বিষয়: আধুনিক পদ্ধতিতে মাছের পোনা উৎপাদন ও পরিচর্যা, মাছের পোনা উৎপাদন, রেনু পোনা উৎপাদন।
হ্যাশট্যাগ:#আধুনিক পদ্ধতিতে মাছের পোনা উৎপাদন ও পরিচর্যা#মাছের পোনা উৎপাদন#রেনু পোনা উৎপাদন।
আধুনিক পদ্ধতিতে মাছের পোনা উৎপাদন ও পরিচর্যাঃ ‘মাছের পোনা উৎপাদন’
- পোনা সংগ্রহের আগে পুকুর প্রস্তুত করে রাখতে হবে। রুই ও কাতলা মাছের চাষের জন্য পুকুরগুলোকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: ১. আতুড় পুকুর ২. চারা পোনার পুকুর ও ৩. ওমজুত পুকুর। আতুড় পুকুর আকারে ছোট, শীতকালে শুকিয়ে যায় এবং মাছ রেণু ছাড়ার সময় ৪ ফুটের বেশি পানি থাকে না। অগভীরতাই এর প্রধান বৈশিষ্ট্য।
- গভীর পুকুরে মাছ রেণুগুলো বেঁচে থাকার মতো পরিবেশ পায় না। ছোট ছোট ডোবা, গর্তগুলোকে সংস্কার করে পোনা মাছের পুকুর হিসেবে ব্যবহার করা যায়। পোনা মাছের পুকুরগুলোকে ‘আঁতুড়ে পুকুর’ বা ‘নার্সারি পুকুর’ বলা হয়।
- ডিম পোনাগুলোকে প্রভাবে এদের জীবন নাশ হয়। সাধারণত পোনা মাছের পুকুরের আয়তন ২ কাঠার (এখানে প্রতি কাঠা = ১০ শতাংশ) বেশি হয় না এবং গ্রীষ্মকালে শুকিয়ে যাওয়ায় এর তলদেশে কোনো প্রকার বিষাক্ত গ্যাস জন্মাতে পারে না এবং শোল, টাকি বেঙ ও সাপ প্রভৃতি মৎস্যভুক প্রাণী ধ্বংস হয়ে যায়।
- যদি পুকুরের পানি কোনো কারণে না শুকায়, তাহলে পানি সেচে তলার পানি সরিয়ে দিতে হয় এবং পুকুরের তলায় চাষ করে ১ থেকে ২ সপ্তাহ পর্যন্ত শুকাতে দেওয়া দরকার।
- পোনা ছাড়ার পূর্বে চটজাল দ্বারা পোনাভুক্ত কীট পতঙ্গ দূর করে নেওয়া উচিত। এছাড়া ৩ ভাগ সরিষার তেল ও ১ ভাগ সাবান দিয়ে ঘোলা মিশ্রিত তৈরি করে সমস্ত পুকুরের পানির উপরিভাগে ছড়িয়ে দিলে পোনাভুক্ত কীট পতঙ্গ দমন হয়। তবে এ জাতীয় চিকিৎসা পোনা ছাড়ার ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা আগে করা দরকার। স্প্রে মেশিনের সাহায্যে এর কাজ সম্পন্ন করা যেতে পারে।
- পোনা মাছের পুকুরের একপাশে একটি কম্পোষ্ট সার তৈরি করলে পোনা চাষের সময়ে সারের অভাব হয় না। একটি বাঁশের খাঁচার মধ্যে (১) খইল / ৫ সের, (২) পাঁচা গোবার ২ মণ, (৩) হাঁড়ের গুঁড়া বা মাছের শুটকি ২ সের (৪) কচুরি পানার ছাই ২ সের প্রভৃতি উপাদানসমূহ স্তরে স্তরে সাজিয়ে রেখে এর উপরে মাটি দিয়ে লেপে দেওয়ার পর যে সার হয় তাকে ‘কম্পোষ্ট সার’ বলে।
- প্রয়োজন বোধে এরূপ কম্পোষ্ট সার একাধিকও করা যেতে পারে। কম্পোষ্ট সার ব্যবহার করতে গেলে পুকুরে পানি আসার সংগে সংগে হাঁস পোকা, কাঠি পোকা, জল বিছা, জল দোবার পোকা, জল ফড়িং-এর জন্ম হতে পারে। এগুলো যথাসম্ভব মশারীর জাল টেনে নষ্ট করে ফেলতে হবে।
