Skip to content

 

পরিপাক তন্ত্রের বিভিন্ন অংশের নাম, কাজ কি, গঠন, চিত্র ও প্রধান অংশ কয়টি? এবং খাদ্য পরিপাক পক্রিয়া (বিস্তারিত বর্ণনা)।

I. পরিপাক কি? পরিপাক তন্ত্র কাকে বলে? II. পৌষ্টিকনালি কি? III. (a) মুখ (Mouth) IV. (b) মুখগহ্বর (Buccal cavity) V. মুখগহ্বর কাক বলে? VI. (c) দাঁত (Tooth) VII. মানুষের দাঁতের সংখ্যা কয়টি? VIII. কোন দাঁত খাদ্য কাটার কাজ করে? IX. আক্কেল দাঁত কাকে বলে? X. দাঁতের প্রকারভেদঃ XI. দাঁতের বিভিন্ন অংশ বা গঠনঃ XII. দাঁত কি দিয়ে তৈরি হয়ঃ XIII. 4. গলবিল (Pharynx) XIV. 5. অন্ননালি ( Oesophagus ) XV. 6. পাকস্থলী (Stomach) XVI. পাকস্থলী কি? পাকস্থলির কাজ কি? XVII. 7. অন্ত্র (Intestine) XVIII. অন্ত্র কি? XIX. অন্ত্র কি কাজ করে/অন্ত্রের কাজ কি? XX. (i) ক্ষুদ্রান্ত (Small Intestine) XXI. (ii) বৃহদন্ত্ৰ (Large Intestine) XXII. (d) পায়ু (Anus) XXIII. পরিপাকতন্ত্র (Digestive glands) XXIV. পৌষ্টিক গ্ৰন্থি কি? XXV. পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন অংশের নাম, কাজ কি, গঠন ও প্রধান অংশ কয়টি? XXVI. (a) লালাগ্রন্থি (Saliyary glands) XXVII. লালাগ্রন্থি কি? লালাগ্রন্থি কয় জোড়া? লালাগ্রন্থি কয় প্রকার ও কি কি? XXVIII. (b) যকৃৎ (Liver) XXIX. যকৃৎ কি/কাকে বলে? XXX. যকৃতের গঠনঃ XXXI. যকৃতের কাজ কি? XXXII. (c) অগ্ন্যাশয় (Pancreas) XXXIII. অগ্ন্যাশয় কি? XXXIV. অগ্ন্যাশয় এর কাজ কি/ অগ্ন্যাশয় ফাংশনঃ XXXV. (d) গ্যাস্ট্রিকগ্রন্থি (Gastric glands) XXXVI. গ্যাস্ট্রিকগ্রন্থি কোথায় থাকে? XXXVII. (e) আন্ত্রিকগ্রন্থি (Intestinal glands) XXXVIII. আন্ত্রিকগ্রন্থি কোথায় থাকে? XXXIX. আন্ত্রিকগ্রন্থি থেকে কোন উৎসেচক ক্ষরিত হয়? XL. খাদ্য পরিপাক পক্রিয়া (Digestion of Food)

আজকে আমরা আলোচনা করবঃ

যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মানুষের পৌষ্টিক নালির অভ্যন্তরে জটিল, অদ্রবণীয়, অশোষণযোগ্য খাদ্য উপাদানগুলো নির্দিষ্ট উৎসেচক বা এনজাইম এবং প্রাণরস বা হরমোনের উপস্থিতিতে বিশ্লেষিত হয়ে শোষণযোগ্য এবং দ্রবণীয় সরল উপাদানে পরিণত হয়, তাকে পরিপাক বলে।

যে তন্ত্রের সাহায্যে খাদ্যদ্রব্য ভেঙে দেহের গ্রহণ উপযোগী উপাদানে পরিণত ও শোষিত হয়, তাকে পৌষ্টিকতন্ত্র বা পরিপাকতন্ত্র বলে।

মানবদেহ অসংখ্য কোষের সমন্বয়ে গঠিত। এই কোষগুলোকে সজীব এবং কার্যকর রাখতে হলে সময়মতো খাদ্য সরবরাহ প্রয়োজন। কিন্তু অধিকাংশ খাদ্য জটিল এবং জৈব যৌগ অবস্থায় গ্রহণ করা হয়। দেহের কোষগুলো তা সরাসরি গ্রহণ করতে পারে না। খাস্তকে শোষণযোগ্য ও কোষ উপযোগী করতে হলে তাকে ভেঙে সহজ, সরল এবং তরল অবস্থায় রূপান্তরিত করা আবশ্যক।

