আজকে আমরা আলোচনা করবঃ
বিড়াল পালনঃ
◾ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে পোষা প্রাণী হিসেবে বিড়ালের কদর সবচেয়ে বেশি। বিড়াল শান্তশিষ্ট প্রাণী, তার মেজাজ-মর্জিও অন্যসব পোষা প্রাণী থেকে আলাদা।
◾ বিড়ালের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ যুগ যুগ ধরে অব্যাহত। ঠিক কবে থেকে বিড়ালকে পোষা প্রাণী হিসেবে রাখার প্রচলন শুরু হয়, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।
◾ সাইপ্রাস দ্বীপে মানুষ ও বিড়ালের একসাথে কবর দেয়া কঙ্কাল থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিড়াল মানুষের সাথে বাস করছে প্রায় ৮০০০ বছর থেকে।
◾ প্রাচীন মিশরবাসীর ধারণা ছিল বিড়াল একটি পবিত্র প্রাণী। বর্তমানে সমগ্র পৃথিবীতে বিড়াল একটি সর্বধিক জনপ্রিয় পারিবারিক পোষা প্রাণী হিসেবে স্বীকৃত।
◾ বিড়ালকে গৃহপালিত বিড়াল বা হাউস ক্যাটও বলা হয়। বিড়াল একটি ছোট আকৃতির ফিলাইন মাংসাশী স্তন্যপায়ী প্রাণী ।
◾ গৃহপালিত বিড়ালের অধিকতর নিকটবর্তী পূর্বপুরুষ আফ্রিক্যান বন্য বিড়াল (Felis silvestris lybica)।
◾ বিড়াল মানুষের সাথে বাস করছে কম পক্ষে ৩৫০০ বছর থেকে। প্রাচীন মিশরে শস্যকে ইঁদুর-জাতীয় প্রাণী থেকে নিরাপদ রাখার জন্য বিড়াল ব্যবহার করতো।
বিড়াল পালন কি জায়েজঃ
✔ হ্যা বিড়াল পালন জায়েজ। প্রাক-ইসলামি যুগ থেকে শুরু করে নবী করিম (সা.)-এর জামানায় অনেকেই বিড়াল পুষতেন। এমনকি সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনাকারী (৫৩৭৫টি হাদিস তিনি বর্ণনা করেছেন) সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.)- কে বিড়ালের পিতা বলে ডেকেছেন নবী করিম (সা.)। তিনিও বিশ্ববাসীর কাছে আবু হুরায়রা নামে পরিচিত। তার প্রকৃত নাম আবদুর রহমান ইবনে সাখর।
✔ ‘আবু হুরায়রা’ (বিড়ালের বাবা) নামটির পেছনে একটি মজার কাহিনী রয়েছে। এক দিন হজরত আবু হুরায়রা (রা.) জামার আস্তিনের নিচে একটি বিড়ালছানা নিয়ে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হন। সে সময় বিড়ালটি হঠাৎ করে সবার সামনে বেরিয়ে পড়ল। এ অবস্থা দেখে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে রসিকতা করে, ‘হে বিড়ালের পিতা’ বলে সম্বোধন করলেন। এরপর থেকে তিনি আবু হুরায়রা নামে খ্যাতি লাভ করেন। আর সেদিন থেকে তিনি নিজেকে আবু হুরায়রা নামেই পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন।

বিড়াল পালনে উপকারিতা ও অপকারিতাঃ
