারলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  তাবুক থেকে আসছেন, তখন আমি অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। তাই মিথ্যা অজুহাত পেশ করার প্রস-তি নিলাম। কিভাবে তার অসন’ষ্টি থেকে বাঁচতে পারব, চিন্তা করতে লাগলাম। আমার পরিবারের বুদ্ধিমান লোকদের কাছে এ ব্যাপারে পরামর্শ চাইলাম। এরপর যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শীঘ্রই এসে পড়বেন বলে খবর পেলাম তখন মিথ্যা বলার ইচ্ছা উধাও হয়ে গেল। এমনকি কোন কিছু দ্বারা মুক্তি পাওয়া যাবে না বলে বুঝতে পারলাম, তাই সত্য কথা বলার সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরদিন সকালে পৌছে গেলেন। আর তিনি সফর থেকে ফিরে মসজিদে দু রাকাআত নামাজ আদায় করতেন। এরপর লোকজনের সামনে বসতেন। এ নিয়ম অনুযায়ী তিনি যখন বসলেন, যারা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি তারা তখন কসম করে করে যুদ্ধে না যাওয়ার কারণ বলতে শুরু করল। এরূপ লোকের সংখ্যা আশি জনের কিছু বেশি ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  তাদের মুখের বক্তব্য গ্রহণ করলেন। তাদের বাইআত (শপথ) গ্রহণ করালেন এবং তাদের অপরাধ ক্ষমা করার জন্য আল্লাহর কাছে আর্জি পেশ করে তাদের গোপন অবস্থা আল্লাহর উপর ন্যস- করলেন। এরপর আমি উপস্থিত হয়ে যখন সালাম দিলাম, তিনি রাগের ক্রোধের সাথে মুচকি হাসলেন। এরপর বললেন, আস, আমি তার সামনে গিয়ে বসলাম। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, কি কারণে তুমি পিছনে রয়ে গেলে। তুমি কি তোমার জন্য যানবাহন ক্রয় করনি? কাআব বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যদি আপনি ব্যতীত অন্য কোন দুনিয়াদার ব্যক্তির কাছে বসতাম, তাহলে এ ব্যাপারে কোন অজুহাত পেশ করে এর অসন্তোষ থেকে বেঁচে থাকার পথ দেখতে পেতাম। এবং এধরণের যুক্তি প্রদর্শন করার যোগ্যতা আমার আছে। কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি জানি, যদি আজ আমি আপনার কাছে মিথ্যা কথা বলি তাহলে আপনি আমার প্রতি খুশী হবেন, কিন্তু মহান আল্লাহ আমার প্রতি আপনাকে অতি শীঘ্রই অসন্তুষ্ট করে দেবেন। আর যদি আপনাকে সত্য কথা বলি, তাহলে আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হলেও আমি মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর কাছে শুভ পরিণতির আশা করি। আল্লাহর শপথ! আমার কোন সমস্যা ছিল না। (আমি অভিযানে অংশ নিতে পারতাম) আল্লাহর কসম! এ যুদ্ধে আপনার সাথে না গিয়ে পিছনে থেকে যাবার সময় আমি যতটা শক্তিমান ও শক্তিশালী ছিলাম ততটা কখনো ছিলাম না। কাআব বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বললেন, এ ব্যক্তি সত্য কথাই বলেছে। তুমি এখন উঠে যাও। তোমার ব্যাপারে আল্লাহ কোন ফয়সালা না করার পর্যন্ত দেখা যাক। বনী সালামার কয়েকজন ব্যক্তি আমার পিছনে পিছনে এসে বলতে লাগল, আল্লাহর কসম! ইতিপূর্বে তুমি কোন অন্যায় করেছ বলে আমরা জানি না। তুমি অন্যদের মত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে অজুহাত পেশ করতে পারলেনা কেন? তোমার পাপের জন্য আল্লাহর কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  ক্ষমা প্রার্থনাই যথেষ্ঠ ছিল। আল্লাহর কসম! এরা আমাকে এতই তিরস্কার করতে লাগল যে, আমার ইচ্ছে হল আমি আবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে ফিরে গিয়ে নিজেকে মিথ্যাবাদী বলে সাব্যস- করি। এরপর আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম, আমার মত এরূপ ঘটনা কারো ব্যাপারে ঘটেছে কি না? তারা বলল, হ্যাঁ আরো দুজনের ব্যাপারটিও তোমার মতই ঘটেছে। তুমি যা বলেছো তারাও সে রকম বলেছে। কাআব বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, সে দু জন কে? তারা বলল, মুররা ইবনে রাবিয়া আমেরী ও হেলাল ইবনে উমাইয়া ওয়াকেফী।

