আজকে খামারিয়ান এর এই পর্বে আমরা আলোচনা করব বাংলাদেশে গরুর জাত নিয়ে, যে সকল গরুর জাতের নাম বাংলাদেশে অতি পরিচিত, সচরাচর ও সহজলভ্য। আমরা আরও জানব যে বাংলাদেশে বিদ্যমান সর্বাধিক পালিত গরুর জাত সমূহ কি কি এবং বাংলাদেশের প্রচলিত গরুর জাত পরিচিতি ও বাংলাদেশি গরুর জাত কত প্রকার?
আজকে আমরা আলোচনা করবঃ
[১] দেশী গরুর জাত
১) দেশী জাতের গরু মূলত পরিশ্রমী জাত। বলদ কৃষি কাজ ও ভারবহনের কাজে বেশ উপযোগী। বাংলাদেশে গরুর জাত সমূহের মাঝে দেশী গরুর চাহিদা কম বেশি সবসমই লক্ষ্য করা যায়।
২) বাংলাদেশের অধিকাংশ গরুই দেশী গরুর জাতের। এরা আকারে ছোট। একটি পূর্ণ বয়স্ক দেশী গরুর ওজন গড়ে ১৫০ কেজি হয়।
৩) দেশী জাতের গাভী দুধ (1-3 লিটার) দেয় কিন্তু দেশী জাতের গরুর মাংশ বেশ সুস্বাদু।
[২] পাবনা জেলার জাতের গরু
১) দ্বৈত উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত গরুর জাত। গাভী ও বলদ উভয়েই আকারে বেশ উচু ও লম্বা হয়।
২) দেহের রং গাঢ় ধুসর হতে সাদা ছাপযুক্ত হয়ে থাকে।
৩) একটি গাভী পতিদিন ৬-১০কেজি দুধ দেয়।
৪) এই গরুর জাতটির বলদ দেশীয় সাধারণ গরুর জাত হতে অনেক বেশী পরিশ্রমী এবং কৃষি কাজে বেশ উপযুক্ত।
[৩] ফরিদপুর জেলার গরুর জাত
১) বাংলাদেশের মধ্যে ফরিদপুরের গরু বেশ উন্নত ধরনের। মূলত দ্বৈত উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত গরুর জাত।
২) হরিয়ানা জাতের ত্রস গরু ফরিদপুর জেলায় যথেষ্ট দেখা যায়।
৩) এই গরুর জাতটির রং সাদা, চামড়া পাতলা। এরা মাথা উচু করে হাটে।
৪) এই গরুর জাতটির একটি ষাড়ের ওজন ২৫০-৩০০কেজি এবং গাভীর ওজন ২০০-৩০০কেজি পর্যন্ত হয়।
৫) এসব গাভী দৈনিক প্রায় ১৩-১৪ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়।
[৪] ঢাকা মুন্সিগঞ্জ এলাকার গরু জাত
১) আকৃতি মধ্যম, একটু লম্বাটে ধরনের বিভিন্ন বর্ণের হয়। মূলত দ্বৈত উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত জাত।
২) মুখ কিছুটা গরুও লম্বা। গাভীর চূড়া প্রায় থাকে না। পিঠ সোজা, শিং গরুও খুব ধারালো। দুই চোখের মধ্যবর্তী কপালের অংশ বিশেষ উচু।
৩) দেহের সাথে আটসীট ওলান সম্মুখের দিকে একটু বাকানো। মিক্ষ ভেইন মোটা ও স্পষ্ট। দৈনিক ১০-১২ লিটার দুধ দেয়।
৪) এই গরুর জাতটির ঘাড় ও বলদ বেশ বড় ও কর্মঠ। গাভী টানা ও চাষের বেশ উপযুক্ত।
[৫] চট্টগ্রামের লাল গরুর জাত
১) মূলত দ্বৈত উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত জাত। হালকা লাল বর্ণের এজাতের গরুদেখতে ছোট খাটো পিছনের দিক বেশ ভারী, চামড়া পাতলা, শিং ছোট ও চ্যাপ্টা।
২) মুখ খাটো ও চওড়া। লেজ যথেষ্ট লম্বা এবং শেষ প্রান্তে চুলের গুচ্ছ লাল বর্ণের।
৩) ওলান বেশ বর্ধিত। বাট সুডৌল। মিল্ক ভেইন স্পষ্ট। দৈনিক ১০-১২ লিটার দুধ দেয়।
৪) এই গরুর জাতটির ষাড় ও বলদ বলিষ্ট ও শক্তিশালী। কৃষি ও ভারবহনের কাজে উপযোগী।
[৬] শাহিওয়াল গরুর জাত
১) শাহিওয়াল পাকিস্তানের একটি দুধাল জাতের গরু। বর্তমানে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিশ্বের বহুদেশে এই গরুর জাতটি গরুপালিত হয়।
