ভোগে নয়, ত্যাগেই মনুষ্যত্বের বিকাশ।
আজকে আমরা আলোচনা করবঃ
ভাব সম্প্রসারণঃ
মূলভাব: ত্যাগের মধ্য দিয়ে প্রকৃত মনুষ্যত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। ভোগের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয় ব্যক্তির লোভ-লালসা। তাই ভোগ নয়, ত্যাগের চর্চাই মানুষের সুন্দর গুণাবলিকে উৎকর্ষ দান করে।
সম্প্রসারিত ভাব: ভোগ ও ত্যাগ দুটি বিপরীত বিষয়। মানুষ ইন্দ্রিয় সুখের আশায় ভোগে মত্ত হয়; অন্যদিকে মানসিক তৃপ্তির আশায় ত্যাগ স্বীকার করে। ভোগ সাময়িক সুখ আনতে পারে। তবে যিনি ত্যাগে কুণ্ঠিত হন না, তিনি অনাবিল আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। ভোগের নিমিত্তে মানুষ জড়িয়ে যায় পঙ্কিলতায় – হিংসা, স্বার্থপরতা ও ঘৃণা, স্বেচ্ছাচারিতাকে আপন করে নেয়। ভোগবাদী মানুষ তাদের সম্পদ কখনো পরার্থে ব্যয় করে না, পরের দুঃখে কাতর হয় না; বরং হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সুযোগের সন্ধান করে। মানবিকতা ও পরার্থপরতা তাদের কাছে অর্থহীন। তাই সমাজের মানুষের কাছেও তাদের কোনো মর্যাদা থাকে না। তারা জন্মগতভাবে মানুষ হলেও তাদের মনুষ্যত্ব আসলে বিকশিত হয় না। আবার কিছু মানুষ ভোগের চেয়ে ত্যাগকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। মানুষের বিপদে তাঁরা ছুটে যান, নিজের সুবিধার কথা না ভেবে বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভাবেন, দুঃখীজনের দুঃখ দূর করতে নিজের সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে আনন্দ পান। ভোগবাদী মানুষের ভ্রান্ত ধারণা ভোগের মধ্যেই সকল সুখ। তাই তারা সম্পদের পাহাড় গড়ে বিলাস-ব্যসনে মগ্ন হয়। তারা ভোগের মাধ্যমে সুখী হতে চায় বটে, তবে তারা প্রকৃত সুখের সন্ধান পায় না। বরং যেসব মানুষ নির্দ্বিধায় অন্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকেন, তাঁদের দ্বারা সমাজ যেমন উপকৃত হয়, তাঁরা নিজেরাও এসব কাজের মধ্য দিয়ে অনাবিল আনন্দ লাভ করেন।
মন্তব্য: ত্যাগের মহীমা অসীম। মনুষ্যত্ব বিকাশে ত্যাগের চর্চার কোনো বিকল্প নেই। ভোগ মনুষ্যত্বকে লজ্জা ও হীনতায় ডুবিয়ে রাখে।
ভাব সম্প্রসারণ কীঃ
কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় কখনো কোনো একটি বাক্যে বা কবিতার এক বা একাধিক চরণে গভীর কোনো ভাব নিহিত থাকে। সেই ভাবকে বিস্তারিতভাবে লেখা, বিশ্লেষণ করাকে ভাবসম্প্রসারণ বলে।
যে ভাবটি কবিতার চরণে বা বাক্যে প্রচ্ছন্নভাবে থাকে, তাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে হয়। সাধারণত সমাজ বা মানবজীবনের মহৎ কোনো আদর্শ বা বৈশিষ্ট্য, নীতি-নৈতিকতা, প্রেরণামূলক কোনো বিষয় যে পাঠে বা বাক্যে বা চরণে থাকে, তার ভাবসম্প্রসারণ করা হয়। ভাবসম্প্রসারণের ক্ষেত্রে রূপকের আড়ালে বা প্রতীকের ভেতর দিয়ে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়, তাকে যুক্তি, উপমা, উদাহরণ ইত্যাদির সাহায্যে বিশ্লেষণ করতে হয়।
ভাব সম্প্রসারণের কয়টি অংশঃ
পরীক্ষায় বাংলা দ্বিতীয় পত্র বিষয়ের ভাব-সম্প্রসারণে বেশি নম্বর পেতে মূল ভাব ঠিক রেখে সঠিক বানানে উত্তর লিখবে ও বিখ্যাত ব্যক্তির উক্তি দেবে। ভাব-সম্প্রসারণ তিনটি প্যারায় লিখবে।
ভাব সম্প্রসারণ লেখার নিয়মঃ