দেহে দুভাবে খাদ্য শোষিত হওয়ার উপযোগী হয়, যান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়া।

যান্ত্রিক প্রক্রিয়া: খাদ্ৰব্য মুখগহ্বরে দাঁতের সাহায্যে চিবানো হয়। প্রথমত চিবানোর ফলে খাদ্যবস্তু ছোট ছোট টুকরায় পরিণত হয়। পাকস্থলী এবং অস্ত্রের মধ্যে এই টুকরা খাদ্যবস্তুগুলো মন্ডে পরিণত হয়।

রাসায়নিক বিক্রিয়া: রাসায়নিক প্রক্রিয়া পরিপাকের দ্বিতীয় ধাপ। পরিপাক রসের এনজাইম খাদ্যের রাসায়নিক ক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে। এতে খাদ্যের জটিল উপাদানগুলো ভেঙে দেহের গ্রহণযোগ্য সরল উপাদানে পরিণত হয়। তাছাড়া কোষের ভিতরকার কর্মকাণ্ড এই এনজাইমের উপর নির্ভরশীল।

পরিপাকতন্ত্র বা পৌষ্টিক (Digestive System): খাদ্যদ্রব্য পরিপাকের জন্য মানবদেহে পরিপাকতন্ত্র বা পৌষ্টিকতন্ত্র নামে একটি আলাদা তন্ত্র আছে। যে তন্ত্রের সাহায্যে খাদ্যদ্রব্য ভেঙে দেহের গ্রহণ উপযোগী উপাদানে পরিণত ও শোষিত হয়, তাকে পৌষ্টিকতন্ত্র বা পরিপাকতন্ত্র বলে। এ তত্ত্বটি পৌষ্টিকনালি এবং কয়েকটি গ্রন্থি নিয়ে গঠিত। পৌষ্টিকনালি মুখ থেকে শুরু হয়ে পায়ুতে শেষ হয়।

মুখগহ্বর থেকে পায়ুপথ পর্যন্ত বিস্তৃত এই নালিপথ কোথাও সরু আবার কোথাও প্রশস্ত। যাকে পৌষ্টিকনালি বলা হয়।

পৌষ্টিকনালি এর প্রধান অংশগুলো নিম্নরূপ:.

(a) মুখ (Mouth)

মুখ থেকে পৌষ্টিকনালির শুরু হয়। এটি নাকের নিচে আড়াআড়ি একটি বড় ছিল, যেটি উপরে এবং নিচে ঠেটি দিয়ে বেন্টিত থাকে।

(b) মুখগহ্বর (Buccal cavity)

মুখগহ্বর কাক বলে?

মুখের অভ্যন্তরে দাঁত, জিহ্বা ও লালাগ্রন্থি থাকে। এগুলো প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে। দাঁত খাদ্যকে চিবিয়ে ছোট ছোট অংশে পরিণত করে। জিহ্বা খাদ্যবস্তুকে নেড়েচেড়ে চিবাতে সাহায্য করে এবং তার স্বাদ গ্রহণ করে। মুখের ভিতরের লালাগন্থি থেকে এনজাইম ক্ষরণ হয়। এই পিথলি- প্রন্থিগুলো কানের নিচে চোয়ালের পাশে এবং জিহ্বার নিচে অবস্থিত। লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত লালারসের মিউসিন খাদ্যকে পিচ্ছিল এপেনডিক্স- ডিওডেনাম বৃহদা করে গলধঃকরণে সাহায্য করে। লালারসের টায়ালিন ও মলটেজ নামক এনজাইম শর্করা পরিপাকে অংশ নেয়।

চিত্রঃ পরিপাকতন্ত্র

চিত্রঃ পরিপাকতন্ত্র

(c) দাঁত (Tooth)

মানুষের দাঁতের সংখ্যা কয়টি?

মানবদেহে সবচেয়ে শক্ত অংশ দাঁত। প্রাপ্ত বয়সে মুখগহ্বরে উপরে ও নিচের চোয়ালে সাধারণত 16 টি করে মোট 32 টি দাঁত থাকে। প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ৪ টি কর্তন দাঁত, 4টি ছেদন দাঁত, ৪ টি অপ্রপেষণ দাঁত, ৪টি পেষণ দাঁত এবং 0-4 টি আক্কেল দাঁত থাকে। মানবদেহে দাঁত দুবার পলায়। প্রথমবার শিশুকালে দুধদাঁত, দুধদাঁত পড়ে গিরে 18 বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার স্থায়ী দাঁত গজায়।

কোন দাঁত খাদ্য কাটার কাজ করে?

