Skip to content

 

বড় শিরক ও ছোট শিরকঃ শিরক কাকে বলে? শিরক কি ও কেন? + শিরক থেকে বাঁচার দোয়া, আমল ও উপায় কি? শিরক পরিহার করার উপায় সমূহ বর্ণনা কর + শিরক কয়/কত ধরনের? শিরক এর প্রকারভেদ।

বড় শিরক ও ছোট শিরক কাকে বলে কি ও কেন থেকে বাঁচার দোয়া আমল ও উপায় পরিহার করার শিরক ধরনের

এই আর্টিকেলটি পড়লে জানতে পারবেন-
বড় শিরক ও ছোট শিরকঃ
শিরক কাকে বলে? শিরক কি ও কেন?
শিরক থেকে বাঁচার দোয়া, আমল ও উপায় কি? শিরক পরিহার করার উপায় সমূহ বর্ণনা কর।
শিরক কয়/কত ধরনের? শিরক এর প্রকারভেদ

আজকে আমরা আলোচনা করবঃ

বড় শিরকের অর্থ হচ্ছে, আকীদা-বিশ্বাস, কথা-বক্তব্য কিংবা আমল-আচরণের মাধ্যমে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বানানো। আল্লাহকে যেভাবে ডাকা হয় তাকে তেমনিভাবে ডাকা। তার জন্য কোনো ইবাদত নির্দিষ্ট করা হয়। যেমন, সাহায্য প্রার্থনা, জবেহ, নজর-নেয়াজ, মানত প্রভৃতি। 

সহিহ বুখারি ও মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, 

আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রশ্ন করলাম : সবচেয়ে বড় গুনাহ কি ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার পক্ষে আল্লাহর কোনো সমকক্ষ নির্ধারণ করা, অথচ তিনি তোমায় সৃষ্টি করেছেন। (বুখারি ও মুসলিম)

বড় শিরকের বিশেষ বিশেষ প্রকাশঃ

১। দোয়ার মধ্যে শিরক : 

অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে দোয়া করা, কোনো কিছু ঝাঞ্ছা করা। যেমন, নবী কিংবা আউলিয়াদের কাছে, রিযিক বৃদ্ধি, রোগ মুক্তি, অভাব দূরীকরণ ইত্যাদির জন্য দোয়া করা। 

আল্লাহ তাআলা বলেন :

আর আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুকে ডেকো না, যা তোমার উপকার করতে পারে না এবং তোমার ক্ষতিও করতে পারে না। যদি তুমি (এমনটি) কর, তাহলে নিশ্চয় তুমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা ইউনুস : আয়াত ১০৬)

আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দোয়া করা শিরক। যেমন মৃত ও আউলিয়াদের কাছে দোয়া করা।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে ডাকছ তারা খেজুরের আটির আবরণেরও মালিক নয়। যদি তোমরা তাদেরকে ডাকো, তারা তোমাদের ডাক শুনবে না; আর শুনতে পেলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দেবে না। আর কেয়ামতের দিন তারা তোমাদের শরিক করাকে অস্বীকার করবে। আর সর্বজ্ঞ আল্লাহর ন্যায় কেউ তোমাকে অবহিত করবে না। (সূরা ফাতির : আয়াত ১৩ ও ১৪) 

২। আল্লাহর গুণের ক্ষেত্রে শিরক: 

যেমন, আম্বিয়া কিংবা আওলিয়াগণ গায়েব জানেন মর্মে বিশ্বাস করা।

আল্লাহ বলেন,

এবং তাঁর নিকটেই গায়েবের চাবিকাঠিসমূহ, তিনি ছাড়া কেউই তা জানে না।  (সূরা আনআম : আয়াত ৫৯) 

৩। মহব্বতের ক্ষেত্রে শিরক : 

আল্লাহকে ভালবাসার মত কোনো ওলীকে ভালবাসা। 

আল্লাহ তাআলা বলেন :

আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালবাসার মত ভালবাসে। আর যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লঅহর জন্য ভালবাসায় দৃঢ়তর। (সূরা বাকারা: আয়াত ১৬৫) 

৪। আনুগত্যের ক্ষেত্রে শিরক : 

যেমন, পাপের ক্ষেত্রে কোনো আলেম অথবা কোনো পীরের আনুগত্য করা , এই ধারণায় যে তারা ঠিকই করছে। 

আল্লাহ বলেন :

তারা (খৃষ্টানরা) আল্লাহকে ছেড়ে তাদের আলেম ও আবেদদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে। (সূরা তাওবা: আয়াত ৩১) 

এ আনুগত্যের ব্যাখ্যা হল, তারা পাপের ক্ষেত্রেও তাদের আনুগত্য করত, যেমন আল্লাহ তাআলার নির্দেশিত হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল জ্ঞান করত। 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : 

স্রষ্টার অবাধ্যতার কাজে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না। (আহমদ, সহিহ )      

৫। হুলুলের ক্ষেত্রে শিরক : 

