একশ্রেণির অসাধু খামারি নিষিদ্ধ ওষুধ প্রয়োগ করে গরু মোটাতাজা করেন। তাঁরা স্টেরয়েড গ্রুপের ওষুধ, যেমন ডেকাসন, ওরাডেক্সন, প্রেডনিসোলন ইত্যাদি সেবন করিয়ে অথবা ডেকাসন, ওরাডেক্সন স্টেরয়েড ইনজেকশন দিয়ে গরুকে মোটাতাজা করেন। এ ছাড়া হরমোন প্রয়োগ যেমন: ট্রেনবোলন, প্রোজেস্টিন, টেস্টোস্টেরন ইত্যাদি করেও গরুকে মোটাতাজা করা হয়। তাই ভেজাল গরু চেনার উপায় জানা থাকা দরকার।
কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর এ ধরনের চিন্তার কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় সাধারণ মানুষের। বেশি দামে পশু বিক্রি করতে নানা ধরনের পন্থা অবলম্বন করে থাকেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, ইনজেকশন ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে এসব পশুকে মোটাতাজা করে থাকেন তারা।
তবে বর্তমানে, অনেক সচেতনতা রয়েছে। সঠিক খাদ্যভাস এবং নির্দিষ্ট পরিচর্যার মাধ্যমে অনেক অনেক খামারি গরু হৃষ্টপুষ্ট করে থাকেন। বর্তমানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিরলস প্রচেষ্টা ও বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে খামারিদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ফলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রাকৃতিক ও নিরাপদ উপায়ে গরু মোটাতাজা করা হচ্ছে।
তবুও ভেজাল গরু চেনার উপায় ১২ টি জেনে রাখা ভালো, যদিও বর্তমানে বাজারে ভেজাল গরুর পরিমাণ খুবই কম।
কুরবানির গরু কেনা সময় ভেজাল গরু চেনার উপায় ১২ টি:
চিন্তার কোন কারণ নেই, নির্ভয়ে ও নিশ্চিতে গরু ক্রয় করুন, যদি আপনার কোরবানির গরু কেনার আগে স্টেরয়েড দেওয়া ভেজাল গরু চেনার ১২ টি উপায় সম্পর্কে জানা থাকে, খুব সহজেই আপনি সুস্থ ও অসুস্থ গরু চিনতে পাবেনঃ-
১) আচরণ: স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হৃষ্টপুষ্ট গরুর আচরণ হবে সক্রিয়। দৃষ্টি থাকবে তীক্ষ্ম, যেকোনো পরিবেশে তারা প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করবে। আর কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা গরু পরিবেশ সম্পর্কে ততটা সজাগ থাকবে না। ক্লান্ত এবং নির্জীবের মতো মনে হতে পারে। গরু অস্বস্তিকর অবস্থা অনুভব করবে। এ ধরনের পশু খুব চুপচাপ থাকবে। ঠিকমতো চলাফেরাও করতে পারবে না।
২) মুত্রত্যাগ: কম করবে: স্বাভাবিক পশুকে যে পরিমাণ পানি দেওয়া হয় তার ওপর নির্ভর করে দিনে বেশ কয়েকবার সে মূত্রত্যাগ করে। কিন্তু স্টেরয়েড দেওয়া পশু দিনে মাত্র একবার বা দুইবার মূত্রত্যাগ করবে।
৩) খাবারে অনীহা: পশু খাওয়া দাওয়ায় অনীহা দেখাবে সুস্থ পশু দেখতে যেমনি হোক না কেন তার মুখের সামনে খাবার ধরলে সে বেশ উৎসাহ নিয়েই খাবে। কিন্তু স্টেরয়েড দেওয়া পশু অসুস্থ থাকার কারণে সে খাওয়া দাওয়া করতে চায় না। সুস্থ ও স্বাভাবিক উপায়ে বেড়ে উঠা গরু খাবার দেখতেই জিহ্বা দিয়ে টেনে খাওয়ার চেষ্টা করবে। অন্য সমস্যা থাকলে খাবারে অনাগ্রহ দেখায়।
৪) অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি: কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরুর ফুসফুস কিছুটা দুর্বল হয়ে থাকে ফলে বেশিক্ষণ শ্বাস ধরে রাখতে পারে না। দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে। একটু হাঁটলেই হাঁপায়, শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো দুর্বল থাকে। খুবই ক্লান্ত দেখায়। শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের সময় যদি শব্দ হয়, তাহলে এ ধরনের গরু না কেনাই ভালো।
