আজকে আমরা আলোচনা করবঃ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রচনাঃ
ভূমিকা:
মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ও রক্তাক্ত অধ্যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলার মানুষ অর্জন করে স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ। স্বাধীনতা হলো একটি জাতির আজন্ম লালিত স্বপ্ন। স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার মধ্যে যেমন গৌরব থাকে, তেমনি পরাধীনতায় থাকে গ্লানি। আর তাই পরাধীন হয়ে কেউ বাঁচতে চায় না। দাসত্বের শৃঙ্খলে কেউ বাঁধা পড়তে চায় না। বাঙালি জাতিও চায়নি বছরের পর বছর ধরে শাসনে-শোষণে পাকিস্তানিদের দাস হয়ে থাকতে। তাই তারা শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে পড়েছিল আন্দোলনে, সোচ্চার হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পেয়েছিল তাদের স্বপ্নের স্বাধীনতা।
পটভূমি:
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামের দুইটি পৃথক রাষ্ট্র। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ছিল দুটি অংশ – পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা কখনোই পূর্ব পাকিস্তানকে সমান মর্যাদা দেয়নি। বরং সব সময় চেয়েছে পূর্ব পাকিস্তানকে দমিয়ে রাখতে। পশ্চিম পাকিস্তান সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যে জর্জরিত করতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানকে। শিল্প কারখানার কাঁচামালের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান নির্ভর করতো পূর্ব পাকিস্তানের ওপর। শ্রমিকদের অল্প বেতন দিয়ে উৎপাদনের কাজ করাতো। রাজস্ব থেকে আয়, রপ্তানি আয় প্রভৃতির সিংহভাগ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় যেখানে ৯৫% ব্যয় হতো, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় ব্যয় হতো মাত্র ৫ শতাংশ। আবার, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশভাবে জয়ী হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কোনোভাবেই বাঙালিদের হাতে শাসনভার তুলে দিতে চায়নি। পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অভাব, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ, অবকাঠামোগত উন্নয়নে অবহেলা, মৌলিক নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপসহ সকল প্রকার বৈষম্য স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠনের দাবিকে জোরালো করে তোলে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশ:
বাঙালি জাতির রাজনৈতিক সচেতনতা ও জাতীয়তাবাদের উন্মেষ পূর্ব থেকে হলেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তা জোরালো হয়। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্ উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার ঘোষণা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। এই ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। ওই দিন ভাষার দাবিতে রাজপথে শহিদ হন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেকে। ভাষা ও সংস্কৃতির উপর শাসকগোষ্ঠীর আঘাত ছিল বাঙালির কাছে তাদের অস্তিত্বের মূলে আঘাতস্বরূপ। একদিকে বাঙালিরা যেমন সংকটের প্রকৃতি ও গভীরতা বুঝতে পারে, অন্যদিকে তা মোকাবেলার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। ১৯৫৪-র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভ, ১৯৬২-র গণবিরোধী শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬-র বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি, ১৯৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় – এই প্রত্যেকটি ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ ঘটে এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ চূড়ান্ত স্বীকৃতি লাভ করে।
স্বাধীনতার ডাক:
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। বরং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সরকার তখন ষড়যন্ত্র শুরু করে। এর ফলে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতায় উন্মুখ দশ লক্ষাধিক মানুষের সামনে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এরপর গড়ে ওঠে তীব্র অসহযোগ আন্দোলন। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার লিখিত ঘোষণাপত্র দিয়ে যান। ২৬শে মার্চ দুপুরে এম এ হান্নান চট্টগ্রামের কালুরঘাটের স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।
অপারেশন সার্চলাইট:
ইতিহাসের ঘৃণিত গণহত্যা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ওইদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এবং ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে হত্যা করে অসংখ্য নিরস্ত্র বাঙালিকে।
মুজিবনগর সরকার গঠন:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। এই দিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত সরকার ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা ইউনিয়নের আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। তখন থেকে এই জায়গার নতুন নাম হয় মুজিবনগর। পরবর্তীকালে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী দেশ চলতে থাকে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ও সুদূরপ্রসারী সাংবিধানিক পদক্ষেপ ছিল মুজিবনগর সরকার গঠন। এই সরকারের নেতৃত্বে নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। বিশ্বব্যাপী জনসমর্থন আদায়ে এই সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও জনযুদ্ধ:
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ নিরস্ত্র জনগণের উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আক্রমণ চালালে বাঙালি ছাত্র, জনতা, পুলিশ, ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা সদস্যরা সাহসিকতার সাথে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। বিনা প্রতিরোধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে বাঙালিরা ছাড় দেয়নি। দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে বহু মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন রণাঙ্গনে শহিদ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের এ ঋণ কোনো দিন শোধ হওয়ার নয়। জাতি চিরকাল মুক্তিযোদ্ধাদের সূর্যসন্তান হিসেবে মনে রাখবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের বাঙালি অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মানুষও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। তাই এ যুদ্ধকে বলা হয় গণযুদ্ধ বা জনযুদ্ধ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল নিয়ামক শক্তি ছিল জনগণ। তাই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী, ছাত্র, পেশাজীবী, নারী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ সর্বস্তরের জনসাধারণ নিজ নিজ অবস্থান থেকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি করে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর সর্বাধিনায়ক। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য পুরো দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। ৩রা ডিসেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় মিত্রবাহিনী যুক্ত হয়ে যৌথভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করে। যুদ্ধে পর্যুদস্ত হয়ে ১৬ই ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় হয়।
মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নারী সক্রিয় ছিল কখনও সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে, কখনোবা যুদ্ধক্ষেত্রের আড়ালে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন এমন নারীর সংখ্যা অসংখ্য। অজানা-অচেনা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষা করেছেন বহু নারী। চরম দুঃসময়ে পাকিস্তানি হানাদারের হাত থেকে রক্ষা করতে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। অনেক সময়ে শত্রুর কাছে নিজেদের সম্ভ্রম এবং প্রাণও দিতে হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের অবদান:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। বিভিন্ন দেশে তারা মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ে বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের কাছে ছুটে গিয়েছেন। তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছেন। পাকিস্তানকে অস্ত্র, গোলাবারুদ সরবরাহ না করতে বিশ্বের বিভিন্ন সরকারের নিকট আবেদন করেছেন। এক্ষেত্রে ব্রিটেনের প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা:
যুদ্ধের সময়ে দেশপ্রেম জাগ্রতকরণ, মনোবল বৃদ্ধিসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ও অবদান ছিল খুবই প্রশংসনীয়। পত্রপত্রিকায় লেখা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে খবর পাঠ, দেশাত্মবোধক ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গান, আবৃত্তি, নাটক, কথিকা, জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘চরমপত্র’ ইত্যাদি মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব:
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষে দাঁড়ায়। ভারত সে সময়ে এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন দেয়। তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের বিরোধিতা করলেও সে দেশের জনগণ, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়। বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গানের দল বিটস্-এর জর্জ হ্যারিসন এবং ভারতীয় সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত রবিশঙ্কর ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ”-এর আয়োজন করেছিলেন। ফরাসি সাহিত্যিক আদ্রে মালরো, জাঁ পল সার্ত্রে-সহ অনেকেই তখন বাংলাদেশকে সমর্থন দিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা:
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ক্ষুধা- দারিদ্র্য-অশিক্ষা-কুসংস্কার থেকে মুক্ত অসাম্প্রদায়িক একটি দেশের – বঙ্গবন্ধু যার নাম দিয়েছিলেন ‘সোনার বাংলা’। এই সোনার বাংলা গঠনের চেতনাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। নতুন প্রজন্মের কাছে এই চেতনাকে পৌঁছে দেওয়া জরুরি। কেননা উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এই চেতনার কোনো বিকল্প নেই।
উপসংহার:
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির অহংকার। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ জাতিকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এনে দেয়। এই স্বাধীনতা ত্রিশ লক্ষ ভাইয়ের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত, লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া। তাই এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমাদের নিবেদিতপ্রাণ হওয়া উচিত। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানো যেমন জরুরি, তেমনি নাগরিকদের নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন হওয়া উচিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কর্তব্যবোধ, ন্যায়নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে বাংলাদেশের যথার্থ অগ্রগতি নিশ্চিত করা সম্ভব।
রচনা লেখা নিয়ম-
প্ৰবন্ধ/রচনা কি? রচনা কত প্রকার ও কি কি?