কোনো কবিতা বা গদ্যরচনার অংশকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করাকে ভাব-সম্প্রসারণ বলে। কবিতার বেলায় সেইসব পঙ্ক্তির ভাব-সম্প্রসারণ দরকার হয়, যেগুলোর মধ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য বা তত্ত্ব থাকে। অন্যদিকে গদ্যরচনার সেইসব বাক্য ভাব-সম্প্রসারণের জন্য ঠিক করা হয়, সাধারণত যা প্রবাদ বা প্রবচনের মর্যাদায় উন্নীত। ভাব-সম্প্রসারণ করার সময়ে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মনে রাখা যেতে পারে:
ক. ভাব-সম্প্রসারণকে প্রধানত তিনটি অংশে বিভক্ত করা যায়: প্রথম অংশে ভাবের অর্থ, দ্বিতীয় অংশে ভাবের ব্যাখ্যা এবং তৃতীয় অংশে ভাবের তাৎপর্য।
খ. ভাব-সম্প্রসারণের এই অংশগুলোকে আলাদা তিনটি অনুচ্ছেদে উপস্থাপন করা যায়।
গ. ভাবের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যুক্তি দেখাতে হয়, উদাহরণ দিতে হয়, তুলনা করতে হয়।
ঘ. ভাব-সম্প্রসারণের বাক্যগুলো যাতে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।
ঙ. প্রয়োজনে সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে।
চ. ভাব-সম্প্রসারণে আলাদা কোনো শিরোনামের দরকার হয় না।
ছ. মূল ভাবটি রূপক বা প্রতীকের আড়ালে থাকলে তাকে স্পষ্ট করতে হয়।
জ. ভাব-সম্প্রসারণ করার সময়ে প্রদত্ত অংশের রচয়িতার নাম উল্লেখ করতে হয় না।
ঝ. কমবেশি ২০০ শব্দ অথবা অনধিক ২০টি বাক্যের মধ্যে ভাব-সম্প্রসারণ সীমিত থাকা উচিত।
উপরে- ভোগে নয়, ত্যাগেই মনুষ্যত্বের বিকাশঃ ভাব সম্প্রসারণের একটি নমুনা দেওয়া হয়েছে।
ভাব সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যঃ
ভাবের শিল্পসম্মত প্রসারণই ভাব-সম্প্রসারণ। নানা তথ্যে, ভাব তাৎপর্যে ও ইঙ্গিতের মধ্য দিয়ে লুক্কায়িত কোনাে বিষয় বিস্তৃতভাবে সহজবােধ্য করে প্রকাশ করাই ভাব-সম্প্রসারণের প্রধান উদ্দেশ্য।
সাধারণত কবিতার পঙক্তি, স্তবক কিংবা গদ্যের অংশবিশেষ, কোনাে মনীষীর উদ্ধতি কিংবা প্রবাদ-প্রবচন ভাব-সম্প্রসারণের জন্য। দেওয়া হয়। আর এ ক্ষুদ্র অংশের আড়ালে থাকতে পারে মানবজীবনের গভীর অভিব্যক্তি, মানবতার কথা, নৃশংসতার কথা, সামাজিক বৈষম্যের কথা, ব্যক্তির স্বার্থপরতার কথা, সংসার জীবনের নানা অসংগতির কথা, নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি, সমাজ-রাষ্ট্র অথবা বিশ্বশান্তির কোনাে বার্তা। ভাব-সম্প্রসারণের বক্তব্যকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তি-তর্ক, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, দৃষ্টান্তসহ বস্তুনিষ্ঠ এবং প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করাই মূল কাজ। কবি বা লেখক তাঁর সৃষ্টির প্রয়ােজনে সামান্য অংশে নানা উপমা, অলংকার ব্যবহার করতে পারেন; আকর্ষণীয় করার প্রয়ােজনে বক্তব্যকে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন, সংলাপ থাকতে পারে, এমনকি প্রশ্নেরও অবতারণা হতে পারে, থাকতে পারে শব্দ ও বাক্য ব্যবহারে যথেষ্ট মুনশিয়ানা; এর ফলে সহজেই সেই বক্তব্যকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। তাই মূল বিষয়টিকে আবিষ্কার করে প্রয়ােজনীয় যুক্তির সাহায্যে ব্যাখ্যা, বিচার-বিশ্লেষণ, উদাহরণ কিংবা দৃষ্টান্তসহ নিজস্ব অভিমত সহজ-সরল ভাষায় উপস্থাপন করতে হয়।
ভাব সম্প্রসারণের প্রয়ােজনীয়তাঃ
- যে কোনাে সংক্ষিপ্ত, যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার যােগ্যতা অর্জিত হয়।
- ভাব-প্রকাশে ভাষা চর্চার আবশ্যকতা রয়েছে তা অনুধাবন করা যায়।
- সংক্ষিপ্ত বিষয় থেকে নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়।
- কোনাে বিশেষ বক্তব্য থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কৌশল রপ্ত করা যায়।
- অপেক্ষাকৃত কঠিন কথাকে সহজ করে বলার যােগ্যতা অর্জিত হয়।