Skip to content

 

বিল-হাওড়ে মাছ চাষ ও ব্যবস্থাপনা, প্লাবন-ভূমিতে পেনে মাছ চাষ, মহাসড়ক ও রেলওয়ের পাশের জলাশয়ে মাছ চাষ, মাছ চাষ প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা

হাওড়ে মাছ চাষ প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা প্লাবন ভূমিতে পেনে মাছ চাষ জলাশয়ে মাছ চাষ

বিল-বাওড়ে মাছ চাষ ও ব্যবস্থাপনা

দেশে বিভিন্ন এলাকায় বিল-বাওড়সমূহের পরিবেশ ও প্রকৃতি ভিন্ন। হাওড় অভ্যন্তরস্থ বিলগুলোর পরিবেশ প্লাবনভূমিসহ বিস্তীর্ণ এলাকার শস্য উৎপাদন ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভরশীল। হাওড় অঞ্চলের বিলে ও পার্শ্ববর্তী জমিগুলোতে ধান ও অন্যান্য শস্য আবাদ করা হয় বলে ব্যবহৃত রাসায়নিক সারের ক্রিয়া থাকে।

নদীর সঙ্গে সংযুক্ত বিলসমূহের পরিবেশ নির্ভর করে নদীর পানির গুণাগুণের উপর। তবে বদ্ধ বিল ও বাওড়ের পরিবেশ এ থেকে ভিন্নতর ও মাছ চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি ও বন্যার পানি পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে অজৈব সারের ধোয়ানী, ফফেট ও নাইট্রেট, জৈব পদার্থ ও তলানী বিল ও বাওড়ে বয়ে আনে। এ সকল কারণে বিল ও বাওড়ের পানি ও মাটি উর্বর থাকে ফলে প্রাকৃতিক খাবারও উৎপাদিত হয়। বিদ্যমান প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে মাছের সন্তোষজনক বৃদ্ধি ঘটে।

সাধারণত বিল-বাওড় জাতীয় জলাশয়ে কোনো সার বা খাবার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। বিল ও বাওড় জলাশয়গুলো সারা বছর স্বাদু পানির সকল প্রজাতির মাছের চারণভূমি ও উৎকৃষ্ট আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বর্ষা মৌসুমে এ সকল জলাশয় মাগুর, শিং, কই, টেংরা, চান্দা, মলা, পাবদা, শোল, গজার, বোয়াল, চিতল ইত্যাদি মাছের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্লাবন ভূমি অভ্যন্তরস্থ বিলগুলোতে বর্ষা মৌসুমে পানি আসার সময় শিং, মাগুর, শোল, পুটি, টাকি, টেংরা ইত্যাদি প্রজাতির মাছ প্রজনন করে।

আগাছা দমন

বিল ও বাওড়ের পানি উর্বর থাকায় এতে বিভিন্ন প্রকার আগাছা জন্মে থাকে। কচুরিপানা, শাপলা, পাতা শেওলা ইত্যাদি ক্ষতির জলজ আগাছাসমূহ পানির উর্বরতা শক্তি কমিয়ে এর গুণাগুণ নষ্ট করে ফেলে। কচুরিপানা ও অন্যান্য আগাছা পানির সকল সার জাতীয় পদার্থ শোষণ করে বলে প্রাকৃতিক খাবার বিশেষ করে ক্ষুদ্র প্রাণী ও উদ্ভিদ কণা জন্মানো বাধাগ্রস্থ হয়।

কচুরিপানা ও অন্যান্য ভাসমান আগাছা পানির উপরিস্তরে ভাসমান অবস্থায় থাকায় বাতাস থেকে পানিতে অক্সিজেন মিশ্রণে ও সূর্যের আলো প্রবেশে বাধা দেয়। এতে পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি না হওয়ায় কার্প বা রুই জাতীয় মাছের উৎপাদন আশানুরূপ হয় না। ভাসমান কচুরিপানা জাতীয় আগাছা মাছ আহরণকালে জাল টানতেও বাধার সৃষ্টি করে। এ সকল কারণে বিল ও বাওড় থেকে কচুরিপানা সরিয়ে ফেলা দরকার।

