বিষয়: চাষ উপযোগী 10 টি মাছের বৈশিষ্ট্য, মৎস্য সম্পদ ও মাছ চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব, মাছ চাষের উপকারিতা, মাছ চাষের উদ্দেশ্য। মাছের গুরুত্ব, মাছের উপকারিতা, মাছের পুষ্টিগুণ কি? মৎস্য সম্পদ কমে যাওয়া কারণ? মৎস্য সম্পদ কমে যাওয়া কারণ? মাছ চাষের ইতিহাস।
হ্যাশট্যাগ:#মাছ চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব#মাছ চাষের উপকারিতা#মাছ চাষের উদ্দেশ্য।
বর্তমানে এদেশের জাতীয় আয়ে মাছের অবদান প্রায় ৫ শতাংশ। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশই মাছ থেকে পূরণ হয়। তাই মাছ প্রাণিজ আমিষের মূল উৎস। আমিষ জাতীয় খাদ্য খেলে দেহের বৃদ্ধি, ক্ষয় পূরণ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। মানুষের মেধা বিকাশেও আমিষ জাতীয় খাদ্য প্রয়োজন। বাংলাদেশের আবহাওয়া, পানি ও মাটি মাছ চাষের জন্য বেশ উপযোগী।
এই পোষ্টটি থেকে আমরা মাছ চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব, মাছ চাষের উপকারিতা ও মাছ চাষের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পারব। তাই আশা করি খামারিয়ানের সাথেই থাকবেন।
মাছ চাষের ইতিহাস
- বলা যায়, প্রাচীন চৈনিকরাই হচ্ছে মাছ চাষের আদিম দাবিদার। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে লেখা ফ্যান্ লাই-এর মাছের চাষ বই থেকে চৈনিকদের মাছ চাষ সম্পর্ক বেশ কিছু তথ্য জানা যায়।
- প্রাচীন চিনারা নদী নালায় জাল, বাঁশের চাটাই বা বান দিয়ে মাছের ডিম ও পোনা মাছ সংগ্রহ করতো। চৈনিক মৎস্যজীবীগণ ডিম সংগ্রহ, পোনামাছ ফোটানো ও তা বিভিন্ন জায়গায় চালান দিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো।
- ডিম থেকে পোনা মাছ ফোটানোর এক অদ্ভূত প্রথা প্রাচীন চিনে প্রচলিত ছিল।
- মুরগির ডিমের ভিতরের অংশ কৌশলে বের করে তাতে মাছের ডিম পুরে আবার মুরগির নিচে এসব ডিম তা দেওয়ার জন্য রেখে দেওয়া হতো। পরে মুরগীর নিচ থেকে ডিমগুলো নিয়ে তা সূর্যতাপে গরম করা পানিতে খোলা হতো এবং ভ্রুণ পূর্ণাঙ্গ মাছের রূপ নিয়ে ফুটে না বের হওয়া পর্যন্ত সেই পানিতেই ডিমগুলোকে রেখে দেওয়া হতো। এসব পোনা মাছকে পরে ডালের সাথে ডিমের কুসুম মিশিয়ে খেতে দেওয়া হতো। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য মাছকে খাদ্য সরবরাহ করা এবং পানির উর্বরতা রক্ষা করার জন্য পুকুরের সার প্রয়োগ করাও যে দরকার আছে তা তারা জানতো। মানুষের মলকে তারা পুকুরের সার হিসেবে ব্যবহার করতো, যা আজো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কোনো কোনো দেশে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
- চিনাদের মধ্য থেকে যারা মালয়, ফরমোজা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এসব দেশে বসবাস শুরু করেছিল, তারা বংশ পরম্পরায় অর্জিত মাছ চাষের বাস্তব জ্ঞান প্রয়োগ করে সেখানেও মাছ চাষের ব্যবসা গড়ে তোলে।
- চিনাদের সমসাময়িককালে ভারত উপমহাদেশেও মাছ চাষ বিস্তার লাভ করে। খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ৩২৫ বছর আগের কোনো এক সময়ের লেখা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে এ উপমহাদেশে মাছ চাষ সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। তাছাড়া খনার বচনে মাছ চাষের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
- ১১১৭ খ্রিষ্টাব্দে চালুক্য বংশের রাজা সোমেশ্বর তাঁর বিশ্বকোষ “মন ষোলসার’র ‘মৎস্য বিনোদ’ অধ্যায়ে মাছের ফলন বাড়ানো পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
