পশু পালনের গুরুত্বঃ
⇾ বাংলাদেশের আবহাওয়া পশুসম্পদ উন্নয়নের জন্যে যথেষ্ট উপযোগী। এখানকার গোটা আবহাওয়া গরু, মহিষ, ছাগল ইত্যাদি পশুর যথাযথ দৈহিক বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জনের সহায়ক। অতিরিক্ত তাপমাত্রা কিম্বা অতিরিক্ত শীত দুটোই পশু সম্পদ উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। সেদিক থেকে বাংলাদেশের তাপমাত্রা, আবহাওয়া, জমির ধরণ, পরিবেশ অত্যন্ত অনুকূলে।
‘⇾ স্টেটিস্টিক্যাল ইয়ার বুক’ ১৯৯৬ এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে গরুর সংখ্যা ২ কোটি ২৪ লক্ষ ৯৮ হাজার, ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ১ কোটি ৪৪ লক্ষ ৭৬ হাজার এবং হাঁস-মুরগির সংখ্যা ৭ কোটি ৬৪ লক্ষ ৪৬ হাজারটি। এই তথ্যটির উৎস ১৯৮৩-৮৪ সনে অনুষ্ঠিত কৃষি পশু-পাখী জরীপ প্রতিবেদন, এর পর আর কোন বাস্তব জরীপ অনুষ্ঠিত হয়নি।
⇾ পশু সম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যাদি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগির সংখ্যা বর্তমান সময়ে আরো বেশি। তাছাড়া বর্তমানে গরু, মহিষ, ছাগল-ভেড়া, হাঁস-মুরগি পালনের বিষয়টি পারিবারিক পর্যায় থেকে শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ গ্রাম কিম্বা শহর সকল স্তরের জনগণই কোন না কোন ভাবে জড়িত। কেউ পারিবারিক ভাবে আবার কেউ ব্যবসায়িক ভাবে পশুপালনের সাথে জড়িত। একই সময় কেউ উৎপাদিত পশু, পশুর মাংস, দুধ, চামড়া ইত্যাদি বিপণনে জড়িত। আবার কেউ বা এসব সম্পদ ভোগের সাথে জড়িত।
⇾ পশুপালন মানব সভ্যতার আদিকাল থেকে চলে আসছে। তবে পশুপালনের উদ্দেশ্য, দৃষ্টি ভংগী, পদ্ধতি আর প্রযুক্তির পরিবর্তন এসেছে সময়ের সাথে তাল রেখে। একই ভাবে পরিবর্তন এসেছে খাদ্য সরবরাহ আর ব্যবস্থাপনার কৌশলে। আধুনিক বিজ্ঞানের বদৌলতে পশুর জাত উন্নয়ন, খাদ্যের গুণাগুণ বিচার, রোগ প্রতিরোধের পন্থা আর রোগাক্রান্ত পশুর চিকিৎসা ইত্যাদি সম্ভব হয়েছে।
⇾ পশু পালনের গুরুত্বের বিষয়টি আজ সর্বজন স্বীকৃত। পারিবারিক, সামাজিক কিম্বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পশু পালনের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে গৃহীত হচ্ছে পশু সম্পদ উন্নয়নে নানাবিধ কর্মসূচী। আজ দুধ বিক্রেতার সাথে কারো আত্মীয়তা করতে আপত্তি নেই। পশুপালন চিহ্নিত হয়েছে একটি সম্মানজনক উৎপাদন কার্যক্রম হিসেবে। পশুপালনের গুরুত্বকে নানা ভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। আলোচনার সুবিধার্থে কতিপথ উল্লেখযোগ্য উপ-শিরোনামে তা বর্ণিত হলো।
১. হালচাষে পশুর গুরুত্ব
⇾ বাংলাদেশে আবাদী জমির পরিমান ২ কোটি ১ লক্ষ ৫৭ হাজার ৫৬৪ একর। বিগত ১৯৮৩- ৮৪ সনে অনুষ্ঠিত কৃষি ও পশুসম্পদ জরীপের এই তথ্যের পাশাপাশি সর্বশেষ ১৯৯৩-৯৪ সনের জমির ব্যবহার তথ্যানুযায়ী—
জমির ধরণ | জমির পরিমাণ |
১. চাষের অযোগ্য জমি ২. বনাঞ্চল জমি ৩. চাষযোগ্য পতিত জমি ৪. এক ফসলী জমি ৫. দুফসলী জমি ৬ তিন ফসলী জমি | ১,০৩,৫৫,০০০ একর ৪৬, ৭৩,০০০ একর ১৫,৬৮,০০০ একর ৭২,২৯,০০০ একর ৯৪,৯৭,০০০ একর ২৩,৬৪,০০০ একর |
⇾ দেশের জনসংখ্যার তুলনায় মাথাপিছু চাষযোগ্য জমির পরিমান মাত্র ২৫ শতাংশ, যার উপর ভিত্তি করে গোটা চাষ ব্যবস্থার যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব নয়। ছোটছোট জমিতে যান্ত্রিক চাষ যেমন সমস্যা, তেমনি দেশের বিরাট বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের দিক থেকে বিবেচনা করলেও তা সম্ভব নয়।
⇾ বেকার জনগোষ্ঠীকে কাজে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে সমস্ত আবাদযোগ্য এবং আবাদী জমিতে কৃষি নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থাকে সচল রাখতে হলে পশুর ভূমিকা অনেক। বাংলাদেশের সকল চাষীই গরু-মহিষ কিম্বা কোথাও কোথাও ঘোড়ার সাহায্যে চাষাবাদ করে থাকে। পুরুষানুক্রমিক ভাবেই বাংলাদেশের জমির চাষ ব্যবস্থা পশুর উপর নির্ভরশীল। তাই কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে হালচাষে পশুর গুরুত্ব অপরিসীম।
