প্রাথমিক কথা
সমন্বিত চাষাবাদের মধ্যে ধান ও মাছের চাষ সবচেয়ে উপযোগী ও লাভজনক। ধান চাষে আমন ও বোরো, উভয় মৌসুমেই ধান ও মাছের সমন্বিত চাষ করা যায়। ধান চাষাবস্থায় ধানক্ষেতে ধানের সাথে, আবার ধান কাটার পর পতিত অবস্থায় ধান ক্ষেতে মাছ চাষ করা যায়। উভয় ক্ষেত্রে জমি ও উপকরণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত হয়।
বর্তমানে যে সকল ধানের জাত চাষ করা হয় তাতে জমিতে সবসময় কিছু পানি ধরে রাখতে হয়। আবার ধান চাষের স্বার্থে জমির নিচু স্থানে, অথবা সুবিধামতো জমিতে গর্ত করে পানি সংরক্ষণ করতে হয়। এজন্য, ধানক্ষেতে মাছ চাষে বাড়তি কোনো খরচ ছাড়াই করা সম্ভব। ধানক্ষেতে মাছ চাষ করলে ধানের ফলন বাড়াতে সাহায্য করে। ক্ষেতে মাছ যে মল ত্যাগ করে তাতে সারের কাজ হয় ৷ ধান-মাছের সমন্বিত চাষাবাদ পদ্ধতিগতভাবে ব্যবস্থাপনা করা হলে ধানের ফলন ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
উপযোগী জমি
বৃষ্টি, বন্যা বা আকস্মিক ঢলে ডুবে বা ভেসে যায় না এমন জমিতে ধান-মাছের সমন্বিত চাষ করতে হবে। ব্যবস্থাপনার সুবিধের জন্য জমির পরিমাণ ৫০ থেকে ১০০ শতকের মধ্যে হলে ভালো হয়। কমপক্ষে ৩-থেকে ৫ মাস পর্যন্ত ১০ থেকে ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পানি সহজে ধরে রাখা যায় এমন জমি বেশি উপযোগী হবে।
ভৌত কার্যক্রম
ধানের সাথে মাছ চাষ করার জন্য জমির আইল উঁচু করা, জমিতে প্রয়োজনে গর্ত বা নালা খন করার প্রয়োজন হতে পারে। স্বাভাবিক ধান চাষের জমি থেকে ধানের সাথে মাছ চাষ করার জন্য জমির আইল ১৫-২০ ইঞ্চি পর্যন্ত উঁচু ও শক্ত করে বেঁধে নিতে হবে। জমির ঢালু অংশে, মোট জমির শতকরা ৩-৫ ভাগ স্থান জুড়ে ২-৩ ফুট গভীর একটি গর্ত করে নিতে হবে। জমির চারপাশের আইল ঘেঁষে ১ থেকে দেড় ফুট প্রশস্ত ও গভীর নালা করতে হবে। নালা প্রয়োজনে জমির মাঝ বরাবর অনেকগুলো নালা আড়াআড়িভাবেও করা যায়।
ধান চাষ ও ব্যবস্থাপনা
ধান ও মাছের সমন্বিত চাষে নিয়ম অনুযায়ী ক্ষেতে ধান রোপণ করতে হবে। যে জাতের ধান বেশি পানি সহ্য করার ক্ষমতা রাখে, ফলনও বেশি হয় সেই জাত রোপণ করতে হবে। আমন মৌসুমের জন্য বিআর ১১, বিআর ৩, বিআর ৩০ এবং বোরো মৌসুমে বিআর ১৪ ও বিআর ১৬ উপযোগী জাত। বোরো মৌসুমে ধানের উচ্চ ফলনশীর জাতের (উফসী সাথে ও মাছ চাষ করা যাবে।
ধানের বেশি ফলন পেতে নিয়মিত ক্ষেত্রের ও ধানের যত্ন নিতে হবে। আগাছা জন্মালে তা পরিষ্কার করতে হবে। ধানে পোকা-মাকড় জন্মালে দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। কীটনাশক ব্যবহার করা সমীচীন হবে না। পোকা-মাকড় দমনে “সমন্বিত বালাই নাশক” পদ্ধতিতে পোকা-মাকড় দমন করতে হবে। কীটনাশক ব্যবহার জরুরী হলে চাষাধীন মাছ রক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে। ক্ষেত্রের মাছ জলপথে তাড়িয়ে এনে গর্তে আটকিয়ে রাখতে হবে। পরে ক্ষেত শুকিয়ে কীটনাশক ছিটাতে হবে। এক সপ্তাহ পর কীটনাশকের বিষক্রিয়া কমে গেলে ক্ষেতে পানি দিয়ে পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক চাষাবাদের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