কচুরিপানা সরিয়ে ফেললে পানিতে বিদ্যমান সার জাতীয় পদার্থ বিশেষ করে নাইট্রেট ও ফসফেট সহজলভ্য হয়। ফলে বিভিন্ন প্রকার প্রাণিকণা ও ক্ষুদে শ্যাওলাসহ অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ কণার জন্ম হয়, যা মাছ খেয়ে থাকে। এগুলো খেয়ে মাছ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। উপরিস্তরের মাছের নিঃসরিত বর্জ্য পদার্থসমূহ নিচের স্তরের মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

হাওড় এলাকার বিলগুলোতে নল খাগড়া, তারা, চাইল্যা, বনতুলশি ইত্যাদি আগাছা জন্মে থাকে যা ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত। ক্ষতিকর সকল ধরনের আগাছা বিল ও বাওড় থেকে অবশ্যই সরিয়ে ফেলতে হবে। অপসারিত কচুরিপানা পশুর খাদ্য ও কম্পোস্ট সার তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

কাটা শেওলা, ঝাঝি, কলমি, ক্ষুদিপানা, শিংরা ইত্যাদি আগাছাপূর্ণ স্থানগুলো বিলে প্রজননকারী মাছের নিরাপদ আশ্রয় ও প্রজননস্থল হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। এ ধরনের আগাছা জলাশয়কে উর্বরতার আধিক্যজনিত অপকার থেকে রক্ষা করে। তবে জলাশয়ে যাতে এগুলো অধিক বিস্তার লাভ না করে সেজন্যে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।

হাওড় অঞ্চলের বিলে হিজল, করচ, মান্দাইর, মেরা, বরুন ইত্যাদি জলজ বৃক্ষ জন্মে থাকে যা পরিবেশ সহায়ক বলে গণ্য হয়।

পোনা মজুদ

বদ্ধ বিল-বাওড়ে মাছের চাষ ও উৎপাদন বাড়াতে হলে পোনা ছাড়া আবশ্যক। হাওড় ও প্লাবনভূমির অভ্যন্তরস্থ এবং নদীর সাথে সংযুক্ত বিলগুলোতে বাইরের উৎস থেকে রুই জাতীয় ও অন্যান্য মাছের প্রবেশ ঘটে। তা সত্ত্বেও এ ধরনের জলাশয়েও অধিক উৎপাদনের জন্য পোনা ছাড়া দরকার।

বিল-বাওড়ে পোনা ছাড়ার সংখ্যা নির্ভর করে এতে বিদ্যমান মাছের মজুদ ও প্রাকৃতিক খাবারের উপস্থিতির উপর। জাল টেনে বিদ্যমান মাছের মজুদ যাচাই করা যায়। কোনো জলাশয়ের প্রাকৃতিক খাবারের উপস্থিতি সেচী-ডিস্ক দ্বারা পরিমাপ করা যেতে পারে। সেচী গভীরতা কম হলে তাতে প্রাকৃতিক খাদ্য বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে অধিক পোনা মজুদ করা যেতে পারে। অপরদিকে সেচী গভীরতা বেশি হলে ধরে নিতে হবে জলাশয়ে প্রাকৃতিক খাবার কম এবং সেক্ষেত্রে কম সংখ্যক পোনা মজুদ করতে হবে।

See also  মাছ চাষে পুকুরের শ্রেণিবিভাগ? পুকুর কাকে বলে, কি কি?#আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ শিক্ষা by খামারিয়ান.কম

বিল-বাওড় জাতীয় জলাশয়ে রাক্ষুসে মাছের (বোয়াল, গজার, শোল, চিতল, ইত্যাদি) উপস্থিতি থাকায় এ ধরনের জলাশয়ে ৫-৬ (১২-১৫ সেন্টিমিটার) আকারের পোনা ছাড়তে হবে। এর নিচের আকারের পোনা কোনো ক্রমেই ছাড়া উচিত নয়।