কৰ্ত্তন দাঁত খাদ্য কাটার কাজ করে। মানুষের ৪ টি কর্তন দাঁত থাকে।

আক্কেল দাঁত কাকে বলে?

মাড়ির সবচেয়ে পেছনের বা শেষের দাঁত দুটোকে আক্কেল দাঁত বলা হয়।

দাঁতের প্রকারভেদঃ

মানুষের স্থায়ী দাঁত চার ধরনের। সেগুলো হচ্ছে-

(i) কৰ্ত্তন দাঁত (Incisor): এই দাঁত দিয়ে খাবার কেটে টুকরা করা হয়।

(ii) ছেদন দাঁত (Canine): এই দাঁত দিয়ে খাবার ছেঁড়া হয়।

(ii) অপেষণ দাঁত (Premolar): এই দাঁত দিয়ে চর্বণ, পেষণ উভয় কাজ করা হয়।

(iv) পেষণ দাঁত (Molar): এই দাঁত খাদ্যবস্তু চর্বণ ও পেষণে ব্যবহৃত হয়।

চিত্রঃ বিভিন্ন ধরনের দাঁত, উপরের পাটি (বামে) এবং নিচের পাটি (ডানে)

চিত্রঃ বিভিন্ন ধরনের দাঁত, উপরের পাটি (বামে) এবং নিচের পাটি (ডানে)

দাঁতের বিভিন্ন অংশ বা গঠনঃ

প্রতিটি দাঁত যেসব দাঁতের বিভিন্ন অংশ বা গঠন তা হলো:

(i) মুকুট: মাড়ির উপরের অংশ;

(ii) মূল: মাড়ির ভিতরের অংশ;

(iii) গ্রীবা: দাঁতের মধ্যবর্তী অংশ;

দাঁত কি দিয়ে তৈরি হয়ঃ

দাঁত মূলত ডেন্টিন, এনামেল, দপ্তমজ্জা ও সিমেন্ট এই ৪ টি উপাদান দিয়ে তৈরি হয়।

(i) ডেন্টিন (Dentine) : দাঁত প্রধানত ডেন্টিন নামক শক্ত উপাদান দিয়ে গঠিত।

(ii) এনামেল (Enamel) : দাঁতের মুকুট অংশে ডেন্টিনের উপরিভাগে এনামেল নামক কঠিন উপাদান থাকে। এনামেল এবং ডেন্টিন ক্যালসিয়াম ফসফেট, ক্যালসিয়াম কার্বনেট এবং ফ্লোরাইড দিয়ে তৈরি।

(iii) দপ্তমজ্জা (pulp) : ডেন্টিনের ভিতরের ফাঁপা নরম অংশকে দন্কমজ্জা বলে। দপ্তমজ্জার মাধ্যমে ডেন্টিন অংশ পুষ্টি ও অক্সিজেন গঠন করে।

(iv) সিমেন্ট (Cement) : সিমেন্ট নামক পাতলা আবরণ দাঁতের মূল অংশ ডেন্টিনকে আবৃত করে রাখে। এই সিমেন্টের সাহায্যে দাঁত মাড়ির সাথে আটকানো থাকে।

চিত্রঃ দাঁতের লম্বচ্ছেদ

চিত্রঃ দাঁতের লম্বচ্ছেদ

4. গলবিল (Pharynx)

গলবিল কি: মুখগহ্বরের পরের অংশ গলবিল। মুখগহ্বর থেকে খাদ্যবস্তু গলবিলের মধ্য দিয়ে অন্ননালিতে পৌঁছে।

5. অন্ননালি ( Oesophagus )

অন্ননালি এর ইংরেজি হলো Oesophagus, গলবিল থেকে পাকস্থলী পর্যন্ত বিস্তৃত নালিটির নাম অন্ননালি। খাদ্যবস্তু এই নালির মধ্যে দিয়ে পাকস্থলীতে পৌঁছে।

6. পাকস্থলী (Stomach)

পাকস্থলী কি? পাকস্থলির কাজ কি?

