বিষয়: বিদেশি মাছের চাষ: সাইপ্রিনাস্কার্পি, তেলাপিয়া, নাইলোটিকা, গ্রাস্কাপ, সিলভার কার্প, আফ্রিকান মাগুর, রাজপুটি মাছ এর বৈশিষ্ট্য ও মাছ চাষ।
১. সাইপ্রিনাস্কার্পিও মাছ চাষ
এ মাছ দেখতে অনেকটা আমাদের রুই মাছের মতো। শারীরিক আকৃতি রুইয়ের মতো হলেও এদের দেহের রঙ বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। যেমন: লাল, হলুদ, সাদা ইত্যাদি। জাপান, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতে এ মাছের আবাদ অপেক্ষাকৃত বেশি।
এরা পুকুরে ডিম ছাড়ে এবং ডিম থেকে পোনা হয়। পৌষ ও মাঘ মাসের কনকনে শীতে এরা পুকুরে থাকে এবং ২-৩ দিনের মধ্যে ডিম থেকে ডিম পোনা হয়। ডিমগুলো আকারে সরষের দানার মতো এবং রঙ স্বচ্ছ অথবা হলুদ বর্ণের হয়ে থাকে।
পুকুরে ছাড়ার সময় এ মাছগুলোকে অত্যন্ত উত্তেজিত দেখায় এবং খুব ছোটাছুটি করে। এ সময় এরা কখনো কখনো ভাসমান জলজ উদ্ভিদগুলোকে কামড়াতে ও পুরুষ মাছ মেয়ে মাছটিকে দৌড়াতে দেখা যায়।
দৌড়াদৌড়ি ও ছোটাছুটির সময় মেয়ে মাছ ডিম ছেড়ে দেয় এবং পুরুষ মাছ বীর্য স্থলন করে ও ডিমগুলোকে নিষিক্ত করে। নিষিক্ত ডিম ভেসে ওঠে এবং ভাসমান জলজ উদ্ভিদের ডালপালা, কচুরির ছোবলায় বা মলে প্রচুর পরিমাণ ডিম লেগে থাকে। ১০-১২ দিনের মধ্যে ডিম পোনাগুলো ধানী পোনাতে রূপান্তরিত হয়। এক জোড়া কার্পো মাছ হতে ১০ হাজার পর্যন্ত ধানী পোনা পাওয়া যায়।
আঁতুড়ে পুকুরে কার্পো মাছের রেণুপোনা ছাড়ার পর ১০-১৫ দিনের মধ্যে ১ ইঞ্চি বড় হয়ে যায়। বাল্যাবস্থায় এরা পুকুরের চারধারে দল বেঁধে ঘোরাফেরা করে এবং পুকুরের খাবারসমূহ অতি অল্প সময়ের মধ্যে খেয়ে শেষ করে ফেলে। তাই এদের বৃদ্ধিও চমৎকার।
খাদ্যাভাস অনুযায়ী এ মাছগুলোকে পেটুক মাছও বলা চলে। আঁতুরে পুকুরে খাবারের প্রাচুর্যতা থাকলে রেণু পোনাসমূহ একদিকে যেমন তাড়াতাড়ি বড় হয়, অন্যদিকে তেমনি খাবারের অভাবে এদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে যেতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ১০ হাজার রেণু ছেড়েও খাবারের অভাব হেতু পুকুর হতে ৩০০-৪০০ এর বেশি পাওয়া যায় না।
মাছগুলো খুবই চঞ্চল প্রকৃতির এবং ছোটাছুটি খুব বেশি করে। সে জন্যেই খাবারের তাগিদও অনেক বেশি। খাবারের অভাব না হলে পুকুরের পানিতে একটি মাছ বছরে ৩-৪ সের হয়ে যায়।
এ মাছগুলো পেটুক এবং এদের খাবারের হার খুব বেশি। তাই এদের সংগে দেশজ রুই, কাতলাগুলো খাবার নিয়ে পাল্লা দিয়ে চলতে পারে না। ফলে এ দুই শ্রেণীর মাছকে একত্রে চাষ করা যায় না।
২. তেলাপিয়া মাছ চাষ
তেলাপিয়া ১৯৫৪ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের কই মাছের মতো।