অর্থাৎ এমন ধারণা পোষণ করা যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে অবস্থান করছেন। তাদের মাঝে দ্রবীভূত হয়ে গেছেন। এটা অনেক সূফি-পীরদের ধারণা। যেমন ইবনে আরাবী বলেন, রবই দাস আর দাসই রব। হায়… তাহলে সালাত, সিয়ামের দ্বারা কি লাভ হবে? অন্য একজন বলেছেন : কুকুর শুকরও আল্লাহ ছাড়া কিছু না। মন্দিরের ঋষিও আল্লাহ। (নাউযুবিল্লাহ )। 

৬। দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ-পরিচালনার ক্ষেত্রে শিরক : 

এমন বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহর এমন অনেক ওলী আছেন যারা এ সৃষ্টিজগতকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। তাদেরকে কুতুব বলা হয়। অথচ আল্লাহ তাআলা পূর্বেকার মুশরিকদের প্রশ্ন করেছিলেন :

(যদি প্রশ্ন কর) কে সব বিষয় পরিচালনা করেন? তখন তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। (সূরা ইউনুস : আয়াত ৩১) 

৭। শাসন ও বিচার- ফয়সালার ক্ষেত্রে শিরক : 

যেমন, ইসলাম বিরোধী আইন প্রনয়ণ ও তাকে জায়েয মনে করা। অথবা এমন ধারণা পোষণ করা যে, বর্তমান যুগে ইসলামী আইন চলতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আইন প্রণেতা-রাজা এবং গ্রহীতা-প্রজা উভয়েই অন্তর্ভুক্ত।

১. বড় শিরক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পূর্বেকৃত সকল নেক আমল নষ্ট করে দেয়

আল্লাহ তাআলা বলেন, 

অবশ্যই আমি তোমার কাছে এবং যারা (নবীরা) তোমার পূর্বে ছিল তাদের কাছে এ  মর্মে ওহী পাঠিয়েছি যে, যদি শিরক কর তাহলে অবশ্যই তোমার আমল নষ্ট হয়ে যাবে। এবং অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে। (সূরা যুমার, আয়াত ৬৫) 

২. বড় শিরক আল্লাহ তাআলা তওবা ছাড়া মাফ করেন না 

আল্লাহ তাআলা বলেন :

নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমা করেন না তাঁর সাথে শিরক করাকে এবং এ ছাড়া যাকে চান ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শিরক করে সে তো ঘোর পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হল। (সূরা নিসা: আয়াত ১১৬) 

শিরকের অনেক শ্রেণী বিভাগ আছে। তার মাঝে কোনোটা বড় আবার কোনোটা ছোট। সকলের উপর ওয়াজিব হল, সর্ব প্রকার শিরক হতে সাবধান থাকা। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এই দোয়া শিখিয়েছেনঃ

হে আল্লাহ! আমরা তোমার কাছে জেনে- বুঝে শিরক করা হতে পানাহ চাই। এবং অজানা শিরক হতে ক্ষমা চাই। (আহমদ, হাসান)। 


৩. আল্লাহকে ছেড়ে যারা অন্যকে ডাকে তাদের দৃষ্টান্ত

হে মানুষ, একটি উপমা পেশ করা হল, মনোযোগ দিয়ে তা শোন, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না। যদিও তারা এ উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়। আর যদি মাছি তাদের কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে  নেয়, তারা তার কাছ থেকে তাও উদ্ধার করতে পারবে না। অন্বেষণকারী ও যার কাছে অন্বেষণ করা হয় উভয়েই দুর্বল। (সূরা হজ : আয়াত ৭৩) 

এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা সমস্ত মানুষদের সম্বোধন করে বলেছেন, যে সব ওলীআল্লাহ বা নেককার ব্যক্তিদেরকে তোমরা তাদের মৃত্যুর পর তোমাদের সাহায্য করার জন্য ডাকছো, কক্ষণোই তারা তা করতে সমর্থ হবে না। আর যদি কোনো মাছি তাদের খাদ্য দ্রব্য বা পানীয় ছিনিয়ে নিয়ে যায় তারা তা তাদের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। এটা তাদের দুর্বলতার প্রমাণ এবং মাছিরও দুর্বলতা । তাহলে কেমন করে-কোন যুক্তিতে তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে তাদেরকে ডাক? যারা আল্লাহকে কোনো নবী বা ওলীদের ডাকে এ উপমা তাদের জন্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে এ অসার কাজ হতে প্রচন্ডভাবে নিষেধ করেছেন।

২। আল্লাহ রাববুল ইযযত বলেন :

সত্যের আহ্বান তাঁরই, আর যারা তাকে ছাড়া অন্যদেরকে ডাকে, তারা তাদের ডাকে সামান্যও সাড়া দিতে পারে না, বরং (তাদের দৃষ্টান্ত) ঐ ব্যক্তির মত, যে পানির দিকে তার দু’হাত বাড়িয়ে দেয় যেন তা তার মুখে পৌঁছে অথচ তা তার কাছে পৌঁছবার নয়। আর কাফেরদের ডাক তো শুধু ভ্রষ্টতায় পর্যবসিত হয়।(সূরা রাদ : আয়াত ১৪) 

