প্রিয় খামারিয়ান পাঠকবৃন্দ, আপনাদের সালাম জানিয়ে শুরু করছি আজকের পোষ্ট, যেখানে আমারা আলোচনা করব ভাসমান বেডে সবজি চাষ/ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ পদ্ধতিঃ উপকারিতা, বেড তৈরির স্থান নির্বাচন, বেডের আকার, (খাপ) উপকরণ, ৰেড তৈরির সময়, নিয়ম, চারা তৈরি, বীজ বপন, যেসব ফসল চাষ করা যায় ও ফসলের পরিচর্যা। (ধাপে ফসল চাষ) সম্পর্কে। আপনি যদি তা জানতে ও শিখতে চান শেষ অবধি পোষ্টটি পড়ুন ও খামারিয়ানের সাথেই থাকুন।
আজকে আমরা আলোচনা করবঃ
ভাসমান বেডে ফসল চাষ প্রযুক্তি কি কেন কিভাবেঃ
◼ বন্যা ও জলাবদ্ধ এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন কৌশল হিসেবে ভাসমান ধাপে সবজি ও মশলা চাষ একটি লাগসই প্রযুক্তি। ভাসমান বেডে সবজি ও মশলা চাষ পদ্ধতিতে নিচু, পতিত, জলমগ্ন, খাল, হাওড় বা হ্রদে অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় আনা যায়।
◼ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অভিযোজন কৌশল হিসেবে বাংলাদেশের ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি ও মশলা উৎপাদন পদ্ধতি জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও) কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে।
◼ কচুরিপানায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়ামের পরিমাণ পচা গোবর বা কম্পোস্ট অপেক্ষা বেশি থাকে। তাই কম পরিমাণে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করে ভাসমান বেডে জৈব পদ্ধতিতে পরিবেশবান্ধব ফসল উৎপাদন করা যায়।
◼ এ পদ্ধতিতে একই জমিতে পরিকল্পিতভাবে মাছ, সবজি ও মশলা চাষ করা যায়। জলাবদ্ধ এলাকায় গরিব কৃষকদের আয় বাড়ে এবং সারা বছর কাজের সুযোগ তৈরি হয়। মৌসুম শেষে ধাপ পচিয়ে প্রচুর পরিমাণে জৈব সার উৎপাদন করা যায়। এসব জৈব সার জমিতে ব্যবহার করে জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ করা যায়।
◼ পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার কৃষকরাই প্রথম ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছেন প্রায় দেড়শ বছর আগে।
◼ বিল এলাকা হওয়ায় নাজিরপুর উপজেলার দেউলবাড়ী ও দোবড়া ইউনিয়নের বেশির ভাগ জমি পানিতে ডুবানো থাকত। বছরের পর বছর জুড়ে পতিত এ জমিতে কচুরিপানা, দুলালীবন, শেওলা ও ফেনা ঘাসে ভরা থাকত। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে স্থানীয় কৃষকরা সম্মিলিত উদ্যোগে জমির পানিতে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া কচুরিপানা, শেওলা, দুলালীবন পচিয়ে সারি সারি কান্দি (আইল) তৈরি করে তার উপর ফসল চাষের চেষ্টা করে সফল হন। ইতিমধ্যে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ দেশের বন্যা ও জলাবদ্ধপ্রবণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।