অন্ননালি এবং ক্ষুদ্রান্ত্রের মাঝখানে একটি থলির মতো অঙ্গ। এর প্রাচীর পুরু ও পেশিবহুল। পাকস্থলীর প্রাচীরে অসংখ্য গ্যাস্ট্রিক গ্রন্থি থাকে। পাকস্থলীর পেশি সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে খাদ্যবস্তুকে পিষে মণ্ডে পরিণত করে। গ্যাস্ট্রিক গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রস খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে।

7. অন্ত্র (Intestine)

অন্ত্র কি?

পাকস্থলীর পরের অংশ অন্ত্র। এটি একটি লম্বা প্যাঁচানো নালি। অন্য দুটি প্রধান অংশে বিভক্ত, ক্ষুদ্রান্ত ও বৃহদন্ত্র।

অন্ত্র কি কাজ করে/অন্ত্রের কাজ কি?

(i) ক্ষুদ্রান্ত (Small Intestine)

পাকস্থলী থেকে বৃহদন্ত্র পর্যন্ত বিস্তৃত লম্বা, প্যাঁচানো নলটিকে ক্ষুদ্রান্ত্র বলে। ক্ষুদ্রান্ত্র আবার তিনটি অংশে বিভক্ত, ডিওডেনাম, জেজুনাম ও ইলিয়াম। ক্ষুদ্রান্ত্রের ডিওডেনামে পিত্তথলি থেকে পিত্তনালি এবং অগ্ন্যাশয় থেকে অগ্ন্যাশয় নালি এসে মিলিত হয়। পিত্তনালির মাধ্যমে যকৃতের পিত্তরস এবং অগ্ন্যাশয়ের অগ্ন্যাশয় রস ডিওডেনামে এসে পৌঁছে। ক্ষুদ্রান্ত্রের গায়ে আন্ত্রিক গ্রন্থিও থাকে। ক্ষুদ্রান্ত্রের অন্তঃপ্রাচীরে আঙুলের মতো প্রক্ষেপিত অংশ থাকে, এদের ভিলাস বলে। ভিলাস পরিপাককৃত খাদ্য উপাদান শোষণ করে।

(ii) বৃহদন্ত্ৰ (Large Intestine)

ইলিয়াম থেকে পায়ু পর্যন্ত বিস্তৃত মোটা নলাকৃতির অংশ হলো বৃহদন্ত্র। বৃহদন্ত্র তিনটি অংশে বিভক্ত, সিকাম, কোলন ও মলাশয়। সিকামের সাথে অ্যাপেনডিক্স নামক ক্ষুদ্র নলের মতো প্রবৃদ্ধি সংযুক্ত থাকে। বৃহদন্ত্রে মূলত পানি শোষিত হয়, মল তৈরি হয় এবং মল জমা থাকে।

(d) পায়ু (Anus)

পৌষ্টিক নালির শেষ প্রান্তে অবস্থিত ছিদ্রপথই হলো পায়ু।

পৌষ্টিক গ্ৰন্থি কি?

যেসব গ্রন্থির রস খাদ্য পরিপাকে অংশ নেয় তাদেরকে পরিপাকগ্রন্থি বা পৌষ্টিকগ্রন্থি বলে।

চিত্রঃ পৌষ্টিক বা গ্রন্থিপরিপাকতন্ত্র

চিত্রঃ পৌষ্টিকগ্রন্থি/পরিপাকতন্ত্র

পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন অংশের নাম, কাজ কি, গঠন ও প্রধান অংশ কয়টি?

(a) লালাগ্রন্থি (Saliyary glands)

লালাগ্রন্থি কি? লালাগ্রন্থি কয় জোড়া? লালাগ্রন্থি কয় প্রকার ও কি কি?

মানুষের তিন জোড়া লালাগ্রন্থি আছে। দুই কানের সামনে ও নিচে এক জোড়া (গ্যারোটিডগ্রন্থি), চোয়ালের নিচে একজোড়া (সাব-ম্যাক্সিলারি) এবং চিবুকের নিচে একজোড়া (সাব-শিয়ালগ্রন্থি)। এগুলো পৃথক পৃথক নালির মাধ্যমে মুখগহ্বরে উন্মুক্ত হয়। লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রস, লালা (saliva) নামে পরিচিত। লালা রসে টায়ালিন নামক এনজাইম এবং পানি থাকে।

(b) যকৃৎ (Liver)

যকৃৎ কি/কাকে বলে?