এরা শেওলা ও জলজ উদ্ভিদ ক্ষুদিপানা, কলমিলতা প্রভৃতি আহার করে। ছোট চিংড়ি, ছোট মাছ, জলজ কীট ও কীটাণু ইত্যাদিও এরা আহার করে। চালের গুড়া, গমের ভূষি, এগুলো এদের কৃত্রিম খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এগুলো মশার শুককীটও খেয়ে থাকে।
এগুলোকে পুকুর-দীঘিতে আবাদ করা যায় এবং পুকুর-দীঘিতে এরা ডিম দেয়। উপযুক্ত পরিবেশে তেলাপিয়া মাছ বছরে ৩-৪ বার ডিম ছাড়ে। এক বছরে একজোড়া তেলাপিয়া থেকে প্রায় ১০ হাজার পোনা মাছ পাওয়া যায়।
৪ মাস বয়স হলেই তেলাপিয়া প্রজনন ক্রিয়া শুরু হয়। প্রজনন ক্রিয়া ও ডিম পাড়ার সময় এরা পানির নিচে চলে যায়। এ সময় এদেরকে ঝাঁকে ঝাঁকে পানির উপর ভেসে বেড়াতে দেখা যায়। ডিম দেওয়ার পূর্বে পুরুষ মাছটি মাটিতে গর্ত করে আবাস তৈরি করে এবং ঐ আবাসেই মেয়ে মাছটি ডিম দিয়ে থাকে ও পুরুষ মাছটি বীর্য স্থলন করে। বীর্য ডিমগুলোকে নিষিক্ত ডিম মেয়ে মাছটি তার মুখে তুলে নেয়। এ সময় স্ত্রী মাছ কিছুই খায় না। নিষিক্ত ডিমগুলোকে মুখের মধ্যে রাখার ১২ দিন পরে ডিম থেকে রেণু পোনার জন্ম হয়। একই পদ্ধতিতে রেণু পোনাগুলোকেও মা আরো অন্ততপক্ষে ১০-১২ দিন রক্ষণাবেক্ষণ করে। এরপর ৩-৪ মাস বয়স হলেই এ মাছগুলো আবার পরিপক্ক হয়।
জিওল মাছের মতোই এদের প্রাণ খুব শক্ত এবং কম অক্সিজেনে বাস করতে পারে।
শীতকালে এদেরকে গর্ত করে মাটির আশ্রয়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু অন্যান্য ঋতুতে এরা ঝাঁকে ঝাঁকে পানির উপরের স্তরে ভেসে বেড়ায়।
পুকুর, ডোবা, গর্ত, বিল, হাওড়-বাওড় এমনকি বোরো ধানের ক্ষেতেও এর আবাদ করা চলে। স্বাদু ও লবণাক্ত দু প্রকার পানিতে এগুলোর চাষ করা হয়। নদ-নদীতে এর আবাদ ফলপ্রসূ হয় না।
তেলাপিয়ার বংশবৃদ্ধি খুব দ্রুত হয়। ১ বিঘা আন্দাজ পুকুরের ১০০টি বয়স্ক মাছ ছাড়া হলে ১ বছরে পুকুর ভরে যায়।
৩. নাইলোটিকা মাছ চাষ
দ্রুত আমিষ জাতীয় খাদ্যের অভাব দূর করার জন্য ১৯৭৪ সালে থাইল্যান্ড থেকে নাইলোটিকা নামক এক নতুন প্রজাতির মাছের পোনা আমদানি করা হয়। এ মাছের চাষ করে আমরা আমাদের দীর্ঘ-পুকুর, ডোবা ও পরিত্যক্ত সব রকম জলার সদ্ব্যবহার করে খুব তাড়াতাড়ি আমিষ জাতীয় খাদ্যের অভাব দূর করতে পারব বলে বিশেজ্ঞগণের বিশ্বাস।
নাইলোটিকা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। ৩ মাসে এ মাছ লম্বায় ৫ ইঞ্চি এবং ওজনে প্রায় ১ পোয়ার মতো হয়। এ সময় থেকেই এদের খাওয়া চলে।
৩ বছরে নাইলোটিকা প্রায় আড়াই কেজি ওজনের হয়। নাইলোটিকার বংশ বৃদ্ধি করার ক্ষমতা খুবই বেশি।
৩ মাস বয়সেই এ মাছ প্রজননে সক্ষম হয়। বছরে ৪ বার স্ত্রী-মাছ ডিম দিয়ে বংশ বৃদ্ধি করে থাকে।