- মৎস্যভূক প্রাণীর হাত থেকে পোনাগুলোকে বাঁচাবার জন্য আরো কিছু সাবধানতার প্রয়োজন আছে। যেমন পুকুরের কিনারায় জঙ্গল রাখলে এতে সাপ, ব্যাঙ প্রভৃতি প্রাণী আশ্রয় নিতে পারে এবং সুযোগ বুঝে পানিতে নেমে পোনা ধ্বংস করতে পারে। এ প্রসঙ্গে এটাও জেনে রাখা দরকার যে, এ জাতীয় পুকুরের হাঁস পালন করাও মৎস্য জীবনের পরিপন্থী।
- এছাড়া গ্রীষ্মকালে যখন পুকুর শুকিয়ে যায়, তখন পুকুরের তলদেশে ধঞ্চে, কলাই প্রভৃতি ফসল করে থাকেন। এগুলো যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপকারী বলে প্রমাণিত হয়েছে, তবুও ক্ষেত্র বিশেষে কুফল দেখা দিতে পারে।
- যদি এদের শিকড়গুলো বর্ষা আসার সংগে সংগে পচে গিয়ে নাইট্রাজেন সারে রূপান্তরিত না হয়, তাহলে ঐ পুকুরে মাছের খাবার জন্ম হবে না। তাছাড়া বর্ষার পানিতে এগুলো পচবে, তারপরে রেণু ছাড়া হবে এ প্রতীক্ষায় বসে থাকা যায় না। এ ছাড়া এ সব গাছ গাছড়ার অবশিষ্টাংশে এমন সব পোকা থেকে যেতে পারে যা মৎস্যরেণুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
- পোনা মাছের পুকুরে ২-৪ টা কলমিলতা, হেলেঞ্চা প্রভৃতি জলজ উদ্ভিদ ২-৪টা বাঁশের সাহায্যে পুকুরের মাঝখানে পুঁতে রাখা যেতে পারে। কারণ, তাতে গ্রীষ্মের গরম বা অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি প্রভৃতির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পোনাগুলো এর নিচে আশ্রয় নিতে পারে।
- ২ কাঠা আয়তনের পুকুরে ১ পোয়া রেণু ছাড়তে হবে।
আধুনিক পদ্ধতিতে মাছের পোনা উৎপাদন ও পরিচর্যাঃ ‘পোনা মাছের খাদ্য’
- সার প্রয়োগ করার পর প্রতি সপ্তাহে ২-১ বার করে পুকুরের পানিতে কী জাতের মৎস্য খাদ্য উৎপন্ন হলো তা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। প্ল্যাঙ্কটন্ জালের (মোচ্যকৃত দু মুখ বিশিষ্ট মশারির কাপড়ের জাল) সাহায্যে পানিতে কোনো জাতের খাদ্য উৎপন্ন হয়েছে তা জানা যায়।
- পুকুরের ১২ জায়গা থেকে দেড়মণ পানি নিয়ে প্ল্যাঙ্কটন্ জালের মুখ দিয়ে ঢালতে হয়।
- এক হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে ৫ কেজি আয়তনের মগের সাহায্যে পুকুরের মধ্য থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। পানি সংগ্রহের সময় পানির উপরিভাগ আস্তে আস্তে নাড়া দিয়ে ৬ ইঞ্চি পরিমাণ পানির নিচে মগটি ডুবিয়ে আস্তে আস্তে কাত করে মগে পানি ভর্তি করতে হয়।
- তারপর প্ল্যাঙ্কটন্ জালের হাতল বাম হাতে ধরে জালের মুখ ২ ইঞ্চি পানির উপরে রেখে ডান হাতে মগটি ধরে ধীরে ধীরে পানি ঢালতে হয়। এভাবে পুকুরের আরো ১১ জায়গা থেকে পানি নিয়ে একই নিয়মে প্ল্যাঙ্কটন্ জালের মধ্যে ঢালতে হয়।
- সর্বশেষে জালের মুখটি উপরে রেখে জালটি পানির মধ্যে রেখে উপর নিচ করে সমস্ত প্ল্যাঙ্কটন্ কাঁচের নলের মধ্যে নিতে হয়।