কাআব বলেন, তারা যে আমাকে দু জন লোকের নাম বলল, তারা ছিলেন খুবই সৎ ও আদর্শ মানুষ এবং তারা বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। কাআব রা. বলেন, লোকেরা আমাকে এ দু জনের খবর দিলে আমি আমার পূর্বের নীতিতে অটল থাকলাম। যারা পিছনে রয়ে গিয়েছিল তাদের মধ্যে আমাদের এ তিন জনের সাথে কথা বলার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধাজ্ঞা জারী করলেন। কাআব বলেন, একারণে লোকেরা আমাদের বয়কট করে চলত। অথবা তিনি বলেছেন, তারা পরিবর্তন হয়ে গেল। এমনকি পরিচিত পৃথিবী আমার জন্য একেবারে অপরিচিত হয়ে গেল। কি আশ্চর্য! আমরা পঞ্চাশ রাত পর্যন- অতিবাহিত করলাম। অপর দু জন সাথী ছিলেন দূর্বল। তারা ঘরে বসে বসে কাঁদতে লাগলেন। আর আমি যুবক ও শক্তিশালী ছিলাম বলে বাইরে বের হয়ে মুসলমানদের সাথে নামাজ আদায় করতাম এবং বাজারে ঘোরাফেরা করতাম। অথচ কেউ আমার সাথে কথা বলত না। নামাজের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  নিজ স্থানে বসলে আমি তাকে সালাম দিতাম এবং মনে মনে বলতাম, দেখি তিনি সালামের উত্তরে ঠোট নাড়েন কি না। এরপর আমি তার নিকটবর্তী স্থানে নামাজ আদায় করতাম এবং আমি আড় চোখে দেখতাম, তিনি আমার দিকে তাকান কিনা। আমি যখন নামাজে ব্যস্ত হতাম তখন তিনি আমার দিকে তাকাতেন। আবার আমি যখন তার দিকে মনোযোগ দিতাম, তখন তিনি আমার দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন। অবশেষে যখন মুসলিম সমাজের অসহযোগিতার কারণে আমার দুরাবস্থা দীর্ঘায়িত হল, তখন আমি (একদিন) আমার চাচাত ভাই ও প্রিয় বন্ধু আবু কাতাদার বাগানের দেয়াল টপকে সেখানে পৌছে তাকে সালাম দিলাম। আল্লাহর কসম! সে আমার সালামের উত্তর দিল না। আমি তাকে বললাম, আবু কাতাদাহ! আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি জান না আমি আল্লাহ ও তার রাসূলকে ভালোবাসি। সে নিশ্চুপ রইল। আবার আমি কসম দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সে চুপ থাকল। আবার আমি তাকে কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। এ কথা শুনে আমার দু চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এল। আমি দেয়াল টপকে ফিরে এলাম। একদিন আমি মদীনার বাজারে হাটছিলাম। এমন সময় মদীনায় খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করার জন্য আগত এক সিরিয়াবাসী কৃষক বলতে লাগল, কে