৫) পাঁজরের হাড়: স্টেরয়েড প্রয়োগ করা গরুর পাঁজরের হাড়ও দেখা যায় না। এ ধরনের পশুকে সব সময় বাতাসে রাখতে হয়। এরা রোদ সহ্য করতে পারবে না।
৬) গরুর রানের মাংসের পুরুত্ব: স্বাভাবিক উপায়ে মোটাতাজা গরুর পেছনের রানের মাংস শক্ত হয়। স্টেরয়েড হরমোন ইনজেকশন দেওয়া গরুর রানের মাংস নরম হয়। মাংসের গাঠনিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়ে পেশির কোষে অতিরিক্ত পানি জমার কারণে মাংস নরম হয়ে যায়। তাই গরুর পেছনের রানের মাংস পরীক্ষা করে কেনা ভালো।
৭) আঙুল দিয়ে চাপ: অতিরিক্ত হরমোনের কারণে পুরো শরীরে পানি জমে মোটা দেখাবে। আঙুল দিয়ে গরুর শরীরে চাপ দিলে সেখানে দেবে গিয়ে গর্ত হয়ে থাকবে। পশুর ঊরুতে অনেক মাংস দেখা যাবে। কিন্তু আসলে তা পানি। আঙুল দিয়ে চাপ দিলে ওই স্থানটি দেবে যাবে এবং দেবে যাওয়া অংশ আবার স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক উপায়ে বা স্বাভাবিকভাবে মোটা করা গবাদিপশুর ক্ষেত্রে দ্রুতই মাংস স্বাভাবিক হয়।
৮) লালা বা ফেনা: আবহাওয়া খুব গরম না থাকলে যদি গরু মুখে লালা বা ফেনা বেশি থাকে তাহলে তা কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা বলে ধারণা করা হয়। তবে সাময়িকভাবে খাবারের সমস্যার কারণেও অতিরিক্ত লালা বা ফেনা এবং পেট ফাঁপা দেখা যায়। যেসব গরুর মুখে কম লালা বা ফেনা থাকে, সেই গরু কেনার চেষ্টা করুন।
৯) হাটাচলা: কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজাকৃত গরুর শরীর ভারী হয়ে যায়। বেশি পানি জমার কারণে সহজে হাঁটতে চায় না এবং এক জায়গায় বসে থাকে। বসে থাকা গরুকে উঠিয়ে হাঁটিয়ে দেখা উত্তম।
১০) মাজেল শুষ্ক থাকা: অসুস্থ গরুর মাজেল বা নাকের উপরের অংশ শুষ্ক থাকে। কিন্তু সুস্থ উপায়ে বেড়ে উঠা গরুর মাজেল বা নাকের উপরের অংশ ভেজা ভেজা থাকে।
১১) পা ও মুখ ফোলা: ইনজেকশন দিয়ে কিংবা ওষুধ খাইয়ে মোটা করা গরুর পা ও মুখ ফোলা থাকবে, শরীর থলথল করবে, অধিকাংশ সময় এই গরু ঝিমাবে, সহজে নড়াচড়া করবে না। প্রাকৃতিক উপায়ে পালিত গরু চঞ্চল হবে। এর গায়ের রঙ উজ্জ্বল দেখা যাবে, তবে চকচকে হবে না। গায়ে হাত দিলে এটি নড়াচড়া করবে, এমনকি তেড়েও আসতে পারে।এগুলো কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরুর বেলায় দেখা যাবে না।
১২) তাপমাত্রা: স্বাভাবিক পরিবেশের তাপমাত্রায় সুস্থ গরুর তাপমাত্রা সাধারণত ১০০-১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইট হয়ে থাকে। গরুর শরীরে হাত দিয়ে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মনে হলে বুঝতে হবে গরুটি অসুস্থ। পরিবেশ এবং ভ্রমণ জনিত ধকলের কারণেও তাপমাত্রা বাড়তে পারে। এক্ষেত্রে বিক্রেতার কাছে গরু হাটে পৌঁচেছে কখন সে সময়টা জেনে নিতে হবে। দূর থেকে ভ্রমণ করে আসা গরুর তাপমাত্রা স্বাভাবিক হতে সাধারণত ১-২ ঘণ্টা সময় লাগে। অন্যকিছু হলে তা সমস্যা হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে।