ভাসমান বেডে বা ধাপে ফসল চাষের উপকারিতাঃ
- ভাসমান বেডে ফসলের উৎপাদন খরচ কম।
- সারা বছর বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে যখন সবজি চাষের জমি পানিতে তলিয়ে যায় অথবা বৃষ্টির পানি জমে থাকার কারণে সমতল ভূমিতে সবজি চাষ করা যায় না তখন ভাসমান বেডে সবজি চাষ করা যায় এবং বাজারমূল্য বেশি হওয়ায় কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন।
- অতিরিক্ত বৃষ্টি ও মৌসুমি বন্যায় ভাসমান বেডের ফসলের তেমন ক্ষতি হয় না। এ কারণে বন্যা এলাকায় আগাম সবজির চারা তৈরি করা যায় এবং বন্যায় আমন ধানের চারা তৈরি করা যায়।
ভাসমান বেড তৈরির স্থান নির্বাচনঃ
ঘন কচুরিপানা আছে এমন সব হাওর, বিল, খাল, মজা পুকুর যেখানে বছরের ৬ মাস বা তারও বেশি সময় পানি জমে থাকার কারণে ফসল চাষ করা সম্ভব হয় না; এমন স্থান ভাসমান বেড তৈরির জন্য নির্বাচন করতে হবে।
ভাসমান বেডের আকারঃ
- ভাসমান বেডের দৈর্ঘ্য জমির দৈর্ঘ্য অনুযায়ী করতে হয়। বেডের গ্রন্থ বা চওড়া এবং উচ্চতা ১.২৫ মিটার হবে।
- ভাসমান বেডের উপর উঠা যাবে না, ছোট নৌকা বা ভেলার সাহায্যে পাশে থেকে বীজ বপন/চারা রোপণ, ফসলের পরিচর্যা ও ফসল সংগ্রহ করার জন্য বেডের চওড়া ১.২৫ মিটার রাখা ভালো।
- বেডের পুরুত্ব কাঁচা অবস্থায় ১.৫০ মি. রাখা ভালো। বেডের গুরুত্ব যত বেশি হয় বেডের স্থায়িত্ব তত বেশি হয়।
- পাশাপাশি দুইটি বেডের দুরত্ব ১.২৫ মিটার রাখতে হয়। এতে ছোট নৌকা বা ভেলা দিয়ে দুই বেডের মাঝখানে সহজে আসা-যাওয়া করা যায় এবং ভাসমান বেডে লাগানো সবজি ও মশলার প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করা যায় এবং ফসল সংগ্রহ করা যায়।
ভাসমান বেড (খাপ) তৈরির উপকরণঃ
- ভাসমান বেড তৈরির প্রধান উপকরণ কচুরিপানা।
- এছাড়া টোপাপানা, শেওলা, বিভিন্ন ধরনের জলজ আগাছা, ধানের খড় বা ফসলের অবশিষ্টাংশ, আখের ছোবড়া ব্যবহার করে এ ভাসমান বেড তৈরি করা যায়।
- পূর্ণতাপ্রাপ্ত গাঢ় সবুজ রঙের বড় ও লম্বা কচুরিপানা দিয়ে বেড তৈরি করা হলে বেডের স্থায়িত্ব বেশি হয়।
- বেডের আয়তনের ৫ (পাঁচ) গুণ জায়গার কচুরিপানা ব্যবহার করে বেড তৈরি করতে হয়।
- এছাড়া ভাসমান বেডে চারা তৈরি করার জন্য পচা কচুরিপানা, সোনা শেওলা, টোপাপানা, দুলালীলতা, কয়ার ডাস্ট (নারিকেলের ছোবড়ার গুঁড়া), খড় ইত্যাদি প্রয়োজন হয়।

চিত্রঃ ভাসমান বেড তৈরির জন্য স্থান নির্বাচন
ভাসমান ৰেড (খাপ) তৈরির সময়ঃ
- বর্ষার শুরুতে যখন কচুরিপানা দ্রুত বংশ বিস্তার শুরু করে। আষাঢ়-শ্রাবণ (মধ্য জুন-মধ্য আগস্ট) মাসে এই ভাসমান বেড তৈরি করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
- জোয়ার-ভাটা এলাকায়, মজা পুকুরে, হাওর এলাকায় সারা বছর ভাসমান বেড তৈরি করে সবজি আবাদ করা যায়।