আমাকে কাআব ইবনু মালেককে দেখিয়ে দেবে। লোকেরা তাকে আমার দিকে ইঙ্গিত দিল। সে আমার কাছে এসে আমাকে গাস্‌সান বাদশার একটা পত্র দিল। আমি লেখাপড়া জানতাম। তাই আমি পত্রখানা পড়লাম। এতে লেখা ছিল, আমরা জানতে পারলাম, তোমার সাথী (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমার ব্যাপারে সীমা লংঘন করেছে। আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছনা ও ধ্বংসের স্থানে থাকার জন্য সৃষ্টি করেননি। তুমি আমাদের কাছে চলে এসো, আমরা তোমাকে সাহায্য করব। আমি পত্রখানা পাঠ করে বললাম, এটাও আমার জন্য একটা পরীক্ষা। আমি পত্রটি চুলায় জ্বালিয়ে ফেললাম। অবশেষে যখন ৫০ দিনের ৪০ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল, তখনও কোন অহী নাযিল হল না। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একজন সংবাদদাতা আমার কাছে এসে বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  তোমাকে তোমার স্ত্রী থেকে পৃথক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি বললাম, আমি কি তাকে তালাক দেব, না অন্য কিছু করব? সংবাদবাহক বলল, তুমি তার থেকে পৃথক থাকবে, তার নিকটে যাবে না। আমার অন্য দু জন সাথীকেও অনুরূপ খবর দেয়া হল। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, তুমি বাপের বাড়ীতে চলে যাও। যতক্ষণ পর্যন্ত এ ব্যাপারে আল্লাহ কোন ফয়সালা না করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি তাদের নিকট থাকবে। হেলাল ইবনে উমাইয়ার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! হেলাল ইবনে উমাইয়া খুবই বৃদ্ধ মানুষ, তার কোন পরিচর্যাকারী নেই। আমি তার সেবা করলে আপনি কি অসন’ষ্ট হবেন? তিনি বললেন, না, তবে সে যেন তোমার নিকটবর্তী না হয়। হেলাল ইবনে উমাইয়ার স্ত্রী বললেন, আল্লাহর কসম! এ ব্যাপারে তার কোন শক্তি সামর্থই নাই। আল্লাহর কসম! এ দিন পর্যন্ত তার ব্যাপারে যা কিছু হচ্ছে তাতে সে কেবল কাঁদছে। কাআব বলেন, পরিবারের একজন আমাকে বলল, তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে তোমার স্ত্রীর সেবা নেয়ার অনুমতি চাইতে পার। তিনি তো হেলাল ইবনে উমাইয়ার স্ত্রীকে অনুমতি প্রদান করেছেন। আমি বললাম, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এ বিষয়ে অনুমতি প্রার্থনা করব না। আমি যুবক হয়ে কিভাবে সেবা পাওয়ার প্রার্থনা করি।