মাছ চাষ ও ব্যবস্থাপনা
ধানের সাথে মাছ চাষ করার জন্য যে মাছ অল্প সময়ে আশানুরূপ বড় হবে এবং সহজে ব্যবস্থাপনা করা যাবে সেগুলোই ছাড়তে হবে। যেমন: রাজপুটি, তেলাপিয়া, কমনকার্প, শিং মাগুর এসব মাছ ধানের সাথে চাষ করা লাভজনক। ঐ মাছের যে কোনো একটি এককভাবে, আবার রাজপুটি ও কমনকার্প এবং শিং ও মাগুরের মিশ্রচাষ করা যায়।
মাছের মজুদ হার
১. একক চাষে রাজপুটি প্রতি শতাংশে ১৫-২০টি।
২. একক চাষে কমনকার্প প্রতি শতাংশে ১০-১৫টি।
৩. রাজপুটি ও কমনকার্পের মিশ্রচাষে প্রতি শতাংশে ১২-১৫টি।
৪. একক চাষে শিং মাছ প্রতি শতাংশে ৩০-৩৫টি।
৫. একক চাষে মাগুর মাছ প্রতি শতাংশে ২৫-৩০টি।
৬. শিং ও মাগুর মাছের মিশ্রচাষে প্রতি শতাংশে ২৫-৩০টি।
পোনা মজুদের সময়
ক্ষেতে ধান রোপনের পর পরই পোনা মাছ ছাড়া যাবে না। রোপণের পর ধানের চারা মাটিতে শিকড় মেলে শক্ত হতে ও ধানের কুশী গজাতে ১০-১৫ দিন সময় লাগে। এজন্য, ১০-১৫ দিন পর পোনা মজুদ করতে হবে। তবে, ক্ষেতে গর্ত থাকলে বা করা হলে গর্তে পরিমিত পানি দিয়ে ধান রোপণের পরই পোনা মজুদ করা যায়। এ রূপ করাই অনেক ভালো।
মাছের জন্য বাড়তি খাদ্য
ধানের সাথে মাছ চাষ করলে মাছের জন্য সাধারণত বাড়তি কোনো খাদ্য লাগে না। ধানের গোড়ায় জন্মানো শেওলা, প্রাকৃতিক খাদ্যকণা, পোকা-মাকড়ের কীট, কিছু কিছু পোকা এবং ছোট ছোট আগাছা মাছ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করবে। প্রাকৃতিক ঐসব খাদ্যের অভাব হলে সামান্য চালের কুঁড়া, গমের ভূষি খাদ্য হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। এসব বাড়তি খাদ্য প্রতিদিনই গর্তে একই সময়ে ছিটিয়ে দিতে হবে।
মাছের রোগ ও চিকিৎসা
ধানের সাথে মাছ চাষ করলে মাছের তেমন কোনো রোগ হওয়ার ভয় নেই। ধান ও মাছ চাষের সময়সূচি মেনে চললে ধান কাটার পরপরই মাছ বড় হয়ে যাবে। এ অবস্থায় রোগ দেখা দিলে মাছ ধরে ফেলতে হবে। ধান কাটার পর সুযোগ অনুযায়ী আরো কিছুদিন মাছ চাষ অব্যাহত রাখলে ঐ অবস্থায় যদি মাছের রোগ হয় তাহলে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। ধানের মৌসুমের শেষের দিকে বিশেষ করে রাজপুটি মাছের ক্ষত রোগ হতে পারে। এ অবস্থায় ক্ষেতের মাছ গর্তে এনে শতাংশে ১ কেজি হারে চুন গুলে ছিটিয়ে দিতে হবে।
ধান কাটা ও মাছ ধরা
ক্ষেতে পানি থাকলে ধান কাটার পর মাছ ধরতে হবে। কোনো কারণে ক্ষেতের পানি কমে গেলে ধান থাকা অবস্থায় মাছ ধরে ফেলতে হবে। কিংবা মাছ গর্তে এনে মজুদ করতে হবে।
মাছের ফলন
পূর্বে বর্ণিত সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় ধানের মাছ চাষ করে একজন চাষী হেক্টর প্রতি ২৫০-৩০০ কেজি মাছ অতিরিক্ত উৎপাদন হিসেবে পেতে পারে। এতে একজন চাষী কমপক্ষে ১০-১২ হাজার টাকা মাছ থেকে এবং ৪-৫ হাজার টাকা ধান থেকে আয় করতে পারেন।