মধ্যচ্ছদার নিচে উদরপহারের উপরে পাকস্থলীর ডান পাশে যকৃৎ অবস্থিত। এটি মানবদেহের সবচেয়ে বড় গ্রন্থি। এর রং লালচে খয়েরি।

যকৃতের গঠনঃ

যকৃতের ডান খণ্ডটি বাম খণ্ড থেকে আকারে কিছুটা বড়। প্রকৃতপক্ষে চারটি অসম্পূর্ণ খন্ড নিয়ে যকৃৎ গঠিত। প্রতিটি খন্ড ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লোবিউল দিয়ে তৈরি। প্রত্যেকটি লোবিউলে অসংখ্য কোষ থাকে। এ কোষ পিত্তরস (bile) তৈরি করে।

পিত্তরস ক্ষারীয় গুণ সম্পন্ন। যকৃতে বিভিন্ন রকম জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, তাই একে রসায়ন গবেষণাগার বলা হয়। যকৃষ্ণের নিচের অংশ পিত্তথলি বা পিত্তাশয় সংলগ্ন থাকে। এখানে পিত্তরস জমা হয়। পিত্তরস গাঢ় সবুজ বর্ণের এবং তিন্তু স্বাদবিশিষ্ট। পিত্তথলি পিত্তনালির সাহায্যে অগ্ন্যাশয় নালির সাথে মিলিত হয়। এটি যকৃৎ-অগ্ন্যাশয় নালির মাধ্যমে ডিওডেনামে প্রবেশ করে।

যকৃতের কাজ কি?

যকৃৎ পিত্তরস তৈরি করে। পিত্তরসের মধ্যে পানি, পিও-লবণ, কোলেস্টেরল ও খনিজ লবণ প্রধান। এই রস পিত্তথলিতে জমা থাকে। প্রয়োজনে ডিওডেনামে এসে পরোক্ষভাবে পরিপাকে অংশ নেয়। পিত্তরসে কোনো উৎসেচক বা এনজাইম থাকে না। যকৃৎ উদ্বৃত্ত গ্লুকোজ নিজদেহে গ্লাইকোজেনরূপে সঞ্চয় করে রাখে।

পিত্তরস খাদ্যের অম্লভাব প্রশমিত করে এবং ক্ষারীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে। এই পরিবেশ খাদ্য পরিপাকের অনুকূল। কেননা আম্লিক পরিবেশে খাদ্য পরিপাক হয় না।

পিত্তরস চর্বিজাতীয় খাদ্যকে ক্ষুদ্র দানায় পরিণত করে, যা লাইপেজ সহযোগে পরিপাকে সহায়তা করে। অতিরিক্ত অ্যামাইনো এসিড যকৃতে আসার পর বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে ইউরিয়া, ইউরিক এসিড ও অ্যামোনিয়ারূপে নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য পদার্থ তৈরি করে এবং স্নেহজাতীয় পদার্থ শোষণে সাহায্য করে।

রক্তে কখনো গ্লুকোজের মাত্রা কমে গেলে যকৃতের সঞ্চিত গ্লাইকোজেনের কিছুটা অংশ গ্লুকোজে পরিণত হয় এবং রক্তস্রোতে মিশে যায়। এভাবে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকে।

(c) অগ্ন্যাশয় (Pancreas)

অগ্ন্যাশয় কি?

অগ্ন্যাশয় পাকস্থলীর পিছনে আড়াআড়িভাবে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ মিশ্রগ্রন্থি। এটি একাধারে পরিপাকে অংশগ্রহণকারী এনজাইম ও রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন নিঃসৃত করে। অর্থাৎ অগ্ন্যাশয় বহিঃক্ষরা ও অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির মতো কাজ করে। অগ্ন্যাশয়রস অগ্ন্যাশয় নালির মাধ্যমে যকৃৎ- অগ্ন্যাশয়নালি দিয়ে ডিওডেনামে প্রবেশ করে।

অগ্ন্যাশয় এর কাজ কি/ অগ্ন্যাশয় ফাংশনঃ

অগ্ন্যাশয় একাধারে পরিপাকে অংশগ্রহণকারী এনজাইম ও রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন নিঃসৃত করে। অর্থাৎ অগ্ন্যাশয় বহিঃক্ষরা ও অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির মতো কাজ করে। অগ্ন্যাশয়রস অগ্ন্যাশয় নালির মাধ্যমে যকৃৎ- অগ্ন্যাশয়নালি দিয়ে ডিওডেনামে প্রবেশ করে।