এ অবস্থায় আরো দশ দিন অতিবাহিত করলাম। অবশেষে আমাদের সাথে কথা বলা নিষিদ্ধ ঘোষণার পঞ্চাশ দিন পূর্ণ হল। এরপর আমি আমার এক ঘরের ছাদে পঞ্চাশতম দিনের ভোরে ফজরের নামাজ আদায় করে এমন অবস্থায় বসেছিলাম, যে অবস্থার কথা আল্লাহ তাআলা কুরআনে আমাদের সম্পর্কে বলেছেন। আমার মন সংকীর্ণ হয়ে গেছে। পৃথিবী প্রশস- হওয়া সত্বেও আমার কাছে সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমি এ অবস্থায় বসে আছি। হঠাৎ এমন সময় সালআ পাহাড়ের চূড়া থেকে এক ব্যক্তিকে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলতে শুনলাম। হে কাআব! তুমি সুসংবাদ গ্রহণ কর। আমি এ কথা শুনেই সিজদায় লুটিয়ে পড়লাম। বুঝতে পারলাম, মুক্তি এসেছে। মহান আল্লাহ আমাদের তাওবা গ্রহণ করেছেন। এ খবর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  ফজরের নামাজ শেষে সমস্ত মানুষকে জানিয়ে দিলেন। অতএব মানুষেরা আমাদের সুসংবাদ দিতে থাকল। কিছু লোক আমার অন্য দু সাথীকেও খবর দিতে গেল। আর একজন লোক (যুবাইর ইবনু আওয়াম) আমার দিকে ঘোড়া নিয়ে ছুটে এল। আসলাম গোত্রের একজন দৌড়ে গিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে খবর পৌছাল। ঘোড়ার চেয়ে শব্দের গতি ছিল দ্রুততর। যে আমাকে প্রথমে সুখবরটি দিয়েছিল সে যখন আমার কাছে এলো, তখন সুখবর দেয়ার জন্য আমি তাকে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নিজের কাপড় দুখানা খুলে তাকে পরিধান করিয়ে দিলাম। আল্লাহর কসম! সেদিন দু খানা কাপড় ব্যতীত আমার কাছে কোন কাপড়ই ছিল না। আমি দু খানা কাপড় ধার করে তা পরিধান করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বের হলাম। লোকেরা দলে দলে আমার সাথে দেখা করে তাওবা কবুলের জন্য ধন্যবাদ জানাতে লাগল। তারা আমাকে বলতে লাগল, মহান আল্লাহ তোমার তাওবা কবুল করায় তোমার প্রতি মোবারকবাদ। আমি মসজিদে নববীতে প্রবেশ করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বসা ছিলেন। আর লোকেরা তার চারিদিকে বসা ছিল। তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ রা. দ্রুতবেগে উঠে এসে সাদরে আমার সাথে মোসাফাহা করে আমাকে মোবারকবাদ জানালেন। আল্লাহর কসম তালহা ব্যতীত আর কোন মুহাজির উঠেননি। বর্ণনাকারী বলেন, এ কারণে কাআব তালহার ব্যবহারের কথা জীবনে কখনো ভুলেননি। কাআব বলেন, আমি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সালাম দিলাম, তখন তার পবিত্র চেহারা আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে গিয়েছিল। তিনি বললেন “তোমার জন্ম দিন থেকে আজ পর্যন- সময়ের সর্বাপেক্ষা উত্তম দিনের সুসংবাদ গ্রহণ কর। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! খবর কি আপনার কাছ থেকে না আল্লাহর কাছ থেকে? তিনি বললেন : না, বরং আল্লাহর কাছ থেকে। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  যখন আনন্দিত হতেন তখন তার পবিত্র চেহারা এমন উজ্জল হয়ে যেত, মনে হত এক টুকরো চাদ। আমরা তা বুঝতে পারতাম। এরপর আমি যখন তার সামনে বসলাম, তখন বললাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার তাওবা কবুল হওয়ার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য আমি আমার সকল ধন-সম্পদ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন’ষ্টির জন্য ছদকাহ করে দিতে চাই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বললেনঃ “কতক সম্পদ রেখে দাও, সেটাই তোমার পক্ষে উত্তম হবে। আমি বললাম, আমার খায়বরের মালের অংশটা রেখে দিলাম। আমি আরো বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মহান আল্লাহ আমাকে সত্য কথা বলার জন্য মুক্তি দিয়েছেন। অতএব আমার তাওবার এটাও দাবী যে, আমি বাকী জীবনে সত্য কথাই বলব। আল্লাহর কসম! আমি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এ কথা বলছিলাম, তখন থেকে সত্যের ব্যাপারে মহান আল্লাহ অন্য কোন মুসলিমকে আমার মত এত উত্তম পরীক্ষা করেছেন বলে আমি জানি না। আল্লাহর কসম! আমি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে এ কথা বলেছি, তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমি কোন মিথ্যা কথা বলার ইচ্ছা পর্যন্ত করিনি। বাকী জীবনে আল্লাহ আমাকে মিথ্যা থেকে রক্ষা করবেন বলে আমি আশা রাখি। কাআব বলেন নিঃসন্দেহে এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ আয়াত নাযিল করেছেন। আয়াত হল :