ধান ক্ষেতে পোনার চাষ
ধান ক্ষেতে কার্পিও, তেলাপিয়া, এমনকি রুই জাতীয় মাছের ধানী পোনা ছেড়েও আঙুলী পোনা উৎপাদন করা যায়। এক্ষেত্রে পোনার জন্য খইল ও কুড়া নিয়মিত খাবার হিসেবে দিতে হবে। ধানের জমিতে পোনার চাষের ক্ষেত্রে ধানী মজুদের হার শতাংশ প্রতি ৮০০- ১০০০টি হতে পারে।
ধানের পর মাছের চাষ
সাধারণত নিচু এলাকায় জমিতে একবার ধান চাষ করা হয়। ধান কাটার পর ঐ জমি পতিত থাকে। কিন্তু জমিতে ধানের মৌসুমের পর প্রচুর পানি জমে থাকে যাতে মাছ চাষ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রেও জমিকে ধান ও মাছের চাষের মতো কিছুটা উপযোগী করে তৈরি করে নিতে হবে।
বাঁধ নির্মাণ
জমির অবস্থান ও প্লাবনের মাত্রা অনুযায়ী জমিতে পাঁড় উঁচু করে শক্ত বাঁধ নির্মাণ করতে হবে, যাতে পাড় উপচে পানি ভিতরে প্রবেশ না করে অথবা বর্ষাকালে ভিতরের পানি বের না হতে পারে।
নিচু এলাকায় ধানি জমি প্রাকৃতিকভাবে ২-৩ দিকে উঁচু জমিতে ঘেরাও করা থাকে। এমন জমিতে একদিকে বাঁধ দিলেই মাছ চাষের উপযোগী জলাশয়ে পরিণত হয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, সেচ প্রকল্পের বাঁধ বা পোল্ডার অঞ্চলের অভ্যন্তরে ধানের পর জমি পতিত থাকে। এমন এলাকায় পানি নিয়ন্ত্রণ করে মাছ চাষের উপযোগী জলাশয়ে পরিণত করা যায়।
দেশে প্রায় ২৬ লক্ষ হেক্টর ধানী জমি আছে। এ থেকে মাছ চাষ উপযোগী জমি চিহ্নিত করে যৌথ উদ্যোগে মাছ চাষ করলে আরো অধিক মাছ উৎপাদন করা সম্ভব।
সংযোগ নালা খনন
নিচু এলাকায় মাছ চাষের জন্য স্থায়ী বাঁধ করলে পানি চলাচলের জন্য সংযোগ নালা রাখতে হবে। সংযোগ নালা চাষাধীন জলাশয়ের ভিতর ও বাইরের পানির সমতা রক্ষা করবে। মাছ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নালার মুখে জাল বা বাঁশের বানা এঁটে বন্ধ করে দিতে হবে।
মাছ চাষ
ধানের পরে মাছ চাষ করলে পুরো বর্ষাকালব্যাপী মাছ চাষ করা যায়। এ সময়ে ক্ষেতে পুকুরের মতো পানি থাকে। এজন্য রুই জাতীয় মাছের মিশ্রচাষ করা যাবে। পানির স্থায়িত্ব কম হলে রাজপুটি, তেলাপিয়া, কার্পিও, মিরর কার্পের চাষ করা ভালো।
পোনা মজুদের পর যথাযথ পোনার পরিচর্যা করতে হবে। মজুদের পর ৪-৬ মাস পর্যন্ত চাষের সময় পাওয়া যাবে। এ সময়ের মধ্যেই মাছ বাজারে বিক্রির উপযোগী হবে। বৃহদাকার ধানের মাঠে সমবায় ভিত্তিতে মাছচাষ
সাংগঠনিক ব্যবস্থা
ধান কাটার পর নিম্নাঞ্চল ও প্লাবন প্রবণ এলাকায় ধান ক্ষেতে প্লাবিত হয়ে বৃহৎ জলাশয়ের আকার ধারণ করে। এমন জলাশয়ে একক প্রচেষ্টায় মাছ চাষ করা কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ। মাছ চাষের মাধ্যমে এমন ধানি জমি ব্যবহার করতে সমাজ ভিত্তিক প্রচেষ্টায় মাছ চাষ সফল হবে।