প্ৰবন্ধ/রচনা/রচনা এক প্রকার গদ্য রচনা। রচনা শব্দের অর্থ নির্মাণ বা সৃষ্টি করা। কোনো বিশেষ ভাব বা তত্ত্বকে ভাষার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার নামই রচনা। কোনো বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিতে প্ৰবন্ধ/রচনা/রচনা রচিত হয়।
সব ধরনের প্ৰবন্ধ/রচনাকে অন্তত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যথা – বর্ণনামূলক প্ৰবন্ধ/রচনা, চিন্তামূলক প্ৰবন্ধ/রচনা ও ব্যক্তি অনুভূতিমূলক প্ৰবন্ধ/রচনা।
উদাহরণস্বরূপঃ বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প’ বা ‘ভাষা আন্দোলন’ প্ৰবন্ধ/রচনাকে বলা যায় বর্ণনামূলক প্ৰবন্ধ/রচনা, ‘সময়ানুবর্তিতা’ বা ‘মাদকাসক্তি’ প্ৰবন্ধ/রচনাকে বলা যায় চিন্তামূলক প্ৰবন্ধ/রচনা, এবং ‘লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা’ বা ‘কোনো ঘটনার স্মৃতি’ প্ৰবন্ধ/রচনাকে বলা যায় ব্যক্তি অনুভূতিমূলক প্ৰবন্ধ/রচনা।
রচনা লেখার ফরমেট/স্টাইলঃ
রচনার সাধারণত তিনটি অংশ। যথা-
১। ভূমিকা: প্রবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদটি হবে এর ভূমিকা বা সূচনা। ভূমিকা হচ্ছে প্রবন্ধের সূচনা অংশ। অনেকটা বিষয়ে ঢোকার দরজার মতো ভূমিকা যত বিষয় অনুযায়ী, আকর্ষণীয় ও মনোরম হয় ততই ভালো। লক্ষ রাখা দরকার, ভূমিকা অংশে যেন অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য ভিড় না করে আর তা যেন খুব দীর্ঘ না হয়।
ভূমিকা হল বাড়ীর দরজার মতো। তাই আপনি কি নিয়ে রচনা লিখতে চলেছেন তা পরিষ্কার করে ফুটিয়ে তুলবেন ভূমিকা তে।
এমনভাবে ভূমিকা লিখুন, যেন পাঠক বুঝতে পারেন আপনি কিসের ওপর রচনা লিখতে চলেছেন। কিন্তু সেই সব ব্যাপারে বেশী তথ্য ভূমিকা তে দেবেন না। কিন্তু পাঠকের মনে আরও ভেতরে প্রবেশ করার একটা কৌতূহল জন্মাবে, মানে পাঠক আপনার রচনা পড়তে আগ্রহী হবেন। পাঠক এর মনে হবে- এর পরে কি আছে, আরও একটু পড়া যাক।
২। মূল অংশ: ভূমিকার পরে প্রবন্ধের মূল বিষয়ের আলোচনা শুরু হয়। প্ৰবন্ধ/রচনাের মূল অংশ একাধিক অনুচ্ছেদে বিভক্ত হয়ে থাকে। অনুচ্ছেদগুলো যাতে সমরূপ থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হয়। বিশেষভাবে বর্ণনামূলক ও চিন্তামূলক প্ৰবন্ধ/রচনাের বেলায় অনুচ্ছেদগুলোর আলাদা শিরোনাম থাকে। এগুলোর নাম অনুচ্ছেদ-শিরোনাম। এসব শিরোনামের পরে কোলন যতি (:) দিয়ে লেখা শুরু করা যায়।
৩। উপসংহার: প্রবন্ধের সর্বশেষ অংশ উপসংহার। সূচনার মতো সমাপ্তিরও আছে সমান গুরুত্ব। প্রবন্ধের ভাববস্তু ভূমিকার উৎস থেকে ক্রমাগ্রগতি ও ক্রমবিকাশের ধারা বহন করে উপসংহারে এসে একটি ভাবব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে সমাপ্তির ছেদ-রেখা টানে। এখানে লেখকের ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশের যথেষ্ট অবকাশ থাকে। উপসংহারে লেখক একদিকে যেমন আলোচনার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, অন্যদিকে তেমনি লেখকের নিজস্ব অভিমতের কিংবা আশা-আকাঙ্ক্ষার সার্থক প্রতিফলনও ঘটে।