- তারপর নলটি জাল থেকে খুলে তাতে ১৫ ফোঁটা খাটি ফর্মালিন মেশাতে হয়। ১৫- ২০ মিনিটের মধ্যে সব প্ল্যাঙ্কটন্ মরে নলের নিচে জমা হয়।
- যদি তলানি এক চতুর্থাংশ বা এক ষষ্ঠাংশ ইঞ্চি হয়, তাহলে বুঝতে হবে পুকুরে মাছ ছাড়ার উপযোগী খাদ্য আছে।
- বেশি পরিমাণ প্রাণী প্ল্যাঙ্কটন্ থাকলে তলানির রঙ ফিকে বাদামি হবে, আর উদ্ভিদ প্ল্যাঙ্কটন থাকলে সবুজ হবে। পোনা মাছ পালনের জন্য তলানির রঙ ফিকে বাদামি হওয়া দরকার।
আধুনিক পদ্ধতিতে মাছের পোনা উৎপাদন ও পরিচর্যাঃ ‘পোনার প্রতি সাবধানতা’
- রেণু পোনা পুকুরে ছাড়ার আগে একটি মাটির পাত্রে উক্ত পুকুরের কিছু পানি নিয়ে তাতে কিছু ডিম পোনা ছেড়ে ৪-৫ ঘণ্টা রেখে এদের অবস্থা পরীক্ষা করা দরকার। যদি দেখা যায় যে, পোনাগুলো পানিতে ভালোই খাপ খাওয়াতে পারছে। তাহলে বুঝতে হবে পুকুরের পানি ডিম পোনা চাষের উপযোগী। আর যদি তা না হয়, তাহলে রাসায়নিক পরীক্ষার দ্বারা পুকুরের পানির দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করতে হবে।
- পোনা বহন করে এনে হঠাৎ করে ধপাধপ্ পুকুরের পানিতে ছাড়া উচিত নয়। আসলে পুকুরের অল্প পরিসর স্থানে পোনাসহ হাঁড়ির গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে রেখে ধীরে ধীরে প্রায় আধঘণ্টা সময় নাড়তে হয়। পরে হাঁড়ির সিকি পরিমাণ পানি ফেলে দিয়ে ঠিক ঐ পরিমাণ পুকুরের পানি হাঁড়িতে ভর্তি করতে হয়। মিনিট পর পর এ প্রক্রিয়া ৪-৫ বার করার পর হাঁড়ির প্রায় সমস্ত পানি পুকুরের পানি দিয়ে বদল হয়ে যায়। এভাবে পোনাগুলোকে হাঁড়ির মধ্যে টেকসই করার পর হাঁড়ির একপাশ উঁচু করে ধরলেই পোনাগুলো আস্তে আস্তে আপন থেকেই বের হয়ে যায় পোনাগুলো যখন বের হয়ে যায় তখন অল্প অল্প পানি ছিটিয়ে দিলে এরা পুকুরের নিম্নস্তরে শীতল পানিতে আশ্রয় গ্রহণ করে। খুব সকালে অথবা সন্ধ্যায় পানির তাপ কম থাকে, সে সময় রেণু অথবা পোনা ছাড়া উচিত।
- অতিরিক্ত খার বা এসিডযুক্ত পানিতে এ জাতীয় মাছের পোনা ছাড়া উচিত নয়। তবে সামান্য খারযুক্ত পানি মাছ চাষের পক্ষে ভালো।
- পোনা ছাড়ার পরে মোট পোনার ওজনের সমান চালের কুঁড়া ও খইল ৫০:৫০ আনুপাতিক হারে একত্রে মিশিয়ে প্রতিদিন ২ বার করে পোনা মাছকে খাবার দিলে ভালো হয়। কুড়া ও খইল খুব ভালোভাবে গুঁড়া করে নিতে হয়। প্রয়োজনবোধে এ জাতীয় কৃত্রিম খাবারের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ানো যেতে পারে। এছাড়া সুজিপানা, ফিশমিল, সিদ্ধ ডিমের গুড়া, ভূষির গুড়া, আটার গুড়া প্রভৃতিও কৃত্রিম খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পরিমিত সুজিপনা পুকুরের একপাশে রেখে দিলে পোনাগুলো প্রয়োজন বোধে তা খেতে পারে।
