আজকে আমরা আলোচনা করবঃ
মুরগি পালনঃ
সমগ্র পৃথিবীতে মোরগ-মুরগির সংখ্যা প্রায় ১৪১৩৯ মিলিয়ন এবং বাংলাদেশে মোরগ-মুরগির সংখ্যা মাত্র ১৩৮ মিলিয়ন। আমাদের দেশের ডিম ও মাংসের চাহিদার চার ভাগের এক ভাগ উৎপাদিত হয়। তাই এদেশের মোরগ-মুরগি পালন একটি লাভজনক ব্যবসা হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত।
পোল্ট্রির নামকরণ ও কতিপয় সংজ্ঞাঃ
ভ্যারাইটি (Variety) : একই জাতের মধ্যে পালকের রং, ঝুঁটি ও অন্যান্য দৈহিক বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে ভ্যারাইটিতে ভাগ করা হয়েছে।
বেবি চিক (Baby chick) : মুরগির নবজাত ছানাকে ‘বেবি চিক’ বলা হয়।
পুলেট (Pullet) : এক বছরের কম বয়সী মুরগিকে পুলেট বলা হয়। এই বয়সে পুলেট ডিম দেয়া আরম্ভ করবে অথবা প্রথম বারের মত ডিম দেয়া শুরু করছে। আমাদের দেশে এই বয়সের মুরগিকে অনেক অঞ্চলে ‘ডেকরী’ বলে। অনেক অঞ্চলে আবার এই মুরগি ‘নলী’ বা ‘টিল্লী’ নামে পরিচিত।
মোরগ (Cock) : এক বছরের বা ততোধিক বছরের মোরগকে বুঝায়।
পাখি (Bird) : পক্ষীকূলের যে কোন জীবকে পাখি বলা হয়। যেমন- গৃহপালিত পাখি, চিড়িয়াখানার পাখি, পোষা পাখি বন্য পাখি ইত্যাদি।
পোল্ট্রি (Poultry) : যে সকল গৃহপালিত পাখিকে ডিম ও মাংস খাবার এবং অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত উপায়ে পালন করা হয় তাকেই পোল্ট্রি বলে। যেমন- মুরগি, হাঁস, টার্কি, রাজহাঁস, কবুতর ইত্যাদি।
জাত (Breed) – পোল্ট্রির একই শ্রেণির মধ্যে দৈহিক আকৃতি বা পৃথক বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে জাত ভাগ করা হয়েছে।
হাঁস (Duck) : হাঁস বলতে স্ত্রী-পুরুষ উভয়কেই বোঝায়।
কবুতর (Pigeon) : কবুতর বলতে স্ত্রী-পুরুষ উভয়কে বোঝায়।
স্কোয়াব (Squab) : পাখা গজায়নি বা উড়তে শিখেনি কবুতরের এমন ছানাকে স্কোয়াব বলা হয়।
মুরগি (Hen) : এক বছরের বা ততোধিক বয়সের মুরগিকে বুঝায়। তবে এই বইয়ে বর্ণনার সুবিধার জন্য এই বয়সের সীমারেখাকে প্রধান্য দেয়া হয়নি। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মোরগ-মুরগি উভয়কেই বুঝানো হয়েছে।
ককরেল (Cockerel) : এক বছরের কম বাড়ন্ত বয়সের মোরগকে ককরেল বলা হয় ।
ছুকেপন (Capon) : অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে খাসি করা মোরগকে কেপন বলা হয়।
ব্রয়লার (Broiler) : অল্প সময়ে পরিমাণে বেশী ও নরম মাংস লাভের জন্য মাংসল জাতের মোরগ-মুরগির সংমিশ্রণে সৃষ্ট ৮-৯ সপ্তাহ বয়সের মোরগ-মুরগিকে ব্রয়লার বলা হয়।
মুরগির বহিঃদেহের পরিচয়ঃ
মুরগি একটি গৃহপালিত পাখি। মুরগিসহ সকল পাখির দুইটি পা, দুইটি ডানা ও শক্ত একটি ঠোঁট আছে। মোরগ-মুরগির মাথায় লাল বর্ণের ঝুঁটি ও গলায় গলকম্ব থাকে। মোরগ-মুরগির জাত ও প্রকারভেদ বিভিন্ন ধরনের ও আকৃতির ঝুঁটি দেখা যায়। যেমন— একক ঝুঁটি, গোলাপ ঝুঁটি, মটর ঝুঁটি, স্ট্রবেরি ঝুঁটি ইত্যাদি।