তাই কখনোই তাড়াহুড়ো করে, যেমন তেমন করে উপসংহার লিখে রচনাটি শেষ করে দেবেন না যেন। উপসংহার হবে –আপনি এতক্ষণ যা কিছু লিখলেন তার সারকথা।
প্ৰবন্ধ/রচনা লেখার সাধারন নিয়মঃ
- ক. ভূমিকা হলো প্ৰবন্ধ/রচনাের প্রবেশক অংশ। এটি সাধারণত এক অনুচ্ছেদের হয়। এই অংশে প্রায়ই মূল আলোচনার ইঙ্গিত থাকে।
- খ. প্ৰবন্ধ/রচনাের মূল অংশ একাধিক অনুচ্ছেদে বিভক্ত হয়ে থাকে। অনুচ্ছেদগুলো যাতে সমরূপ থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হয়। যুক্তি বা কালের অনুক্রম মনে রেখে অনুচ্ছেদগুলোর সমরূপতা ঠিক করা যেতে পারে।
- গ. বিশেষভাবে বর্ণনামূলক ও চিন্তামূলক প্ৰবন্ধ/রচনাের বেলায় অনুচ্ছেদগুলোর আলাদা শিরোনাম থাকে। এগুলোর নাম অনুচ্ছেদ-শিরোনাম। এসব শিরোনামের পরে কোলন যতি (:) দিয়ে লেখা শুরু করা যায়।
- ঘ. উপসংহার হলো প্ৰবন্ধ/রচনাের সমাপ্তি অংশ। প্ৰবন্ধ/রচনাের প্রকৃতি অনুযায়ী এখানে সাধারণত ফলাফল, সম্ভাবনা, সীমাবদ্ধতা, প্রাসঙ্গিকতা ইত্যাদি স্থান পায়।
- ঙ. প্ৰবন্ধ/রচনাের ভাষা হওয়া উচিত সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল।
- চ. প্ৰবন্ধ/রচনাের প্রতিটি অনুচ্ছেদ লেখার সময়ে প্ৰবন্ধ/রচনাের শিরোনামের কথা মনে রাখতে হয়, তাতে প্ৰবন্ধ/রচনাের মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা প্রবেশ করতে পারে না।
- ছ. উদ্ধৃতি ব্যবহারে সতর্ক হওয়া উচিত। অপরিহার্য না হলে উদ্ধৃতি ব্যবহার করা ঠিক নয়। বিশেষভাবে বাংলা প্ৰবন্ধ/রচনাের মধ্যে অন্য কোনো ভাষার উদ্ধৃতি বর্জনীয়।
- জ. প্ৰবন্ধ/রচনাের নির্দিষ্ট কোনো আয়তন নেই। এমনকি এর অনুচ্ছেদসংখ্যাও নির্দিষ্ট করা যায় না। তবে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য প্ৰবন্ধ/রচনাের শব্দসংখ্যা কমবেশি এক হাজার হতে পারে।
রচনার লেখার সাধারণ নিয়মের পাশাপাশি আরও যা যা লক্ষ্য রাখা প্রয়োজনঃ
প্রবন্ধ রচনার সময় কিছু নিয়মকানুন অনুসরণ করা প্রয়োজন। তাহলে প্রবন্ধের মান বৃদ্ধি পায় এবং পরীক্ষায় অধিক নম্বর পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে-
১। রচনা লিখার পর একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিন সব বানান ঠিক আছে কিনা
২। সাধু ভাষা, চলিত ভাষা মিশিয়ে ফেলবেন না, যে কোন একটা ভাষা তে লিখুন।
৩। যে টপিকের ওপর রচনা লিখবেন, তার ওপর জ্ঞান থাকাটা খুবই জরুরী।
৪। আপনার জানা জ্ঞান কে খুব সুন্দর ভাবে পয়েন্ট অনুসারে সাজিয়ে লিখবেন। কোন তথ্য কোন হেডলাইনে রাখা যাবে তা আগে ঠিক করে নিন।
৫। কিছু বিখ্যাত কবিদের কবিতার লাইন যদি প্রাসঙ্গিক মনে হয়, তাহলে সেইসব লাইন বা কোন প্রাসঙ্গিক কোটেশন প্রতিটি হেডলাইনেই দিতে পারেন। তবে প্রাসঙ্গিকতা বিচার করে দেবেন।
৬। অপ্রাসঙ্গিক কিছুই লিখবেন না। তথ্য ছাড়া শুধু নানান রকম গল্প লিখে রচনা কে বিনা কারনে দীর্ঘায়িতো করবেন না।