অতীতে এদেশের নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা ও ধান ক্ষেতে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে এ সব মাছের প্রাপ্যতা মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে দিন দিন হরাস পাচ্ছে।
ছোট মাছে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, ভিটামিন, ক্যাল্সিয়াম এবং আয়রন রয়েছে। প্রতি বছর আমাদের দেশে ৩০ হাজারের অধিক শিশু ভিটামিন-‘এ’ এর অভাবে রাতকানা রোগে আক্রান্ত হয়। ছোট মাছ রাতকানা রোগসহ অপুষ্টিজনিত রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
অধিকন্তু, শহর ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠির কাছে ছোট মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমাদের দেশে প্রায় ১৪৩ প্রজাতির ছোট মাছ আছে যার মধ্যে ইতোমধ্যে কিছু প্রজাতি বিপন্ন হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে। মাছের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিট্যুটের ময়মনসিংহস্থ স্বাদুপানি কেন্দ্র ইতোমধ্যে বেশ কিছু ছোট মাছ চাষের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এখানে এ সব প্রজাতির চাষ পদ্ধতি সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
ছোট মাছ কী?
সাধারণত যে সমস্ত মাছ পরিপক্ক অবস্থায় ৫-২৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়, তাদেরকে আমরা ছোট মাছ হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। নিম্নে অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন কিছু ছোট মাছের নাম উল্লেখ করা হলো-
ছোট মাছের গুরুত্বঃ
১. ছোট মাছ গরীব জনগোষ্ঠির আমিষের যোগান দেয় এবং আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
২. ছোট মাছে প্রচুর পরিমাণে আমিষ ও মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্ট (ভিটামিন, ক্যাসিয়াম, আয়রণ ইত্যাদি) থাকে।
৩. গ্রামীণ জনসাধারণ বড় মাছের তুলনায় ছোট মাছ বেশি পছন্দ করে থাকে।
৪. এটা পরিবারের সকল সদস্যদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে।
৫. বাজারে সব সময়ই কম বেশি পাওয়া যায়।
৬. ছোট মাছ তুলনামূলকভাবে কম দামে পাওয়া যায়।
৭. ছোট ছোট ভাগে বিক্রি হয় বিধায় সুলভ মূল্যে ক্রয় করা যায়।
৮. ছোট বড় সব ধরণের জলাশয়েই সহজ ব্যবস্থাপনায় চাষ উপযোগী।
৯. ছোট মাছ সব ধরণের জলাশয়েই প্রাকৃতিকভাবে প্রজনন করে বিধায় পোনা ক্রয়ের জন্য বাড়তি পুঁজির প্রয়োজন হয় না।
১০. ছোট মাছ অপেক্ষাকৃত কম অক্সিজেনে এবং ঘোলা পানিতেও চাষ করা সম্ভব।
১১. ছোট মাছ দ্রুত বর্ধনশীল এবং কার্প জাতীয় মাছের সাথেও একত্রে চাষযোগ্য।
১. মলা, চেলা ও পুঁটি মাছের চাষঃ
মলা, চেলা ও পুঁটির চাষের বিশেষ বৈশিষ্ট্য
১. একক ও মিশ্র পদ্ধতিতে চাষ করা যায়।
২. বছরে ২-৩ বার প্রাকৃতিকভাবে প্রজনন করে থাকে।
৩. সহজ ব্যবস্থাপনায় এবং বিরূপ পরিবেশে চাষ করা সম্ভব।
মলা, চেলা ও পুঁটির চাষের উৎপাদন নির্দেশিকা
১. পুকুরের পাড় মেরামত ও রাক্ষুসে মাছ দমন করে প্রতি শতাংশে ১ কেজি চুন ও ৪ কেজি পঁচা গোবর প্রয়োগ করতে হয়।
২. সার প্রয়োগের ৩-৪ দিন পরে পানির রং হালকা বাদামি হলে প্রাকৃতিক উৎস হতে পরিপক্ক ছোট মাছ ছাড়তে হবে।
৩. একক চাষের ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে ৪০০-৫০০ টি মলা বা চেলা বা পুঁটি মজুদ করা যায়।