▶ আমরা শখের বশে অনেকেই বিড়াল পুষি। খুব আদুরে স্বভাবের এবং তাড়াতাড়ি পোষ মানে বলে পোষা প্রাণীর মধ্যে বিড়াল আমাদের প্রথম পছন্দ। তাকে অবশ্যই পরিবারের একজন সদস্য ভেবে আদর যত্নে রাখা উচিৎ। মনে রাখবেন, পোষা বিড়াল ধীরে ধীরে আপনার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে যাবে। ঘরের বিড়ালকে রাস্তায় ছেড়ে দিলে প্রতিকূল পরিবেশে সে বেঁচে থাকতে পারে না । তাই ভেবে চিন্তে বিড়াল ঘরে আনুন।
▶ তাছাড়া ইঁদুর এবং তেলাপোকার উপদ্রব থেকে বাঁচিয়ে ঘর পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব পালন করবে ঘরের ছোট্ট ওই চারপেয়ে সদস্য। পোষা প্রাণী হিসেবে বিড়ালের জনপ্রিয়তা আছে বেশ। উঁচু দালানের ফ্ল্যাটবাড়িতে পোষার জন্য বিড়ালের রয়েছে আলাদা কদর। তবে বিড়াল পালার সঠিক নিয়মগুলো অনেকেই জানেন না। ঘরে একজন বাড়তি সদস্য আনতে চাইলে তার দেখাশুনাও করতে হবে যথেষ্ট সচেতনতার সঙ্গে।
বিড়ালের বিভিন্ন নামকরণঃ
→ বিড়াল ছানা (Kitten)- নবজাত বিড়াল ছানা।
→ পুসী বিড়াল ছানা (Pusy kitten)- অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক স্ত্রী বিড়ার।
→ ক্লোডেন (Clowden) – একদল বিড়ালকে ক্লোডেন বলা হয়।
→ বিড়াল (Cat) – স্ত্রী-পুরুষ উভয় বিড়াল।
→ হুলোবিড়াল ছানা (Tom kitten) – অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ বিড়াল।
→ কুইন/পুসী (Queen/Pusy) – অন্তত ১ বার বাচ্চা প্রসবকারী স্ত্রী বিড়াল।
→ ক্লোডর (Clowder) – বিড়ালের আবাসস্থল।
→ হুলোবিড়াল (Tom cat)- প্রজননক্ষম পুরুষ বিড়াল।
বিড়ালের বৈশিষ্ট্যঃ
(ক) সাধারণত বিড়ালের দৈহিক ওজন ২.৫ থেকে ৭ কেজির মধ্যে হয়। তবে কতিপয় জাতের বিড়াল বিশেষ করে মেনি-কুন (Maine-coon) জাতের বিড়ালের ওজন ১১.৩ কেজি হয় ।
(খ) বৈন্দিদশায় বা বাড়ির মধ্যে পালিত বিড়াল সাধারণত ১৫ থেকে ২০ বছর বাঁচে, তবে ৩৬ বছর বয়স পর্যন্ত বিড়াল বেঁচে থাকার তথ্য রয়েছে।
(গ) কুকুরের মতই বিড়ালের পা আঙ্গুল বিশিষ্ট্য, বিড়াল তার সরাসরি আঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে হাঁটে। বিড়াল নিঃশব্দে হাঁটতে পারে এবং হাঁটার পথে পদচিহ্ন রেখে যায়।
(ঘ) বিড়াল দক্ষ শিকারী। বিড়াল বুদ্ধিমান প্রাণী। কতিপয় ট্রেনিং প্রাপ্ত বিড়াল সাধারণ কাজ নিপুনভাবে করতে পারে যেমন— দরজার ছিটকানি খোলা এবং টয়লেট ফ্লাশ।
(ঙ) বিড়াল নিজেদের মধ্যে সংবাদাদি আদান-প্রদান করে (‘Meow’)।
(চ) বর্তমান যুগেও বিড়াল বন্য প্রাণী হিসেবে বাস করে।
(ছ) বিড়াল দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৮-৩৯° সেন্টিগ্রেড (১০১-১০২.২° ফারেনহাইট)।

বিড়ালের খাদ্য ও শিকারঃ