- জানা যায় যে, মধ্যযুগে ইউরোপে মাছ চাষ প্রণালি বেশ ভালোভাবে প্রসারতা লাভ করে। তখনকার ইউরোপের অভিজাত শ্রেণির লোকদের নিজস্ব পুকুর ছিল এবং তাতের গভীর মনোযোগ দিয়ে তারা মাছ চাষ করতো। পোনামাছ সংরক্ষণ, পরিবহন মাছের খাদ্য, পুকুর তৈরি ও তাদের যত্ন এসব ব্যাপারে ইউরোপীয়গণ জোর দিত বেশি।
- ১৪২০ খ্রিষ্টাব্দে ডম্পিংকন্ নামে জনৈক খ্রিষ্টান ধর্মযাজকের কৃত্রিম উপায়ে মাছের প্রজনন ইউরোপে মাছ চাষে এক নতুন যুগের সূচনা করে। ডপিঙ্ক প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও স্ত্রী ট্রাউট মাছের পেট পিটে যথাক্রমে বীর্য ও ডিম স্খলন করে এবং বীর্যের দ্বারা ডিম নিষিক্ত করে কৃত্রিম প্রজননে সফলতা লাভ করেন।
- খ্রিষ্টীয় ১৫ থেক ১৮ শতকে নথ ও বসিয়াস্এ সব মনীষীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ইউরোপে মৎস্যচাষ পদ্ধতি অধিকতর উৎকর্ষতা লাভ করে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, ফিনল্যান্ড, হাঙেরি, চেকোশ্লোভাকিয়া, রাশিয়া প্রভৃতি দেশ মাছ চাষে সফলতা অর্জন করতে শুরু করে।
- আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে যদিও অষ্টাদশ শতাব্দীতে মাছ চাষ শুরু হয়, কিন্তু তা ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং বিংশ শতাব্দীতে অধ্যাপক মি. জর্জ এমবোডিকে যুক্তরাষ্ট্রে মাছ চাষের অগ্রাধিনায়ক হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি তাঁর পুস্তিকা ‘দ্য ফার্ম ফিস পন্ড’ এর বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষের বহু জটিল সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
- মাছ চাষ বিশেষজ্ঞগণ মোটামুটিভাবে মাছ চাষ যুগকে দু ভাগে ভাগ করেছেন। এদের প্রথম ভাগকে ধরা হয়েছে খ্রিষ্টের জন্মের পূর্ব থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত এবং শেষ যুগকে রাখা হয়েছে ১৯৩০ সাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত।
মৎস্য সম্পদ: মাছ চাষের উদ্দেশ্য
- এক হিসাব অনুযায়ী আজ পর্যন্ত ১৫ হাজার থেকে ১৭ হাজার মাছ প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, আজ থেকে প্রায় ৪০ কোটি বছর আগেও মাছ প্রজাতির উপস্থিতি ছিল।
- আজ পর্যন্ত যে সব মাছ পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে হাঙর বংশের রীন্ কডন্না মক মৎস্য প্রজাতি আকারে সর্ববৃহৎ অর্থাৎ লম্বা ৭০ ফুট ও ওজনে ২৫ টন।
- মাছের মতো অনেক প্রাণী আছে যেমন: তিমি, শিশু ও বিভিন্ন প্রকার চিংড়ি ইত্যাদি।
- প্রাণীদের মধ্যে তিমি সর্ববৃহৎ। সাগর, মহাসাগর এর বাসস্থল। আকারে তিমি ১০০ হাত পর্যন্ত হতে পারে। সর্ব প্রকার তিমিই মৎস্যভোজী। এর মুখগহ্বর বৃহদাকার এবং মুখের পাশে চুল আছে। একটি বৃহদাকার তিমি থেকে ১৫০ ব্যারেল্ পর্যন্ত তেল পাওয়া যায়।
- আদিকাল থেকেই মাছ একিট বিশিষ্ট খাদ্য হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত। পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি নেই যারা মাছ খায় না। অবশ্য খাবারের প্রকরণ আলাদা, যেমন: জাপানিরা কাঁচা মাছ আবার কেউ সিদ্ধ করে, কেউ লবণ দিয়ে, কেউ বা তাপ দিয়ে প্রভৃতি নানাবিধ উপায়ে খেয়ে থাকে।
- কয়েকটি মৎস্য প্রজাতি বাদে সব মাছই খেতে সুস্বাদু। মৎস্য পেশীগুলোতে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন ও চর্বি জাতীয় খাদ্য আছে। এছাড়া যে সব মাছ প্ল্যাঙ্কটন্ জাতীয় খাদ্য বেশি পরিমাণে খেয়ে থাকে তাদের শরীরে ভিটামিনও আছে।
- সাধারণত মাছের শরীরে শতকরা হিসাবে ৬০%-৮২% পানি এবং ১৩%-২০% প্রোটিন আছে।
- ভূ-পৃষ্ঠের ৭০-৮০% সাগর ও মহাসাগরে আবৃত, আর ২৯.২% নদী-নালা, খাল-বিল, জমি, পাহাড় প্রভৃতিতে আবৃত এবং স্বভাবত কারণেই মাছ উৎপাদনের বেশির ভাগই পাওয়া যায় সাগর থেকে এবং স্বল্প পরিমাণ মাছ স্বাদু পানি থেকে আহরণ করা হয়।
