মাযহাব ও তাকলীদ কি ও কেন? মাযহাবের উৎপত্তির কারণ কি?
প্রত্যেক মুসলমানের উপর মূলতঃ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর আনুগত্য ও অনুসরণ করা ফরয। কুরআন এবং হাদীসের অনুসরণের মাধ্যমেই এ ফরয আদায় হবে।
কিন্তু সরাসরি যারা কুরআন হাদীসের ভাষা-আরবী বোঝেন না, কিংবা আরবী ভাষা বুঝলেও কুরআন হাদীস যথাযথ ভাবে অনুধাবন ও তা থেকে মাসআলা-মাসায়েল চয়ন ও ইজতেহাদ করার জন্য আরবী ব্যাকরণ, আরবী অলংকার, আরবী সাহিত্য, উসূলে ফেকাহ, উসূলে হাদীস, উসূলে তাফসীর ইত্যাদি যে সব আনুষঙ্গিক শাস্ত্রগুলো বোঝা প্রয়োজন নিয়মতান্ত্রিক ভাবে সেগুলো পাঠ করেননি বা পাঠ করলেও গভীরভাবে এসব বিদ্যায় পারদর্শী হতে পারেননি, তাদের পক্ষে সরাসরি সব মাসআলা- মাসায়েল কুরআন হাদীস থেকে চয়ন ও ইজতিহাদ (গবেষণা) করে বের করা যেমন সম্ভব নয় তেমনি তা নিরাপদও নয় বরং গভীর বুৎপত্তি ও দক্ষতার অভাবে অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও গোমরাহীর শিকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাইস্বাভাবিক।
তাই এসব শ্রেণীর লোকদের জন্য বিস্তারিত মাসআলা-মাসায়েল ও বিধি-বিধানের জন্য এমন কোন বিজ্ঞ আলেমের শরণাপন্ন হওয়া ব্যতীত গত্যন্তর নেই, যিনি উপরোক্ত বিদ্যাসমূহে পারদর্শী ও দক্ষ হওয়ার ফলে সরাসরি সব মাসআলা-মাসায়েল ও বিধি-বিধান কুরআন হাদীস থেকে চয়ন ও ইজতিহাদ করে বের করতে সক্ষম।
এরূপ বিজ্ঞ ও ইজতিহাদের ক্ষমতা সম্পন্ন আলেম তথা মুজতাহিদ ইমামের শরণাপন্ন হওয়া এবং তিনি কুরআন-হাদীস থেকে চয়ন ও ইজতিহাদ করে সব মাসআলা-মাসায়েল ও বিধি-বিধান যেভাবে বলেন তার অনুসরণ করাকেই বলা হয় উক্ত ইমামের তাকলীদ করা বা উক্ত ইমামের মাযহাব অনুসরণ করা।
তাকলীদ করা তাই উপরোক্ত শ্রেণী সমূহের লোকদের জন্য ওয়াজিব এবং যে ইমামেরই হোক এরূপ যে কোন এক জনেরই তাকলীদ করা ওয়াজিব। উম্মতের ইজ্মা (ঐক্যমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, এক সাথে একাধিক ইমামের অনুসরণ করা যাবেনা, অর্থাৎ, এক এক মাসআলায় এক এক জনের অনুসরণ করা যাবেনা।
বরং যে কোন একজন ইমামেরই পুরোপুরি অনুসরণ করতে হবে।
এক এক মাসআলায় এক এক জনের অনুসরণ করার অবকাশ নেই এবং সেরূপ করা জায়েযও নয়, কারণ তাতে সুবিধাবাদ ও খাহেশাতের অনুসরণ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায় এবং তার ফলে গোমরাহী-র পথ উন্মুক্ত হয়।
ইতিহাসে অনুরূপ মুজতাহিদ ইমাম অনেকেই অতিবাহিত হয়েছেন। তবে তম্মধ্যে বিশেষভাবে চারজন ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছেন এবং তাদের চয়ন ও ইজতিহাদকৃত মাসআলা-মাসায়েল তথা তাঁদের মাযহাব ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়ে আসছে।
তাই আমরা চার ইমাম ও চার মাযহাব-এর কথা শুনে থাকি।
উক্ত চার জন ইমাম হলোেন:
- হযরত ইমাম আবূ হানিফা (রহঃ)
- হযরত ইমাম শাফিঈ (রহঃ)
- হযরত ইমাম মালেক (রহঃ)
- হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ)
তাদের মাযহাবকেই যথাক্রমে হানাফী মাযহাব, শাফিঈ মাযহাব, মালেকী মাযহাব ও হাম্বলী মাযহাব বলা হয়ে থাকে।
উপরোক্ত সব মাযহাবই হক, তবে অনুসরণ যে কোন একটারই করতে হবে, যেমন পূর্বে বলা হয়েছে। উপমহাদেশের মুসলমানসহ পৃথিবীর অধিক সংখ্যক মুসলমান হযরত ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর তথা হানাফী মাযহাব-এর অনুসারী।
অনেকের মনে সন্দেহ জাগে যে, এক আল্লাহ, এক নবী এক কুরআন, তাহলোে এত মাযহাব কেন!
আসলে ‘মায্হাব’ অর্থ কি তা তারা ভালভাবে খেয়াল করেননা। এখানে মাযহাব অর্থ ধর্ম নয় যে, একাধিক মাযহাব থাকলে ধর্ম একাধিক হয়ে গেল।
বরং পূর্বেই বলা হয়েছেঃ বিজ্ঞ ও ইজতিহাদের ক্ষমতা সম্পন্ন আলেম তথা মুজতাহিদ ইমামের ব্যাখ্যাকেই এখানে মাযহাব বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
অতএব বিজ্ঞ ও ইজতিহাদের ক্ষমতা সম্পন্ন আলেম একাধিক থাকার ক্ষেত্রে কোন বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যাও একাধিক হতে পারে। এভাবে মাযহাব একাধিক হয়ে গিয়েছে।
আরও মনে রাখতে হবে অনুসরণীয় সব ইমামই কুরআন-হাদীসের আলোকে সব ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাদের কারও ব্যাখ্যাই কুরআন-হাদীসের বাইরে নয়। কোন বিষয়ে ইমামদের মধ্যে মতবিরোধ থাকলে সকলের মতের স্বপক্ষেই কুরআন/হাদীস রয়েছে।
অর্থাৎ, কুরআন-হাদীসে সে বিষয়ে একাধিক সূরতের আবকাশ রয়েছে। তাই সব মাযহাবই হক, তবে অনুসরণ যে কোন একটারই করতে হবে, যেমন পূর্বে বলা হয়েছে।
পোষ্টটি লিখতে নিম্নক্তো বই/লেখকের লিখনী থেকে সাহায্য নেওয়া হয়েছে: আহকামে জিন্দেগী (মাকতাবাতুল আবরার প্রকাশনী) মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীন শায়খুল হাদীস, জামেয়া ইসলামিয়া আরার্বিয়া, তাঁতী বাজার, ঢাকা-১১০০ মুহাদ্দিছ, জামিয়া ইসলমিয়া দারুল উূলুম মাদানিয়া, ৩১২, দক্ষীণ যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২৩৬