মধুর রাসায়নিক উপাদানঃ
মধুর মধ্যে রয়েছি চিনি আর চটচচে তরল পদার্থ। কিছু সুকরাজ্, ডেকাট্রিন এবং চটচটে আঠালো পদার্থ। মদুভস্মের মধ্যে সিলিকা, আয়রন, তামা, ম্যাঙ্গানীজ, ক্লেরিন, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ক্লোরিন, ফসফরাস, গন্ধক এল্যুমিনিয়ম এবং ম্যাগনেসিয়াম, তাছাড়া এমিনো এসিড সহ ৬ প্রকার এসিড, পরগরেণু এবং মোমের অণু পাওয়া গেছে।
তাছাড়া মধুর পুষ্টিগুণ অসাধরণ। যদিও বিভিন্ন অঞ্চলের মধুতে রাসায়নিক উপাদানের মাত্রাভেদ বা হেরফের ঘটতে পারে। তবে সকল মধুর মধ্যেউ আর্দ্রতা, গুকোজ লিভিউলোজ, সুকরোজ, অ্যাশ এবং বিভিন্ন প্রকার অ্যাসিড রয়েছে।

পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবে মধুঃ
পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, ৭ আউন্স মধুর মধ্যে প্রায় আড়াই পাউগুদুধের সমান পুষ্টিগুণ বিদ্যমান। অতএব মধু একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য। দুধ অন্যান্য খাদ্যের সাথে মধু মিশ্রিত করে খেলে অত্যন্ত Rich Energy হিসেবে অনায়াসে বিবেচিত হতে পারে।
বাচ্চাদের, বৃদ্ধদের তথা পঙ্গুদের খাদ্য হিসেবে মধু একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য। মধু রক্তে Haemoglobin তৈরিতে সাহায্য করে। ক্ষয়িত Energy পূরণ করার জন্য খলোয়াড়গণ দুধ ও মধু খান। মধু খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্ষয়িত Energy পূরণ হয়ে থাকে।
বিভিন্ন খাদ্য তথা পানীয়ের সাথে মধু মিশ্রিত করে নিয়মিত খাওয়া চলতে পারে। এক আউন্স মধু এক গ্লাস ঠান্ডা জলের সাথে মিশিয়ে গরমকালে সরবত করে খেতে পারেন অথবা শীতকালে গরম জলের সাথে ১ আউন্স মধু মিলিয়ে খেথে পারেন।
চা, কফি, দুধ, মাখনের সাথেও চিনির পরিবর্তে মধু ব্যবহার করতে পারেন। দইয়ের সাথে, বিস্কুটের সাথে রুটি- মাখনের সাথে মধু মিশিয়ে বা মাখিয়ে খেতে পারেন। গরমকালে মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে খেতে পারেন অথাবা বরফ-মিশ্রিত লেবু জলের সাথে মধু মিশিয়ে খেতে পারেন।
কেক, পাইরুটি তথ বিস্কুট তৈরি করার সময়ও মধু ব্যবহার করা যেতে পারে।

ওষুধ হিসেবে মধুর ব্যবহারঃ
হোমিওপ্যাথিকপ্রায় সকল ওষুধের সাথে যেমন Lactose-কে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তেমনি মধুও আয়ুর্বেদিক তথা ইউনানী বহুপ্রকার ওষুধের মধ্যে ব্যবহার করা য়ে থাকে।
বাড়ির মেয়েরাও শ্বাসকষ্ট সয়ক্রান্ত রোগের ওশুধ হিসেবে সচরাচর মধু ব্যবহার করে থাকেন।
বাহ্যকারক, রক্তপরিশোধক, তাছাড়া ঠাগু লাগা বা সর্দি-কাশি প্রতিরোধের জন্য, জ্বর নিরাময়ের জন্য, ক্ষত, চক্ষুরোগ, জিহ্বার ঘা, গলার ঘা, এবং আগুনে ঘা দূর করার জন্য মধু ব্যবহার করা হয়-এটি বিশেষ টরীক্ষিত সত্য।
অটুস্টিজনিত রোগ, হৃদরোগ, হজমের গোল।যোগ, পরিপাক স্থালীর গোলযোগ তথা অন্ত্রক্ষত দূরীকরণের বিভিন্ন ওষুধে মধুর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যারা বহুমূত্র রোগে ভুগছেন বা এলার্জি জনিত রোগে ভুগছেন তাঁদের পক্ষেও মধু বিশেষ উপকারী।
মধু ফলের মতোই Alkaline গুণসম্পন্ন। ফলে মধু খেলেও অম্বল হয় না। টাইফয়েড খা আমশয়ের জীবাণু মধুর মধ্যে ফেললে নষ্ট হয়ে যায়।
তাছাড়া মধু দুধ অপেক্ষা নিরাপদে ব্যবহার করা যায়-দুধের মধ্যে ভেজাল দীর্ঘদিন ধরে চলছে। কিন্তু নিজে মৌমাছি পালন করলে বা বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে মধু ক্রয় করলে ভেজাল বিহীন বিশুদ্ধ মধু অনায়াসে পাওয়া যায়।

ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ও অন্যবিধাভাবে মধুঃ
ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তথা নানাভাবে মধুর ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে। মদ তৈরির জন্য, বিউটি লোশন হিসেবে, চিউয়িং গামে, গাড়ির Shock Absorber এবং গল্ফ বলেও মধুর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। Bacteierial Culture এর ব্যাপারেও মধুর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

মধু শোধন পদ্ধতিঃ
বাজারে যে সকল মধু পাওয়া যায় তার মধ্যে নানাপ্রকার ভেজাল (মোম, পরাগ, মৌমাছির অংশ, শূককীট বা মূককীটের দেহের ভগ্নংশ, ডিম-চাকের অন্যান্য আবর্জনা প্রভৃতি) মিশ্রিত থাকে, কারণ সকল মধুই মধু নিস্কশন যন্ত্রের মাধ্যমে নিস্কশন করা হয়না, তাছাড়া মধু- নিষ্কশনের সময়ে যথাযথভাবে যত্ন নেয় হয় না।
বিশুদ্ধ বা পরিশোধিত মধু পেতে হলে–
- কেবলমাত্র মধুকক্ষের মধু বন্ধ সাদাচাকের তেকেই মধু নিষ্কশন করতে হবে। মধু-নিস্কশিত করে ঘরে একটি পরিস্কার বদ্ধপাত্রে রাখতে হবে।
- ঘরটির উত্তাপ ৯০ ফারেনহাইট হওয়া আবশ্যক।
- তারপর কয়লার চুল্লী জ্বালিয়ে-ওই চুল্লীতে আধাআধি জলভর্তি একটি চৌকো টিন বসাতে হবে।
- আধাআধি জলভর্তি ওই টিনের পাত্রের অভ্যন্তর ভাগের নিচের একটু উঁচু ধরনের পাথর বা আধ- ভাঙা ইট রেখে-তদুপরি অপর একটি স্টীল বা টিনের গভীর ধরনের পাত্রে-Honey Extractor-এর সাহায্যে মধু নিস্কশন করে ওই পাত্রে রাখতে হবে।
- তারপর মধু উষ্ণ জলের সাহায্যে গরম করে নিতে হবে।
- মধু মাঝে মাঝে চামচ দিয়ে নেড়েচেড়ে দিতে হবে। তবে মধুর তাপমাত্রা ১২০ফারেনহাইটের বেশি যেন না হয়।
- যদি তপমপন থর্মোমিটারনা থাকে—মধু পাতলো হয়ে এল অথবখুিব গরম হলে আর ফোটানো যাবে না—কারণ উত্তাপ ১৪০ ফারেনহাইট থেকে ১৪৫ ফারেনহাইট হলেই মধুর অভ্যন্তর মোম গলতে শুরুকরে।
- অতএব মধু অল্প কিছুক্ষণ উষ্ণ জালে উত্তপ্ত করার পর অপর একপি এত্রে ছেঁকে রেখে, তারপর বেতলে ভর্তিকরে প্যাক করতে হবে।

মধু সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও মধুর মানঃ
সংরক্ষণজনিত ত্রুটির ফলে মধুর রং ক্রমশা বেশি কালেচে হয়ে। ঠান্ডা (৭০ ফারেনহাইট) অথবা শুস্ক স্থানে মধু সংরক্ষণ করুন।
মধু সংরক্ষণের পাত্র কাচের নির্মিত হওয়া বাঞ্ছনীয়, পাত্রটি ধাতু নির্মিত হলে মধুর মধ্যে Acd থাকায় বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে মধুর রং আরও বেশি কালচে হতে পরে।
আগের উপায়ে মধু পরিশোধিত করে কাচের বোতলে বা পাত্রে ছিপিএঁটে রাখতে হবে। Standard মধুর আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.৪১৫ এর কম হওয়া উচিত নয়, মধুতে ২০% এর বেশিজল থাকা উচিত নয়।
মধুর মধ্যে Sucrose-এর পরিমাণ ৮% এর বেশি থাকে উচিত নয়-এর বেশি থাকলেই বুঝতে হবে যে মধুর সাথে চিনি বা গুড়ের রস মেশানো হয়েছে।