মুরগির জাত পরিচিতিঃ
বাংলাদেশে প্রধানত নিম্নোক্ত দু’ধরনের মোরগ-মুরগি পালন করা হয়।
দেশী জাত : আসিল (Aseel), চাটগেঁয়ে মুরগি (Chittagong variety), সাধারণ দেশী জাত (Deshi breed) ।
বিদেশি জাত : হোয়াইট লেগহর্ন (White Leghorn), রোড আইল্যান্ড রেড (Rhode Island Red), অস্ট্রালৰ্প (Australorp), ফাইওমি (Fayoumi), স্টার ক্রস (Starcross), হাইসেক্স ব্রাউন (Hisex brown), নেকিড নেক (Naked neck), নিউ হ্যাম্পশায়ার (New Hampshire), ব্যারেড প্লাইমাইথ রক (Barred plymouth Rock)।
১। বাংলাদেশী মুরগির জাত
(ক) আসিল (Aseel) মুরগির জাত পরিচিতি
- পা ও গলা বেশ লম্বা। এদের গায়ে পালন খুব কম থাকে।
- সাধারণত লড়াইয়ের জন্য এই জাতের মোরগ ব্যবহৃত হয়।
- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে আসিল জাতের মোরগ-মুরগির বাস।
- এদের শরীরে বেশ মাংস থাকে এবং সুস্বাদু মাংসের জন্য বিখ্যাত।
- এ জাতের মুরগি ডিম খুব কম দেয়। পূর্ণ বয়সে এদের দৈহিক ওজন ২-৩ কেজি পর্যন্ত হয় ।
- সাদা, লাল, কাল, সোনালী প্রভৃতি বর্ণের মটর ঝুঁটি এই মুরগি দেখতে অত্যন্ত সুন্দর ও সুঠাম।

(খ) চাটগেঁয়ে বা মালয়ী মুরগির জাত পরিচিতি (Chittagong variety)
- এদের শরীর বেশ মোটা এজন্য মাংসের জন্য ভাল। আসিল জাতের মুরগির সাথে সাদৃশ্য আছে। তবে
- এরা অপেক্ষাকৃত বেশি ডিম দেয়।
- বিভিন্ন রংয়ের মধ্যে কমলা হলদে, ফিকে হলুদ ও সোনালী বর্ণের এ জাতের মুরগি বেশ জনপ্রিয় ।
- বাংলাদেশে চট্টগ্রাম ও মালয়ে উপদ্বীপে পাওয়া যায় বলে এদের এইরূপ নামকরণ করা হয়েছে।

(গ) সাধারণ দেশী মুরগির জাত পরিচিতি (Deshi breed)
- ডিম ফুটানো ও বাচ্চার যত্নের ব্যাপারে এরা অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও কষ্টসহিষ্ণু। তবে ঘনঘন কুঁচে বসে বলে স্বাস্থ্যহানি ঘটে।
- দেশী মুরগির বাচ্চা ফুটার ৪ সপ্তাহ পরে মুরগি ও বাচ্চাকে পৃথক করে পালনে ২৪০ দিনে ৬০টি ডিম এবং ৯ সপ্তাহ পরে বাচ্চাকে মুরগি থেকে পৃথক করে পালনে মাত্র ৪২টি ডিম পাওয়া যায় ।
- আসিল ও চাটগেঁয়ে জাতের মোরগ-মুরগি ছাড়া বাংলাদেশের আর সব মোরগ-মুরগি এই সাধারণ দেশী জাতের মুরগির অন্তর্ভুক্ত।
- সাধারণ দেশী জাতের মোরগ-মুরগি আকারে ছোট ও গায়ের রং মিশ্র।
- এরা ডিমও দেয় অত্যন্ত কম। বছরে এরা ৪০-৬০ টি ডিম দেয়।