8. রুই জাতীয় মাছের সাথে মিশ্রচাষে প্রতি শতাংশে ২০০-২৫০টি মলা বা চেলা বা পুঁটি এবং ২৮-৩২টি রুই জাতীয় মাছ (রুই-১: কাতলা-১: মৃগেল-১) ছাড়তে হয়।
সম্পূরক খাবার প্রয়োগ
একক চাষে শুধু চালের কুড়া মাছের দৈহিক ওজনের ৪-৫% হারে প্রতিদিন প্রয়োগ করতে হবে। মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে প্রতিদিন দৈহিক ওজনের ৩% হারে চালের কুঁড়া (৭০%) ও সরিষার খইল (৩০%) একত্রে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যায়। সম্পূরক খাদ্যের পাশাপাশি প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য প্রতি শতাংশে ৪ কেজি পঁচা গোবর ১৫ দিন অন্তর অন্তর পুকুরে প্রয়োগ করতে হয়। প্রতি মাসে মাছের নমুনায়ন করে খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয় করা প্রয়োজন। মলা বা চেলা বা পুঁটি মজুদ করার ৩ মাস পর হতে প্রতি মাসে একবার জাল টেনে আংশিক আহরণ করা বাঞ্ছনীয়। এভাবে মাছ চাষ করে ৬ মাসে একক চাষের ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে ৩-৬ কেজি মলা বা চেলা বা পুটি এবং মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে ১২-১৪ কেজি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব।
২. পাবদা মাছের চাষঃ
পাবদা মাছের চাষে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ
১. কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন সম্ভব।
২. মৌসুমী পুকুর ও অন্যান্য অগভীর জলাশয়ে চাষযোগ্য।
৩. ৫-৬ মাসে বিপণনযোগ্য হয়।
পাবদা মাছের চাষের উৎপাদন নির্দেশিকা
১. প্রতি শতাংশের পুকুরে ১ কেজি চুন, ৫ কেজি গোবর, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টি.এস.পি সার প্রয়োগ করে পুকুর তৈরি করতে হবে।
২. পুকুর প্রস্তুতির ৭ দিন পর প্রতি শতাংশে ৫ গ্রাম ওজনের ৭০-৭৫টি পাবদা, ৪০-৪৫টি রাজপুটি এবং ১৫-২০টি মিরর্ কার্প মজুদ করা যায়।
৩. সম্পূরক খাবার হিসেবে চালের কুড়া (৬০%) ও সরিষার খইল (৪০%)-এর মিশ্রণ মাছের ওজনের ৫-৬% হারে প্রতিদিন প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৪. এছাড়া প্রতি ১৫ দিন অন্তর অন্তর প্রতি শতাংশে ৪ কেজি পঁচা গোবর সরবরাহ করতে হবে।
৫. নমুনায়ন করে খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এ পদ্ধতিতে চাষ করে ৬ মাসে প্রতি শতাংশে ১০-১২ কেজি মাছ উৎপাদন পাওয়া সম্ভব।
3. গুলশা মাছের চাষঃ
গুলশা মাছের চাষের বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ
১. এ মাছ দ্রুত বর্ধনশীল মাছ।
২. কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন সম্ভব।
৩. বিভিন্ন স্থানের মৌসুমী ও অ-গভীর জলাশয়ে চাষযোগ্য।
৪. গুলশা মাছ ৫-৬ মাসে বিপণনযোগ্য হয়।
গুলশা মাছের চাষের উৎপাদন নির্দেশিকা
১. পাবদা মাছ চাষের মতোই পুকুর প্রস্তুতির সমস্ত কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে। পুকুর প্রস্তুতির পর ৫-৮ গ্রাম ওজনের পাবদা, গুলশা ও সিল্ভার কার্পের পোনা প্রতি শতাংশ যথাক্রমে ৭০-৭৫, ৪০-৪৫ এবং ১৫-২০টি ছাড়া যায়।
২. খাবার হিসেবে চালের কুড়া (৬০%) ও সরিষার খইল (৪০%)-এর মিশ্রণ মাছের ওজনের ৫% হারে প্রতিদিন দেওয়া আবশ্যক।