অবকাঠামো উন্নয়ন ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা

হাওড় অভ্যন্তরস্থ বিলসমূহ শুষ্ক মৌসুমে যখন একটি থেকে অপরটি পৃথক হয়ে যায় তখন মাছ মজুদ ও এর সুষ্ঠুভাবে পরিচর্যা করা হলে ঐ সকল বিলে আশানুরূপ উৎপাদন পাওয়া যায়। একইভাবে নদীর সাথে সংযুক্ত বিলসমূহ শুষ্ক মৌসুমে নদী হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পোনা মজুদের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

তবে শুষ্ক মৌসুমে নদীর সাথে বিলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হলে সেক্ষেত্রে সাময়িকভাবে বাঁশের বানা বা পাটা দিয়ে ঘের তৈরি করে মাছ চাষ করা যেতে পারে। তবে বানা বা পাটার দুই চটার মধ্যবর্তী ফাঁকের প্রশস্ততা এমন হতে হবে যাতে মাছ বের হয়ে না যেতে পারে। বাওড়সমূহে পাটা স্থাপন করতে হলে বর্ষার সর্বোচ্চ পানির উচ্চতার চেয়ে পাটার উচ্চতা অন্তত ২-২.৫ ফুট (৬০-৭৫ সে. মি.) বেশি করতে হবে।

বদ্ধ বিলসমূহের পাড় বর্ষাকালে ডুবে যাওয়ার আশংকা থাকলে তা উঁচু করে নিতে হবে। এর সাথে কোনো খাল বা সেচ নালার সংযোগ থাকলে সংযোগস্থলে প্রয়োজন অনুসারে স্ক্রীন দেওয়া যেতে পারে অথবা সংযোগ বন্ধ করে মাছ চাষের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

বিল-বাওড়ের অভ্যন্তরভাগে যে স্থানে গভীরতা বেশি সেখানে জলজ বৃক্ষের ডাল-পালা বা কাঠা দিয়ে মাছের আশ্রয়স্থল ও অভয়াশ্রম স্থাপন করা হলে মাছের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পায় এবং জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষিত হয়। বিল ও বাওড়ে মাছ চাষ ব্যবস্থাপনায় অবশ্যই অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা দরকার।

উন্মুক্ত বিলসমূহের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অথবা অভ্যন্তরস্থ ধানী জমিতে কীটনাশক ব্যবহারে সচেতন হতে হবে। মাছের জন্য ক্ষতিকারক নয় এমন কীটনাশকের ব্যবহার এবং প্রয়োগ মাত্রা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। বিলের পাড়ে জলজ বৃক্ষ রোপণ করলে তা পরিবেশ উন্নয়নে সহায়ক হবে। বর্জ্য বা অন্য কোনো প্রকার দূষিত পানি প্রবেশ করে এবং অত্যাধিক আগাছা জমে যাতে জলাশয়ের পরিবেশ নষ্ট হয়ে মাছের রোগ-বালাই ছড়িয়ে না পড়ে সে সম্পর্কে দৃষ্টি রাখতে হবে।

মাছ আহরণ ও উৎপাদন

বিল বাওড়ের মাছ বিভিন্ন উপায়ে ও বিভিন্ন প্রকার জাল ব্যবহার করে আহরণ করা যেতে পারে। বিল-বাওড় প্রকৃতির জলাশয়ে সাধারণত গ্রাস্কার্প, কমন কার্প ও কাতলা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। মৃগেল ও রুই মাছের বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে কম হয়। বিল-বাওড় জাতীয় জলাশয়ে ছোট মাছের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে ও উৎপাদন ভালো হয়। মাঝে মাঝে ছোট মাছ (এলাকা ভেদে গুড়া মাছ বা রাণী মাছ হিসেবে পরিচিত) আহরণ করা হলে বড় প্রজাতির মাছের উৎপাদন ভালো হয়।