অগ্ন্যাশয় থেকে অগ্ন্যাশয়রস নিঃসৃত হয়। অগ্ন্যাশয়রসে ট্রিপসিন, লাইপেজ ও অ্যামাইলেজ নামক উৎসেচক থাকে। এসব এনজাইম শর্করা, আমিষ এবং স্নেহজাতীয় খাদ্যের পরিপাকে সহায়তা করে। তাছাড়াও অম্ল-ক্ষারের সাম্যতা, পানির সাম্যতা, দেহতাপ প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করে।

অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি হিসেবে অগ্ন্যাশয়ের একটি অংশ অতি প্রয়োজনীয় কিছু হরমোন, যেমন: গ্লুকাগন ও ইনস্যুলিন নিঃসরণ করে। গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় কাজে এ হরমোন দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(d) গ্যাস্ট্রিকগ্রন্থি (Gastric glands)

গ্যাস্ট্রিকগ্রন্থি কোথায় থাকে?

গ্যাস্ট্রিকগ্রন্থি পাকস্থলীর প্রাচীরে থাকে। এ গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রস (ট্রিপসিন, লাইপেজ, অ্যামাইলেজ) গ্যাস্ট্রিক রস বা পাচক রস নামে পরিচিত।

(e) আন্ত্রিকগ্রন্থি (Intestinal glands)

আন্ত্রিকগ্রন্থি কোথায় থাকে?

ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রাচীরে ভিলাইয়ে আন্ত্রিকগ্রন্থি থাকে।

আন্ত্রিকগ্রন্থি থেকে কোন উৎসেচক ক্ষরিত হয়?

আন্ত্রিকগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রসের নাম আন্ত্রিক রস।

যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মানুষের পৌষ্টিক নালির অভ্যন্তরে জটিল, অদ্রবণীয়, অশোষণযোগ্য খাদ্য উপাদানগুলো নির্দিষ্ট উৎসেচক বা এনজাইম এবং প্রাণরস বা হরমোনের উপস্থিতিতে বিশ্লেষিত হয়ে শোষণযোগ্য এবং দ্রবণীয় সরল উপাদানে পরিণত হয়, তাকে পরিপাক বলে। এ প্রক্রিয়ায় খাদ্য প্রথমত সরল দ্রবণীয় অবস্থায় রূপান্তরিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে কোষ আবরণীর ভিতর দিয়ে অতি সহজে কোষের ভিতরে প্রবেশ করে। সবশেষে রক্ত এই পরিপাককৃত সরল উপাদানগুলোকে দেহের বিভিন্ন অংশে সরবরাহ করে।

(a) মুখে পরিপাক

মুখগহ্বরে দাঁত ও জিহ্বার সাহায্যে খাদ্য চিবানোর ফলে খাদ্যবস্তু ছোট ছোট টুকরোয় পরিণত হয়। এ সময় লালাগ্রন্থি থেকে লালা নিঃসৃত হয়ে খাদ্যের সাথে মিশে যায়। লালা খাদ্যবস্তুকে গলাধঃকরণে সাহায্য করে। লালায় টায়ালিন বা স্যালাইভারি অ্যামাইলেজ নামক উৎসেচক বা এনজাইম থাকে। এটি শ্বেতসারকে মলটোজে পরিণত করে। মুখগহ্বরে আমিষ বা স্নেহজাতীয় খাদ্যের কোনোরূপ পরিবর্তন হয় না।

মুখগহ্বর থেকে খাদ্যদ্রব্য পেরিস্টালসিস (Peristalsis) প্রক্রিয়ায় অন্ননালির মধ্য দিয়ে পাকস্থলীতে প্রবেশ করে। পৌষ্টিক নালিগাত্রের পেশির পর্যায়ক্রমিক সংকোচন ও প্রসারণের ফলে খাদ্যদ্রব্য সামনের দিকে অগ্রসর হয়। অন্ননালিতে খাদ্যের কোনো পরিপাক ঘটে না।

(b) পাকস্থলীতে পরিপাক

পাকস্থলীতে খাদ্য আসার পর অন্তঃপ্রাচীরের গ্যাস্ট্রিকগ্রন্থি থেকে গ্যাস্ট্রিক রস ক্ষরিত হয়। এই রসে প্রধান যে উপাদানগুলো থাকে তা হলো:

হাইড্রোক্লোরিক এসিড: হাইড্রোক্লোরিক এসিড খাদ্যের মধ্যে কোনো অনিষ্টকারী ব্যাকটেরিয়া থাকলে তা মেরে ফেলে, নিষ্ক্রিয় পেপসিনোজেনকে সক্রিয় পেপসিনে পরিণত করে এবং পাকস্থলীতে পেপসিনের সুষ্ঠু কাজের জন্য অম্লীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে।

নিষ্ক্রিয় পেপসিনোজেন →  HCL → সক্রিয় পেপসিন

পেপসিন (Pepsin): এক ধরনের এনজাইম, যা আমিষকে ভেঙে দুই বা ততোধিক অ্যামাইনো এসিড দিয়ে তৈরি যৌগ গঠন করে, যা পলি পেপটাইড নামে পরিচিত।

আমিষ → পেপসিন → পলিপেপটাইড

শর্করা এবং স্নেহজাতীয় খাদ্য সাধারণত পাকস্থলীতে পরিপাক হয় না। কারণ এদের পরিপাকের জন্য গ্যাস্ট্রিক রসে নির্দিষ্ট কোনো এনজাইম থাকে না।

পাকস্থলীতে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছানো মাত্র উপরোক্ত রসগুলো নিঃসৃত হয়। পাকস্থলীর অনবরত সংকোচন ও প্রসারণ এবং এনজাইমের ক্রিয়ার ফলে খাদ্য মিশ্র মণ্ডে পরিণত হয়। একে পাকমণ্ড বা কাইম (chyme) বলে। এই মণ্ড অনেকটা স্যুপের মতো এবং কপাটিকা ভেদ করে ক্ষুদ্রান্ত্রে প্রবেশ করে।

(c) ক্ষুদ্রান্ত্রে পরিপাক

পাকস্থলী থেকে পাকমণ্ড ক্ষুদ্রান্ত্রের ডিওডেনামে প্রবেশ করে। এ সময় অগ্ন্যাশয় থেকে একটি ক্ষারীয় পাচকরস ডিওডেনামে আসে। এই পাচকরস খাদ্যমণ্ডের অম্লভাব প্রশমিত করে। পাচকরসের এনজাইম দিয়ে শর্করা এবং আমিষ পরিপাকের কাজ চলতে থাকে এবং স্নেহপদার্থের পরিপাক শুরু হয়।

যকৃৎ থেকে পিত্তরস নিঃসৃত হয়। এটি অত্নীয় অবস্থার খাদ্যকে ক্ষারীয় করে পরিপাকের উপযোগী করে তোলে। পিশু-লবণ স্নেহপদার্থের ক্ষুদ্র কণাগুলোকে পানির সাথে মিশতে সাহায্যে করে। পিশু-লবণ পিত্তরসের অন্যতম উপাদান। লাইপেজ নামক এনজাইমের কাজ যথাযথ সম্পাদনের জন্য পিত্ত লবণের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ লবণের সংস্পর্শে স্নেহপদার্থ সাবানের ফেনার মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানায় পরিণত হয়। স্নেহবিশ্লেষক লাইপেজ এই দানাগুলোকে ভেঙে ফ্যাটি এসিড এবং গ্লিসারলে পরিণত করে।

চিত্ৰঃ ইলিয়ামে দ্রবীভূত খাদ্য ও ব্রেহণদার্থের শোষণ
চিত্ৰঃ ইলিয়ামে দ্রবীভূত খাদ্য ও ব্রেহণদার্থের শোষণ

চিত্ৰঃ ইলিয়ামে দ্রবীভূত খাদ্য ও ব্রেহণদার্থের শোষণ

স্নেহপদার্থ → লাইপেজ →  ফ্যাটি এসিড + গ্লিসারল

অগ্ন্যাশয় রসে অ্যামাইলেজ, লাইপেজ ও ট্রিপসিন নামক এনজাইম থাকে। আর্থিক রসে আজিক অ্যামাইলেজ, লাইপেজ, মলটেজ, ল্যাকটেজ ও সুক্রেজ ইত্যাদি এনজাইম থাকে। আংশিক পরিপাককৃত আমিষ ক্ষুদ্রান্ত্রে ট্রিপসিনের সাহায্যে ভেঙে অ্যামাইনো এসিড এবং সরল পেপটাইডে পরিণত হয়।