মিঠা ও লবণাক্ত এ দু রকম পানিতেই নাইলোটিকা বেঁচে থাকতে পারে। নাইলোটিকা ৯°– ৩৩° সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রার পরিধিতে বেঁচে থাকতে সক্ষম। জিয়ল মাছের (শিং ও মাগুর) মতো নাইলোটিকা অল্প অক্সিজেনযুক্ত পানিতে বেঁচে থাকতে পারে।
আমাদের দেশের জলাশয়সমূহের যে সব শেওলা ও জলজ কীটপতঙ্গ, পোকা-মাকড় জন্মে, নাইলোটিকা সে সব খেতেই পছন্দ করে। তাছাড়া রান্নাঘরের আবর্জনা, চালের কুড়া, গমের ভূষি ইত্যাদি ও এসব মাছ তাদের খাদ্য হিসেবে বেশ পছন্দ করে।
নাইলোটিকার আদি বাসস্থান আফ্রিকা কালক্রমে এ মাছ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। নাইলোটিকার দেহের গঠন তেলাপিয়া গোত্রের অন্যান্য মাছের মতো। আকারে এরা অন্যান্য তেলাপিয়ার চেয়ে বড় হয়। নাইলোটিকার দেহ ছাই রং-এর। পাখনাও লেজ হলদে রং-এর। পিঠ ও লেজের পাখনায় সোনালি ডোরা কাটা দাগ থাকে।
স্ত্রী নাইলোটিকার দেহ কিছুটা নিষ্প্রভ। স্ত্রী মাছ সাধারণত পুরুষ মাছের চেয়ে ছোট হয়ে থাকে।
প্রসবের আগে পুরুষ মাছ পুকুরের ১ থেকে দেড় ফুট গভীর অংশে বাসা তৈরি করে। গর্ত বানিয়ে বাসা তৈরি শেষে হলে পুরুষ নাইলোটিকা ঐ বাসায় ডিম ছাড়ার জন্য একটি স্ত্রী মাছকে আমন্ত্রণ জানায়।
প্রসবকালে স্ত্রী মাছের ছেড়ে দেওয়া ডিম গর্তের মধ্যে জমা হয়। প্রজননের পর স্ত্রী মাছ ঐ সব ডিম গর্ত থেকে তুলে মুখে রেখে দেয়। স্ত্রী-মাছ প্রতিবারে এক সাথে ১৫টি ডিম ছাড়ে। স্ত্রী মাছ বাসা থেকে ডিম মুখে তুলে নেওয়ার পর পুরুষ মাছ স্ত্রী- মাছকে তাড়িয়ে দিয়ে অন্য একটি স্ত্রী মাছকে ঐ বাসায় ডিম ছাড়ার সুযোগ দেয়।
নাইলোটিকা সারা বছর ধরেই ডিম দিয়ে পোনা ফুটিয়ে থাকে। প্রতিটি স্ত্রী মাছ বছরে ৪ বার ডিম ছাড়ে। ৩ থেকে ৫ দিনের মধ্যে ২৫°-৩৩° সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রায় স্ত্রী মাছের মুখের ভিতর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। সদ্য ফোটা রেণু পোনা তাদের বড় আকারের ডিম থলির জন্য চলাফেরা করতে পারে না। এ অবস্থায় স্ত্রী-মাছ তাদের মুখেই বাচ্চাদের রেখে দেয় এবং মাঝে মাঝে মুখ থেকে বের করে রেণু পোনাগুলো চলাফেরা করার উপযুক্ত হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে থাকে।
এ সময় যদি রেণু পোনা ভয় পায় বা শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে স্ত্রী মাছ তৎক্ষণাৎ তাদের মুখে তুলে নিয়ে পালিয়ে যায়। প্রসবের ১০-১২দিন পর স্ত্রী-মাছ পোনাগুলোকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার জন্য মুখ থেকে বের করে দেয়। এ সময় কচি মাছগুলো দলবদ্ধ হয়ে পুকুরের অগভীর অংশে অবস্থান করে থাকে।