২. পুষ্টি চাহিদা পূরণে পশুর গুরুত্ব
⇾ একজন মানুষের দৈহিক বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ ও কর্মক্ষম থাকার জন্যে যে পরিমাণ খাদ্য উপাদান বা পুষ্টির চাহিদা আমরা তা পাইনা। পুষ্টি বিজ্ঞানের ভাষায় আমিষসহ অন্যান্য খাদ্য উপাদান যথাযথ মানে ও পরিমাণে পাওয়া না গেলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং নানাবিধ রোগ আক্রমণ করতে পারে। আর সকল খাদ্য উপাদানের মধ্যে আমিষই হচ্ছে প্রধান। এই আমিষ আবার দুভাগে বিভক্ত—উদ্ভিজ আমিষ ও প্রাণীজ আমিষ। মাংস ও দুধ প্রাণীজ আমিষের প্রধান যোগান দিয়ে থাকে। তাছাড়া কার্বোহাড্রেট, স্নেহ পদার্থ ইত্যাদি খাদ্য উপাদানও মাংস এবং ডিম থেকে পাওয়া যায়। তাই পুষ্টি চাহিদা পুরণেও পশুর গুরুত্ব অনেক বেশি।
৩. চামড়ার যোগানে পশুর গুরুত্ব
⇾ চামড়ার ব্যবহার বিশ্বব্যাপী প্রচলিত। ব্যবহারের ধরণ নানাবিধ, নানা প্রকার এবং উদ্দেশ্যও বহুমাত্রিক। জুতা, ব্যাগ, শীত বস্ত্র, মানিব্যাগ, পার্স ইত্যাদি বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরির কাজে চামড়ার ব্যবহার দেখা যায়। তাছাড়া কোন কোন সময় কোন কোন দেশে আদিকালে তাবু তৈরিতেও চামড়ার ব্যবহারের কথা জানা যায়। কোথাও কোথাও আবার গৃহস্থালী আসবাবপত্র এবং সাজশয্যামূলক দ্রব্যাদি তৈরিতে চামড়ার ব্যবহার হতে দেখা যায়। রপ্তানী আয় অর্জনেও চামড়ার ভূমিকা অনেক। এই বহুবিধ ব্যবহার উপযোগী চামড়ার যোগান আসে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি থেকে। বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটির মতো গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া আছে বলে এক তথ্যে জানা যায়।
⇾ দেশিয় ভাবে চামড়ার ব্যবহার দিনের পর দিন ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হতে চলেছে। পাশাপাশি চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যাদি দেশের উল্লেখযোগ্য রপ্তানী পণ্য হিসেবেও চিহ্নিত। পশুর চামড়ার উৎপাদন বাড়াতে হলে পশুপালনের উদ্যোগকে আরো জোরদার করতে হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। দেশিয় ব্যবহারকে আরো জোরদার করে যেমন আমরা দেশের আমদানী ব্যয় কমাতে পারি, তেমনি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানী করে বাড়াতে পারি আমাদের রপ্তানী আয়ের পরিমাণ। সুতরাং চামড়ার যোগানের ব্যাপারে পশুর গুরুত্ব সর্বজন স্বীকৃত।
৪. পরিবহণ ও ঘানি টানায় পশুর গুরুত্ব
⇾ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ফসলের মাঠ থেকে ফসল বাড়িতে আনার কাজে, কিম্বা বাড়ি থেকে বিপননযোগ্য মালামাল বাজারে নিয়ে যেতে, কিম্বা হাট থেকে হাটে মালামাল আনা নেয়া করতে গরুর গাড়ীর প্রচলন যথেষ্ট ভাবে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। আবার কোথাও এই মালবাহী গাড়ী টানার কাজে গরুর বদলে মহিষ বা ঘোড়াও ব্যবহার হতে দেখা যায়। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে এর ব্যবহার অত্যন্ত পরিচিত। সকাল দুপুর রাত সর্বদাই গাড়ীর চাকার ক্যারাত্ ক্যারাত্ শব্দ ভেসে আসে কানে। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকার হাওড় কিম্বা বিলের ফসল আনার ব্যাপারেও গরুর গাড়ী ব্যবহার হয়।
⇾ সরিষা, তিল, বাদাম থেকে ঘানির সাহায্যে তৈল আহরণে ঘোড়া কিম্বা গরুর ব্যবহার সারাদেশেই কম বেশি দেখা যায়। সকাল বিকাল কিম্বা রাত্রির স্বাভাবিক শব্দের ভেতর থেকে ভেসে আসতে শোনা যায় ঘানি টানার শব্দ। দেশের গোটা তৈল উৎপাদনের একটা উল্লেখযোগ্য উৎপাদন কাজ সম্পন্ন হয় ঘানির দ্বারা। আর এ ঘানি টানায় গরু কিম্বা ঘোড়ার কোন বিকল্প নেই। গরুর গাড়ী আর ঘানি টানার পরিচিত শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে গান ধরে সেই কুলো কিম্বা গাড়ীয়াল। আবার সেই গাড়ীয়ালকে লক্ষ্য করে কুল-নারীর কন্ঠে ধ্বনিত হতে শোনা যায় ওকি গাড়ীয়াল ভাই —।