⇒ বিভিন্ন রকম বিড়াল বিভিন্ন খাবার খেতে পছন্দ করে। বাজারে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের ‘ক্যাট ফুড’। তবে এই খাবার বিড়ালের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এমনটাই জানালেন আটটি বিড়ালের মালিক এমি অপর্ণা বাড়ই। “মুরগির মাংস কিংবা মাছ সেদ্ধ, সঙ্গে একটু ভাত বিড়ালের জন্য সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর খাবার” বললেন এমি। তিনি আরও বলেন, “এক্ষেত্রে মাংস কিংবা মাছ শুধুমাত্র লবণ দিয়ে সেদ্ধ করতে হবে, বিড়ালের খাবার তৈরি করতে হবে সম্পূর্ণ মসলা ছাড়া”। মানুষের কিছু খাবার হতে পারে বিড়ালের জন্য বিষাক্ত।
⇒ অস্ট্রেলিয়ার ওয়েবসাইট ‘ক্যাট ওয়ার্ল্ড’য়েল দেওয়া তথ্য অনুসারে, বিড়ালের জন্য নিষিদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে চকোলেট, কাঁচাডিম, আঙুর ফল, আদা-রসুন- পেঁয়াজ, এমনকি দুধ। বিড়ালকে দুধ খাওয়ানোর প্রচলন অনেক পুরানো হলেও, গবেষণায় দেখা গেছে দুধের কিছু উপাদানের কারণে বিড়ালের ডায়রিয়া হতে পারে।
⇒ এর দুধে টয়রিন/টরিন তেমন থাকেনা। আবার প্রাপ্ত বয়স্ক বিড়াল দুধ শর্করা বা ল্যাকটোজ সহ্য করতে পারে না। তাই ল্যাকটোসহীন দুধ বিড়ালের জন্য নিরাপদ। তবে মাংসের বিকল্প নয়।
⇒ বাড়ীর মধ্যে পালিত বিড়ালের জন্য বালিযুক্ত লিটার বক্সের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অবশ্য বিড়ালের লিটার বক্স টক্সোপ্লাজমোসিস রোগ সংবেদনশীল গর্ভবর্তী মহিলা ও ইমুনো-কম্প্রোমাইজড ব্যক্তির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
⇒ কতিপয় বিড়াল টয়লেটে প্রসব-পায়খানায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং তাদের লিটার বক্সের প্রয়োজন হয় না।
⇒ বিড়াল সুচতুর শিকারী। গৃহপালিত বিড়াল প্রায় এক হাজারের অধিক প্রজাতি শিকার করে খায়। তবে অনেক বড় প্রজাতির বিড়াল ১০০ প্রজাতির নিচে শিকার করে। বিড়ালের বিশেষ বৈশিষ্ট্য গুণ দাঁত রয়েছে এবং পরিপাকতন্ত্র মাংস হজমের উপযোগী।
⇒ বন্দীদশায় বা গৃহপালিত অবস্থায় নিরামিষ ভোজনে দেহের সকল প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড সংশ্লেষণ বা পূরণ হয়না। যেমন— টয়রিন (Taurine) এর অভাবে বিড়ালের রেটিনা ধীরে ধীরে ডিজেনারেট হয়ে অবশেষে অপরিবর্তনীয় অন্ধত্ব দেখা দেয়। এই অবস্থাকে সেন্ট্রাল রেটিনাল ডিজেনারেশন (Central Retinal Degeneration = CRD) বলা হয়।
বিড়ালের প্রজনন প্রক্রিয়াঃ
- বিড়ালের গর্ভাবস্থাকাল প্রায় ৬০ দিন। বিড়াল ৩ থেকে ৫টি বাচ্চা প্রসব করে।
- বিড়াল ছানা মায়ের দুধ খাওয়া ছাড়ে ৬ থেকে ৭ সপ্তাহে। সাধারণত স্ত্রী বিড়াল ৬ মাস এবং পুরুষ বিড়ালের ৭ মাস বয়সের যোনি পরিপক্কতা আসে।
- বিড়াল ঋতুভিত্তিক পলিইস্ট্রাস। অর্থাৎ বছরে অনেকবার ইস্ট্রাস পিরিয়ড হয়।