- রোদের তাপ বেশি হলে পোনারা পানির নিচে শীতল পরিবেশে চলে যায়। এ অবস্থায় রোদের মধ্যে পোনাকে পানির উপরে যদি ভাসতে দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে পানিতে নিশ্চয় কোনো না কোনো দোষ দেখা দিয়েছে এবং তখনই জাল টেনে পুকুরের পানি আলোড়িত করে, মধ্যকার বিষাক্ত গ্যাস দূর করে দিতে হয়।
- জাল টানার সময় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, পুকুরের পানি যেন ঘোলা না হয়। জাল টানার পরেও যদি পোনাগুলো ভেসে থাকে, তাহলে পোনাগুলোকে অন্য পুকুরে সরিয়ে নিতে হবে। সাধারণত পানিতে অক্সিজেনের অভাব হয় এবং মাছ ভেসে ওঠে। এ সময়ে কলাগাছ টুকরো টুকরো করে পানিতে ফেললে অনেক সময় ভালো ফল পাওয়া যায়। সরিষার খইল ভিজিয়ে মাঝে মাঝে পুকুরে ব্যবহার করলে ছোট ছোট মাছের ভালো খাদ্য হবে।
- পুকুরে অনেক সময় কেচকি, পুটি, চাপলা, মলা প্রভৃতি ছোট মাছ থাকতে পারে। পোনা ছাড়ার আগেই ঘন ফাঁস জাল দিয়ে এগুলোকে সরানো দরকার।
- রাক্ষুসে মাছ ও কীট পতঙ্গ ছাড়াও কচ্ছপ, মাছরাঙা, উদ্ সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি মাছের বিস্তার ক্ষতিসাধন করে। এগুলোর প্রতিও সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার।
- অতিরিক্ত অজৈব সার বা রাসায়নিক সার ব্যবহারে বা অন্য কোনো কারণে পানিতে অম্লতা বৃদ্ধি পেতে পারে, আর সে জন্যেই বছরে অন্তত একবার ২ মণ চুন ছিটিয়ে দেওয়া উচিত।
- অবস্থা বুঝে গ্রীষ্মকালে আম, গাব ও পেয়ারা প্রভৃতি গাছের শাখার সাহায্যে ছায়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
- এ পুকুরে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা যাবে না।
- পোনা মাছ বেঁচে থাকার হার ,রেণু পোনা আঁতুড়ে পুকুরে ছাড়ার পর উপযুক্ত খাদ্য ও পরিবেশের অভাব না হলে ১৫-২০ দিনের মধ্যে ১ ইঞ্চি পরিমাণ বড় হয়ে যায় এবং এর আকৃতি ১ ইঞ্চি হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারা পুকুরে স্থানান্তরিত করতে হয়।
- রেণু বা ডিম পোনা পুকুরে ছাড়ার পর থেকে ২০- ২৫ দিন পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে ২ বার করে মশারির জাল টেনে পোনাগুলোর স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং গণনা করা দরকার। একটি ১০ বর্গফুট আয়তন সম্পন্ন মশারির জাল পুকুরের ৪ চার কিনারায় ৪-৫টি টান দেওয়ার পর প্রতি টানেই যে পোনা আসে তা নির্ধারিত পরিমাপের পাত্র বা ভিকার দিয়ে গণনা করে পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরূপভাবে ৫টি টান ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় দেওয়ার পর এর গড় সংখ্যা বের করা যায়। যদি ৫টি টানের গড় পোনার সংখ্যা “ক” হয় তাহলে ঐদিনকার প্রতি ১০ বর্গফুট