উপরোক্ত আয়াত থেকে আমরা এই শিক্ষাই পাই যে, দোয়া হল ইবাদত। তা কেবল আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। যারা আল্লাহকে ছেড়ে অন্যকে ডাকছে, তাদের কাছ থেকে তারা কোনো উপকার পায় না এবং কোনো ব্যাপারেই তারা তাদের উত্তর দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। এ উদাহরণ হুবহু সে ব্যক্তির মত, যে হাত দিয়ে পানি পান করার জন্য কূপের পাড়ে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ হাত দ্বারা কখনই তার নাগাল পাওয়া যাবে না। 

মুজাহিদ রহ. বলেন, মুখের সাহায্যে পানিকে ডাকছে ও তার দিকে ইশারা করছে, কিন্তু তা কখনোই তার কাছে আসবে না। (ইবনে কাসীর )। 

যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যদেরকে ডাকে তিনি তাদেরকে কাফের বলে আখ্যায়িত করেছেন। এবং বলেছেন যে, তাদের দোয়া ও ডাকা ডাকি ব্যর্থতায় পর্যবসিত। 

সুতরাং হে আমার মুসলিম ভাই! আল্লহকে ছেড়ে অন্যের কাছে দোয়া করা হতে সাবধান হোন। এর ফলে কাফের ও পথভ্রষ্ট হয়ে যাবেন। একমাত্র আল্লাহকে ডাকুন, যিনি সর্বময় কর্তা ও সকল ক্ষমতার মালিক। এতে করে আপনি খাঁটি মুমিন ও একত্ববাদীদের অন্তর্ভূক্ত হতে পারবেন। 

আল্লাহর সাথে শিরক করা-এ মহা ক্ষতিকর পাপ হতে আমরা পরিত্রাণ পেতে পারি কিভাবে?

তিন প্রকারের শিরক হতে মুক্ত হওয়া অবধি আল্লাহর সাথে শিরক করা হতে পরিত্রাণের কোন উপায় নেই। 

১। রুবুবিয়াতের ক্ষেত্রে শিরক : 

অর্থাৎ, পৃথিবী পরিচালানার ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার সাথে অন্য স্রষ্টা ও পরিচালক আছে মর্মে বিশ্বাস পোষণ করা। যেমন, কতিপয় পীর মনে করে থাকে যে, আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর কিছু কাজ বিভিন্ন ওলীদের দায়িত্বে ন্যাস্ত করে থাকেন। সে সব কাজ তারাই নির্বাহ করে। এমন অবান্তর ধারণা ইসলামের পূর্বের মুশরিকরা পর্যন্ত করেনি। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,

(যদি প্রশ্ন কর) কে সব বিষয় পরিচালনা করেন? তখন তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। (সূরা ইউনুস : আয়াত ৩১) 

আমি এক সূফি সম্পর্কে শুনেছি সে বলে যে, আল্লাহর এমন বান্দাও আছে যদি সে বলে, হও সাথে সাথে তা হয়ে যায়। 

অথচ পবিত্র কোরআন বলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ গুণ কেবল তাঁর জন্য নির্দিষ্ট করেছেন।

আল্লাহ বলেন :

তাঁর ব্যাপার শুধু এই যে, কোন কিছুকে তিনি যদি হও বলতে চান, তখনই তা হয়ে যায়। (সূরা ইয়াসিন : আয়াত ৮২ )

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন :

শুনে রাখ! সৃষ্টি এবং হুকুম তাঁরই (জন্য নির্ধারিত)। (সূরা আরাফ ৭ : ৫৪ আয়াত)। 

২। ইবাদতের ক্ষেত্রে শিরক : 

অর্থাৎ, আল্লাহর সাথে অন্যের ইবাদত-আনুগত্য করা। যেমন, নবী ও নেককার বান্দাদের ইবাদত করা। তাদের ওসিলায় বিপদমুক্তি প্রার্থনা করা। বিপদের সময় তাদের কাছে দোয়া করা এবং এ জাতীয় বিভিন্ন কাজ। যেমন এভাবে বলা যে,  হে আল্লাহর রাসূল! সাহায্য করুন, হে আব্দুল কাদের জিলানী! সাহায্য করুন। আর এ সাহায্য প্রার্থনাটাই ইবাদত। কারণ, এটি সরাসরি দোয়া। আর হাদিসে এসেছে, দোয়াই ইবাদত।

বড়ই অনুতাপের বিষয়, বর্তমানে এ সব বিষয় এ উম্মতের মধ্যে নানাভাবে বিরাজমান। এক ধরনের বাতেল পীর সমাজে এ সব বিষয়ের প্রচলন ঘটিয়েছে এবং নানা কৌশলে এর ব্যাপক প্রসার ঘটাচ্ছে। দিন দিন নানা মানুষ এ বিভ্রান্তি ও শিরকি কাজে নীপতিত হচ্ছে নতুন করে। যে সব ভন্ড পীর শরিয়ত পরিপন্থী এসব শিরকি কাজ সমাজে ছড়িয়েছে, বলার অপেক্ষা রাখে না, সাধারণ বিভ্রান্ত মানুষের পাপের বোঝাও তাদেরকে বহন করতে হবে। ওসিলা খোঁজার নাম করে এ সব শিরকি প্রচারণা চালানো হচ্ছে।  অথচ ওসিলার অর্থ হল কোনো মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করা। নেক আমলকে ওসিলা করে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করার বিষয়টি শরিয়ত অনুমোদিত। কিন্তু কোনো মৃত ব্যক্তিকে ওসিলা হিসাবে দাঁড় করানো অবৈধ।  