সিল্ভার কার্প ১ কেজি, কাতলা ১ কেজি, গ্রাস্কার্প ১.৫ কেজি, রুই ও মৃগেল ৬০০ গ্রাম এবং কমন্কার্প ১.৫ কেজি ওজনের হলে ঐগুলো আহরণ ও বিক্রয়যোগ্য হয়।

সাধারণত অগ্রহায়ণ মাস থেকে আষাঢ় মাস (নভেম্বরের মাঝামাঝি হতে জুনের মাঝামাঝি কাল পর্যন্ত) পর্যন্ত বিল-বাওড়ের মাছ ধরার উপযুক্ত সময়। শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে বন্যার সময় মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে।

মাছ কখনোই যাতে কারেন্ট জাল বা পানি সেচ করে আহরণ না করা হয় সে সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। উন্মুক্ত বিলের ডিমওয়ালা মাছ আহরণ করা উচিত নয়। এসব ব্যবস্থাপনা ও আহরণ পদ্ধতি অনুসরণ করলে বছরে হেক্টর প্রতি গড়ে ১.২-১.৫ টন মাছ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

প্লাবন-ভূমিতে পেনে মাছ চাষ

পেনে মাছ চাষ কী?

কোনো উন্মুক্ত বা আধাবদ্ধ জলাশয়ে এবং প্লাবন ভূমিতে এক বা একাধিক দিক থেকে বাঁশের বানা, বেড়া, জাল বা অন্য কোনো উপকরণ দিয়ে ঘিরে উক্ত জলাশয়ের মধ্যে মাছের পোনা মজুদ করে চাষ করাকে ‘পেনে মাছ চাষ’ বলা হয়।

পেনে মাছ চাষের গুরুত্ব

১. পেনে মাছ চাষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকার সমস্যা দূর করা ও অধিক আমিষ উৎপাদন করা যায়।

২. অভ্যন্তরীণ পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।

৩. বহু মালিকানাধীন জলাশয়ের মালিকানা সমস্যা সমাধান করা যায়।

৪. সরকারি মালিকানাধীন যে সমস্ত জলাশয়ে আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা সম্ভব নয়, সে সমস্ত জলাশয়ে পেন তৈরি করে ছোট ছোট ইউনিটে নিবিড় বা আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে মাছের অধিক উৎপাদন করা সম্ভব।

See also  মাছ চাষে উন্নত খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও মাছ চাষে সার প্রয়োগঃ মাছ চাষে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট এর ব্যবহার + আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ + মাছ চাষে ইউরিয়া + মাছ চাষের উপায় + মাছ চাষ কিভাবে করা যায় + মাছ চাষে পটাশ এর ব্যবহার

৫. জলাশয়ের বহুবিধ ব্যবহার যেমন কৃষি, সেচ ইত্যাদির কোনো অসুবিধা না করেও পেনে মাছ চাষ করা সম্ভব।

৬. পেনে মাছ চাষ করে দেশের মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন ও চাষীর আয় বৃদ্ধি করা যায়।

চাষ পদ্ধতি

১. বছরে ৬-৮ মাস পানি থাকে এমন মৌসুমী জলাশয় যেমন সেচ প্রকল্পের খাল, সংযোগ খাল, মরা নদ-নদী, প্লাবন ভূমির অংশ এবং নদ-নদীর খাড়ী অঞ্চলে পেনে মাছ চাষ করা যায়।

২. পেনের ঘের বা বেড়া জলাশয়ের তলায় পুঁতে রাখা হয় এবং পেনের ভিতরের পানির সাথে বাইরের পানির সংযোগ বা প্রবাহ থাকে।

৩. প্রয়োজনবোধে অল্প সময়ে পেন এক স্থান অন্য স্থানে স্থানান্তর ও তৈরি করা যায়।

৪. যে কোনো সময়ে সামান্য শ্রম ও কম খরচে পেনের মাছ ধরা যায়।

পেনে মাছের ব্যবস্থাপনা

১. বাঁশের বেড়া অথবা টায়ার কর্ড জাল বা গিটবিহীন নাইলন জাল (জালের ফাঁস ১০ মি. মি.-এর কম) দিয়ে পেন তৈরি করা যায়।