নিশ্চয়ই আল্লাহ নবী, মুহাজির ও আনসারদের তাওবা কবুল করেছেন। যারা সংকটকালে তার অনুসরণ করেছে-এমনকি যখন তাদের এক দলের চিত্ত-বৈকল্যের উপক্রম হয়েছিল। পরে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করলেন। তিনিতো তাদের প্রতি দয়াদ্র, পরম দয়ালু। এবং তিনি ক্ষমা করলেন অপর তিনজনকেও, যাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল। যে পর্যন্ত না পৃথিবী বিস্তৃত হওয়া সত্বেও তাদের জন্য সংকুচিত হয়েছিল এবং তাদের জীবন তাদের জন্য দুর্বিষহ হয়েছিল এবং তারা উপলদ্ধি করেছিল যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন আশ্রয়স্থল নেই, তাঁর দিকে ফিরে আসা ব্যতীত। পরে তিনি তাদের তাওবা কবুল করলেন যাতে তারা তাওবায় সি’র থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। হে মুমিনগন! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের অন্তর্ভূক্ত হও। (সূরা আত-তাওবা : ১১৭-১১৯)

কাআব বলেন, আল্লাহর কসম! যখন আল্লাহ আমাকে ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য দান করেছেন তখন থেকে এ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে সত্য কথা বলাই আমার জন্য আল্লাহর সবচেয়ে বড় নেআমত। আমি যেন মিথ্যা বলে ধ্বংস না হই। যেমন অন্যান্য মিথ্যাবাদীরা মিথ্যা বলে ধ্বংস হয়ে গেছে। মহান আল্লাহ অহী নাযিল করার সময় মিথ্যাবাদীদের সর্বাধিক নিন্দা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন :

তোমরা তাদের নিকট ফিরে আসলে অচিরে তারা আল্লাহর নামে শপথ করবে যাতে তোমরা তাদের উপেক্ষা কর। সুতরাং তোমরা তাদের উপেক্ষা করবে। তারা অপবিত্র এবং তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ জাহান্নাম তাদের আবাসস্থল। তারা তোমাদের নিকট শপথ করবে যাতে তোমরা তাদের প্রতি তুষ্ট হও। তোমরা তাদের প্রতি তুষ্ট হলেও আল্লাহ তো সত্যত্যাগী সমপ্রদায়ের প্রতি তুষ্ট হবেন না। (সূরা আত-তাওবা : ৯৫-৯৬)

কাআব বলেন আমাদের এ তিনজন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ঐ সকল লোক পিছনে পড়ে গেল, যারা কসম করে মিথ্যা অজুহাত দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  তো তাদের অজুহাত গ্রহণ করে তাদের শপথ করিয়েছিলেন এবং তাদের ক্ষমার জন্য দোআ করেছিলেন। আর তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  আমাদের এ তিনজনের ব্যাপারে সিদ্ধান- গ্রহণ স্থগিত করেছিলেন। অবশেষে আল্লাহ এ ব্যাপারে মীমাংসা করে বললেন, যে তিন জন পিছনে রয়ে গেছে এর অর্থ আমাদের যুদ্ধ থেকে পিছনে পড়ে থাকা নয়। বরং এর অর্থ হচ্ছে এটাই যে, আমাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়াটা এ সকল লোকদের পিছনে রাখা হয়েছিল। যারা মিথ্যা অজুহাত পেশ করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  তা কবুল করেছিলেন। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)

অপর এক বর্ণনায় আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বৃহস্পতিবার তাবুক যুদ্ধে রওয়ানা হন। আর তিনি বৃহস্পতিবার সফরে যাত্রা করা পছন্দ করতেন। অন্য এক বর্ণনায় আছে, তিনি দিনের বেলায় দুপুরের আগে সফর থেকে ফিরে আসতেন। সফর থেকে ফিরে এসে প্রথমে মসজিদে যেতেন এবং সেখানে দু রাকাআত নামাজ আদায় করে বসতেন।

শিক্ষা ও মাসায়েল :

১- মুসলমানের সত্যিকার চরিত্র হল সত্যবাদিতা, স্পষ্টভাষী ও নিজের দোষত্রুটি অকপটে স্বীকার করা। সে কোন অন্যায় করে ফেললে তার সমর্থনে অসাড় বা মিথ্যা অজুহাত দাঁড় করে না।