২। বিদেশি উন্নত মুরগির জাত
(ক) হোয়াইট লেগহর্ন মুরগির জাত পরিচিতি (White Leghorn = WLH)
- এ জাতের মুরগি বিভিন্ন বর্ণ ও প্রকারের হয়। তবে এদের মধ্যে সাদা রংয়ের অখন্ড ঝুঁটি বিশিষ্ট উপজাত
- অধিক জনপ্রিয়। প্রচুর ডিম দেয় বলে এ জাতের মুরগি বিশ্ব বিখ্যাত। এরা বছরে আমাদের দেশে ২০০-২৫০টি ডিম দিয়ে থাকে।
- ইতালীর লেগহর্ন নামক স্থানে এ জাতের মুরগির প্রথম উৎপত্তি হলেও উন্নতি লাভ করে আমেরিকায়। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে এ জাতের মুরগি পালন করা হয়।

(খ) রোড আইল্যান্ড রেড মুরগির জাত পরিচিতি (Rhode Island Red = RIR)
- বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এরা নিজেদের বেশ খাপ খাইয়ে নেয়।
- এদের পালকের রং গাঢ় বা কলচে লাল এবং দেখতে বেশ হৃষ্টপুষ্ট।
- এরা যেমন ডিম দেয় প্রচুর তেমনি মাংসও পাওয়া যায় ভাল।
- আমাদের দেশে এরা বছরে ১৫০-২০০টির ডিম দেয়। ডিমের রং বাদামী।
- এ জাতের একটি মুরগির ওজন ২-৩ কেজি হয়।
- আমেরিকার রোড আইল্যান্ড রাজ্যে এই জাতের মুরগির উদ্ভব।
- বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে এ জাতের মুরগি পালন করা হয়।

(গ) অস্ট্রালৰ্প মুরগির জাত পরিচিতি (Australorp = AUS)
- বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে এ জাতের মুরগি পালন করা হয়।
- ডিম ও মাংস উভয়ই উৎপাদনের জন্য এ জাতের মোরগ-মুরগি বেশ ভাল।
- বৃটেনের অরপিংটন জাত হতে উদ্ভূত এই জাতটির উৎপত্তি হয় অষ্ট্রেলিয়ায়।
- এরা আমাদের দেশে বছরে ১৫০-২০০টি ডিম দেয়।

(ঘ) ফাইওমি মুরগির জাত পরিচিতি (Fayoumi = FAY )
- এরা দেখতে অনেকটা আমাদের সাধারণ দেশী জাতের মুরগির মত।
- আমাদের দেশে এ জাতের মুরগি বছরে ১৫০-২০০টি ডিম দিয়ে থাকে। এদের পালকের রং কাল সাদা মিশ্রিত।
- মিশরের ফাইওমি অঞ্চলে এদের আদিবাসভূমি। বর্তমানে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এ জাতের মুরগি পালন করা হয়।
- বিদেশি বিভিন্ন উন্নত জাতের (WLH, RIR, AUS, FAY, Barred Plymouth Rock) মুরগির দৈহিক
- ওজন ও ডিম উৎপাদনের তুলনামূলক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, ফাইওমি জাতের মুরগির বাংলাদেশের
- আবহাওয়ায় অধিক উপযোগী ও উৎপাদনশীল ।

সমাপ্ত।