জায়গায় পোনার ঘনত্ব “ক” ধরে নেওয়া যেতে পারে। এখন পুকুরটির আয়তন যদি ৫০০ বর্গফুট হয়, তাহলে ঐ পুকুরে ঐ দিন বেঁচে আছে এমন সংখ্যক পোনার পরিমাণ ক× ৫০ = ৫০ ক। এভাবে প্রতি ৭দিন পর পর প্রতি সপ্তাহে ২ বার করে জাল টেনে মোট ২০-২৫ দিনের মধ্যে ৭-৮ বার জাল টানার পর পোনা বেঁচে থাকার হার নির্ণয় করা যায়। এ পদ্ধতিকে ‘এরিয়া ডেন্সিটি পদ্ধতি’ বলা হয়।
আধুনিক পদ্ধতিতে মাছের পোনা উৎপাদন ও পরিচর্যাঃ ‘পোনা উৎপাদন খামার খামার’
প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, প্রতিকূল আবহাওয়া ও অনাবৃষ্টি ইত্যাদি কারণে অনেক সময় আমাদের দেশে পোনা মাছ ছাড়ার মৌসুমে চাষ উপযোগী মাছের পোনা পাওয়া যায় না। ফলে অনেক উৎসাহী মৎস্যচাষী পোনার অভাবে মাছ চাষ করতে পারে না। তা ছাড়া চাহিদা মাফিক ও পছন্দমতো পোনাও অনেক সময় মাছ চাষীদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। মাছ চাষের এসব বাধা-বিপত্তি দূর করার জন্য মৎস্য চাষীদের সুবিধার্থে বিভিন্ন স্থানে স্থানে বেশ কিছু সংখ্যক মৎস্য পোনা উৎপাদন খামার বা মাছ বীজাগার স্থাপিত হয়েছে।
চারা মাছের পুকুর:
- এ জাতীয় পুকুর ৩-৪ ফুট গভীর এবং এ পুকুরে ১ ইঞ্চি হতে দেড় ইঞ্চি আকারের পোনা ছাড়া হয়। বস্তুত আঁতুড় পুকুরে পোনা একটু বড় হলেই চারা পুকুরে স্থানান্তরিত করে এগুলোকে একটু ভালোভাবে চলাফেলা করার সুযোগ দেওয়া হয়।
- এছাড়া আতুড় পুকুরে রুই, কাতলা মাছের সঙ্গে অন্যান্য মৎস্যভূক মাছের পোনা থাকলে সেগুলোকে চারা পুকুরে ছাড়ার সময়ে সরিয়ে নেওয়া হয়। চাড়া মাছের পুকুর আতুড় পুকুরের চেয়ে বড় ও গভীর হবে। একটি আতুড় পুকুরের পোনাকে ধারণ করার জন্য ২-৩টি চারা পুকুরের প্রয়োজন।
- এ পুকুরের পোনাগুলোকে ৫-৬ ইঞ্চি বড় করা হয়। ৪-৫ কাঠা আয়তনের মধ্যে ৪-৫ ফুট গভীর বিশিষ্ট পুকুর চারা মাছ চাষের জন্য অধিকতর উপযোগী। চারা পোনা চাষের জন্য রেণু পোনার তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম যত্ন নিলেও চলতে পারে। কারণ, বড় হওয়ার সংগে সংগে এদের খাদ্য গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং নানারূপ প্রতিকূল অবস্থা থেকে আত্মরক্ষার ক্ষমতাও অনেকখানি বেড়ে যায়।
- পোনা মাছের পুকুরের মতো গ্রীষ্মের সময় চারা মাছের পুকুরের তলাও শুকিয়ে চাষ করে নেওয়া দরকার। সার প্রয়োগ, মৎস্যভূক প্রাণী দূরীকরণ, গ্রীষ্মের গরমে ছায়া প্রদান ও কৃত্রিম খাবার সরবরাহ প্রভৃতি সবই পোনা মাছের পুকুরের মতো পালন করা দরকার।
বড় মাছের পুকুর প্রস্তুতি:
- এ পুকুর সাধারণত ৮-৯ ফুট গভীর হয় এবং এতে নলা মাছ ছাড়ার পর এগুলোকে বড় হতে দেওয়া হয়ে থাকে। এ পুকুরগুলো ১ বিঘা হতে ৪ বিঘা আয়তনের পর্যন্ত হয়। যেসব পুকুর এর চেয়ে বেশি বড় ও গভীরতায় আরো বেশি সেগুলোকে ‘দীঘি’ বলা হয়। বড় মাছের পুকুরে সারা বছরই পানি থাকে। এ সব পুকুর থেকে মানুষে পানি খেয়ে থাকে এবং গোসল প্রভৃতি দৈনন্দিন কাজের জন্য অনেক পুকুরেই ঘাটলা আছে।
- এ পুকুরে মাছ ছাড়ার আগে ভালোভাবে জাল টেনে রাক্ষুসে মাছসমূহ দূর করে নেওয়া দরকার। এ জাতীয় পুকুরের পানির রঙ নানা প্রকারের হয়ে থাকে, যেমন— সবুজ, বাদামি ও ঘোলাটে প্রভৃতি। প্ল্যাঙ্কটন বা জলজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণীর উপস্থিতির উপর ভিত্তি করেই পানির রঙ বিভিন্ন প্রকার হয়। পানির রংয়ের উপর ভিত্তি করেই বিভিন্ন জাতীয় মাছ কী হারে ছাড়া যেতে পারে সেটা স্থির করা হয়। পানির বর্ণ বা রং অনুযায়ী পুকুরগুলোকে কয়েক শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যেমন:
সবুজ বর্ণের পানির পুকুর:
এ পুকুরে সারা বছরই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ থাকে। এ পুকুরে বিঘা প্রতি ১ হাজার মাছ ছাড়তে হবে যা এখানে দেখানো হলো: (১) কাতলা ১৫%, (২) রুই ২৫%, (৩) মৃগেল ৪০%, (৪) কালবাউস ২০%। তাছাড়া অন্যান্য বিদেশি মাছ ৫% হারে দেওয়া যায়। বিঘা প্রতি ১ বছরে ১৫-১৬ মণ মাছ ফলন পাওয়া যায়।
বর্ণহীন পানির পুকুর:
এ শ্রেণির পুকুরে উচ্চ শ্রেণির জলজ উদ্ধিদ যেমন- ঝাউ, ঝাঁজি ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে থাকে। কাতলা, রুই, মৃগেল ও কালবাউস যথাক্রমে শতকরা ৩০:৩৫:৩৫ আনুপাতিক হারে বিঘা প্রতি ১ হাজার নলা মাছ মজুদ করার পর এদের প্রতি যত্নবান হলে বছরে বিঘা প্রতি ৩-৪ মণ মাছের ফলন পাওয়া যেতে পারে।
বাদামি বর্ণের পানির পুকুর:
এ পুকুরে ক্ষুদ্র প্রাণীর সংখ্যা বেশি ও ক্ষুদ্র প্রাণীর তুলনায় ক্ষুদ্র উদ্ভিদের সংখ্যা কম। এ পুকুরে রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালবাউস যথাক্রমে শতকরা ৪০:৩০:৩০ আনুপাতিক হারে বিঘাপ্রতি ৮০০ নলামাছ পালনের পর ৩ মণ মাছ পাওয়া যায়।
স্বচ্ছ বর্ণের পানির পুকুর:
এ পুকুরে ক্ষুদ্র প্রাণী, উদ্ভিদ বা উচ্চতর জলজ উদ্ভিদ-এর কোনোটিই প্রচুর পরিমাণে নেই। এখানে কাতলা, রুই, মৃগেল ও কালবাউস যথাক্রমে শতকরা ৩০:৩৫:৩৫ আনুপাতিক হারে বিঘাপ্রতি ৭০০ নলামাছ পালন করলে বিঘা প্রতি ২ মণ হারে ফলন পাওয়া যেতে পারে।
ঘোলাটে বর্ণের পানির পুকুর:
স্থায়ী ঘোলাটে পানি। ক্ষুদ্র প্রাণী ও উদ্ভিদ এবং উচ্চতর জলজ উদ্ভিদ এখানে নেই। এ পুকুরে রুই, কাতলা, মৃগেল ও কাল বাউস যথাক্রমে শতকরা ৩৩.৩৩৩.৩৩৩.৩ আনুপাতিক হারে বিঘাপ্রতি ৩৫০ নলামাছ পালন করলে বিঘাপ্রতি ১ মণ হারে ফলন পাওয়া যায়। সার প্রয়োগ ও মাছের খাবার দিয়ে উল্লিখিত ফলনের হার কয়েকগুণ বাড়ানো হয়ে থাকে।