- সাগর থেকে যে সব মাছ পাওয়া যায় তাদের মধ্যে হেরিং ট্রট সেমন্ মেকারিল ইল্ হেরিবাট কড্ বাছ ব্রীম্ফ্লা ন্ডার মুলেট প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। নরওয়ে, স্কটল্যান্ড, নিউ ফাউন্ডল্যান্ড, জাপান, আলাস্কা, সাইবেরিয়া প্রভৃতি দেশের উপকূলে হেরিং মাছ শিকার করা একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য শিল্প।
- সামুদ্রিক মাছ শিকারের প্রধান অঞ্চলগুলো উত্তর উঞ্চ বলয়ে। এর অধিকাংশ অঞ্চল ৪০° ডিগ্রি উত্তর দ্রাঘিমায় অবস্থিত। এসব অঞ্চলের কোথাও সমুদ্রের গভীরতা সাধারণত ২০০ ফেদমের নিচে নয়। এছাড়া উপকূলীয় সমুদ্রে মাছ শিকার করাও একটি উল্লেখযোগ্য শিল্প।
- ভারত, শ্রীলংকা, মায়ানমার, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে যদিও উপকূলীয় সমুদ্রে মাছ শিকারের প্রচেষ্টা একেবারে কম নয়। তবু স্বাদু পানির নদ-নদী থেকে মাছ শিকারই সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ।
মাছের চাষের উপকারিতা, মাছের পুষ্টিগুণ
- খাদ্য হিসেবে: দেহের পুষ্টির জন্য আমিষ একটি অন্যতম উপাদান। আমিষ জাতীয় খাদ্য সুস্থ ও সবলভাবে বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমরা সাধারণত উদ্ভিদ ও প্রাণী থেকে আমিষ পেয়ে থাকি। প্রাণিজ আমিষ আমাদের দেহের জন্য গুরুত্বপুর্ণ। মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম প্রাণিজ আমিষের উৎস। এর মধ্যে প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ প্রাণিজ আমিষ আসে মাছ থেকে।
- মাছের তেলে, খনিজ পদার্থ ও ভিটামিন ছাড়া আরো পুষ্টি উপাদান আছে। সেজন্য পুষ্টিহীনতা রোধে মাছ গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখে।
- মাছের আমিষ অত্যন্ত উন্নতমানের। তাছাড়া মাছ সহজে হজম হয় এবং মাছে চর্বির অংশ কম ৷ মাছ ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ সমৃদ্ধ। সুতরাং খাদ্য হিসেবে মাছ এ সকল অত্যাবশ্যক ভিটামিনের অভাব পূরণ করে।
- প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ শিশু ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে রাতকানা রোগের শিকার হয়। মলা, ঢেলাসহ বিভিন্ন ছোট মাছে প্রচুর ভিটামিন ‘এ’ রয়েছে। ভিটামিন ‘ডি’-এর অভাবে রিকেট নামক রোগ হয়।
- মাছের তেলে প্রচুর ভিটামিন ডি, ক্যাল্সিয়াম ও ফসফরাস আছে, যা শরীরের হাড় ও দাঁত গঠনে সাহায্য করে। ছোট মাছ কাঁটাসহ খেলে ক্যাল্সিয়াম ও ফসফরাস পাওয়া যায়। সামুদ্রিক মাছে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন আছে।
মাছ চাষের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
- অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে: জাতীয় অর্থনীতিতে পুষ্টি জোগাতে কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মাছের ভূমিকা গুরুত্বপুর্ণ। আমাদের দেশের এক বিরাট জনশক্তি পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে মাছ চাষ, মাছ ধরা, মাছ বাজারজাতকরণ ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত আছে।
- প্রায় ১০-১২ লক্ষ লোক বঙ্গোপসাগরসহ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে সারা বছর মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত। এছাড়াও মওসুমে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ লোক খণ্ডকালীনভাবে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়।
- মাছ ও মাছজাত পণ্য রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা হয়। রফতানি পণ্যের মধ্যে মাছের স্থান দ্বিতীয় ৷
