দরূদে নারিয়া পড়ার নিয়মঃ
দরূদে নারিয়া একটি বিদআতী দরুদ শরীফ।
আজকাল লোক মুখে নানা ধরণের দরূদ শুনতে পাওয়া যায়। যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অথবা তাঁর সাহাবিগণ হতে বর্ণিত হয়নি। না তাবেয়ীনগণ এর সমর্থন করেছেন না প্রসিদ্ধ ইমাম চতুষ্ট।
বরং এসব দরূদ নির্ভরযোগ্য তিন যুগের পরবর্তী যুগের কিছু লোকের বানানো। এগুলো সর্ব সাধারণ ও কতিপয় আলেমদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। তারা এগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত দরূদের চেয়েও অধিক হারে পাঠ করে। আমার ধারণায় অনেকেই সহিহ দরূদকে ছেড়ে দিয়েছে এবং বুজুর্গানের নামে তৈরী এ দরূদগুলোকে প্রচার করছে।
১। গভীর মনোযোগ দিয়ে খুব সুক্ষ্মভাবে এ সমস্ত দুরূদের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখতে পাব যে, এগুলো নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত রাস্তার বিপরীত।
যেমন, হে আল্লাহ! সে নবীর উপর শান্তি বর্ষণ কর, যিনি অন্তরের শান্তি ও তার ঔষধ, শরীরের সুস্থতা ও তার শেফা, চোখের নূর ও তার আলো। অথচ শরীর, অন্তর ও চোখের রোগ উপশমকারী ও সুস্থতা দানকারী কেবলমাত্র আল্লাহ তাআলা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামতো তাঁর নিজের ভাল-মন্দ করার ক্ষমতাই পর্যন্ত রাখতেন না। আল কোরআনে বর্ণিত আছে :
قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ (الاعراف 188)
অর্থাৎ, বল, আমিতো আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া আমার নিজের ভাল ও মন্দ করার ক্ষমতাও রাখি না। (সূরা আরাফ : আয়াত ১৮৮)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
لا تُطْرُوْنِي كَمَا أطْرَتِ النَّصَارى اِبْنَ مِرْيَمَ فَإنَّمَا أنَا عَبْدٌ فَقُوْلُوْا عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهُ (رواه البخاري)
অর্থাৎ, তোমরা আমার ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন কর না যেমন সীমালঙ্ঘন করেছে খৃষ্টানরা ঈসা ইবনে মারইয়াম সম্বন্ধে। আমি একজন বান্দা বৈ নই। সুতরাং তোমরা বল, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। (বুখারি)
২। অন্য একটি পাওয়া যায় যাতে বলা হয়েছে : সালাত ও সালাম আপনার উপর হে আল্লাহর রাসূল! আমার অবস্থা সংকীর্ণ হয়ে গেছে তাই আমাকে উদ্ধার করুন হে আল্লাহর দোস্ত। এর প্রথম অংশে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু শেষ অংশ শিরকযুক্ত।
কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন :
أَمَّنْ يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ (النمل 62)
অর্থাৎ, অথবা কে বিপদগ্রস্তের ডাকে সাড়া দেয়- যখন সে তাকে ডাকে এবং বিপদ হতে উদ্ধার করে । (সূরা নামল ২৭ : আয়াত ৬২)
অন্যত্র বলেন :
وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ (الانعام 17)
অর্থাৎ, আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোনো দুর্দশা দ্বারা স্পর্শ করেন, তবে তিনি ছাড়া তা দূরকারী কেউ নেই। ( সূরা আনআম, ৬ : আয়াত ১৭)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে দুঃখ, দুশ্চিন্তায় আপতিত হলে বলতেন :
ياَ حَيُّ ياَ قَيُّومُ بِرَحْمَتِكَ أسْتَغِيْثُ . (رواه الترمذي)
অর্থাৎ, হে চিরঞ্জীব, হে সু প্রতিষ্ঠিত ধারক! তোমার করুণার অসিলায় সাহায্য প্রার্থনা করছি। (তিরমিযি)
সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিপদে আমাদের উদ্ধার করেন ও বাঁচান, এমন সব অসাড় কথা আমরা কিভাবে বলি? এটি রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশিত বাণীর সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তিনি বলেছেন :
إذا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللهَ وَاذا اسْتَعَنْتَ فاسْتَعِنْ باللهِ (رواه الترمذى وقال حسن صحيح)
অর্থাৎ, যখন চাইবে আল্লাহর কাছেই চাইবে আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করবে। (তিরমিযি, হাসান সহিহ)।
আস সালাতুন্নারিয়া (দরূদে নারিয়া) পড়ার ফজিলতঃ
এ ধরণের দরূদ বহু মানুষের নিকট অতি পরিচিত। এর ফযিলত সম্পর্কে বলা হয়, যে ব্যক্তি দরূদে নারিয়া ৪৪৪৪ বার পাঠ করবে সে সব রকম বালা-মুসিবত থেকে নিরাপদে থাকবে এবং তার যে কোনো ধরণের অভাব-অভিযোগ পুরণ হবে। কোরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে এ সব বাতিল ধারণা। এর পক্ষে কোনো সহিহ দলীল-প্রমাণ নেই।
এ দরূদের প্রতি ভালভাবে লক্ষ্য করলে কিংবা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাব যে, এটি শিরকি কথা-বার্তায় পূর্ণ। যেমন,
اَللًّهُمَّ صلِّ صَلاةً كَامِلَةً وَسَلِمْ سَلامَا تَامًّا عَلى سَيِّدِناَ مُحًمَّدٍ الَّذِي تَنْحَلُّ بِهِ الْعُقَدُ وَتَنْفَرِجُ بِهِ الْكُرَبُ وَتَقْضىِ بِهِ الْحَوَائِجُ وَتَنَالُ بِهِ الرَّغَائِبُ وَحَسُنَ الْخَواتِيْمٌ وَيُسْتَسقَي الغَمَامُ بِوَجْهِهِ الْكَرِيْمُ وَعَلى آلِهِ وَصَحْبِهِ عَدَدَ كُلِّ مَعْلُومٍ لَكَ.