পলিপেপটাইড → ট্রিপসিন → অ্যামাইনো এসিড +  সরল পেপটাইড

আ্যমাইলেজ শ্বেতসারকে সরল স্তরে শর্করায় পরিণত করে।

শ্বেতসার → আ্যমাইলেজ → গ্লুকোজ

পরিপাককৃত খাদ্য শোষণ: ক্ষুদ্রান্ত্রে সব ধরনের খাদ্যই সম্পূর্ণভাবে নির্দিষ্ট এনজাইমের ক্রিয়ায় পরিপাক হয়ে সরল, শোষণযোগ্য খাদ্য উপাদানে পরিবর্তিত হয়। ক্ষুদ্রান্ত্রের অন্তঃপ্রাচীরে অবস্থিত রক্তজালকসমৃদ্ধ আঙ্গুলের মতো প্রক্ষেপিত অংশ থাকে। একে ভিলাই বলে, আর একবচনে বলে ভিলাস। প্রতিটি ভিলাসের মাঝখানে ল্যাকটিয়াল নামক লসিকা-জালক রক্তের কৈশিক নালি দিয়ে পরিবেষ্টিত থাকে। ভিলাই ভাঁজে ভাঁজে থাকায় ইলিয়ামের প্রাচীরপাত্রের আয়তন বৃদ্ধি পায় এবং ব্যাপকভাবে পরিপাককার্য চলা সম্ভব হয়।

এসব রক্তনালি যুক্ত হয়ে হেপাটিক শিরা গঠন করে। এই শিরা দিয়ে শোষিত রন্তু ষকৃতে আসে। স্নেহপদার্থের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা ভিলাসের ল্যাকটিয়ালে শোষিত হওয়ার পর প্রথমে লসিকা দিয়ে বাহিত হয়ে রক্তস্রোতে মিশে। কোষে অনুপ্রবেশের পর পিত্ত লবণ ফ্যাটি এসিড থেকে পুনরায় পৃথক হয়ে যায়।

লসিকা: কৈশিক নালির মধ্যে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার সময় নালির প্রাচীর ছুঁয়ে জলীয় পদার্থ বের হয়। এই জলীয় পদার্থকে লসিকা বলে। লসিকা খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে কোষে পৌঁছে দেয় এবং দূষিত পদার্থ সংগ্রহ করে রক্তস্রোতে ফিরে আসে। শোষণের পর পাকমণ্ডের অবশিষ্টাংশ কোলনে পৌঁছে।

(d) বৃহদন্ত্রে পরিপাক

কোলনে পাকমণ্ডের কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া বা পরিপাক ঘটে না। তবে খাদ্যের অসার অংশের সাথে যে পানি থাকে, তা এখানে শোষিত হয়। তাছাড়া থাকে কিছু আমিষ, লিপিড, লবণ এবং উদ্বৃত্ত এনজাইম। এসব বস্তু থেকে বৃহদন্ত্র লবণ ও পানি শোষণ করে রক্তে স্থানান্তরিত করে। ফলে উচ্ছিষ্ট খাদ্য ঘনীভূত হয়ে মলে পরিণত হয়। এই মল মলাশয়ে জমা থাকে এবং প্রয়োজনমতো পায়ুপথ দিয়ে বের হয়ে আসে।

আত্তীকরণ: শোষিত খাদ্যবস্তুর প্রোটোপ্লাজমে পরিণত বা রূপান্তরিত করার পদ্ধতি হলো আত্তীকরণ। এটা একটি গঠনমূলক বা উপচিতি প্রক্রিয়া। কোষের প্রোটোপ্লাজম নিঃসৃত এনজাইমের সহযোগিতায় সরল খাদ্য জটিল উপাদানে পরিণত হয়। যেমন অ্যামাইনো এসিড, গ্লুকোজ, ফ্যাটি এসিড এবং গ্লিসারল রক্তের সাহায্যে দেহের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং এসব স্থানে প্রোটোপ্লাজম নিঃসৃত এনজাইমের প্রভাবে আমিষ, স্নেহ এবং শর্করা তৈরি হয়। এভাবে প্রোটোপ্লাজম কোষের ক্ষয়পূরণ ও গঠনে সহায়তা করে এবং তার ফলে দেহের বৃদ্ধি ঘটে।

Copyright Notice

কপি করা নিষিদ্ধ!