বিষয়: জমি বিক্রি, বর্গা দেয়া, বন্ধক রাখা, গরু, ছাগল, হাস, মুরগি রাখালী দেয়া সম্পর্কে মাসায়েল।
হ্যাশট্যাগ: #জমি বিক্রি, বর্গা দেয়া, বন্ধক রাখা, গরু, ছাগল, হাস, মুরগি রাখালী দেয়া সম্পর্কে মাসায়েল।।
হক্কে শোফআর মাসায়েল
* কোন জমিতে শরীক বা তার পাশ-আলিয়া প্রতিবেশীকে বলা হয় “শফী”। যেমন হামেদ যায়েদ-এর সাথে একই জমিতে শরীক বা তার পাশ আলিয়া প্রতিবেশী। তাহলে হামেদ হল যায়েদের ‘শফী’। এমতাবস্থায় যায়েদ যদি ঐ জমি বিক্রি করতে চায় তাহলে হামেদ তা ক্রয় করতে চাইলে অন্য কেউ তা নিতে পারবে না। এই যে হামেদের দাবী, এই দাবীকে বলা হয় ‘হক্কে শোফআ’ (Pre-emption) বা অগ্রক্রয়াধিকার।
* শফী যদি ‘হক্কে শোফআর’ দাবী চায় তাহলে তাকে এতটুকু করতে হবে যে, বিক্রয় সংবাদ শোনা মাত্রই অবিলম্বে মুখ দিয়ে তাকে বলতে হবে যে, “আমি ঐ জমি ক্রয় করব।” যদি কিছু মাত্র দেরী করে বলে তাহলে তার দাবী অগ্রাহ্য হবে অর্থাৎ, ‘হক্কে শোফআর’ দাবী করা তার জন্য জায়েয হবে না। এমনকি কোন একটা চিঠির শুরুতে যদি জমি বিক্রয়ের কথা থাকে এবং সে চিঠিখানা শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বলে যে, ‘আমি ঐ জমি ক্রয় করব বা নিব, তবুও তার দাবী অগ্রাহ্য হবে।
* শফী যদি বলে যে, আমাকে এত টাকা দাও আমি আমার ‘হক্কে শোফআর’ দাবী ছেড়ে দেই, তাহলে হক্কে শোফার দাবীতো সে আর করতে পারবেই না, অধিকন্তু টাকাও পাবে না; এভাবে টাকা নিলে তা রেশওয়াত (ঘুষ) বলে গণ্য হবে।
* আদালতের রায় হওয়ার পূর্বেই শফী মারা গেলে শফীর ওয়ারেছরা ‘হক্কে শোফআর’ দাবী করতে পারবে না; কিন্তু ক্রেতা মারা গেলে শফীর হক্ বাতিল হয় না।
* শফী প্রথমে শুনল যে, জমি এত টাকায় (উদাহরণ স্বরূপ এক হাজার টাকায়) বিক্রি হয়েছে, এই শুনে সে চুপ করে থাকল, পরে শুনল যে, কমে বিক্রি হয়েছে (উদাহরণ স্বরূপ পাচঁশত টাকায় বিক্রি হয়েছে), তাহলে তার ‘হক্কে শোফআ’ বাতিল হয়নি।
* শফী প্রথমে শুনল যে, অমুকে জমিটি ক্রয় করেছে, সে সময় দাবী করলনা, পরে জানতে পারল যে,
* শফী প্রথমে শুনল যে, অর্ধেক জমি বিক্রি হয়েছে তখন শোফআর দাবী করলনা, পরে জানতে পারল যে, সমস্ত জমি বিক্রি হয়েছে তাহলে সে শোফআর দাবী করতে পারবে।
(হক্কে শোফআ সম্পর্কিত যাবতীয় মাসায়েল ছাফাইয়ে মোআমালাত গ্রন্থ থেকে গৃহীত।)
জমি বর্গা দেয়ার মাসায়েল
* জমি বর্গা বা ভাগা দেওয়া জায়েয আছে, কিন্তু যখন কথা-বার্তা অর্থাৎ, ইজাব কবূল হয় তখনই নিম্নলিখিত শর্তগুলো পরিষ্কার হওয়া চাই।
১. কতদিন যাবৎ বর্গা করবে তা পরিষ্কার বলে দেওয়া চাই।
২. বীজ কে দিবে তা পরিষ্কার হওয়া চাই।
৩. কোন্ ফসল করবে তা পরিষ্কার বলে দেওয়া চাই।