৩. সার হিসেবে ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ও ১০০ গ্রাম টি.এস.পি প্রতি শতাংশে ১৫ দিন পর পর গুলিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
৪. মাছের নমুনায়ন করে প্রয়োজনীয় খাদ্যের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
৫. ৬ মাসে প্রতি শতাংশে পুকুর থেকে ১৩-১৫ কেজি মাছ উৎপাদন পাওয়া যায়।
4. দেশি সরপুঁটির চাষঃ
দেশি সরপুঁটির চাষের বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ
১. যে কোনো প্রকার পুকুর, ডোবা ও পতিত জলাশয়ে চাষযোগ্য।
২. কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সরপুটি মাছের পোনা উৎপাদন সম্ভব।
৩. রুই জাতীয় মাছের সাথে মিশ্র চাষ করা সম্ভব।
৪. ৪-৬ মাসের মধ্যেই বিক্রির উপযোগী হয়।
৫. সহজ ব্যবস্থাপনায় চাষ করা যায়।
৬. সরপুটি মাছ অপেক্ষাকৃত বিরূপ পরিবেশ চাষ সম্ভব।
৭. যে কোনো ধরণের খাবার খেতে সরপুটি মাছেরা অভ্যস্ত।
দেশি সরপুঁটির চাষের উৎপাদন নির্দেশিকা
১. পুকুর প্রস্তুতি পাবদা এবং গুলশা মাছ চাষের মতোই সম্পন্ন করতে হবে।
২. পুকুর প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর ৬-৮ গ্রাম ওজনের দেশি সরপুটির পোনা প্রতি শতাংশে ৬৫-৭০টি মজুদ করা যেতে পারে।
৩. সম্পূরক খাবার হিসেবে মাছের দৈহিক ওজনের ৬% হারে শুধু চালের মিহি কুঁড়া প্রতিদিন সরবরাহ করতে হয়।
৪. প্রতি মাসে মাছের নমুনায়ন করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
৫. প্রতি ১৫ দিন অন্তর পুকুরে ৪ কেজি পচা গোবর এবং ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টি.এস.পি সার প্রয়োগ করতে হয়।
৬. এ পদ্ধতি অবলম্বন করে মাছ চাষ করলে ৬ মাসে প্রতি শতাংশে ৫-৭ কেজি মাছ উৎপাদন করা সম্ভব।
5. কই মাছের চাষঃ
কই মাছের চাষে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ
১. কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে কই মাছের পোনা উৎপাদন সম্ভব।
২. কম অক্সিজেনযুক্ত পানিতে কই চাষ করা যেতে পারে। ৩. জলাশয়ে উচ্চ ঘনত্বে কই মাছ চাষ সম্ভব।
কই মাছের চাষে উৎপাদন নির্দেশিকা
১. পুর্বের মতোই পুকুর প্রস্তুতির কাজগুলো সেরে নিতে হবে।
২. পুকুরের চার পাশে ২ ফুট উচ্চতার বাঁশের বা পাট শলার বানা স্থাপন করতে হবে।
৩. ৪-৫ গ্রাম ওজনের কই মাছের পোনা শতাংশ প্রতি ৭০-৮০টি মজুদ করতে হবে।
৪. মাছ ছাড়ার পর চালের কুড়া (৬%), সরিষার খইল ও ফিশ্ মিল (২০%) এর মিশ্রণ মাছের দৈহিক ওজনের ৫-৬% হারে প্রতিদিন প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
৫. এছাড়া জৈব সার হিসেবে ১৫ দিন পর পর প্রতি শতাংশে ৮ কেজি হারে পচা গোবর পানিতে গুলে দিতে হবে।
৬. খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি জন্য প্রতি মাসে একবার মাছের নমুনায়ন করা আবশ্যক।
৭. কই মাছের একক চাষ করে ৫ মাসে প্রতি শতাংশে ২-৩ কেজি মাছ পাওয়া যেতে পারে।
৮. প্রাকৃতিক জলাশয় হতে ছোট মাছের প্রাপ্যতা ও আধিক্য দিন দিন ব্যাপকভাবে হরাস পাওয়ার কারণে চাহিদা মোতাবেক বাজারে ছোট মাছের সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে এ সমস্ত মাছের উৎপাদন বাড়ানো ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা সম্ভব। পাশাপাশি এ সব প্রজাতির মাছ, চাষের মাধ্যমে গ্রামীণ দারিদ্র জনগোষ্ঠি তাদের পারিবারিক দৈনন্দিন আমিষের চাহিদা পূরণসহ বাড়তি আয়ের সংস্থান করতে পারে।