২- সত্য মানুষকে মুক্তি দেয়, মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণীর বাস্তব চিত্র হল এ হাদীস। যারা মিথ্যা বলে রেহাই পেতে চেয়েছিল তারা কিছু দিনের জন্য রেহাই পেলেও চির দিনের জন্য তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। যতদিন কুরআন ও হাদীস থাকবে ততদিন মানুষ তাদের মিথ্যাবাদীতা সম্পর্কে জানবে। আর যারা সত্য বলে কয়েক দিনের জন্য বিপদে পড়েছিল, তারা প্রকৃতপক্ষে মুক্তি পেয়েছে। আল-কুরআন ও হাদীসের মাধ্যমে কেয়ামত পর্যন্ত মানুষ তাদের সত্যবাদিতা সম্পর্কে অবগত হবে। তাদের নাম স্মরণ করবে ও তাদের আদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে।

৩- একজন সফল সেনাপতি হিসাবে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এর দায়িত্ব পালন করার বিষয়টি ফুটে উঠেছে। এত হাজার হাজার মানুষের মধ্যে কে অনুপসি’ত থাকল, কেন থাকল ইত্যাদি বিষয়গুলো সুনিপুনভাবে তদারক  করেছেন।

৪- যত বাধা-বিপত্তি ও সমস্যা থাকুক, যখন যথাযথ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে জেহাদের ডাক আসবে তখনই মুসলমানদের তাতে অংশ নিতেই হবে।

৫- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবাগণ সত্য বলার বিপদ জেনেও সত্য বলা থেকে একটুও পিছপা হননি। যদি সে সত্যটি নিজের বিরুদ্ধে যায় তবুও তা বলেছেন।

৬- মানুষ প্রকাশ্যে যা বলবে অথবা করবে বা দাবী করবে, সে অনুযায়ী তার পক্ষে বা বিপক্ষে ফয়সালা হবে। অন-রে তার কি আছে তা দেখা বা দাবী করার দায়িত্ব মানুষের নয়। এ বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিতে হবে।

৭- যদি মুসলমানদের যথাযথ কর্তৃপক্ষ কাউকে বয়কট করার নির্দেশ দেয়, তবে তা পালন করতে হবে। প্রকাশ্যে বয়কটের সাথে একাত্মতা আর গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করা গ্রহণযোগ্য নয়।

৮- নিজের কোন অন্যায় অপরাধ হয়ে গেলে তার জন্য অনুতাপ প্রকাশ, কান্নাকাটি করা ঈমানদারের একটি বড় গুণ।

৯- শেষ পরিণতি মুত্তাকীদের জন্যই। তাইতো যারা মিথ্যা অজুহাত দিয়ে রেহাই পেয়ে গেছে তারা আসলে রেহাই পায়নি। পরবর্তীকালে কুরআন তাদের তিরস্কার করেছে। কিন্তু যারা সত্য বলে বিপদে পড়েছিল, পরিশেষে তাদেরই জয় হল। তাদের প্রশংসার কথা আল-কোরআনে কেয়ামত পর্যন- থেকে যাচ্ছে। আল্লাহ নিজে তাদের প্রতি সন’ষ্টির কথা নাযিল করেছেন তাঁরই পবিত্র কালামে।

১০- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন কত দয়াদ্র মানব। হেলাল ইবনে উমাইয়া তার বৃদ্ধ স্বামীর খেদমত করার অনুমতি চাওয়ায় তাকে অনুমতি দিলেন।