৩। আল্লাহর গুণের ক্ষেত্রে শিরক : 

অর্থাৎ আল্লাহর কোনো সৃষ্টিকে সে সব গুণে ভূষিত করা যা শুধু তাঁরই জন্য নির্দিষ্ট। যেমন গায়েব এর ইলম। অদৃশ্য বা গায়েব-এর ইলম শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। এ সম্বন্ধে কোরআনে বহু আয়াত বিদ্যমান। কিন্তু অনেক লোক প্রচার করে থাকে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও গায়েব জানেন। এসব প্রচারণার কাজে অনেক বাতেল পীর ও তাদের ভক্তবৃন্দ জড়িত। 

যেমন বুছাইরি, সে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশংসায় বলেছে : হে নবী (সা.) তোমার দয়াতেই এই দুনিয়ার ভাল, আর মন্দও তোমা হতে। তোমার ইলম হতেই কলম ও লওহে মাহফুজের ইলম। 

এ প্রচারণা থেকেই পথভ্রষ্ট চরম মিথ্যাবাদীদের কথা সম্মুখে এসেছে, যারা ধারণা পোষণ করে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তারা জাগ্রত অবস্থায় দেখতে পায় এবং তাদের অজানা নানা গপন বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করে। যাদের তারা ভালবাসে তাঁর কাছে তাদের গোপন বিষয়ে জানতে চায়। এবং তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে চায়। এমনকি এমন সব কথাও, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবিত অবস্থায়ও জানতেন না। 

অথচ পবিত্র কোরআন বলে :

 যদি আমি গায়েব জানতাম তাহলে অধিক কল্যাণ লাভ করতাম এবং আমাকে কোনো ক্ষতি স্পর্শ করত না।  (সূরা আরাফ: আয়াত ১৮৮)  

আর এটি কিভাবে সম্ভব যে, তিনি তাঁর মৃত্যুর পর যখন উপরের বন্ধুর কাছে চলে গেছেন সেসব গায়েব সম্বন্ধে জানেন? 

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন একটা বাচ্চা মেয়েকে শুনতে পেলেন, সে বলছে, আমাদের মধ্যে এমন নবী আছেন যিনি আগামীকালের কথা জানেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন: না, এ কথা বলো না। সেগুলোই বলো, যা এতক্ষণ বলছিলে । (বুখারি )। 

যে ব্যক্তি আল্লাহর একত্ববাদের মধ্যে উপরোক্ত তিন ধরণের শিরককে মিশ্রিত করে না। তাঁর সত্তা, ইবাদত, দোয়া এবং যাবতীয় গুণাবলীর ক্ষেত্রে তাঁকে একক বলে মান্য করে, সেই হচ্ছে প্রকৃত একত্ববাদী। যে ব্যক্তি এ শিরকত্রয়ীর কোনোটিকে স্বীকার করে, সে আর একত্ববাদী থাকে না, বরং তার ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণী প্রযোজ্য হবে,

যদি তুমি শিরক কর তাহলে তোমার আমল নষ্ট হয়ে যাবে। এবং তুমি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। (সূরা যুমার: আয়াত ৬৫) 

ছোট শিরক বলতে সে সব কাজ ও পদ্ধতিকে বলা হয় যা মানুষকে বড় শিরকের নিকটবর্তী করে দেয়। তবে ইবাদতের স্তর পর্যন্ত পৌঁছে না। তাই সেগুলো সম্পাদনকারীকে দ্বীন-ইসলাম থেকে বের করে না। তবে কবীরা গুনাহের অন্তর্ভূক্ত। 

যেমন, 

১-রিয়া যা লোক দেখানো আমল। 

প্রতিটি ইবাদতকারী যাবতীয় নেক কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই সম্পাদন করে থাকে। তাঁর জন্যই সালাত, সিয়াম, হজ্জ প্রভৃতি আদায় করে থাকে। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির চিন্তা বাদ দিয়ে মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর উদ্দেশ্যে এসব নেক আমল সম্পাদন করাকে রিয়া বলে।  

আল্লাহ তাআলা বলেন : 

সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে। (সূরা কাহাফ: আয়াত ১১০) 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

তোমাদের জন্য যে জিনিসকে আমি সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা করি তা হল ছোট শিরক, রিয়া। কিয়ামত দিবসে যখন মানুষকে তাদের আমলের বদলা দেওয়া হবে তখন আল্লাহ বলবেন : সে সব লোকদের নিকট যাও যাদেরকে দেখিয়ে আমল করেছিলে, দেখ তাদের কাছে কোনো বদলা পাও কি না। (আহমদ, সহিহ) 

২। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে কসম খাওয়া

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, 

যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নামে শপথ করল, সে শিরক করল। (আহমদ, সহিহ)

৩। গোপন শিরক, 

ইবনে আব্বাস রা. এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কোনো ব্যক্তির অপর ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলা যে, ‌‌‌‌‌‌-আল্লাহ যা চান এবং তুমি যা চাও- অথবা -যদি আল্লাহ না থকত এবং অমুক না থাকত- আল্লাহর চাওয়া ও সাথিত্বকে মানুষের চাওয়া ও সাথিত্বের সাথে মিলিয়ে দেওয়া। তবে এসব ক্ষেত্রে এভাবে বলা যায় যে,-যদি আল্লাহ না থাকত তারপর তুমি না থাকতে। 

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 

তোমরা এভাবে বল না, যা আল্লাহ চান এবং অমুকে চায়। বরং এভাবে বল : যা আল্লাহ চান তারপর অমুকে চায়। (আহমদ)

শিরকের বাহ্যিক প্রকাশঃ

ইসলামি রাষ্ট্রগুলোতে মুসলিমরা আজ যে কষ্ট ও মুসিবতে জর্জরিত তার অন্যতম প্রধান কারণ হল, তাদের মধ্যে প্রকাশ্যভাবে ও ব্যাপকহারে শিরক ছড়িয়ে পড়েছে। তারা যে আজ ফিৎনা- ফাসাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে, তা আল্লাহ তাআলাই তাদের উপর গজব হিসাবে নাযিল করেছেন। তার কারণ, তারা তাওহিদ বিমুখ হয়ে পড়েছে। তাদের আকিদাহ ও কাজে-কর্মে শিরক প্রকাশ পাচ্ছে। অধিকাংশ মুসলিম দেশেই এ অবস্থা বিরাজ করছে। শিরককে উৎখাত করার জন্যই ইসলামের আবির্ভাব এ কথা মুসলিম সমাজ জানলেও কোনটি শিরক তা না জানার কারণে সেসব শিরকি কাজকেই সাওয়াবের কাজ মনে করে আমল করে যাচ্ছে। তাই তারা এসব প্রচলিত শিরকের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করে না। 

শিরকের বিশেষ বিশেষ প্রকাশঃ

১। আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে প্রার্থনা করা 

এ বিষয়টি সাধারণত: মীলাদুন্নবী ও এ জাতীয় অনুষ্ঠানাদিতে নৃত্য-গীত ও কবিতা- কাওয়ালির মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

আমি একবার কাউকে বলতে শুনেছিলাম, হে রাসূলদের ইমাম! হে আমার নেতা! আপনি আল্লাহ তাআলার দরজা এবং দুনিয়া ও আখিরাতে আমার ভরসাস্থল। হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে নিজ হাতে ধরে নিন। আমার বিপদ দুর করে সু-দিন আনতে আপনি ছাড়া আর কেউ পারবে না।

আবার কেউ কেউ বলে, হে সমস্ত হযরতদের মাথার মুকুট, ইত্যাদি।

যদি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব কথা নিজে শুনতেন, তাহলে অবশ্যই নিজেকে তা থেকে মুক্ত বলে ঘোষণা করতেন। কারণ, দুর্দিনকে সু-দিনে পরিণত করতে আল্লাহ ছাড়া কেউ পারে না।

দৈনিক সংবাদপত্র, মাসিক ম্যাগাজিন, এমনকি বই-পুস্তকেও এ জাতীয় অনেক কবিতা-গজল-কাওয়ালি লিখে প্রচার করা হয়। আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে প্রার্থনা করার বিষয়টি যেমন,  রাসূলুল্লাহ, বিভিন্ন ওলী-আওলিয়া ও নেককার লোকদের কাছে সাহায্য চাওয়া, তাদের কাছে বিপদাপদ হতে মুক্তি প্রার্থনা করা ও শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় কামনা করা ইত্যাদি।

২। আওলিয়া ও নেককার লোকদের মসজিদে কবর দেয়া  

বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে  এমন অনেক মসজিদ দেখা যায়, যাতে কবর আছে। তার উপর গম্বুজ, কুব্বা ইত্যাদি তৈরী করা হয়েছে। অনেক লোক আল্লাহকে বাদ দিয়ে প্রার্থনার জন্য সেসব কবরস্থ ব্যক্তি বর্গের কাছে যেতে চায়। 

এ ব্যাপারে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বলেন :

ইয়াহুদি ও খ্রীষ্টানদের উপর আল্লাহ তাআলার অভিশাপ, তারা তাদের নবীদের কবরকে (সেজদার জায়গা) মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে। ( বুখারি ও মুসলিম) 

নবীদেরকে মসজিদে দাফন করা যদি ইসলামি রীতি বিরুদ্ধ, কাফেরদের অভ্যাস ও বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকে। তাহলে সেখানে আওলিয়া ও পীরদের দাফন করা জায়েয হয় কিভাবে ? বিশেষ করে আল্লাহ ব্যতীত এ সব লোকদের নিকট প্রার্থনা করা হলে শিরক হবে মর্মে জানা থাকার পরও।  