- মুক্ত জলাশয়ে প্রাকৃতিকভাবে মাছ উৎপাদিত হয়। কিন্তু বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ করতে হয়। বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষের মাধ্যমে বেকার সমস্যার সমাধান করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
মৎস্য সম্পদ কমে যাওয়া কারণ
দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য দূরীকরণ, প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণ, বেকার ও কর্মহীন মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস মৎস্য সম্পদ। এ সম্পদের মধ্যে রয়েছে-
- আভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় অর্থাৎ নদ-নদী, হাওড়, বিল, হরদ ও প্লাবন ভূমি। যার পরিমাণ প্রায় ৪০ লক্ষ হেক্টর।
- দেশে বন্ধ জলাশয়ের মধ্যে রয়েছে দীঘি, পুকুর, বাওড় ও উপকূলীয় চিংড়ি চাষ এলাকা। এর আয়তন প্রায় আড়াই লক্ষ হেক্টর।
- এছাড়াও রয়েছে দেশের দক্ষিণাংশে বিস্তীর্ণ সমুদ্র এলাকা। দেশে বর্তমানে প্রচুর মাছ উৎপাদিত হচ্ছে।
কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তা তাল রাখতে পারছে না। কারণ, বদ্ধ জলাশয় এবং সামুদ্রিক উৎস থেকে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও দেশের মাছের প্রধান উৎস আভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন কমে গেছে।
মৎস্য সম্পদ কমে যাওয়ার দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমটি প্রাকৃতিক এবং অন্যটি মানব সৃষ্ট।
প্রাকৃতিক কারণ:
- নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো প্রতিনিয়ত পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এটা প্রাকৃতিকভাবে মৎস্য সম্পদ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
- নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তিত হচ্ছে। খাল-বিল ও আশপাশের মাটি ধুয়ে এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে এসব নদী মাছের বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে।
- নদীর স্রোতের সাথে মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন নির্ভর করে। নদীতে পানি কমে যাওয়ার দরুণ মাছের অভিযোজন ও প্রজনন ক্ষেত্রনষ্ট হচ্ছে। মাছের চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।
- বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক কমে যাচ্ছে। বৃষ্টিপাত প্রাকৃতিকভাবে মাছের পোনা উৎপাদনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে খরার দরুন বেশির ভাগ খাল-বিল শুকিয়ে পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে।
- নদীতে নতুন নতুন চর সৃষ্টি হচ্ছে। এতে পরিবেশের অবনতি হচ্ছে। এসব জলাশয়ের পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে মাছের ডিম, পোনা উৎপাদন তথা বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। প্রত্যেক জীবই তার নিজস্ব পরিবেশ ছাড়া ভালোভাবে বাঁচতে পারে না। তেমনি মাছের স্বাভাবিক জীবনের জন্য প্রয়োজন তার নিজস্ব পরিবেশ। প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাওয়ার দরুন অনেক মূল্যবান মাছের প্রজাতি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
মানব সৃষ্ট কারণ:
দেশের মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ার পেছনে মানব সৃষ্ট কারণ প্রকৃতির চেয়ে কম দায়ী নয়। নিচে মানব সৃষ্ট কারণসমূহের কিছু উল্লেখ করা হলো:
- অতি আহরণ: জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে অনেক বেশি হারে মাছ ধরা হচ্ছে। ফলে ঐসব জলাশয়ে ক্রমান্বয়ে মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।
- পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন: মৎস্যজীবীরা জীবিকা অর্জনের তাগিদে মাছের বাচ্চা এবং ডিমওয়ালা মাছ ধরে মাছের ভবিষ্যৎ বংশবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
- নদীতে বাঁধ নির্মাণ: সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নদীতে বাঁধ নির্মাণ করায় মাছের চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়।
- অবকাঠামো নির্মাণ: বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের জন্য নদীতে বা বড় বড় জলাশয়ে অবকাঠামো নির্মাণের ফলে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ও পরিবেশ নষ্ট হয়।
- কৃষির উন্নতি: কৃষির উন্নতির উদ্দেশ্যে অধিক খাদ্য ফলানোর জন্য খাল-বিল শুকিয়ে কৃষিভূমি তৈরি করা হয়েছে। ফলে জলাশয়ের পরিমাণ কমে গেছে।
- কীটনাশকের প্রতিক্রিয়া: উচ্চ ফলনশীল শস্য ফলানোর জন্য কৃষি জমিতে নানারকম ওষুধ ছড়ানো হয়। এর বিষক্রিয়ায় মাছের বৃদ্ধি ও প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া এতে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্যও কমে যায়।
- শিল্পায়ন: শিল্পক্ষেত্রের দ্রুত উন্নতির ফলে নানা রকম কলকারখানা গড়ে উঠেছে। কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ নদ-নদীর পানির সাথে মিশে যায়। এর বিষক্রিয়া মাছের মাছের মৃত্যুর কারণ এবং মাছের নানা রকম রোগ সৃষ্টি করে।
মাছ চাষের প্রয়োজনীয়তা, মাছ চাষের উদ্দেশ্য
- আমাদের দেশে রয়েছে অসংখ্য দীঘি ও পুকুর। মাছ চাষে উন্নত অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের দেশের পুকুরে মাছের গড় উৎপাদন বেশ কম। অথচ মাছ চাষের জন্য আমাদের দেশের জলবায়ু বেশ উপযোগী।
- মাছ চাষ করলে বেকার লোকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণের আমিষের ঘাটতি খুব সহজেই পূরণ করা যাবে।
- এদেশে বহু হাজা-মজা পুকুর ও ডোবা রয়েছে। এগুলো পরিবেশ দূষিত করছে এবং মশার আবাসস্থল হিসেবে কাজ করছে। এর ফলে চারদিকে নানাবিধ রোগ ছড়াচ্ছে। এসব পুকুর, দীঘি, ডোবা পরিষ্কার করে মাছ চাষ করা যায়। পরিবেশ দূষণ ও মশা উৎপাদনের উৎস এবং রোগব্যাধির বাহক এই জলাশয়ই আমিষ, অর্থসংস্থান ও বেকারত্ব দূরীকরণে সাহায্য করতে পারে।
- বর্তমানে নতুন প্রযুক্তির দ্বারা অল্প সময়ে অল্প পুঁজিতে মাছ চাষ করা যায়।
চাষ উপযোগী মাছের বৈশিষ্ট্যসমূহ
আমাদের দেশের স্বাদু পানিতে ২৬০টিরও বেশি মাছের প্রজাতি আছে। আবার সব মাছ পুকুরে চাষের উপযোগী নয়। বর্তমানে বিভিন্ন গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে পকুরে বিভিন্ন জাতের মাছের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। দেশি প্রজাতি ছাড়াও ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ আনা হয়েছে। উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে কৃত্রিম উপায়ে এগুলোর পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে। দেশি প্রজাতির সাথে বিদেশি প্রজাতির মাছও একত্রে চাষ করা হচ্ছে।
চাষযোগ্য দেশি ও বিদেশি প্রজাতির মাছের বৈশিষ্ট্য হলো-
- এসব মাছ পুকুরে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে।
- এরা খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে না।
- এসব মাছ পানির বিভিন্ন স্তর থেকে খাবার গ্রহণ করে। তাই পুকুরের পরিবেশ ভালো থাকে।
- এসব মাছ খেতে খুব সুস্বাদু।
- বাজারে এ মাছের প্রচুর চাহিদা আছে। খুব কম সময়ে বাজারজাত করা যায়।
- এর রাক্ষুসে স্বভাবের নয়।
- প্রাকৃতিকভাবেও এ মাছের পোনা পাওয়া যায়।
- কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এ মাছের পোনা উৎপাদন করা যায়।
- এ মাছ সহজে রোগাক্রান্ত হয় না।
- পুকুরে প্রাকৃতিক খাবার ছাড়াও এরা বাড়তি খাবার খেতে অভ্যস্ত।