রেণুপোনা পুরুষের পাড় সংলগ্ন এলাকা থেকে ক্ষুদে রটিফার (Rotifer) জাতীয় প্রাণী ও থিতানো আবর্জনা থেকে খাদ্য কুড়িয়ে আহার করে থাকে। পোনা মাছ আকারে ১ থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বা হয়ে চালের গুড়া ও অন্যান্য সম্পূরক খাদ্য গ্রহণ করতে পারে।
বড় আকারের পোনা ৩ থেকে ৫টি একত্রিত হয়ে ছোট দলে ভাগ হয়ে প্ল্যাঙ্কটন্সহ অন্যান্য উদ্ভিদ জাতীয় খাদ্য খেতে শুরু করে। নাইলোটিকা সাধারণত ৩ মাসে ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি লম্বা হয়ে পূর্ণবয়স্ক মাছে পরিণত হয়। এ বয়সেই নাইলোটিকা বংশ বৃদ্ধি করতে পারে।
প্রথম বছরে নাইলোটিকার বৃদ্ধির গতি বেশি থাকে এবং এক বছরে ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। নাইলোটিকা ক্ষুদে প্লাঙ্কটন্ থেকে শুরু করে উদ্ভিদ ও প্রাণিজ আমিষসহ বড় বড় রুটির টুকরো খেতে পারে। কোনো বড় আকারের খাদ্য বস্তু পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দিলে এসব মাছ তা ঠুকরিয়ে ঠুকরিয়ে খেয়ে ফেলে।
৪. গ্রাস্কাপ মাছ চাষ
মোটামুটিভাবে এ মাছটি আমাদের রুই মাছের মতোই। এদেশীয় রুই মাছের মতোই এর কোনো শুঙ নেই। গলায় চিরুণীর দাঁতের মতো দু সারি দাঁত আছে। এর শরীরের রঙ পেটের দিকে রূপালি ও সাদা বর্ণের এবং পিঠের দিকে কালচে ধূসর বর্ণের হয়ে থাকে।
আমাদের স্বাদু পানির পুকুর দীঘি ও এমনকি কিছুটা লবণাক্ত পানির দীঘিতেও এ মাছের আবাদ করা যায়। বদ্ধ জলাশয়ে এরা কখনো ডিম দেয় না। হরমোন ইন্জেশনের সাহায্য এসব জলাশয়ে এগুলোকে ডিম পাড়ানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। চিন দেশে এ মাছগুলো মে থেকে জুন মাসের মধ্যে বিভিন্ন নদ-নদীতে ডিম দিয়ে থাকে। খরস্রোতা নদীর মাঝখানে এগুলো ডিম দেয় এবং ডিমগুলো পুরুষ বীর্য কর্তৃক নিষিক্ত হয়।
ডিম থেকে ডিমপোনা বের হয়ে আসতে ৩০ থেকে ৪০ ঘণ্টা সময় লাগে এবং ১৫-২০ দিনের মধ্যে ডিমপোনাগুলো পূর্ণাঙ্গ পোনায় পরিণত হয়।
শিশু অবস্থায় এ মাছগুলো জোপ্ল্যাঙ্কটন্ ও ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন এ দু জাতীয় খাদ্যই খেয়ে থাকে। আকারে পোনাগুলো যখন ২.৫ সেন্টিমিটার বড় হয় তখন থেকেই এরা ধীরে ধীরে জোপ্ল্যাঙ্কটন খাওয়া ছেড়ে দিয়ে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হতে থাকে। অবশ্য শিশু অবস্থায় এ মাছগুলো চালের কুড়া, গমের ভূষি ও শুকনো গোবরের চূর্ণ প্রভৃতি কৃত্রিম খাবারসমূহ ভক্ষণ করে থাকে।
শিশুকাল কাটিয়ে এ মাছটি যখনই বড় হতে হতে নলা মাছের আকার ধারণ করে, তখন থেকেই এরা জলজ ঘাস, ঘাসের পাতা, গাছ-গাছড়ার শাখা প্রশাখা প্রভৃতি খাওয়া শুরু করে। খাবারের দিকে থেকে পেটুক শ্রেণির আওতাভুক্ত এবং জলজ গাছ-গাছড়ার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ থাকায় এগুলোকে ‘তৃণভোজী মাছ’ বলা হয়।