২. জলাশয়ের মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে ১.০ হেক্টর হতে ১০.০ হেক্টর আয়তনের পেন নির্মাণ করা যেতে পারে।

৩. যে সমস্ত এলাকায় পানির প্রবাহ বেশি সেসব এলাকায় তলদেশে বাঁশ দ্বারা ৩ মিটার উঁচু বানা তৈরি করে তলদেশের মাটির মধ্যে কিছু অংশ পুঁতে দিতে হবে, যাতে পানির চাপে তলদেশের বালি বা নরম মাটি সরে না যায়।

৪. পেন তৈরির পর জাল টেনে যতদূর সম্ভব রাক্ষুসে ও অ-চাষকৃত মাছ সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে।

৫. পেনে মাছ চাষের জন্য ১২-১৫ সে.মি. আকারের রুই, কাতলা, মৃগেল, সিল্ভার কার্প, কমন কার্প, যথাক্রমে ৩০ঃ২০ঃ১০ঃ১০ঃ৩০ হারে হেক্টর প্রতি ৩-৪ হাজার অথবা উপরোক্ত মজুদ ঘনত্বের ৫০ঃ৫০ অনুপাতে রুই জাতীয় মাছ এবং পাংগাস মাছ মজুদ করা যেতে পারে। ৬. পেনে গিফ্ট জাতীয় তেলাপিয়ার একক চাষও করা যেতে পারে। ৭. মজুদকৃত মাছের মোট ওজনের ১- ৩% হারে সম্পূরক খাবার দিতে হবে। ৮. ৬-৮ মাস চাষের পরই বিক্রিযোগ্য মাছ পাওয়া যায়। যে সমস্ত জলাশয়ে সারা বছর পানি থাকে সে সমস্ত জলাশয় হতে বাৎসরিক ভিত্তিতে মাছ আহরণ করা যেতে পারে।

পেনে মাছের উৎপাদন

উপরের নিয়মে মাছ চাষ করলে পেনে গড়ে হেক্টর প্রতি ১,৫০০-২,০০০ কেজি মাছ উৎপাদিত হতে পারে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির ফলে শুধু পুকুরে মাছ চাষ ও উন্মুক্ত জলাশয় হতে আহরিত মাছ দ্বারা দেশের মাছের চাহিদা পূরণ ও পুষ্টি সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এ সমস্ত জলাশয়ের উল্লেখযোগ্য অংশে পেনে মাছ চাষ করা সম্ভব। উক্ত জলাশয়ে নিবিড় বা আধা-নিবিড়ভাবে পেনে মাছ চাষ করা হলে একদিকে যেমন মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে অন্যদিকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা সম্ভব হবে।

মহাসড়ক ও রেলওয়ের পাশের জলাশয়ে মাছ চাষ

বেকার যুবকদের জীবনমান উন্নয়ন ও জীবিকা নির্বাহে মাছ চাষ একটি সম্ভাবনাময় ও পরীক্ষিত ক্ষেত্র। দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বেকার-যুবকদেরকে মাছ চাষে সম্পৃক্ত করে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমিষের ঘাটতি পূরণসহ মাছ বিক্রির অর্জিত আয় দ্বারা স্বাবলম্বী হয়ে দারিদ্রের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে।

মাছ চাষের প্রচলিত ক্ষেত্রসমূহ হচ্ছে পুকুর, দীঘি, বাওড়, ঘের ইত্যাদি। এ সমস্ত জলাশয়ের অধিকাংশই কোনো না কোনো ভাবে ব্যবহৃত হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী বেকার যুবকদের অধিক হারে সম্পৃক্ত করার সুযোগ কম। এছাড়াও দেশে এমন সব অ-ব্যবহৃত জলাশয় রয়েছে যেগুলো পরিকল্পিতভাবে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করলে সহজেই বেকার জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থানের পথ উম্মোচন করা যাবে। এসব জলাশয়ের অন্যতম হচ্ছে মহাসড়ক ও রেলওয়ের পাশের জলাশয়।