২) ধীর ও শান্ত প্রকৃতির। মোটাসোটা ভারী দেহ। তুক পাতলা ও শিথিল।
৩) পা ছোট, ছোট ও পুরু শিং নড়ে। মাথা চওড়া ও পোল উঁচু। কান ঝুলানো ও কানের ভিতর কালো দাগ থাকে।
৪) লেজ বেশ লঙ্কা, প্রায় মাটি ছুঁয়ে যায়। লেজের আগায় দর্শনীয় এক গোছা কালো লোম থাকে।
৫) সাধারণত এই গরুর জাতটির গরুর দেহের রং ফ্যাকাশে লাল। তবে কখনও কখনও গাঢ় লাল বা লালের মাঝে সাদা ও কালো ছাপযুক্ত হয়।
৬) গাভীর ওলান বড়, চওড়া, নরম ও মেদহীন। লম্বা মোটা ও সমান আকৃতির বীট। দুগ্ধ শিরা বেশ স্পষ্ট যা দূর থেকেও বোঝা যায়।
৭) এই গরুর জাতটির একটি গাভী গ্রামীণ অবস্থায় পালনে ৩০০ দিন দুগ্ধ দানকালে প্রায় ২১৫০ লিটার এবচং ফার্মে পালনে প্রায় ৪-৫ হাজার লিটার দুধ দেয়।
৮) ষাঁড়ের দৈহিক ওজন প্রায় ৫২২ কেজি এবং গাতীল ওজন প্রায় ৩৪০ কেজি হয়ে থাকে।
[৭] সিদ্ধি গরুর জাত
১) পাকিস্তানের সিন্ধু এলাকায় এজাতের গরুর আদি বাসস্থান। বর্তমানের বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে গরুর জাতটি পালিত হয়।
২) সাধারণত গাঢ় লাল ও চকলেট বর্ণের হয়ে থাকে। গাভী অপেক্ষা ষীড়ের রং বেশী গাঢ় হয়।
৩) আকৃতি মাঝারি, সুডৌল,বলিষ্ট ও দেহ আটসীট। গাভীকে শান্তশিষ্ট ও বুদ্ধিদীপ্ত দেখায়।
৪) ভৌতা শিং যা পাশে ও পিছনে বাঁকানো থাকে। মাথা ও মুখ মণ্ডল ছোট। চওড়া কপাল। কপালের মাঝের অংশ কিছুটা উচু।
৫) ষাড়ের চূড়া বেশ উচু গল কম্বল বৃহদাকার ও ভীজযুক্ত। নাভি চর্ম বড় ও ঝুলন্ত। ষাড়ের ওজন প্রায় ৪৫০ কেজি।
৬) গাভীর ওলানের গঠন বেশ সুন্দর ও সামান্তস্যপূর্ণ। ওজন প্রায় ২৯৫ কেজি। প্রতি বিয়ানে সর্বোচ্চ ৫,৪৪৩ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়। এই গরুর জাতটির বলদ দিয়ে কৃষি কাজ করা যায়।
[৮] জার্সি গরুর জাত
১) প্রায় ৫০০ বছর ধরে ইংলিশ চ্যানেলের জার্সি দ্বীপে জার্সি গরুর জাতটির প্রজনন হয়ে আসছে পরিকল্পিত প্রজননের ফলে জার্সি প্রসিদ্ধ দুধাল জাত হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
২) লম্বা দেহ, খাটো পা এবং চূড়া হতে কোমর পর্যন্ত পিঠ একদম সোজা থাকে।
৩) বিভিন্ন রংয়ের হয়। তবে প্রধানত হালকা লালচে বাদামী রং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
৪) চওড়া জোড়া ডিশযুক্ত কপাল। শিং পাতলা ও সামনের দিকে কিছুটা বাকানো থাকে।
৫) মুখবন্ধনী বা মাজেল কালো ও চকচকে হয়।
৬) জার্সি জাতের গাভী বাংলাদেশের আবহাওয়ায় পালনে উপযোগী।
৭) এই গরুর জাতটির গাভীর শারিরীক গঠন ছোট হওয়ায খাদ্যের পরিমাণ কম লাগে কিন্ত দুধ উৎপাদন ঠিকই হয়।
৮) গাভী ভীতু প্রকৃতির কিন্তু ষাড় কিছুটা অবাধ্য স্বভাবের। গাভী মাঝারী আকৃতির এবং ওজন প্রায় ৩৯০ কেজি হয়ে থাকে।
9) গাভীর ওলান চমৎকার। ইংল্যাণ্ডের একটি জার্সি গাতী এক বিয়ানে ২৫০০-৫০০০ লিটার দুধ দেয়।
[৯] হলস্টিন গরুর জাত
১) হলষ্টিন গরুর উৎপত্তি হল্যাণ্ড বা নেদারল্যা্ড। এই গরুর জাতকে পূর্বে হলস্টিন-ফ্রিজিয়ান বলা হত। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে এজাতের গরুদুধাল জাত হিসেবে পালন করা হয়।
২) হলস্টিন গরুর বর্ণ ছোট বড় কালো সাদা ছাপ যুক্ত। তবে পায়ের নিগংশ(হাটুর নীচে) সাধারণত সাদা হয়।
