মিলাদুন্নবী কি জায়েজঃ
মিলাদুন্নবী জায়েজ নয়। আজকাল বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে মিলাদের নাম করে নানা পাপ কাজ, বিদআত ও শরিয়ত পরিপন্থি বিভিন্ন না জায়েয কাজ মহা ধুমধামে সম্পাদন করা হচ্ছে। অথচ মিলাদের এ উৎসব না রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন, না তাঁর সাহাবিরা, না তাবেয়ীরা না নির্ভরযোগ্য অন্য কেউ। এ বিষয়ে শরিয়তের কোনো দলীলও নেই।
১।
মিলাদ উদযাপনকারী বহু লোকই শিরকে পতিত হয়। কারণ এ অনুষ্ঠানে তারা বলে যে, হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিপদ হতে উদ্ধার করুন, সাহায্য করুন। হে আল্লাহর প্রিয় নবী সা.! আপনারই উপর ভরসা, হে আল্লাহর রাসূল সা.! আমাদের দুঃখ কষ্ট দূর করুন, যখনই আপনাকে দেখি তখনই দুঃখ দুর হয়ে যায়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি এ সব কথা শুনতেন, তাহলে অবশ্যই একে বড় শিরক বলে আখ্যায়িত করতেন। কারণ, বিপদ মুক্তি, ভরসা ও কষ্ট-মুসিবত দূর করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনেরই আছে। এ অধিকার অন্য কারো নেই।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
قُلْ إِنِّي لَا أَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَلَا رَشَدًا
অর্থাৎ, বল, নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য না কোনো অকল্যাণ করার ক্ষমতা রাখি এবং না কোনো কল্যাণ করার। ( সূরা জিন, ৭২ : আয়াত ২১)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
إذا سألتَ فاسأل الله واذا استعنتَ فاستعن باللهِ ( رواه الترمذي )
অর্থাৎ, যখন চাইবে আল্লাহর কাছেই চাইবে আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করবে। ( তিরমিযি)
২।
মিলাদের মধ্যে অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি করা হয়ে থাকে। যেমন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসার ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করে এমন সব কথা বলা হয় যা তিনি এই বলে নিষেধ করেছেন :
لا تُطْرُوْنِي كَمَا أطْرَتِ النَّصَارى اِبْنَ مرْيَمَ فَإنَّمَا أنَا عَبْدٌ فَقُوْلُوْا عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهُ (رواه البخاري)
অর্থাৎ, তোমরা আমার ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন কর না যেমন সীমালঙ্ঘন করেছে খৃষ্টানরা ঈসা ইবনে মারইয়াম সম্বন্ধে। আমি একজন বান্দা বৈ নই। সুতরাং তোমরা বল, আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। (বুখারি)
৩।
মিলাদে বলা হয়, আল্লাহ তাআলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজ নূর হতে সৃষ্টি করেছেন এবং বাকী সব জিনিস সৃষ্টি করেছেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর হতে।
এসব আকীদা পোষণকারীদেরকে পবিত্র কোরআন মিথ্যাবাদী বলেছে।
ইরশাদ হচ্ছে,
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ (الكهف 110).
অর্থাৎ, বল, আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। আমার নিকট ওহী প্রেরণ করা হয় যে, তোমাদের ইলাহই এক ইলাহ। আমিত তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার কাছে ওহী পাঠান হয় এই বলে যে, তোমাদের উপাস্য মাত্র একজন।( সূরা কাহাফ, ১৮ : আয়াত ১১০)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিতা-মাতার মাধ্যমে জন্ম গ্রহণ করেছেন, বিষয়টি সকলেরই জানা। সুতরাং তিনিও মানুষ, কিন্তু তাঁর বিশেষত্ব হল তাঁর কাছে ওহী পাঠান হয়েছে।
মিলাদে আরও বলা হয়ে থাকে যে আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কারণে দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন।
পবিত্র কোরআন তাদের দাবীকে মিথ্যা প্রমাণ করে বলছে,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
অর্থাৎ, আমি মানুষ ও জিনকে কেবল আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। (সূরা জারিয়াত : আয়াত ৫৬)
৪।