বর্তমানে এ সমস্ত জলাশয়গুলোর অধিকাংশই কচুরি পানা ও আবর্জনা দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে পতিত অবস্থায় পড়ে আছে। মশা-মাছির চারণ ও প্রজনন ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবসহ নানাভাবে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। দেশে সড়ক ও জনপথের পাশের প্রায় ৮,৮৭০ হেক্টর এবং রেলওয়ের পাশে প্রায় ৬,০০০ হেক্টর জলাভূমি আছে।

জলাশয় প্রাপ্তি, জরিপ ও চিহ্নিতকরণ

মহাসড়ক ও রেলওয়ের পাশের জলাশয়গুলোর মালিকানা ন্যস্ত রয়েছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়াধীন যথাক্রমে সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং রেলওয়ে বিভাগের উপর। উক্ত জলাশয়সমূহ মাছ চাষের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে হলে উপরোক্ত মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সাথে মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয় ও মৎস্য অধিদফতরের সমঝোতা স্মারক সম্পন্ন করতে হবে।

সমঝোতা স্মারক সম্পন্নের পর উপজেলা ও জেলা ভিত্তিক মহাসড়ক ও রেলওয়ের পাশের মাছ চাষ উপযোগী জলাশয়সমূহ জরিপ করে তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। মাছ চাষ ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে মৌসুমী ও মেয়াদী জলাশয় চিহ্নিত করে যেগুলো সংস্কারযোগ্য ও সংস্কার ছাড়াই মাছ চাষ করা যাবে তার অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করা প্রয়োজন।

See also  কই মাছ চাষ ও কই মাছের বৈশিষ্ট্য + শিং ও মাগুর মাছ চাষ ও শিং ও মাগুর মাছের বৈশিষ্ট্য + লাটা, শোল ও গজার মাছ চাষ ও লাটা, শোল ও গজার মাছের বৈশিষ্ট্য (কই, শিং ও মাগুর, লাটা, শোল ও গজার, ইত্যাদি জিওল জাতীয় মাছের বৈশিষ্ট্য ও চাষ)

মৎস্য ও পশু-সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন এফ.সি.ডি. আই প্রকল্পের সাথে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ধীন সড়ক ও জনপথ বিভাগের মধ্যে সম্পন্ন সমঝোতা স্মারকের আলোকে দেশের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় এসব কার্যক্রম সীমিতভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

দলগঠন: নীতিমালা ও কার্যক্রম

চাষ উপযোগী মহাসড়ক ও রেলওয়ের পাশের জলাশয়সমূহ মাছ চাষের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য একটি নীতিমালার আলোকে সুফলভোগী দল গঠন করা যায়। দল গঠনের নীতিমালায় থাকবে:

১. দলের প্রতিটি সদস্যকে জলাশয়ের আশে পাশের অধিবাসী হতে হবে।

২. দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষ করে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবক ও যুব মহিলা নিয়ে দল গঠনে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত হবে।

৩. দলের সদস্য সংখ্যা জলাশয় অনুপাতে হেক্টর প্রতি ৫-৬ পরিবারের মধ্যে হবে।

৪. দলের কার্যাদি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একটি পরিচালনা কমিটি থাকবে। জলাশয়গুলো দীর্ঘ মেয়াদের ভিত্তিতে সমিতির নিকট ইজারা দেওয়া যেতে পারে।

স্থানীয় ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে দলগঠন কার্যক্রম অনুমোদন ও সার্বিক কার্যক্রম বাস্তবায়িত হবে। সুগঠিত সুফলভোগী দলের নিকট দীর্ঘ মেয়াদে (১০-১৫ বছর) নির্দিষ্ট বুকভ্যালুতে ‘বন্দোবস্ত কমিটির মাধ্যম’ ব্যবহার বন্দোবস্ত (ইজারা) প্রদান করতে হবে। এতে সরকারের একদিকে যেমন রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে জলাশয়গুলো হতে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে আয়ের পথ সুগম হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের স্রোতধারায় সহজেই সম্পৃক্ত হয়ে সুগঠিত সুফলভোগী দলগুলো আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে। ফলে সার্বিকভাবে সমাজ ও দেশ উপকৃত হবে।