৪. অংশ হিসেবে ভাগ করা চাই এবং সে অংশ প্রথমেই পরিষ্কার হয়ে যাওয়া চাই; যেমন অৰ্ধা-অর্ধি বা তিন ভাগের এক ভাগ এবং দুই ভাগ ইত্যাদি।
৫. জমি খালি করে বর্গাতির হাতে দেওয়া চাই।
৬. জমি এবং বীজ গৃহস্তের এবং গরু, লাঙ্গল ও মেহনত বর্গাতির বা শুধু জমীন গৃহস্তের অন্য সব বর্গাতির এরূপ ঠিক হওয়া চাই।
৭. জমি কৃষির যোগ্য হওয়া চাই।
৮. জমির মালিক এবং বর্গাদার উভয়ের বালেগ ও স্বজ্ঞানী হওয়া চাই।
* শরী ‘আত নির্ধারিত শর্তগুলো পালন না করে যদি কেউ জমি বর্গা দেয় তবে তা নাজায়েয হবে, এমতাবস্থায় সমস্ত ফসল বীজওয়ালা পাবে, অপর পক্ষ যদি জমিওয়ালা হয় তাহলে সে দেশাচার অনুসারে জমির ভাড়া পাবে এবং যদি বর্গাতি হয় তাহলে দেশাচার অনুসারে তার মেহনতের মজুরী পাবে; কিন্তু এই ভাড়া এবং মজুরী প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত অংশের মূল্য অপেক্ষা অধিক হতে পারবে না।
* জমি বর্গার কথা-বার্তা (অর্থাৎ, ইজাব-কবূল) ঠিক হয়ে যাওয়ার পর উভয় পক্ষের যে কেউ কোন একটি শর্ত অমান্য করতে চাইলে কাজী (বিচারক)-এর নিকট নালিশ করে তাঁর দ্বারা জোরপূর্বক মানানো হবে; কিন্তু কাজী বীজওয়ালাকে বাধ্য করতে পারবে না।
* জমি মালিক বা বর্গাতি-এর কেউ মারা গেলে জমি বর্গা ছুটে যায়।
* অনেকে আগে বলে না যে, পাট বুনাও, আমন বুনাও কি আউশ বুনাও, শেষে আপোষে ঝগড়া হয়; এ রকম করা চাই না, আগে সব কথা পরিষ্কার করে বলা চাই।
* অনেক জায়গায় ধান কে কাটবে, পাট কে উঠাবে বা খড়-পাটখড়ি কে নিবে তা নিয়ে বাদানুবাদ হয়; এ রকম হওয়া চাই না, আগেই কথা পরিষ্কার করে নেয়া চাই, যাতে পারে দুই কথা হতে না পারে বরং সাক্ষী করে লিখে রাখলে আরও ভাল হয়, যাতে সহজেই স্মরণ থাকতে পারে।
* অনেক জায়গায় ধান ধার্য করে জমি লাগানো হয়। যেমন বলে যে, চাই ধান কর, চাই পাট কর, ফসল হোক বা না হোক, চাই এ জমির উৎপন্ন দ্রব্য হতে দাও, চাই অন্য কোথা থেকে দাও, এই জমি খানায় বা বিঘা প্রতি পাঁচ মণ ধান আমাকে দিতে হবে, এরূপ জায়েয আছে।
* আজকাল গভর্নমেন্টের আইনের বলে অনেকে জমি বর্গা নিয়ে বা জমায় নিয়ে বার বৎসর উত্তীর্ণ হয়ে গেলে বা রেকর্ড হয়ে গেলে পরে আর মালিককে ফেরত দিতে চায় না। কিন্তু নিশ্চিত জেনে রেখ, মলিকের বিনা খুশীতে ঐ জমি রাখা কিছুতেই জায়েয নয়। যদি কেউ রাখে তবে একেতো তা রাখা হারাম, দ্বিতীয়তঃ ঐ জমি চাষাবাদ করা হারাম। তৃতীয়তঃ ঐ জমিতে যা কিছু ফসল হবে তা তার জন্য হারাম ও পলীদ (নাপাক) হবে।
(জমি বর্গা দেয়া সম্পর্কিত যাবতীয় মাসায়েল ছাফাইয়ে মোআমালাত গ্রন্থ থেকে গৃহীত।)
গরু, ছাগল, হাস, মুরগি রাখালী দেয়ার মাসায়েল
গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, ইত্যাদি জীবজন্তু রাখালী দেয়া এই শর্তে যে, এর যে বাচ্চা হবে তা আমরা আধা-আধি (বা চারআনা বা তিনআনা বা এরূপ কোন হারে) ভাগ করে নিব বা মুরগীর ডিম এভাবে ভাগ করে নিব, এরূপ রাখালী বা ভাড়া দেয়া জায়েয নয়। গ্রামাঞ্চলে এরূপ প্রচলিত থাকলেও তা জায়েয নয়। তবে নির্দিষ্ট সময় লালন-পালন করলে তার বিনিময়ে এত টাকা দেয়া হবে, বা এত পারিশ্রমিক দেয়া হবে- এরূপ চুক্তি করা জায়েয।
বন্ধকের মাসায়েল
যদি কারও নিকট থেকে টাকা-পয়সা কর্জ নিয়ে বিশ্বাসের জন্য তার নিকট কোন জিনিস রাখা হয় এই শর্তে যে, যখন কর্জ পরিশোধ করব তখন আমার জিনিস নিয়ে যাব- একে রেহেন বা বন্ধক বলে। এ সম্পর্কিত মাসলা সমূহ নিম্নরূপঃ
* কর্জ পূর্ণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত বন্ধকী জিনিস ফেরত নেয়ার বা দখল নেয়ার অধিকার থাকে না।
* কোন জিনিস বন্ধক রাখলে বন্ধক গ্রহীতা কোন রূপে তা ব্যবহার করলে নাজায়েয হবে। মালিক অনুমতি দিলেও বন্ধকী জিনিস দ্বারা কোন রূপেই লাভবান হওয়া জায়েয নয়। যেমন বাগান বন্ধক রেখে তার ফল খাওয়া, জমি বন্ধক রেখে তার ফসল খাওয়া, ঘর বন্ধক রেখে তাতে বসবাস করা,
অলংকার থালা-বাটি বন্ধক রেখে তা ব্যবহার করা ইত্যাদি।
* গরু, ছাগল, বকরী, ঘোড়া ইত্যাদি বন্ধক রাখলে তার খোরাক ইত্যাদির খরচ মালিককে দিতে হবে। গাভী, বকরীর দুধ ও বাছুর সবই মালিক পাবে। দুধ খেয়ে থাকলে ঋণ পরিশোধ হওয়ার সময় দুধের মূল্য ফেরত দিতে হবে; অবশ্য কিছু খরচ হয়ে থাকলে সে খরচের টাকা কেটে রাখতে পারবে।
* বন্ধকী স্বত্ব বিক্রি করা জায়েয নয়। বন্ধকী জিনিস খোয়া গেলে এবং ঋণের চেয়ে তার মূল্য কম হলে বাকীটুকু পাওনাদার (অথবা বন্ধকী জিনিসের মালিক) থেকে নিয়ে নিতে পারবে এবং বন্ধকী জিনিসের মূল্য পরিমাণ ঋণ পরিশোধ ধরা হবে। আর বন্ধকী জিনিসের মূল্য ঋণের চেয়ে বেশী হলে মালিক ঐ বেশী পরিমাণটুকু বন্ধক গ্রহীতার কাছে দাবী করতে পারবে না।
* তুমি কারও নিকট টাকা চাইলে, সে টাকা দিতে না পেরে কোন জিনিস দিল যা অন্য কারও নিকট বন্ধক রেখে তুমি টাকা আনলে, পরে ঐ জিনিসের মূল মালিক টাকা দিয়ে বন্ধক গ্রহীতার নিকট থেকে তার মাল ছাড়িয়ে নিল, এমতাবস্থায় মূল মালিককে তুমি টাকা দিতে বাধ্য।
* বন্ধকের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও মালিক অর্থ পরিশোধ করে বন্ধকী জিনিস ফেরত না নিলে তা বিক্রি করে নিজের অর্থ আদায় করার অধিকার এসে যায়। ইসলামী জজ (কাজী) থাকলে তার নিকট মামলা দায়ের করে বিক্রির অনুমোদন নিয়ে নিবে।
(বেহেশতী জেওর, ইসলামী ফিকাহঃ ৩য় এবং ছাফাইয়ে মোআমালাত থেকে গৃহীত।)