জলজ জংলা পরিষ্কার করার জন্য এ মাছগুলোর চাহিদা আজকাল দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এরা অতি অল্প সময়ের মধ্যে পুকুরের প্রায় সর্বপ্রকার গাছ-গাছড়াই খেয়ে সাবাড় করে দিতে পারে। এরা চঞ্চল প্রকৃতির এবং এদের হজম শক্তিও বেশি। খাবারের পর পরই এগুলোকে ঘন ঘন মলত্যাগ করতে দেখা যায়।
৫. সিলভার কার্প মাছ চাষ
এ মাছের উৎপত্তি চিনে এবং এটা চিনা কার্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাছ। এ মাছ খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। আমাদের দেশিয় কাতলার ন্যায় পানির উপরের স্তরে থাকে এবং ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদ খেয়ে জীবন ধারণ করে। তাই যেসব পুকুরের পানি সবুজ সে সব পুকুরে এদের বৃদ্ধি খুবই সন্তোষজনক।
পুকুরের তারতম্য ভেদে বিঘাপ্রতি পুকুরে ২ শত থেকে ৫ শত পোনা ছাড়া এবং গড়ে কম পক্ষে বছরে ১টি মাছ ১ সের হয়।
এ মাছের প্রজনন প্রক্রিয়া আমাদের দেশিয় রুই কাতলার মতোই। আমাদের রুই জাতীয় মাছের মতো এরা বর্ষা মৌসুমে বিশেষ বিশেষ নদীতে বিশেষ অবস্থায় প্রজনন করে। কৃত্রিম উপায়ে ও এদেরকে বদ্ধ জলাশয়ে প্রজনন করানো যায়।
৬. আফ্রিকান মাগুর মাছ চাষ
মাগুর আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয় মাছ। এ মাছ খেতে সুস্বাদু এবং অধিক পুষ্টিযুক্ত। ১৯৮৯ সাথে থাইল্যান্ড থেকে মাগুরের একটি প্রজাতি বাংলাদেশে আনা হয়। এ মাছটির আদি নিবাস আফ্রিকায়। এজন্য এ মাছটি ‘আফ্রিকান মাগুর’নামে পরিচিত। থাইল্যান্ড থেকে এ মাগুর দেশে আনা হয়েছে বিধায় অনেকে এটিকে ‘থাইমাগুর’ও বলে থাকে।
আফ্রিকান মাগুর দেশি মাগুর অপেক্ষা অনেক বড় হয়। আফ্রিকান মাগুর রাক্ষুসে শ্রেণিভুক্ত মাছ। এ জন্য অন্য মাছের সাথে এ মাছ চাষ করা যায় না। এককভাবে চাষ করতে হয়।
আফ্রিকান মাগুরের বৈশিষ্ট্য ও চাষের সুবিধা
১. এ মাছ খুব তাড়তাড়ি বাড়ে।
২. অল্প জায়গায় এক সংগে অধিক মাছ চাষ করা যায়।
৩. এ মাছের রোগ-বালাই কম।
৪. ডোবা পুকুর যেখানে ৪-৫ মাস পানি থাকে সেখানেও এ মাছ চাষ করা যায়।
৫. ৩ মাসেই এ মাছ খাবার যোগ্য আকারের হয়। কৃত্রিম উপায়ে সহজেই এ মাছের পোনা উৎপাদন করা যায়।
৭. প্রায় সারা বছরই এ মাছের পোনা পাওয়া যায়।
৮. শহর এলাকায় চৌবাচ্চায় এবং গ্রামে ছোট পুকুরে বা পাগাড়ে এ মাছ চাষ করা যায়।3
আফ্রিকান মাগুরচাষের সম্ভাবনা:
আমাদের দেশে যেমন গ্রামাঞ্চলে বাড়ির আশেপাশে ২-১ টি পাগাড় থাকে তেমনি শহরেও অনেক বাসায় সিমেন্টের ট্যাঙ্ক বা চৌবাচ্চা আছে। এসব পাগাড় বা ট্যাঙ্কে সহজেই এ মাছ চাষ করা যায়।