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর পরিপূর্ণ দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ করুন, যার মাধ্যমে কঠিন বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় এবং সব ধরণের বালা-মুসিবত দূর হয়ে যায়। যার মাধ্যমে সব ধরণের হাজত পূর্ণ হয়। তার মাধ্যমেই সমস্ত আশা আকাংখা বাস্তবায়িত হয়। তার কারণেই (ঈমান অবস্থায় মানুষের) শুভমৃত্যু নসিব হয়। তাঁর সম্মানিত চেহারার অসিলায় বৃষ্টিপাত হয়। তাঁর পরিজন ও সাহাবিদের উপর সে পরিমাণ দরূদ ও সালাম প্রেরণ করুন যে পরিমাণ আপনার জানা আছে । (নাউযুবিল্লাহ)।
১।
পবিত্র কোরআন থেকে আমরা যে তাওহিদের শিক্ষা পেয়েছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের যে আকিদাহ শিক্ষা দিয়েছেন, তার মাধ্যমে প্রতিটি মুসলিমের এমন বিশ্বাসই পেষণ করা জরুরি যে, মানুষের উপর আপতিত বিপদাপদ, বালা-মুসিবত দূর করার মালিক একমাত্র আল্লাহ তাআলা। সর্ব প্রকার প্রয়োজন পুরণ করার মালিকও তিনিই। দোয়া কবুল করার এখতিয়ারও তাঁরই হাতে।
কোনো মুসলিমের পক্ষেই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে দুঃখ পেরেশানী অথবা অসুস্থতা দূর করার জন্য দোয়া করার অনুমতি নেই। হোন না তিনি আল্লাহর নিকটবর্তী কোনো ফেরেশতা কিংবা সম্মানিত কোনো রাসূল। মহা গ্রন্থ আল-কোরআনে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে দোয়া করতে নিষেধ করা হয়েছে।
তার প্রমাণ নিম্ন বর্ণিত আয়াতঃ
বল, ‘তাদেরকে ডাক, আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদেরকে (উপাস্য) মনে কর। তারা তো তোমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার ও পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে না। তারা যাদেরকে ডাকে, তারা নিজেরাই তো তাদের রবের কাছে নৈকট্যের মাধ্যমে অনুসন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে তাঁর নিকটতর? আর তারা তাঁর রহমতের আশা করে এবং তাঁর আযাবকে ভয় করে। নিশ্চয় তোমার রবের আযাব ভীতিকর। (সূরা ইসরা, ১৭ : আয়াত ৫৬ ও ৫৭)
বিখ্যাত তাফসির বেত্তাগণ বলেছেন : এ আয়াত সেসব ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছে, যারা মসিহ ইবনে মারইয়াম-ঈসা আ.-এর নিকট অথবা ফেরেশতা কিংবা নেককার জিনদের নিকট দোয়া করত।
২।
তিনিই কঠিন কাজ ও বিপদ হতে উদ্ধার করতে পারেন’ এসব কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিভাবে গ্রহণ করতে পারেন। কিভাবেই বা এসবের উপর সন্তুষ্ট থাকতে পারেন? অথচ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছেঃ
বল, আমি আমার নিজের ভাল কিংবা মন্দের মালিক নই, তবে আল্লাহ যা চান। আমি যদি গায়েবের খবর জানতামই, তাহলে কল্যাণ অনেক বেশী অর্জন করতে পারতাম আর কোনো অনিষ্টই আমাকে স্পর্শ করতে পারত না। আমি তো কেবল একজন ভীতি প্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা সে কওমের জন্য যারা ঈমান এনেছে। ( সূরা আরাফ, ৭: আয়াত ১৮৮) হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, একদা এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলল,
ماَ شاَءَ اللهُ وَشِئْتَ فَقاَلَ: أجَعَلْتَنى للهِ نداً؟ قُلْ ماَشاَءَاللهُ وَحْدَهُ. (رواه النسائى)
অর্থাৎ, আল্লাহ যা চান ও আপনি যা চান। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : তুমি কি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে ফেলছ? বরং বল, এককভাবে আল্লাহ যা চান। (নাসাঈ)
৩।
মানুষের বানানো ভুলে ভরা এসব দরূদ আমরা কেন পাঠ করব? রাসূলুল্লাহ হতে বর্ণিত (যা আমরা সালাতে পাঠ করে থাকি) অধিক সওয়াব যোগ্য দরূদ পাঠ করতে আমাদের বাধা কোথায়?