⇾ একদিন যানবাহন হিসেবেও ঘোড়ার মতো পশুর ব্যবহার ছিলো উল্লেখযোগ্য। ঘোড়ার গাড়ী আজো দেখা যায় নগর, শহর কিম্বা শহরতলীতে। গরুর গাড়ীতে করে অনেক লোকজনকে আজো এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যেতে দেখা যায়। কাপড়ের পর্দা ছাউনির সাথে ঝুলিয়ে কুল বধুদের বাপের বাড়ি কিম্বা বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যাবার দৃশ্যটা আজো উত্তরাঞ্চলে বেশ পরিচিত। তবে দিনে দিনে এর প্রচলন কিছুটা কমে আসলেও আজো তা উল্লেখ করার মতো।
⇾ পরিবহন কাজে, যানবাহন হিসেবে কিম্বা গাড়ী টানার কাজে পশুর গুরুত্ব আমাদের দেশে যথেষ্ট উল্লেখ করার মতো। তাই পশুপালনের প্রয়োজনীয়তা আর গুরুত্ব বিবেচনা করে এর উন্নয়নে সবার অংশ গ্রহণ বাঞ্চনীয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পশুসম্পদের ভূমিকা
⇾ বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে পশুসম্পদের ভূমিকা অনেক বেশি। অথচ আমাদের দেশে পশুর সংখ্যা ও তাদের গুনগত মান মোটেই সন্তোষজনক নয়। গরু মহিষ আমাদের চাষাবাদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উন্নত দেশে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো স্বল্প ও ক্ষুদ্রাকার জমির ক্ষেত্রে তা তেমন উপযোগী নয়।
⇾ এখনো আমাদের দেশে যান্ত্রিক চাষাবাদ তেমন প্রসার লাভ করেনি, কারণ কৃষি প্রযুক্তির আর্থি মূল্য অনেক বেশি, সকল কৃষকগণ যা বহন করতে পারছেন না। আর জমি যেভাবে দিনের পর দিন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম হয়ে যাচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে যান্ত্রিক চাষাবাদের সম্ভাবনা তেমন নেই। তাই চাষাবাদের জন্যে আমাদের গরু মহিষের উপর নির্ভর করতে হয়। আমাদের দেশের লোকসংখ্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। আর বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার জন্যে প্রয়োজন বেশি পরিমাণ খাদ্যের জোগান। তাই বর্তমান খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা মেটাতে দুধ ও মাংসের চাহিদা অনেক বেশি। একজন সুস্থ মানুষের যে পরিমাণ প্রাণীজ আমিষ পরিমাণ আমরা তা পাইনা।
⇾ ইতিপূর্বে পশুর গুরুত্ব আলোচনায় যেসব কথা বলা হয়েছে তা থেকেই প্রমাণিত হয় যে, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে পশুসম্পদের ভূমিকা অত্যন্ত বেশি ও কার্যকর। তবে পশুসম্পদ ব্যবস্থাপনায় যতোটা সম্ভব আমাদের সকলেকে জ্ঞান দক্ষতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এদেশে একদিন এমন সমাজ ব্যবস্থা ছিলো যখন একজন ভদ্র সমাজের কেউ হাটে দুধ বিক্রি করবে তা ভাব যেতো না। আজ তা পাল্টে গেছে। দুধ আর মাংসের বিপনন আজ আর কোন প্রকার সামাজিক বাঁধার সম্মুখীন নয়।
⇾ গ্রাম্য বা শহুরে, শিক্ষিত বা অশিক্ষিতি, পুরুষ বা মহিলা, শ্রমিক বা চাকুরে, ধনী বা গরীব প্রত্যেকেই পশু পালনে এগিয়ে আসার মানসিকতা সম্পন্ন। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পশু সম্পদের ভূমিকা স্বপ্রমানিত। কেবল এ বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান-দক্ষতার অভাবে, কোন কোন ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা আবার কোন কোন পুঁজির অভাবে ইচ্ছে থাকলেও একাজে সম্পৃক্ত হতে পারছেনা অনেকেই। সুতরাং জ্ঞান-দক্ষতা বাড়াতে, সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করতে আর পুঁজির চাহিদা মিটাতে সরকারী, বেসরকারী সংস্থা কিংবা ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। তবেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পশু সম্পদের ভূমিকা কার্যকর হতে পারে।