পুকুর নির্বাচন:
পুকুরের আয়তন ১০-৪০ শতক এবং পানির গভীরতা ১-১.৫ মিটার হলে ভালো হয়। তবে ১ শতক আয়তনের জলাশয়েও এ মাছ চাষ করা যায়। মৌসুমীও স্থায়ী উভয় পুকুরেই এ মাছ চাষ করা যায়।
পুকুর প্রস্তুতি:
রাজপুটির জন্য যেভাবে পুকুর প্রস্তুত করা হয় হয়েছে, মাগুরের বেলায়ও সেভাবেই পুকুর প্রস্তুত করতে হবে।
পোনা ছাড়া:
পোনা ছাড়ার পরদিন থেকে প্রতিদিন প্রতি শতকে পুকুরে ১৫০ গ্রাম গোবর প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরের পানিতে সবুজ শেওলার আস্তর পড়লে কয়েকদিন গোবর দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে।
খাদ্য সরবরাহ:
এ মাছের পুকুরে অবশ্যই সম্পূরক খাদ্য দিতে হবে। পোনা ছাড়ার দিন থেকে পুকুরে খাদ্য দিতে হয়। খাদ্য হিসেবে প্রতি শতকে ১ কেজি সরিষার খইল, ১ কেজি চাউলের কুঁড়া এবং ০.৫ কেজি শুটকি মাছের বর্জ্য পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
পুকুরে প্রতিদিন দেওয়ার জন্য ৬০ ভাগ খইল, ২০০ ভাগ গমের ভূষি এবং ২০ ভাগ চাউলের কুঁড়া একত্রে মিশিয়ে খাবার তৈরি করা যেতে পারে। এ ছাড়া শামুক-ঝিনুকের মাংস, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির নাড়িভূড়ি কেটে খাদ্য হিসেবে দেওয়া যায়।
মাছ ধরা:
২ মাসেই এ মাছ ২৫০-৩০০ গ্রাম হয়ে থাকে। পোনা ছাড়ার ২ মাস পর বড় মাছগুলো ধরে বিক্রি করে দিতে হবে। এভাবে ৪ মাসে মাগুরের একটি পূর্ণ ফসল পাওয়া যায়। এতে প্রতি শতকে ৫০-৭৫ কেজি মাছ উৎপাদন করা যায়। এ নিয়মে চাষ করলে একটি পুকুরে বছরে ৩ বার এ মাছের চাষ করা যায়।
বিশেষ পরিচর্যা:
আফ্রিকান মাগুর খুব দ্রুত বাড়ে। এজন্য খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের পরিমাণ বেশি থাকলে ভালো হয়। পুকুরে খাদ্যের অভাব হলে এ মাছ নিজের পোনা বা অন্য মাছের পোনা খেয়ে ফেলে। এতে উৎপাদন খুব কমে যায়। তাই পুকুরে চাষের সময় কোনো ক্রমেই যাতে এদের খাদ্যাভাব না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। মাছটি যাতে খালে, বিলে, নদী বা মুক্ত জলাশয়ে না যায়, সেজন্য অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে।
৭. রাজপুটি মাছ চাষ
পরিচিতি:
রাজপুটি দেখতে অনেকটা আমাদের দেশিয় সরপুটির মতোই। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে এ মাছের চাষ হচ্ছে। এ মাছটি থাইল্যান্ড থেকে ১৯৭৭ সালে এ দেশে আনা হয়েছে।
রাজপুটি মাছের দেহ বেশ চেপ্টা ও পাতলা। দেহ রূপালি আঁইশ দিয়ে ঢাকা। পিঠের উপরের রং কিছুটা গাঢ় ধূসর, পিঠের পাখনার গোড়া একটু উঁচু। মুখের গহ্বরে ৩ সারি দাঁত আছে।