- এলাকা ভেদে জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে শুরু করে কার্তিক মাস পর্যন্ত বেড তৈরি করা যায়।
- এছাড়া কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে কচুরিপানা আবদ্ধ থাকলে সেই কচুরিপানা ও অন্যান্য জলজ আগাছা, ধানের খড়, ফসলের অবশিষ্টাংশ, শেওলা প্রভৃতি স্তূপ করে শুকনা স্থানে বেড তৈরি করে রাখা হয়। এগুলো পরবর্তী মৌসুমে পানি আসার সাথে সাথে এগুলো ভেসে উঠে এবং সবজি ও মশলা চাষের উপযুক্ত হয়।
- মৌসুম শেষে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় বেড যদি মাটির উপর বসে যায় তবে তা ভেঙে জমিতে বিছিয়ে কোনো প্রকার চাষ, মই, সার ছাড়াই সফলভাবে শীতকালীন সবজি ও মশলা উৎপাদন করা যায়।
ভাসমান বেড তৈরির পদ্ধতিঃ
- ভাসমান বেড তৈরির জন্য পানির গভীরতা কম হলে পানিতে দাঁড়িয়ে পাশ থেকে কচুরিপানা ও অন্যান্য অশজ আপাছা সংগ্রহ করে বেড তৈরি করতে হয়।
- পানির গভীরতা বেশি হলে নির্বাচিত ঘন কচুরিপানার উপরে বাঁশ ফেলতে হয়।
- এরপর বাঁশের উপর দাঁড়িয়ে বাঁশের চারপাশ থেকে কচুরিপানা টেনে এনে জড়ো করে ভাসমান বেড তৈরি করতে হয়।
- বেড তৈরি শেষে বাঁশ বের করে নেওয়া যায়; তবে ভাসমান বেডকে শক্তিশালী করা এবং ভেসে থাকার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বাঁশ রেখে দেওয়া ভালো।
- বেডের স্থায়িত্ব নির্ভর করে ১ম স্তরের উপর। বেডের ১ম স্তরে যদি ঘন, লম্বা ও পুরু কচুরিপানা ব্যবহার করা হয় তাহলে বেডের স্থায়িত্ব বেশি হয়।
- বেড তৈরির ২/৩ অংশ শেষ হলে উপরের দিকের ১/৩ অংশের কচুরিপানার শিকড় উপরের দিকে এবং কাগুলো নিচের দিক করে আস্তে আস্তে গ্রন্থ থেকে দৈর্ঘ্যের বরাবরে সাজাতে হবে। বেডের উপরের ১/৩ অংশে অপেক্ষাকৃত ছোট কচুরিপানা দিতে হবে।
- বেডের সাথে প্রাকৃতিক স্তর হিসেবে পানিতে লেগে থাকা কচুরিপানার বাড়তি অংশ ধারালো দা/হাসুয়া দিয়ে কেটে দিতে হবে। প্রস্তুতকৃত বেডের উপরিভাগ হাত বা কাঠি দিয়ে সমতল করতে হয়।
- প্রাথমিকভাবে ভাসমান বেড তৈরির পর ১০-১৫ দিন ফেলে রাখা হয় যাতে কচুরিপানাগুলো পচে ফসল বপন/রোপণের উপযোগী হয়।
- তবে সদ্য তৈরি বেডের উপর পচা কচুরিপানা (শুকানো) অথবা কম্পোস্ট দিয়ে ২-৩ ইঞ্চি পুরু স্তর তৈরি করে সরাসরি বীজ বপন করা যায় বা চারা রোপণ করা যায়।
ভাসমান বেডে চারা তৈরি বা বীজ বপনঃ
- সাধারণত বড় আকারের বীজ যেমন- লাউ, মিষ্টিকুমড়া, শিম, বরবটির জন্য বলে চারা তৈরি করে রোপণ করতে হয়।
- পচা কচুরিপানা দিয়ে অথবা টোপাপানা, কচুরিপানার শিকড় দিয়ে বল তৈরি করে ভাসমান বেডে রোপণের জন্য চারা তৈরি করা হয়। বলে বীজ স্থাপন করার আগে বীজগুলো ভিজিয়ে (বীজের আকার অনুযায়ী ০৫-২০ ঘণ্টা) নিতে হয়। এতে বীজের অঙ্কুরোদগম ভালো হয়।
- ছোট আকারের বীজ হলে সরাসরি বেডে বপন করা যায়। রোপণের পূর্বে বীজ ডাবল একশন কমপ্যোনিখনও গ্রাম/কেজি বীজ ছত্রাকনাশক দিয়ে শোধন করে নেওয়া ভালো। এতে বীজবাহিত রোগের প্রকোপ কম হয়।