স্টেরয়েড দেওয়া গরু কেন আমাদের জন্য ক্ষতিকর?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব হরমোন বা স্টেরয়েড শিশুদের মস্তিষ্ক ও যৌনাঙ্গ গঠনে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে মাংসের মাধ্যমে গ্রহণ করা স্টেরয়েড নানা অসুখ ডেকে আনতে পারে। এসব ক্ষতিকর ওষুধ মানবশরীরে জমা হয়ে টিউমার, ক্যানসার, কিডনি নষ্ট করার মতো মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে। এটি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। এমনকি এ ধরনের মাংস খাওয়ার ফলস্বরুপ মহিলাদের গর্ভধারণের ক্ষমতাও নষ্ট হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজাকরণ গরুর মাংস খেলে মানুষের শরীরে পানি জমে যাওয়া, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, মূত্রনালি ও যকৃতের বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই এসব পশু কেনা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মোটাতাজাকরণের এসব ওষুধের কার্যকারিতা নষ্ট হয় না। গরুর দেহের মাংসে রয়ে যায়। এসব মাংস যখন মানুষ খায়, তখন ওই সব ওষুধের প্রতিক্রিয়া মানুষের শরীরেও দেখা দেয়। স্টেরয়েড ওষুধ মানবদেহের কিডনি, ফুসফুস, লিভার, হৃৎপিণ্ডকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। মানবদেহের রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অনিদ্রা, অস্থিরতাসহ নানা রোগের সৃষ্টি করে। এতে মানুষের শরীরে পানি জমে যাওয়া, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, মূত্রনালি ও যকৃতের বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। হরমোন দিয়ে মোটাতাজা করা গরুর মাংস খেলে মানবদেহে এসব হরমোন মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। মানবদেহে প্রতিনিয়ত প্রকৃতিগতভাবে হরমোন তৈরি হচ্ছে। ক্ষতিকর হরমোন পরোক্ষভাবে শরীরে ঢুকলে এই হরমোনগুলো মানবশরীরে নানা রোগ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে অল্পবয়সী বা ছোট শিশুদের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
এছাড়াও স্টেরয়েড দেওয়া গরু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জবাই না করলে মারা যাবে। কারণ এর শরীরে ভয়ংকর রাসায়নিক হরমোন দেওয়া হয় যা আগুনেও নষ্ট হয়না। স্টেরয়েড দিয়ে মোটাতাজা করা গবাদিপশুর মাংস অত্যন্ত বিপজ্জনক। এজাতীয় ওষুধ অতিরিক্ত মাত্রায় দিলে গরুর কিডনি ও যকৃৎ অকার্যকর হয়ে যায়। এতে শরীর থেকে পানি বের হতে পারে না। এতে পানি সরাসরি গরুর মাংসে চলে যায়। এতে গরুকে মোটা, তুলতুলে ও নাদুসনুদুস দেখায়।এমনকি এ ধরনের পশুর মাংস রান্না করলেও স্টেরয়েডের ক্ষতিকর প্রভাব নষ্ট হয়না। তাই স্টেরয়েড জাতীয় গরু খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরুপ।
কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা গরুর মাংস খাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে ব্যাপক প্রচারের পর এ নিয়ে জনসচেতনতাও তৈরি হয়েছে। ফলে মানুষজন হাটে গিয়ে পছন্দের পশুটি খোঁজার পাশাপাশি এটির স্বাস্থ্যগত তথ্যও জানতে চান। পশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আতঙ্কিত না হয়ে একটু দেখেশুনে কিনলেই বিপদের ঝুঁকি এড়ানো যাবে। কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো দেখে সুস্থ, নীরোগ পশু চেনা যাবে সহজেই। তাই ভেজাল গরু চেনার উপায় জানা থাকলে চিন্তার কোন কারণ নেই।