Skip to content

 

মানবকঙ্কালের সাধারণ পরিচিতি, দৃঢ়তা প্রদান এবং চলনে কঙ্কালের ভূমিকা, অস্থি, তরুণাস্থি ও অস্থিসন্ধি কি, কেন এবং কিভাবে কাজ করে?

মানবকঙ্কালের সাধারণ পরিচিতি, দৃঢ়তা প্রদান এবং চলনে কঙ্কালের ভূমিকা, অস্থি, তরুণাস্থি ও অস্থিসন্ধি কি, কেন এবং কিভাবে কাজ করে?

দৃঢ়তা প্রদান, চলন ও কঙ্কালতন্ত্রঃ

প্রতিকূল পরিবেশে খাদ্য অনুসন্ধান, আত্মরক্ষা, বংশবিস্তার— এই ধরনের শারীরবৃত্তীয় প্রয়োজনে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়। যে পদ্ধতিতে প্রাণী নিজ চেষ্টায় সাময়িকভাবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায়, তাকে ঐ প্রাণীর চলন বলে। যে তন্ম দেহের কাঠামো গঠন করে, নির্দিষ্ট আকৃতি দেয়, বিভিন্ন অঙ্গকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে এবং চলনে সাহায্য করে, তাকে কঙ্কালতন্ত্র বলে।

মানবকঙ্কালের সাধারণ পরিচিতিঃ

একটি ঘর তৈরি করতে হলে প্রথম এর কাঠামো বানাতে হয়। আমাদের দেহের কাঠামো হলো কঙ্কাল (Skeleton)। লম্বা, ছোট, চ্যাপ্টা এবং অসমান মোট 206 টি অস্থি দিয়ে পূর্ণবয়স্ক মানুষের কঙ্কাল গঠিত হয়। শিশুর কঙ্কালে অস্থির সংখ্যা আরও বেশি থাকে। এটি মানবদেহকে নির্দিষ্ট আকার দেয়। হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, পাকস্থলী, অভ্র, মস্তিষ্ক— এরকম দেহের কোমল অংশগুলোকে অস্থি দিয়ে তৈরি আবরণ সুরক্ষিত রাখে।

অস্থি দিয়ে তৈরি শক্ত কাঠামো ছাড়া দেহের স্থিতিশীল আকার সম্ভব নয়। মানবদেহের সব অস্থি এবং এদের সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য অংশ মিলে কঙ্কাল তৈরি হয়। অস্থি এবং তরুণাস্থি দুটোই কঙ্কালের অংশ। অস্থিসন্ধি অস্থিতন্ত্রের অংশগুলোকে সংযুক্ত করে এবং অস্থির চলনে সাহায্য করে। অস্থিগুলো ঐচ্ছিক মাংসপেশি দিয়ে পরস্পর সংলগ্ন থাকায় ইচ্ছামতো অঙ্গ সঞ্চালন এবং চলাফেরা করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ অস্থি এবং তরুণাস্থি, পেশি, পেশিবন্ধনী এবং অস্থিবন্ধনী নিয়ে কঙ্কালতন্ত্র গঠিত।

দেখুন- মানুষের/মানব কঙ্কাল চিত্র প্রথমেই দেওয়া হয়েছে।

মানবদেহের কঙ্কালতন্ত্রকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়, বহিঃকঙ্কাল এবং অন্তঃকঙ্কাল।

বহিঃকঙ্কাল (Exoskeleton): কঙ্কালের এ অংশগুলো বাইরে অবস্থান করে। নখ, চুল, কিংবা লোম এর অন্তর্ভুক্ত।

অন্তঃকঙ্কাল (Endoskeleton): কঙ্কাল বলতে আমরা আসলে শরীরের ভিতরকার অন্তঃকঙ্কালই বুঝি। কঙ্কালের এ অংশগুলো আমরা বাইরে থেকে দেখতে পাই না। অস্থি এবং তরুণাস্থি দিয়ে এই কঙ্কালতন্ত্র গঠিত।

দৃঢ়তা প্রদান এবং চলনে কঙ্কালের ভূমিকাঃ

কঙ্কালের সাহায্যে নিম্নলিখিত কাজ সম্পন্ন হয়:

(a) দেহকাঠামো গঠন: কঙ্কাল মানবদেহকে একটি নির্দিষ্ট আকার ও কাঠামো দান করে। এটি নিচের অঙ্গগুলোর সাথে উপরের অঙ্গগুলোর সংযুক্তি সাধন করে।

(b) রক্ষণাবেক্ষণ ও ভারবহন: মস্তিষ্ক করোটির মধ্যে, মেরুরজ্জু মেরুদণ্ডের ভিতরে এবং হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস বক্ষগহ্বরে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকে। পেশিগুলো কঙ্কালের সাথে আটকে থাকে এবং দেহের ভারবহনে সাহায্য করে।