১১- যিনি কোন সুসংবাদ দান করেন তাকে পুরুস্কার দেয়ার বিষয়টি ভাল কাজ বলে স্বীকৃত।

১২- নিজের সকল সম্পদ দান বা ছদকাহ করে দেয়া ঠিক নয়।

১৩- ইসলাম ও মুসলমানের শত্রুরা সর্বদা মুসলিমদের মাঝে ফেৎনা ও বিশৃংলা সৃষ্টিতে তৎপর থাকে। তাদের পারস্পারিক অনৈক্যকে তারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে। এক মুসলিমকে অন্যের বিরুদ্ধে কাজ করতে উস্কানী দেয়। তাই একজন মুসলিম ইসলামী দল, রাষ্ট্র বা সমাজে যতই বেকায়দায় পড়ুক, কোন অবস্থাতেই কাফেরদের ডাকে সাড়া দেয়া বা কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ নয়। বরং ইসলাম ও ঈমানের দাবী হল, এ ধরনের বিষয়ে তাদের সাহায্য ও সহযোগিতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা। যেমন করেছিলেন এ প্রখ্যাত সাহাবী। এতটা বিপদেও গাসসান বাদশা কর্তৃক  আশ্রয় দানের  প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। নিজের স্বার্থে নয়, ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে। তাদের প্রতি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকুক চিরকাল।  তিনি তাদের পথে পথ চলার তাওফীক দান করুন আমাদেরকেও।

আবু নুজাইদ ইমরান ইবনে হুসাইন আল-খুযাঈ রা. থেকে বর্ণিত, জুহাইনা গোত্রের এক মহিলা ব্যভিচারের কারণে গর্ভবতী হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি শাসি-যোগ্য অপরাধ করেছি, আমাকে এর জন্য শাস্তি প্রদান করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  তার অভিভাবককে ডেকে বললেন, এর সাথে ভাল আচরণ করবে। যখন সে সন্তান প্রসব করবে তখন তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। এ লোকটি তাই করল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে শাসি- প্রদানের আদেশ দিলেন। এরপর তার শরীরের কাপড় ভাল করে বেঁধে দেয়া হল। অতঃপর পাথর মেরে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হল। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জন্য জানাযা নামাজ পড়লেন। উমার রা. বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! যে ব্যভিচার করেছে এমন নারীর জানাযা নামায আপনি পড়েছেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ সে এমন তাওবা করেছে যে, তা যদি সত্তর জন মদীনা বাসীর মধ্যে বন্টন করে দেয়া হত, তাহলে তাদের মুক্তির জন্য এটা যথেষ্ঠ হয়ে যেত। যে মহিলা নিজের প্রাণকে মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় উৎসর্গ করে দেয়, তার এরূপ তাওবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কাজ তুমি পেয়েছ কি?  বর্ণনায় : মুসলিম

শিক্ষা ও মাসায়েল :

১- ঈমানদার ব্যক্তির চরিত্র হল, যখন কোন পাপ করে তখন তা থেকে পবিত্র হতে চায়। অনুতাপ, অনুশোচনা, তাওবা ও শাস্তি গ্রহণের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা ও রহমতের আশা করে।

২- শাস্তি প্রদানে নিরাপরাধ মানুষ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে দিকে খেয়াল রাখা। যেমন গর্ভে অবস্থিত বাচ্চার কারণে এ মহিলা সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহার শাস্তি প্রদান বিলম্ব করা হয়েছে।

৩-পাপকে ঘৃণা করা উচিত। যে পাপ করেছে তাকে নয়। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এ মহিলার সাথে সদাচারণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

৪- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দয়া ও করুনার দৃষ্টান্ত: তিনি গর্ভের বাচ্চার প্রতি দয়া দেখালেন, অপরাধী এ মহিলার সাথে ভাল ব্যবহার করার জন্য তার অভিভাবককে নির্দেশ দিলেন, তার শাস্তি কার্যকর করার পর তার জন্য দোআ করলেন, তার প্রশংসা করলেন।

৫- আল্লাহর আইন বাস-বায়নে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এর দৃঢ়তা। তিনি এ মহিলার প্রতি দয়াদ্র হলেও তাকে শাসি- থেকে রেহাই দেয়ার ক্ষমতা রাখলেন না।

৬- যে আদালতের কাছে এসে পাপ বা অপরাধ স্বীকার করে, আদালত তাকে শাসি- দিতে বাধ্য। শাস্তি প্রদান ব্যতীত আদালতের আর কিছু করার থাকে না।

৭- মহিলা বিবাহিত থাকা সত্বেও ব্যভিচার করেছে বলেই তাকে প্রস্তর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। অবিবাহিত ব্যভিচারীর শাস্তি হল একশ বেত্রাঘাত। যেমন আল-কুরআনের সূরা আন-নূরের দ্বিতীয় আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড শুধু বিবাহিত ব্যভিচারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়।