বিশেষভাবে, বাঁধ ও পোল্ডার এলাকার অভ্যন্তরের ধানী জমিতে মাছ চাষের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। সমবায় বা সমাজভিত্তিক মাছ চাষ করে জমির মালিকেরা তার নিজ জমির হারাহারে মাছের লভ্যাংশ ভাগ করে নিতে পারেন। তবে, এ ধরণের উদ্যোগ সফল করতে সমবায়ীদের মধ্যে শক্ত ও আস্থাশীল সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
উন্মুক্ত জমি
১. বোরো মৌসুমে ধান চাষ হয় কিন্তু এপ্রিল-মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১ মিটার পানি থাকে।
২. পানির উৎসের সাথে সংযুক্ত অর্থাৎ নদী বা খালের সাথে যুক্ত, যাতে পানি সংগ্রহ করা যেতে পারে।
৩. চারদিকে গ্রাম বা রাস্তা বা বাঁধ দিয়ে ঘেরা।
8. জমির আয়তন কয়েক শত বিঘা।
ধানক্ষেত মাছ চাষের উপযুক্ত করা
১. যে দিকে পাড় নেই, সেদিকে পাড় বাঁধা বা বানা দিয়ে বেড়া দেওয়া।
২. পানি ধরে রাখার জন্য প্লুইচ গেইট তৈরি করা।
৩. জমির সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রায় ২% জমিতে গভীর করে ৫০-৬০ মিটার চওড়া খাল কাটা প্রয়োজন। যেখানে প্রয়োজনে ছোট মাছ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য অন্যান্য মাছ জমা থাকতে পারে। ৪. এ সব কাজ বোরো ওঠার পর পরই বর্ষার আগেই সম্পন্ন করতে হবে।
চুন প্রয়োগ
১. অন্যান্য প্রকার মাছ চাষের মতো এক্ষেত্রেও চুন প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
২. হেক্টর প্রতি ১৫০-২০০ কেজি চুন প্রয়োজন।
সার প্রয়োগ
১. চুন প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর ২৫০-৫০০ কেজি/হেক্টর হারে মুরগির বিষ্টা সার হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে।
২. এক্ষেত্রে অজৈব সার প্রয়োগের দরকার নেই।
পোনা মজুদ
১. ক্ষেতে প্রায় ১ মিটার পানি হলে পোনা মজুদ করা দরকার। পোনা সাধারণত বিগত বছরের হওয়া উচিত।
২. পোনার আকার ১২-১৫ সেন্টিমিটার বা তদূর্ধ।
৩. পোনা মজুদের পর অজৈব সার ইউরিয়া ৩,০৩৫ কেজি বা হেক্টর টি.এস.পি ২০-৩০ কেজি বা হেক্টর হারে উৎপাদন সময়কালে ৩-৪ বার প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
৪. এচাড়া জৈব সার ১৫০-২০০ কেজি বা হেক্টর প্রয়োগ করা হয় ৩-৪ বার।
সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ
১. চাউলের কুঁড়া, গমের ভূষি, খইল একত্রে মিশিয়ে বল আকারে দিতে হবে। জলাশয় অনুসারে অনেক জায়গায় খাবার দিতে হবে। যাতে সবাই খাবার পায়।
২. খইল ৩৫-৪০% এবং কুঁড়া (গমের+চাউলের) ৬০% হারে মিশ্রিত করতে হবে।
আহরণ
মাছ বিক্রিযোগ্য হলেই ক্রমান্বয়ে আহরণ করতে হবে। নতুবা পানি কমে গেলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। মজুদকৃত প্রজাতি ছাড়াও এ ধরনের ধানক্ষেতে মাছ চাষে বিভিন্ন অ-চাষকৃত মাছ যেমন পুটি, মলা, কই, শিং, শোল, ট্যাংরা ইত্যাদি পাওয়া যায়।
উৎপাদন
৬-৮ মাসের চাষ কালে হেক্টর প্রতি ১,৫০০-১,৮০০ কেজি মাছ উৎপন্ন হতে পারে। এছাড়া বেশ কিছু পরিমাণ অ-চাষকৃত মাছ উৎপন্ন হয়।