(c) নড়াচড়া ও চলাচল: হাত, পা, স্কন্ধচক্র ও শ্রোণিচক্র নড়াচড়ায় সাহায্য করে। এ কাজে পেশিতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অস্থির সাথে পেশি আটকানোর ফলে অস্থি নাড়ানো সম্ভব হয় এবং আমরা চলাচল করতে পারি।

(d) লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদন: অস্থিমজ্জা থেকে লোহিত রক্তকণিকা উৎপন্ন হয়।

(e) খনিজ লবণ সঞ্চয়: ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদি খনিজ লবণ অস্থি সঞ্চয় করে রাখে। এতে অস্থি শক্ত এবং মজবুত থাকে।

অস্থি, তরুণাস্থি এবং অস্থিসন্ধিঃ (Bone, Cartilage এবং Joint)

অস্থি (Bone):

  • অস্থি যোজক কলার রূপান্তরিত রূপ। এটি দেহের সবচেয়ে দৃঢ় কলা। অস্থির মাতৃকা বা আন্তঃকোষীয় পদার্থ এক ধরনের জৈব পদার্থ দিয়ে গঠিত। মাতৃকার মধ্যে অস্থিকোষগুলো ছড়ানো থাকে। একদিকে অস্থির পুরাতন অংশ ক্ষয় হতে থাকে এবং অন্যদিকে অস্থির মধ্যে নতুন অংশ গঠন হতে থাকে। এই ভারসাম্য নষ্ট হলে অস্থির বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়। বয়স বাড়লে অবশ্য এমনিতেই ভারসাম্যটি হাড় ক্ষয়ের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে।
  • অস্থি মূলত ফসফরাস, সোডিয়াম, পটাশিয়াম এবং ক্যালসিয়ামের বিভিন্ন যৌগ দিয়ে তৈরি। এছাড়া অস্থিতে প্রায় 40-50 ভাগ পানি থাকে। জীবিত অস্থিকোষে 40% জৈব এবং 60% অজৈব যৌগ পদার্থ নিয়ে গঠিত।
  • অস্থি বৃদ্ধির জন্য ভিটামিন ‘ডি’ এবং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার প্রয়োজন। এসব খাবারের অভাবে অস্থির স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সূর্যের আলো ত্বকে অবস্থিত কোলেস্টেরলের এমন রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায়, যা যকৃৎ এবং বৃদ্ধে আরও কিছু ধারাবাহিক পরিবর্তনের পর ভিটামিন ডি সংশ্লেষণ করে। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ সূর্যালোকের সংস্পর্শে আসা উচিত। যারা সবসময় ঘরে বসে থাকেন বা সারা শরীর আবৃতকারী পোশাক পরেন, তাদের ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

তরুণাস্থি (Cartilage):

  • তরুণাস্থি অস্থির মতো শক্ত নয়। এগুলো অপেক্ষাকৃত নরম এবং স্থিতিস্থাপক। এটি যোজক কলার ভিন্নরূপ। এর কোষগুলো একক বা জোড়ায় জোড়ায় খুব ঘনভাবে স্থিতিস্থাপক মাতৃকাতে বিস্তৃত থাকে। তরুণাস্থি কোষগুলো থেকে কন্ড্রিন নামক এক ধরনের শন্তু, ঈষদচ্ছ রাসায়নিক বস্তু বের হয়।
  • মাতৃকা কন্ড্রিন দিয়ে গঠিত, এর বর্ণ হালকা নীল। জীবিত অবস্থায় তরুণাস্থি কোষের প্রোটোপ্লাজম খুব স্বচ্ছ এবং নিউক্লিয়াসটি গোলাকার থাকে। কম্ব্রিনের মাঝে পহ্বর দেখা যায়। এগুলোকে ক্যাপসুল বা ল্যাকিউনি বলে। এর ভিতর কন্ড্রিওব্লাস্ট বা কন্ট্রিওসাইট থাকে।
  • সব তরুণাস্থি একটি তন্তুময় যোজক কলা নির্মিত আবরণী দিয়ে পরিবেষ্টিত থাকে, একে পেরিকন্ড্রিয়াম বলে। এই আবরণটি দেখতে চকচকে সাদা, তাই আমরা সাধারণত ভরুণাস্থিকে সাদা, নীলাভ এবং চকচকে দেখতে পাই। আমাদের দেহে কয়েক রকম ভরুদাল্লি আছে (যেমন কানের পিনার তরুণাস্থি)। তরুণাস্থি বিভিন্ন অস্থির সংযোগম্বলে, কিংবা অস্থির কিছু অংশে উপস্থিত থাকে।

অস্থিসন্ধি (Bonejoint ৰা Joint):