মৌচাকের মোমের বিভিন্ন ব্যবহারঃ
প্রায় ৩০০ প্রকার দ্রব্য তৈরির জন্য মোম ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রসাধন দ্রব্য তথা মোমবাতি তৈরির জন্য পর্যপ্ত পরিমাণ মোমের প্রয়োজন হয়। ফেসক্রীম, মলম, লিপস্টিক, বুটপালিশ, আসবাবপত্র, জ্বালানি তেল, বৈদ্যুতিক সজসরঞ্জাম, মডেল তথা প্লাস্টিকের কাজ, রং এবং বার্নিশ পুস্তুত করার জন্যও মোমের প্রয়োজন হয়।
চাক থেকে মোম তৈরির পদ্ধতিঃ
প্রাচীন পদ্ধতি–
- চাকগুলো (যে চাকসমূহ আর কলোনী কোনও প্রয়োজনে লাগে না) প্রথম কেটে টুকরো টুকরো করে, তারপর ওই টুকরো চাকগুলো একটি ন্যাকড়া বা গামছার মধ্যে রেখে বেশ শক্ত করে পুঁটলি বাঁধতে হবে।
- উনোনে একটি বড় কড়াইতে আধভর্তি করে জল ছেপে চাক বদ্ধ পুঁটলিটি এবার উষ্ণ জলের কড়াইতে ছেড়ে দিতে হবে।
- আগুনের উত্তাপে পুঁটলির চাক গলে গিয়ে মোম হয়ে বেরোবে, চাকের আবর্জনা প্রভৃতি ন্যাকড়া বা গামছার ভেতরেই লেগে থাকবে।
- গামছা বা ন্যাকড়ার পুঁটলির সব চাক গলে গেলে কাড়াইটি উনোন থেকে নামানোর পর, ঠান্ডা হলে দেখা যাবে কড়াইয়ের জলের ওপর দুধের মতো মোমের স্তর ভেসে রয়েছ-এবার ওই মোম সংগ্রহ করে পৃথক পাত্রে রাখতে হবে।
- পুঁটলিরভেতরে সঞ্চিত হচাকের আবর্জনা গর্ত করে মাটিরে ভেতরে পুঁতে বা আগুনে পুড়িয়ে ফেলো উচিত। কারণ ওই গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে মৌমাছিরা ওখানে ভিড় জমাতে পারে।
আধুনিক পদ্ধতি–
Solar Wax Extractor নামে এক প্রকার যন্ত্র বর্তমানে চাক থেকে মোম তৈরির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতি মৌপালন কেন্দ্রেই Solar Wax Extractor থাকা দরকার। নিজেও ইচ্ছে করলে এরুপ একটি যন্ত্র অনায়াসে তৈরি করে নেয়া যায়।
- এক পাশ খোলা অথচ অন্যপাশ বন্ধ টিনের পাত্র দরকার।
- ওই টিনের মাঝখানে একটি ফ্রেমের সাথে সরু তারের জাল থাকবে-সেই জালের ওপরে চাক ভেঙে রাখতে হবে।
- আর টিনের খোলা মুখটি বন্ধ করার জন্য একটি বড় আকারের চৌকো ফ্ল্যাট কাচ দরকার।
- চাকগুলো ঐ সরু তারের জালে ওপর লেখে টনের খোলা মুখের ওপর ওইসমতল চৌকো কাঁচটি রাখতে হবে।
- টিনের পাত্রেটি একটি লম্বা ধরনের টুলে বসানো যেতে পারে।
- এবার টিনটি রৌদ্রে বা সূর্যের দিকে মুখ করে রাখতে হবে।
- সূর্যের তাপ কাচের মধ্যেদিয়ে সঞ্চারিত হবে এবং চাক গলেতে থাকবে, আবর্জনা সরু তারের জালে আটকে থাকবে, আর চাক গলা মোম টিনের পাত্রের নিচে জমা হবে।
- তবে এভাবে সূর্যের তাপ চাক গলিয়ে মোম তৈরি করতে বেশ কিছু সময় লাগে।
- বেশি পনিমাণে মোম তৈরি করতে হলে প্রচীন পদ্ধতি অনুসনণ করাই সুবিধাজনক।