৩। আওলিয়াদের নামে মান্নত করা, নযর-নেয়ায দেয়া  

কোনো কোনো ব্যক্তি গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী, টাকা-পয়সা ইত্যাদি নির্দিষ্ট ওলীকে নযর দেয়। তার নামে মান্নত করে। এই নযর দেয়া শিরক। কারণ, নযর দেয়া ইবাদত। যা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই হতে হবে। সুতরাং এ ব্যাধি থেকে বিরত হওয়া অতীব জরুরী। 

৪। নবী ও আওলিয়াদের কবরের কাছে জবেহ করা 

যদিও জবেহ আল্লাহর নামেই করা হয়। কারণ, এটি মূলত: মুশরিকদের কাজ। তারা তাদের যেসব ওলীদের মূর্তি বানিয়ে পূজা করত, তাদের মাজারে পশু নিয়ে জবেহ করত। আর যদি আল্লাহ ব্যতীত তাদের নামে জবেহ করা হয় তাহলেতো শিরক হবার ব্যাপারে কোনো সন্দেহই থাকে না।  

৫। নবী ও ওলীদের কবরের তাওয়াফ করা 

যেমন আব্দুল কাদের জিলানী রহ. মাঈনুদ্দিন চিশতী রহ. প্রমুখ। কারণ, তাওয়াফ হচ্ছে নির্দিষ্ট ইবাদত, যা কাবার চারপার্শ্বে ছাড়া অন্যত্র জায়েয নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :

তারা যেন প্রাচীন ঘরের তাওয়াফ করে। (সূরা হজ্জ : আয়াত ২৯) 

৬। কবরের উপর সালাত আদায় করা 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

তোমরা কবরের উপর বস না এবং তার উপর সালাত আদায় কর না। (মুসলিম)। 

৭। বরকত লাভের আশায় কবর ও মাজারের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করা, কিংবা সেখানে গিয়ে সালাত আদায় করা

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোনো দিকে ভ্রমণ করা যায় না, মসজিদুল হারাম, আমার এ মসজিদ এবং মসজিদুল আকসা। (বুখারি ও মুসলিম) 

সুতরাং মদীনা শরীফ যিয়ারতের ইচ্ছা হলে আমরা নিয়ত করবো এ বলে, মসজিদে নববী যিয়ারতের জন্য যাচ্ছি ।

৮। আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত আইন ছাড়া ভিন্ন আইনে শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনা করা : 

যেমন, জায়েয জ্ঞান করে কোরআন ও সহিহ হাদিসের মর্ম পরিপন্থী মানুষের বানানো আইন দ্বারা বিচার ও শাসন কার্য পরিচালনা করা। অনুরূপভাবে বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়, অনেক আলেম নামধারী ব্যক্তিবর্গ কোরআন ও  হাদিসের বিপরীতে ফতোয়া দিয়ে থাকে। যেমন, অনেক স্থানে স্থানীয় আলেমরা সূদকে হালাল বলে ফতোয়া দিয়েছে, অথচ আল্লাহ সূদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। 

৯। কোরআন ও সহিহ হাদিসের বিপরীতে নেতৃবর্গ, আলেম-ওলামা বা পীর-বুজর্গদের আনুগত্য করা। 

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন :

স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে সৃষ্টির আনুগত্য করা চলবে না। (আহমদ)। 

আল্লাহ তাআলা বলেন : 

তারা আল্লাহকে ছেড়ে  তাদের পণ্ডিতগণ ও সংসার-বিরাগীদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামপুত্র মাসীহকেও। অথচ তারা এক ইলাহের ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছে, তিনি ছাড়া কোন (হক) ইলাহ নেই। তারা যে শরীক করে তিনি তা থেকে পবিত্র।

(সূরা তাওবা: আয়াত ৩১) 

হুযাইফা রা. তাদের ইবাদতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, তাদের আলেমরা যা হালাল করত তারাও তা হালাল বলে মেনে নিত অনুরূপভাবে যা হারাম করত, তারাও তাকে হারাম জ্ঞান করত। ব্যাপারটি আল্লাহর হুকুমের বিপরীত হলেও তারা তা-ই করত।

ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে শিরকের অনেক অনিষ্টকর দিক আছে। তার মাঝে বিশেষ বিশেষ  কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো, 