  • দুই বা ততোধিক অস্থির সংযোগস্থলকে অস্থিসন্ধি বলে। প্রতিটি অস্থিসন্ধির অস্থিগুলো একরকম স্থিতিস্থাপক রজ্জুর মতো বন্ধনী দিয়ে দৃঢ়ভাবে আটকানো থাকে, ফলে অস্থিগুলো সহজে সন্ধিস্থল থেকে বিচ্যুত হতে পারে না। সন্ধিস্থল বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালনে সাহায্য করে।
  • আমাদের শরীরে সব অস্থিসন্ধি এক রকম নয়। এদের কোনোটি একেবারে অনড়, যেমন আন্তঃকশেরুকীয় অস্থিসন্থি, কোনোটি আবার সহজে সঞ্চালন করা যায়, যেমন হাত এবং পায়ের অস্থিসন্ধি।
  • সাইনোভিয়াল অস্থিসন্ধি (Synovial Joint): একটি অস্থিসন্ধিতে দুটি মাত্র অস্থির বহির্ভাগে এসে মিলিত হয়ে একটি সরল সাইনোভিয়াল অস্থিসন্ধি গঠন করে। আর যখন দুয়ের অধিক অস্থি মিলিত হয়, তখন একে জটিল সাইনোভিয়াল অস্থিসন্ধি বলে।
  • সাইনোভিয়াল অস্থিসন্ধির অংশগুলো হলো: তরুণাস্থিতে আবৃত অস্থিপ্রান্ত, সাইনোভিয়াল রস (Synovial fluld) এবং অস্থিসন্ধিকে দৃঢ়ভাবে আটকে রাখার জন্য অস্থিবন্ধনী বা লিগামেন্ট বেষ্টিত একটি মজবুত আবরণী বা ক্যাপসুল। অস্থিসন্ধিতে সাইনোভিয়াল রস এবং তরুণাস্থি থাকাতে অস্থিতে অস্থিতে ধর্ষণ এবং তজ্জনিত ক্ষয় হ্রাস পায় ও অস্থিসন্ধি নড়াচড়া করাতে কম শক্তি ব্যয় হয়।
চিত্রঃ সাইনোভিয়াল সন্ধি

চিত্রঃ সাইনোভিয়াল সন্ধি

অস্থিসন্ধি কয়েক ধরনের। যেমন:

(a) নিশ্চল অস্থিসন্দি (Fixed Jolnt): নিশ্চল অস্থিসন্ধিগুলো অনড়, অর্থাৎ এগুলো নাড়ানো যায় না, যেমন করোটিকা অস্থিসন্ধি

(b) ঈষৎ সচল অস্থিসন্ধি (slightly movable Jolnt): এসব অস্থিসন্ধি একে অন্যের সাথে সংযুক্ত থাকলেও সামান্য নাড়াচাড়া করতে পারে, ফলে আমরা দেহকে সামনে, পিছনে এবং পাশে বাঁকাতে পারি। যেমন মেরুদণ্ডের অস্থিসন্দি।

(c) পূর্ণ সচল অস (Freely movable Joint): এ সকল অস্থিসন্ধি সহজে নড়াচড়া করানো যায়। এ জাতীয় অস্থিসন্ধির মধ্যে বল ও কোটরসন্ধি, কবজাসস্থি প্রধান। সাইনোভিয়াল অস্থিসন্ধিই কেবল পূর্ণ সচল হতে পারে।

(i) বল ও কোটরসন্ধি (Ball & Socket Joint): বল ও কোটরসন্ধিতে সন্ধিস্থলে একটি অস্থির মাথার মতো গোল অংশ অন্য অস্থির কোটরে এমনভাবে স্থগিত থাকে যেন অস্থিটি বাঁকানো, পাশে চালনা করা কিংবা সকল দিকে নাড়ানো সম্ভবপর হয়। এটি এক ধরনের সাইনোভিয়াল অস্থিসন্ধি। উদাহরণ: কাঁধ এবং ঊরুসন্ধি।

চিত্রঃ বল ও কোটর এবং কবজা অস্থিসন্ধি

চিত্রঃ বল ও কোটর এবং কবজা অস্থিসন্ধি

(ii) কব্জা সন্ধি (Hinge Joint): কব্জা যেমন দরজার পাল্লাকে কাঠামোর সাথে আটকে রাখে, সেরূপ কব্জার মতো সন্ধিকে কব্জা সন্ধি বলে। যেমন: হাতের কনুই, জানু এবং আঙুলগুলিতে এ ধরনের সন্ধি দেখা যায়। এসব সন্ধি কেবল এক দিকে নাড়ানো যায়। এগুলোও সাইনোভিয়াল অস্থিসন্ধির উদাহরণ।

Copyright Notice

কপি করা নিষিদ্ধ!