- বিড়ালের ইস্ট্রাস পিরিয়ড ৪ থেকে ৭ দিন স্থায়ী হয়। প্রজনন করা না হলে ইস্ট্রাস চক্র নিয়মিত বিরতিসহকারে পুনঃপুনঃ সংঘটিত হয়।
- পুরুষ বিড়ালের লিঙ্গে স্পাইন থাকে যা পশ্চাৎদিকে ছুঁচালো। তাই মিলনের পর যোনিনালী থেকে পুরুষ লিঙ্গ বের করার সময় যোনিনালীর প্রাচীর আঁচড়িয়ে যায়। এই আঁচড়ানো অবস্থা বিড়ালের ডিম্বক্ষরণ আরম্ভের জন্য জরুরি। একারণে প্রথম স্ত্রী বিড়াল যখন গরম হয় তখন একের অধিক পুরুষ বিড়ালের সাথে সংগম করে ফলে একসাথে প্রসব করা বিড়াল ছানার মধ্যে বিভিন্ন পিতার বাচ্চা থাকে।

গৃহপালিত বিড়ালের জাত ও ভ্যারাইটিসঃ
বিড়ালের জাতের তালিকা বেশ লম্বা। প্রতিটি জাতের বিড়ালের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। গৃহপালিত বিড়ালকে প্রধানত দু’ভাগে বিভক্ত করা যায়।
১। লম্বা ও মাঝারি লম্বা লোম বিশিষ্ট (Long hair and semi-long hairs) – আমেরিকান ববটেল (American bobtail), সাদা এ্যানগোরা (White agnora), হিমালেয়ন বিড়াল (Himalayan cat), সাদা পারসিয়ান বিড়াল (White Persian cat), সাইবেরিয়ান বিড়াল (Siberian cat) ইত্যাদি।
২। অনতিদীর্ঘ লোম (Short hair) – যেমন বার্মীজ বিড়াল (Burmese cat)।
বিড়ালের পরিচর্যাঃ
- পেশায় ছাত্রী মেহজাবিন বাঁধন বিড়াল পালেন দশ বছর ধরে। তিনি জানান, তার চারটি বিড়াল প্রতি বছর শীত আসার আগে আগেই গোসল করান। শীতের পুরো সময় গোসল দেওয়া উচিত নয় বলেই মতামত বাঁধনের।
- তিনি আরও পরামর্শ দিতে গিয়ে জানান, এমনিতে সারা বছর বিড়ালকে গোসল করাতে হবে প্রতি মাসে অন্তত দুই বার।
- গোসলের সময় মেডিকেইটেড শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে। বাজারে বিড়ালের জন্য আলাদা শ্যাম্পু পাওয়া যায়। এছাড়া সাধারণ উকুন- নাশক শ্যাম্পু ব্যবহার করা যেতে পারে।
- শ্যাম্পু ব্যবহার করলেও উকুন এবং পোকা হতে পারে বিড়ালের গায়ে, এক্ষেত্রে গোসল করানোর পর বিড়ালের জন্য বিশেষ ধরনের স্প্রে পাওয়া যায়, যা ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যাবে। বিড়ালের উকুন নাশক এই বিশেষ স্প্রে পাওয়া যাবে প্রাইভেট পশু চিকিৎসকদের চেম্বারে।
- প্রতিদিন একবার বিড়ালের লোম আঁচড়ে দিতে হবে।
- বিড়ালের পায়খানা- প্রস্রাবের ব্যবস্থা বাড়িতেই করা যেতে পারে। ছোট কোন বোলের মধ্যে বালু দিয়ে রাখতে পারেন ঘরের এক কোণায়। বালু না পেলে ব্যবহার করতে পারেন ছাই, কিংবা খবরের কাগজ। তবে সিমেন্ট ব্যবহার না করার পরামর্শ দিলেন বিড়াল পালক দীপান্বিতা হৃদি।
- এছাড়াও সুপারশপগুলোতে পাবেন ‘লিটার বক্স’, সরাসরি বিদেশ থেকে আমদানি করার কারণে এগুলোর দাম পড়বে বেশি।