১। শিরক মানবতার জন্য অবমাননাকর

শিরক মানুষের সম্মানকে ধুলায় মিশিয়ে দেয়, তার সামর্থ ও মর্যাদা নীচু করে দেয়। কারণ, আল্লাহ তাআলা মানুষকে তাঁর খলীফা হিসাবে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। তাদেরকে সম্মানিত করেছেন। তাঁর সমস্ত নাম শিখিয়েছেন। আসমান ও যমীনস্থ সব কিছু তাদের  অনুগত করে দিয়েছেন। এই জগতের সকলের উপর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু শিরক করে তারা প্রমাণ করেছে যে তারা তাদের সে অবস্থা ও অবস্থানকে ভুলে গেছে। ফলে, তাদের অধীনস্থ ও মর্যায় তাদের থেকে নীচু কোনো জিনিসকে নিজেদের ইলাহ ও মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে। এবং এরই মাধ্যমে নিজেদেরকে ছোট ও অপমানিত করেছে। এর থেকে অসম্মানের বিষয় আর কি হতে পারে, যে গাভীকে আল্লাহ মানুষের খেদমতের জন্য সৃষ্টি করেছেন, যাকে জবাই করে খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন সে গাভীকে আজ হিন্দুস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পূজা করা হয়। তাদের কাছে আরাধণা করা হয়।  আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, অনেক মুসলিম ব্যক্তিবর্গ মৃত মানুষের কবরের চারপাশে ঝাঁক ধরে বসে থাকে। তাদের কাছে নিজেদের প্রয়োজন নিবেদন করে। অথচ এসব মৃত ব্যক্তি তাদের মতই আল্লাহর দাস। তারা নিজেদেরই কোনো উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না। লক্ষ্য করে দেখুন, হোসাইন রা.-এর কবরের চতুর্পাশ্বে বর্তমানে লোকেরা ভিড় জমায়। নিজেদের কষ্ট দূর করার জন্য তাঁর নিকট প্রার্থনা করে। অথচ তিনি জীবত অবস্থায়ই নিজেকে শহীদ হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি। নিজের মুসিবত দূর করতে পারেননি। তাহলে মৃত্যুর পর কেমন করে অপরের কষ্ট দূর করবেন? মানুষের ভাল ডেকে আনবেন? বরং সত্য কথা হলো মৃত ব্যক্তিরাই জীবিত মানুষের দোয়ার মূখাপেক্ষী। তাই আমাদের উচিত আমরা যেন তাদের জন্য দোয়া করি। আল্লাহকে ছেড়ে কোনো অবস্থাতেই যেন তাদের কাছে দোয়া না চাই । 

এ সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা বলেন : 

আর তারা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে ডাকে, তারা কিছু সৃষ্টি করতে পারে না, বরং তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়। (তারা) মৃত, জীবিত নয় এবং তারা জানে না কখন তাদের পুনরুজ্জীবিত করা হবে। (সূরা নাহল: আয়াত ২০-২১) 

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন :

আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে যেন আকাশ থেকে পড়ল। অত:পর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল কিংবা বাতাস তাকে দূরের কোনো জায়গায় নিক্ষেপ করল।  ( সূরা হজ্জ: আয়াত, ৩১) 


২। শিরকের কারণে আজেবাজে কুসংস্কার ও বাতিল রসম-রেওয়াজ মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে। 

কারণ, যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে এই জগতে আল্লাহ ছাড়াও অন্যের প্রভাব আছে, যেমন : গ্রহ-নক্ষত্র, জিন, নশ্বর আত্মা ইত্যাদি তার বোধ-বুদ্ধি এমন হয়ে যায় যে, নানা কুসংস্কারকে সে গ্রহণ করতে তৈরী হয়ে যায় এবং সকল মিথ্যাবাদী-দাজ্জালদের বিশ্বাস করতে শুরু করে। আর এইভাবেই জিন বশকারী, গণক, যাদুকর, জ্যোতিষী এবং এ জাতীয় লোকদের মাধ্যমে সমাজের মধ্যে শিরক প্রবেশ করে থাকে। তারা মিথ্যা দাবী করে বলে যে, আমরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলতে পারি, সামনে কি হবে আমাদের সব জানা আছে। অথচ এসব বিষয় আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানে না। এসব কারণে সমাজের মধ্যে ধীরে ধীরে আসবাব সংগ্রহের প্রচেষ্টা দূর্বল হয়ে যায় এবং জগতের নিয়ম পাল্টে যেতে থাকে। 

৩। শিরক সবচেয়ে বড় যুলুম : 

বাস্তবিকই এটা যুলম। কারণ, সবচেয়ে বড় সত্য হল আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং অন্য কোনো প্রতিপালকও নেই। তিনি ছাড়া আইন প্রণেতা আর কেউ নেই। কিন্তু মুশরিকরা আল্লাহকে ছেড়ে অন্যকে মাবূদ স্থির করে নেয়। অন্যের কাছ থেকে আইন ও বিধান গ্রহণ করে। তাছাড়া মুশরিকরা নিজেদের উপরও অবিচার ও যুলুম করে। কারণ তারা তাদেরই মত অন্য একজন দাশের গোলাম হয়ে যায়। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে স্বাধীন বানিয়ে সৃষ্টি করেছেন। শিরক অপরের উপরও অবিচার বা যুলুম। কারণ যে, আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করল, সে তো মহা অত্যাচার করল। কারণ এর মাধ্যমে সে এমন কাউকে সে হক দিল যার সেই অধিকার নেই। 

৪। শিরক হচ্ছে সমস্ত কল্পনা ও ভয়-ভীতির মূল: 