ভাসমান বেডে যেসব ফসল চাষ করা যায়ঃ
গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে: ভাসমান বেডে কলমিশাক, লালশাক, ডাঁটা, ঢেঁড়শ, বরবটি, ঝিঙে, শসা, করলা, চিচিঙ্গা, বেগুন, পুঁইশাক, মিষ্টিকুমড়া, স্কোয়াশ এবং পানিকচু চাষ করা যায়।
শীত মৌসুমে: পালংশাক, লালশাক, ধনেপাতা, ফুলকপি, ব্রোকলি, ওলকপি, মুলা, লাউ, শিম, মরিচ, লেটুস, পেঁয়াজ, রসুন চাষ করা যায়। ভাসমান বেডে সবজির চারাও উৎপাদন করা যায়।

চিত্রঃ পচা কচুরিপানা দিয়ে বল তৈরি করা হচ্ছে

চিত্রঃ ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা
ভাসমান বেডে ফসলের পরিচর্যাঃ
উৎপাদন বাড়ানোর জন্য পরিচর্যার দিকে বেশি যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। ফসলের পরিচর্যার কাজে ছোট নৌকা বা ভেলা ব্যবহার করতে হয়।
১। ভাসমান বেডে ইউরিয়া সার ব্যবহার করা যাবে না। ইউরিয়া ব্যবহার করলে বেড দ্রুত পচে যাবে। তবে কোনো কারণে গাছের বাড়-বাড়তি কম হলে চারা রোপণের বা বীজ বপনের ২০-৩০ দিন পর প্রতি লিটার পানির সাথে ১০ গ্রাম হারে ইউরিয়া পানিতে গুলে শুধুমাত্র পাতায় স্প্রে (ফলিয়ার) করা যেতে পারে।
২। বেডের উপর হাঁস উঠে চারা ও ফসলের ক্ষতি করে। এজন্য বেডগুলো পাশাপাশি রেখে নেট বা জ্বাল দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে। অনেক সময় বেডগুলো পানির স্রোত বা বাতাসে ভেসে যেতে পারে। সেজন্য বাঁশ পুঁতে বেডগুলো নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে। শিম, বরবটি ইত্যাদি লতানো গাছের জন্য মাচা বা বাউনি হিসেবে বেডের উপর ডাল বা কঞ্চি পুঁতে দিতে হবে।
৩। ফসল পোকা দ্বারা আক্রান্ত হলে আইপিএম (IPM) কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেমন- প্রথম দিকে যখন পোকার সংখ্যা কম থাকে তখন হাত দিয়ে বা হাত জাল দিয়ে পোকা ধরে মারতে হবে। পোকার আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে উপযুক্ত কীটনাশক সঠিক সময়ে স্প্রে করতে হবে। স্প্রে এমনভাবে করতে হবে যেন কীটনাশক মাছের কোনো ক্ষতি করতে না পারে।

চিত্রঃ ভাসমান বেডে সবজি
◼ জলাবদ্ধ এলাকার কচুরিপানা ব্যবহার করে সবজি ও মশলা উৎপাদন করলে পুষ্টি জোগানের পাশাপাশি পচা কচুরিপানা জমিতে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করলে জমির উর্বরা শক্তি বাড়বে।
◼ উপরন্তু মৌসুম শেষে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় বেড যখন মাটির উপরে বসে যায় তখন তা ভেঙে জমিতে বিছিয়ে কোনো প্রকার চাষ, মই, সার ছাড়াই সফলভাবে শীতকালীন সবজি ও মশলা উৎপাদন করা যায়।
◼ এছাড়া, মৌসুম শেষে পচা কচুরিপানা ফল গাছের গোড়ায় সার হিসেবে ব্যবহার করে ফলের উৎপাদন বাড়ানো যায়।
সমাপ্ত। আপনার যদি আরও কোন েপ্রশ্ন থেকে থাকেন কমেন্ট করে জানিয়ে দিন।