৩) এই গরুর জাত এর গরুর মাথা লম্বাটে ও সোজা হয়। চওড়া মাজেল ও খোলা নস্ট্রিল থাকে।
৪) অন্যান্য গরুর জাত এর গরুর ন্যায় এদরে পিঠ চূড়া থাকেনা।
৫) এই গরুর জাত এর গাভী শান্ত স্বভাবের তবে ষাঁড় উগ্র স্বভাবের হয়। গাভীল ওজন প্রায় ৭৫০কেজি এবং ষাড়ের ওজন প্রায় ১০০০কেজি।
৬) একটি হলস্টিন গরুর জাতটি গাভীর দুধ দিনে তিনবার দোহন করে এক বিয়ানে প্রায় ১৯.৯৯৫ লিটার দুধ পাওয়া যায়।
[১০] হারিয়ানা জাতের গরু
১) ভারতের হারিয়ানা রাজ্যে এ গরুর জাত এর আদি বাসস্থান বলে স্থানের নামানুসারে নাম করণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে এই গরুর জাত পালিত হয়। এটি একটি দ্বৈত উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত গরুর জাত।
২) দেহের গঠন বলিষ্ট ও আঁটসীট। লম্বা গরু পা বিশিষ্ট এই গরুর জাতও উচ্চতায় বেশ লম্বা হয়।
৩) মাথা ও মুখ লম্বা ও গরু। গলা লম্বা কপাল চ্যাপ্টা, চোখ বড় বড় ও উজ্জল। শিং ছোট ও গরু যা উপর দিকে উঠানো থাকে।
৪) মাথার পোল মধ্যস্থ অস্থি বেশ উন্নত। দেহের তলনায় লেজ ছোট ও গরু।
৫) গাভীর ওলান সামনে পিছনে প্রশস্থ। সামনের বাট পিছনের বাট অপেক্ষা লম্বা।
৬) এই গরুর জাতটি কৃষি কাজ বা ভারবহন ও দুধের জন্য বেশ উপযোগী।
৭) একটি গাভী প্রতি বিয়ানে প্রায় ১৪০০ লিটার দুধ দেয়।
[১১] সংকর বা ক্রস
১) দেশী জাতের গাভীর সাথে বিদেশী জাতের ষাঁড়ের সিমেন দিয়ে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সংকর জাতের গরুউৎপাদন করা হয়।
২) আমাদের দেশে প্রধানত হলস্টিন,জার্সি, শাহিওয়াল, সিদ্ধি জাতের ষাঁড়ের সিমেন কৃত্রিম প্রজননে প্রয়োগ করে সংকর জাতের গরুউৎপাদন করা হয়।
৩) সংকর জাতের গরুর বৈশিষ্ট্য তার জাত গুলোর সংমিশ্রণে হয়ে থাকে। তাই সংকর জাতের গরুদেশী অপেক্ষা আকারে হয় এবং বেশী দুধ দেয়।
৪) একটি পূর্ণবয়স্ক জাতের গাভীর ওজন ২০০-৩০০কেজি হয়ে থাকে।
৫) বিদেশী উন্নত জাতের গরুঅনেক সময় আমাদের দেশের আবহাওয়ায় পালনের উপযোগী হয় না। কিন্তু সংকর জাতের পালন আমাদের দেশের জন্য বেশী উপযোগী তাই বাংলাদেশে পালনের জন্য সংকর জাতের গরুউৎপাদনের প্রতি গুরুতু দেয়া হয়েছে।
৬) বাংলাদেশে গরুর জাত হিসেবে ক্রস জাতের গরু সবসময় সারা দেশেই পাওয়া যায়।
তো আজকের মত এখানেই বিরতি, দেখা হবে পরবর্তী আলোচনায় অন্য কোন টপিকে। আপনাদের পশু পালনের সাথে সম্পর্কিত যে কোন প্রশ্ন সমূহ পাঠিয়ে দিন খামারিয়ানের ইমেইলে অখবা জানিয়ে দিন কমেন্ট করে।
যে সকল দর্শক আমাদের চ্যানেলের নতুন যদি পশুদের বিভিন্ন রকম রোগ তাদের চিকিৎসা এবং মেডিসিন সম্পর্কে আরও জানতে চান তারা খামারিয়ান.কম এ নিয়মিত ভিজিট করবেন এবং আমাদের ইউটিউব চ্যানেলটিকেও সাবস্ক্রাইব ও আমাদের ফেসবুক পেজটিতে একটি লাইক দিয়ে রাখবেন রাখবেন। তাহলে নতুন কোন পোষ্ট করা হলে তা সহজেই বুঝতে পারবেন।
আমাদের আজকের এই আলোচনা এখানেই শেষ করে দিচ্ছে সকলে ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন এবং খামারিয়ান এর সাথেই থাকুন। ধন্যবাদ।
খামারিয়ান.কম – সর্বদা খামারিদের পাশে।