কারণ, তার মাথায় নানা কুসংস্কার বাসা বাঁধতে শুরু করে। এবং দলীল প্রমাণ বিহীন নানা আজে বাজে কথা ও কাজকে গ্রহণ করতে থাকে। ফলে সমস্ত দিক হতেই নানা ভীতি তাকে গ্রাস করে ফেলে। কারণ, সে এমন সব মাবূদের উপর ভরসা করতে শিখেছে। যাদের অক্ষমতা স্বীকৃত। তারা প্রত্যেকেই নিজ বা অন্যের কল্যাণ বা ক্ষতি করতে অপারগ। এমনকি নিজেদের থেকেও তারা কষ্ট-মুসিবত দূর করতে পারে না। ফলে, যেখানে শিরক চলে সেখানে কোনো বাহ্যিক কারণ ছাড়াই নানা ধরণের কুসংস্কার ও ভীতি প্রকাশ পেয়ে থাকে। 

আল্লাহ তাআলা এ সম্বন্ধে বলেন :

অচিরেই আমি কাফেরদের অন্তরসমূহে আতঙ্ক ঢেলে দেব। কারণ তারা আল্লাহর সাথে শরীক করেছে, যে সম্পর্কে আল্লাহ কোনো প্রমাণ নাযিল করেননি। আর তাদের আশ্রয়স্থল হল আগুন এবং যালিমদের ঠিকানা কতই না নিকৃষ্ট। (সূরা আল এমরান, ৩ : ১৫১ আয়াত)।

৫। শিরকের কারণে সম্পাদিত সকল নেক আমল নষ্ট হয়ে যায় 

কারণ, শিরক তার অনুগামীদেরকে মাধ্যম ও শাফায়াতকারীর উপর ভরসা করতে শেখায়। ফলে, নেক আমল ত্যাগ করতে শুরু করে এবং এ ধারণার বশবর্তী হয়ে গুনাহ করতে শুরু করে, সমস্ত অলীরা তাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। এমনটিই ছিল ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবদের বিশ্বাস। 

এদের সম্বন্ধে আল্লাহ বলেন : 

আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদত করছে, যা তাদের ক্ষতি করতে পারে না এবং উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, ‘এরা আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী’। বল, ‘তোমরা কি আল্লাহকে আসমানসমূহ ও যমীনে থাকা এমন বিষয়ে সংবাদ দিচ্ছ যা তিনি অবগত নন? তিনি পবিত্র মহান এবং তারা যা শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে। ( সূরা ইউনুস : আয়াত ১৮)  

খৃষ্টানদের বিশ্বাসের প্রতি লক্ষ্য করে দেখুন, যারা একটার পর একটা অন্যায় কাজ করে যাচ্ছে এ ধারণার বশবর্তী হয়ে যে, ঈসা আ. যখন শূলে চড়েছেন তখন তাদের সমস্ত গুণাহ মুছে দিয়ে গেছেন। সম্ভবত তারই অনুকরণে আজ অনেক মুসলিম ফরয, ওয়াজিব ত্যাগ করছে ও নানা হারাম কাজে জড়িত হচ্ছে। এবং এ বিশ্বাস করে বসে আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জান্নাতে প্রবেশের জন্য অবশ্যই শাফাআত করবেন। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর আদরের কন্যা ফাতেমা রা.-কে বলেছেন, 

হে ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ! তুমি আমার সম্পদ হতে যা ইচ্ছা চেয়ে নাও। আখিরাতে আল্লাহর হাত থেকে তোমাকে বাঁচানোর ব্যাপারে আমার কোনো ক্ষমতা নেই। (বুখারি)। 

৬। শিরকের কারণে মানুষ চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করবে 

শিরকের কারণে মানুষ পৃথিবীতে ধ্বংস হয়ে যায় এবং আখিরাতের চিরস্থায়ী আযাব ভোগ করবে। আল্লাহ বলেন : 

যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শিরক করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন, তার ঠিকানা আগুন এবং যালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই। (সূরা মায়িদা: আয়াত ৭২) 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : 

যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মারা গেল যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো সমকক্ষ ডাকত, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। (বুখারি)। 

৭। শিরক উম্মতের ঐক্য বিনষ্ট করে তাদেরকে টুকরা টুকরা করে দেয়। 

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ 

তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। যারা নিজেদের দীনকে বিভক্ত করেছে এবং যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। ( তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না)। প্রত্যেক দলই নিজদের যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত।  (সূরা রূম: আয়াত ৩১-৩২) 

আলোচনা থেকে পরিস্কারভাবে এটাই ফুটে উঠেছে যে, শিরক খুবই মন্দ ও নিকৃষ্ট কাজ। তাই তা থেকে বেঁচে থাকা ফরয। তাতে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে যার পর নাই সতর্ক থাকা এবং যতদূর সম্ভব তা হতে দূরে অবস্থান করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। কারণ, এটি সবচেয়ে বড় গুনাহ। যা বান্দার সমস্ত নেক আমল নিষ্ফল ও বিনষ্ট করে দেয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন : 

আর তারা যে কাজ করেছে আমি সেদিকে অগ্রসর হব। অত:পর তাকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করে দেব। (সূরা ফুরকান: আয়াত ২৩)

Copyright Notice

কপি করা নিষিদ্ধ!