এ মাছের কোনো পাকস্থলী নেই। অন্ননালীর মধ্যেই এরা খাদ্য পরিপাক ক্রিয়া সম্পন্ন করে। এরা সব ধরনের খাবার খায়। তবে ক্ষুদিপনা এ মাছের প্রিয় খাদ্য। রাজপুটি বছরে ৫৫০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাধারণত কৃত্রিম উপায়ে এ মাছের পোনা উৎপন্ন করা হয়।
রাজপুটি মাছের গুণাবলি ও চাষের সুবিধা:
এ মাছের গুণ অনেক এবং সুবিধাও অনেক। যেমন:
ক. এটি উচ্চ ফলনশীল ও সুস্বাদু মাছ।
খ. বাজারে চাহিদা ও মূল্য বেশি।
গ. ছোট বড় সব ধরনের ডোবা, পুকুরেও নালায় এ মাছ চাষ করা যায়।
ঘ. এ মাছ প্রায় সব ধরনের প্রাকৃতিক ও সম্পূরক খাদ্য খায়।
ঙ. অল্প সময়ে (৪ থেকে ৬ মাস) লাভজনকভাবে এ মাছ চাষ করা যায়।
চ. হ্যাচারিতে সহজেই পোনা উৎপাদন করা যায়।
ছ. একটি পুকুরে বছরে ২ বার চাষ করা যায়।
জ. এ মাছের রোগ বালাই কম এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি।
রাজপুটি চাষের সম্ভাবনা:
বসতবাড়ির আশেপাশের ছোট পুকুরে সাধারণত ৫-৬ মাসের বেশি পানি থাকে না। এসব পুকুর রুই-কাতলা জাতীয় মাছ চাষের উপযোগী নয়। তবে এসব মৌসুমী জলাশয়ে লাভজনকভাবে রাজপুটির চাষ করা যায়। এতে একদিকে পরিবারের আমিষের চাহিদা পূরণ হবে, সেই সাথে মাছ বিক্রি করে বাড়তি আয়ও হবে।
রাজপুটির চাষ পদ্ধতি:
রাজপুটি চাষের পদ্ধতি নিম্নে তলে ধরা হলো:
পুকুর নির্বাচন:
এ মাছ চাষের জন্য নির্বাচিত পুকুরের আয়তন ৪০০-১,০০০ বর্গমিটার হলে ভালো হয়। মৌসুমী কিংবা স্থায়ী উভয় পুকুরেই এ মাছের চাষ করা যায়।
পুকুর প্রস্তুতি:
পুকুরে রাক্ষুসে ও বাজে মাছ থাকলে ঘন ফাঁসের জালটেনে তা দূর করা যায় অথবা রোটেনন্ বা ফস্টক্সিন্ ওষুধ দিয়ে এসব মাছ মেরে ফেলা যায়। এ জন্য প্রতি ঘনমিটার পানিতে ১.৫-২.০ গ্রাম রোটেনন্ বা ০.৫ গ্রাম ফস্টক্সিন্ প্রয়োগ করতে হয়। পুকুরের পাড় ভাঙা থাকলে তা মেরামত করে নিতে হবে। আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
ফস্টক্সিন্ ব্যবহার পদ্ধতি:
ফস্টক্সিন ট্যাব্ব্লেট হিসেবে পাওয়া যায়। এটা ‘বিষটোপ’ নামেও পরিচিত। পুকুরের প্রতি ৪০০ বর্গমিটার (প্রতি শতকে) ৩০ সেন্টিমিটার পানির গভীরতার জন্য ৩ গ্রাম ফস্টক্সিন্ প্রয়োগের ১-২ ঘণ্টা পর মাছ ভাসতে শুরু করলে তা তুলে ফেলতে হবে। ফস্টক্সিন্ দিয়ে মারা মাছ খাওয়া উচিত নয়। এ ওষুধের বিষক্রিয়ার মেয়াদকাল ৭-১০ দিন। তাই এ ওষুধ প্রয়োগের ১২-১৫ দিন পর পুকুরে মাছ ছাড়া উচিত।
চুন প্রয়োগ:
রাক্ষুসে ও বাজে মাছ অপসারণের পর পুকুরে প্রতি ৪০ বর্গমিটারে (প্রতি শতকে) ১ কেজি হারে পাথুরে চুন পানিতে গুলে ছিটিয়ে দিতে হবে।
সার প্রয়োগ:
চুন দেওয়ার পর পুকুরে জৈব ও রাসায়নিক সার দিতে হবে। জৈব সার হিসেবে পুকুরে প্রতি শতকে ৫-৭ কেজি গোবর বা ৩-৪ কেজি মুরগির বিষ্ঠা দেওয়া যায়। রাসায়নিক সার হিসেবে প্রতি শতকে ইউরিয়া ১০০-১৫০ গ্রাম, টি.এস.পি ৫০-৭০ গ্রাম, এম.পি ১৫-২০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হয়। পরিমাণমতো জৈব ও রাসায়নিক সার একটি পাত্রে নিয়ে পানিতে গুলে সারা পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হয়।
পোনা মজুদ:
সার প্রয়োগের ১ সপ্তাহের মধ্যে পানির রং সবুজ হলে পুকুরে রাজপুটির পোনা মজুদ করতে হবে। প্রতি শতকে ১০০টি পোনা ছাড়া যায়। বৈশাখ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত রাজপুটির পোনা পাওয়া যায়। পোনা পলিথিনের ব্যাগে অক্সিজেন দিয়ে বা মাটির পাতিলে পরিবহণ করা যায়। পাতিলে পোনা নিলে পাতিলের পানি সব সময় নাড়াতে হবে। তা না হলে অক্সিজেনের অভাবে পোনা মারা যেতে পারে।
পোনা চাড়ার পদ্ধতি:
খামার থেকে পোনা আনার পর তা সাথে সাথে পুকুরে ছাড়া উচিত নয়। পোনা ভর্তি ব্যাগ বা পাতিল পুকুরের পানিতে কিছুক্ষণ ভাসিয়ে রাখতে হবে। এরপর পোনার পাত্রে অল্প অল্প করে পুকুরের পানি দিতে হবে। তারপর আস্তে আস্তে পোনার পাত্র কাত করে পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে।
সার প্রয়োগ:
পোনা মজুদের পর পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রয়োজনীয় যোগান দেওয়ার জন্য নিয়মিত সার প্রয়োগ করতে হবে। ১ সপ্তাহ পর প্রতি শতকে ১০ কেজি গোবর বা ৫ কেজি মুরগির বিষ্ঠা বা ৫০০ গ্রাম কমপোস্ট গুঁড়া, ২০-২৫ গ্রাম ইউরিয়া, ১০ গ্রাম টি.এস.পি এবং ৫ গ্রাম এম.পি সার পূর্বের নিয়মে দিতে হবে।
সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ:
পোনা মজুদের পরদিন থেকে পুকুরে প্রতিদিন সময়মতো খাদ্য দিতে হবে। পুকুরে দিনে ২ বার খাদ্য দেওয়া উচিত। চালের কুঁড়া এ মাছের উত্তম খাদ্য।
মাছ বৃদ্ধির হার পরীক্ষা:
মাসে মাসে জালটেনে মাছের বৃদ্ধি পরীক্ষা করতে হবে। যদি মাছের দেহ সবল মনে হয়, রং উজ্জ্বল হয়, গায়ে পিচ্ছিল পদার্থ থাকে, কোনো ক্ষতের চিহ্ন না থাকে এবং পাখনাগুলো স্বাভাবিক থাকে তবে বুঝতে হবে মাছের স্বাস্থ্য ভালো আছে।
মাছ ধরা:
১৫০-২৫০ গ্রাম ওজনের রাজপুটি খাওয়ার উপযোগী এবং বাজারে এর চাহিদা বেশি। ৩-৪ মাস পর রাজপুটি ১৫০-২০০ গ্রাম হলে সেগুলো জাল দিয়ে ধরে বিক্রি করা উচিত ৷ বাকি ছোট মাছ পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। এমনিভাবে মৌসুমী পুকুরে ৬-৭ মাসেই সব মাছ ধরে নিতে হবে। স্থায়ী পুকুরে হলে এ মাছ আরো বড় করে বিক্রি করা যায়। সাধারণ পদ্ধতিতে চাষ করলে প্রতি শতকে ৬ মাসে ১০-১৫ কেজি রাজপুটি মাছ উৎপাদন করা যায়।