খ্রীষ্টানরা ঈসা আলাইহিস সালামেরর জন্মবার্ষিকী পালন করে এবং একই ধারায় নিজেদের ব্যক্তিগত জন্ম বার্ষিকীও পালন করে থাকে। তাদের থেকেই মুসলিমরা এ বিদআত গ্রহণ করেছে। ফলে, তারা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম বর্ষিকী পালন করার প্রচলন ঘটিয়েছে। এবং সে খ্রীষ্টানদের অনুকরণে কেউ কেউ নিজের জন্মবার্ষিকীও পালন করে ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে সাবধান করে বলেছেন :
(رواه أبو داود) مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ منْهُمْ
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হবে। (হাদিসটি সহিহ, বর্ণনায় আবু দাউদ)।
৫।
মিলাদের সময় নারী পুরুষদের একত্রে মিলিত হতে দেখা যায়, অথচ ইসলাম এরূপ সম্মেলনকে হারাম বলে ঘোষনা করেছে।
৬।
মিলাদের উৎসব আয়োজন উপলক্ষ্যে সাজ সরঞ্জামের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়। অথচ তা কোনো উপকার ছাড়াই নষ্ট হয়ে যায়। লাভ হয় শুধু অমুসলিমদের, যাদের কাছ থেকে উৎসবের রঙ্গিন কাগজ, মোমবাতি ও নানা সরঞ্জামাদি খরিদ করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অযথা টাকা পয়সা নষ্ট করতে নিষেধ করেছেন।
৭।
মানুষ এসব আনন্দ ফুর্তির মধ্যে অনেক সময় অহেতুক নষ্ট করে। এমনকি প্রায়ই তারা এ কারণে সময়মত সালাত আদায় করতে পারে না। বরং সালাত একেবারে বাদ দিয়ে দিয়েছে, এরূপ দৃশ্যও বহু দেখা গেছে।
৮।
মিলাদের শেষের দিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন ধারণা করে লোকেরা দাঁড়িয়ে যায়। শরিয়তের সুষ্পষ্ট দলিলের আলোকে এ ধারণা সর্বৈবভাবে মিথ্যা। বরং নবীজী জীবিত থাকা অবস্থায় কেউ তাঁকে দাড়িয়ে সম্মান করুক এমনটি পছন্দ করতেন না।
আনাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
مَا كَانَ شَخْصٌ أحَبَّ إلَيْهِمْ مِّنْ رَسُوْلٍ وَكَانُوا إذا رأوهُ (الصحابة) لَمْ يَقُومُوا لَهُ لِمَا يَعْلَمُوْنَ مِنْ كَرَاهِيَّتِهِ لِذلِكَ (رواه أحمد و الترمذي)
অর্থাৎ, সাহাবায়ে কিরামের নিকট নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে অধিক প্রিয় আর কেউ ছিলেন না। তারা তাঁকে দেখতে পেলে সম্মানার্থে দাড়াতেন না, কারণ তারা জানতেন এমনটি তিনি অপছন্দ করেন। ( আহমদ ও তিরমিযি)
৯।
তাদের কেউ কেউ বলে থাকে, মিলাদ মাহফিলে আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী আলোচনা করি। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা এমন সব কাজ করে যা তাঁর আদর্শের বিপরীত এবং জীবনীরও বিপরীত। তাছাড়া তাঁকে যারা ভালবাসে তারাতো তাঁর জীবনী প্রতিটি দিনই পাঠ করে থাকে, বছরে মাত্র একবার নয়। ভালবাসার দাবীদারদেরতো এ বিষয়টিও স্মরণে রাখা দরকার ছিল, যে রবিউল আউয়াল মাসে তাঁর জন্ম হয়, সে রবিউল আউয়াল মাসে তাঁর মৃত্যুও হয়। সুতরাং এ মাসে খুশি হওয়ার চেয়ে দুঃখিত হওয়াই কি অধিক বাঞ্ছনীয় নয়? এ ক্ষেত্রে ভালবাসার দাবী কি?
১০।
মিলাদ উদযাপনকারীদের দেখা যায়, এ অনুষ্ঠান করতে গিয়ে প্রায়ই অধিক রাত পর্যন্ত তাদের জাগ্রত থাকতে হয়। ফলে, ফজরের জামাত ছুটে যায় এমনকি কখনো কখনো সালাতই ছুটে যায়।
১১।
কেউ কেউ যুক্তি প্রদর্শন করে বলে যে, মিলাদ যদি নাজায়েযই হবে তাহলে এত অধিক লোক তা উদযাপন করে কিভাবে? জবাবে আমরা বলব, অধিকাংশ লোক মিলাদ উদযাপন করলেই যে তা শরিয়ত সিদ্ধ হয়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই। শরিয়তে জায়েয নাজায়েয নির্ধারিত হবে কোরআন বা সুন্নাহর দলিলের ভিত্তিতে, পালনকারী সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ (الانعام 116)
অর্থাৎ, যদি তুমি দুনিয়ার বেশীর ভাগ লোকের অনুসরণ কর, তাহলে তারা তোমাকে আল্লাহর রাস্তা হতে বিপথগামী করে দিবে। ( সূরা আনআম : আয়াত,১১৬)
হুযাইফা রা. বলেছেন : প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী, মানুষ তাকে যতই উত্তম বলুক না কেন।
১২।
সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে সিরিয়ার বাদশাহ মোজাফফর সর্বপ্রথম এ মিলাদের প্রবর্তন করে। মিশরে এর প্রচলন শুরু করে ফাতেমীরা। আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. এদেরকে কাফির ও ফাসিক বলে মন্তব্য করেছেন। মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করছি, হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে এ বিদআত হতে হেফাজত কর। (আমীন)।