জলাশয় উন্নয়ন

সড়ক ও রেলপথের পাশে যেসব পতিত জলাশয় রয়েছে সেগুলো পার্শ্ববর্তী ভূমি মালিকের সাথে যৌথভাবে উন্নয়ন করে তাদের মাধ্যমে অথবা সংগঠনের মাধ্যমে উন্নয়ন করে দীর্ঘ মেয়াদী ইজারা দিয়ে মাছ চাষ পরিচালনা করা যেতে পারে। এ উৎস থেকে দেশে বছরে প্রায় ৪০-৪৫ হাজার মেট্রিক টন বাড়তি মাছ উৎপাদন সম্ভব। এতে অনেকের কর্মসংস্থান হবে, আবার আয়ও হবে।

মাছ চাষ প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা

মহাসড়ক ও রেলওয়ের পাশের জলাশয়গুলোর অবস্থান প্রকার যথা মৌসুমী ও মেয়াদী বন্যামুক্ত ও বন্যাকবলিত ভেদে মাছ চাষের প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করতে হবে। বর্তমানে জলাশয়গুলোর কোনোটি খাল, কোনোটি পুকুর আবার কোনোটি ডোবা বা খাদ আকৃতির। এগুলো অধিকাংশই বন্যামুক্ত নয়। খাল আকৃতির বন্যাকবলিত জলাশয়ে বন্যা পরবর্তী ব্যবস্থাপনায় ‘পেনে মাছ চাষ’ পদ্ধতিতে চাষ করতে হবে। অর্থাৎ দীর্ঘতম খাল আকৃতির জলাশয়টিকে পেনের (বাঁশের বানা, বাঁশ ও জাল-গড়ির সমন্বয়ে আড়াআড়ি বাঁধ) মাধ্যমে একাধিক খণ্ডে বিভক্ত করে মাছ চাষ করা যাবে। এতে প্রতিটি খণ্ডের মধ্যে প্রবাহিত পানি অবাধে চলাচল করতে পারবে। এছাড়াও প্রতিটি খণ্ডে বা একাধিক খণ্ডে অধিক সংখ্যক সুফলভোগীকে সম্পৃক্ত করা যাবে।

প্রযুক্তিটি দেশে নতুন হলেও চাঁদপুর জেলায় এফ.সি.ডি.আই প্রকল্পভুক্ত সি.আই.পি খালে পেনে মাছ চাষ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভবিষ্যতে মৎস্য অধিদফতরের উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে এ সমস্ত জলাশয়গুলো সংস্কার করে বন্যামুক্ত করা গেলে সারা বছরই এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ অব্যাহত রাখা যাবে। পেনে কার্পের মিশ্র চাষই লাভজনক। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় পেনে কার্পের মিশ্রচাষ করে বছরে গড়ে হেক্টর প্রতি ৩-৪ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন করা যাবে।

বন্যামুক্ত মেয়াদি পেনে পুকুর, ডোবায় বা খাদে সারা বছরই পরিকল্পিতভাবে মাছ চাষ করা যাবে। চাহিদা ও সুবিধা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে পোনা প্রতিপালন, কার্পের মিশ্রচাষ করা যাবে। এ সব জলাশয়ে বন্যাপূর্ববর্তীতে পোনা প্রতিপালন, অল্প সময়ের চাষযোগ্য মাছ যেমন: রাজপুটি, গিফট জাতীয় তেলাপিয়া চাষ করা যেতে পারে। মেয়াদি জলাশয়ে হেক্টর প্রতি প্রায় ৫ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন করা যায়। পক্ষান্তরে, মৌসুমী জলাশয় হতে হেক্টর প্রতি ১-২ টন তেলাপিয়া বা রাজপুটি মাছ উৎপাদন করা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Copyright Notice

কপি করা নিষিদ্ধ!