৮- কেহ ব্যভিচার করে থাকলে তা থেকে তাওবা ও পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্যে যদি ব্যভিচারের কথা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে স্বীকার করে, তবে তা নাজায়েয নয়। কিন্তু যদি পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে নিজের ব্যভিচারের কথা মানুষকে বলে দেয়, তবে তা আরেকটি অপরাধ। প্রথমত পাপ করার অপরাধ, দ্বিতীয়ত পাপকে প্রচার করার অপরাধ।

ইবনে আব্বাস ও আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন : যদি কোন মানব সন্তানের এক উপত্যকা ভরা সোনা থাকে, তাহলে সে দুটো উপত্যকা (ভর্তি) সোনা কামনা করে। তার মুখ মাটি ব্যতীত আর কিছুতেই ভরে না। আর যে তাওবা করে আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন। বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম

শিক্ষা ও মাসায়েল :

১- সকল মানুষই অর্থ, সম্পদ পেতে চায় ও এর প্রতি লোভী।

২- মানুষ স্বভাবগতভাবে কৃপণ। সে অর্থ সম্পদ শেষ হয়ে যাওয়ার ভয় করে। আর এ জন্য সে যত সম্পদের মালিক হোক না কেন, শুধু আরো চায়।

যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন :

বলঃ যদি তোমরা তোমার প্রতিপালকের দয়ার ভাণ্ডারের অধিকারী হতে তবুও তোমরা খরচ হয়ে যাবে এই আশংকায় ওটা ধরে রাখতে, মানুষ তো অতিশয় কৃপণ।  (সূরা আল-ইসরা : ১০০)

৩- সম্পদ অর্জন করা ভাল, তবে সম্পদ অর্জনটা নেশায় পরিণত হওয়া বা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া মোটেই ভাল নয়।

৪- সম্পদের আধিক্য মানুষকে ধনী করে না। বরং তার অভাব বা চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। মনের দিক দিয়ে যে ধনী, সে-ই প্রকৃত ধনী।

৫- ইসলামী অর্থনীতির একটি মৌলিক বিষয় এ হাদীসে ফুটে উঠেছে। তা হল, যার সম্পদ যত বেশি তার অভাব বা চাহিদা তত বেশি।

৫- তাওবাকারীর তাওবা আল্লাহ তাআলা কবুল করেন। হাদীসের এ বিষয়টির সাথে আলোচ্য বিষয়ের শিরোনামের সম্পর্ক।

আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেনঃ আল্লাহ ছুবহানাহু ওয়া তাআলা এমন দু ব্যক্তির ব্যাপারে হাসবেন, যারা একে অপরকে হত্যা করবে এবং উভয়ই জান্নাতে প্রবেশ করবে। একজন আল্লাহর পথে লড়াই করে শহীদ হবে। এরপর আল্লাহ (সেই শহীদের) হত্যাকারীর তাওবা কবুল করবেন এবং সে ইসলাম গ্রহণ করে (যুদ্ধে অংশ নিয়ে) শহীদ হয়ে যাবে। বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম

শিক্ষা ও মাসায়েল :

১- অপরাধ ও পাপ যত মারাত্নকই হোক, অবশ্যই তা থেকে তাওবা করতে হবে।

২- আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। যত অপরাধ বা পাপ করে না কেন, যত বিপদ-মুসীবতে আক্রান্ত হয় ঈমানদার সর্বদা আল্লাহর রহমত ও ক্ষমার প্রত্যাশা করে।

৩- ইসলাম গ্রহণের কারণে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কাফের থাকা কালীন সময়ের সকল পাপ, অন্যায় ও অপরাধ ক্ষমা করে দেন।

৪- আল্লাহর পথে জিহাদ করে শহীদ হওয়ার মর্যাদা এ হাদীসটি দিয়েও প্রমাণিত। অবশ্যই শাহাদাতের পুরস্কার হল জান্নাত।

সমাপ্ত।

Copyright Notice

কপি করা নিষিদ্ধ!